সাক্ষাৎকার
[প্রায় ছয় শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। শিশুকিশোর মনস্তত্ত্ব, রোমাঞ্চ এবং মানবিকতাসহ নানান বিষয় উঠে এসেছে তাঁর গল্পের ভেতর দিয়ে। তিনি সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় লেখেন। তাঁর গল্পের বুনোট অসাধারণ। যা যে কোনো বয়সী পাঠককেই মোহাবিষ্ট করে রাখতে পারে। তাঁর লেখা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, রোমাঞ্চকর উপন্যাস ও ইতিহাস-ঐতিহ্য সংশ্লিষ্ট রচনা বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। পেশাগত জীবনেও আলী ইমামের রয়েছে বিচিত্র অভিজ্ঞতা। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহা-ব্যবস্থাপক ছিলেন এবং ২০০৬ সালে চাকুরী থেকে অবসরগ্রহণ করেন। নেশা ও পেশাগত কারণে ভ্রমণ করেন পৃথিবীর অনেক দেশ। সম্প্রতি তরুণ কবি ও সাংবাদিক তাওহিদ আদনানকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন কবি ও কথাশিল্পী মোস্তফা মাহাথির। কিশোর পাতার পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি হুবহু প্রকাশ করা হলো।]
: কেমন আছেন?
: কেমন আছি… পৃথিবী জুড়ে এখন ভীষণ উৎকণ্ঠা, না? করোনাকাল। বৈশ্বিক দুর্যোগ। এত ভয়াবহ, ঘাতক মহামারী আগে আর আসেনি। পৃথিবীর প্রায় কোটি কোটি মানুষ আক্রান্ত, উদ্বিগ্ন, অনিশ্চিত। আমাদের দেশও এর বাইরে নয়। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ে গেছি আমরা। মানুষ জাতি যেন বিপন্ন হয়ে আছে। শুনেছি, এত ভয়াবহ এই রোগটি, যা মানুষের ভেতরে কুরে কুরে শেষ করে ফেলে। কাজেই এখন বেঁচে থাকার মুহূর্তগুলোকে ভীষণ মায়া লাগে। মূল্যবান মনে হয়। মনে হয় এটাকে যেন আঁকড়ে ধরতে চাই। বেঁচে আছি। সেই অর্থে কেমন আছি’র উত্তর তো পাওয়া গেল।

: আমরা জানি, আপনি ছয় শতাধিক বই লিখেছেন। শিশুসাহিত্য তথা বাংলাসাহিত্যে আপনার এই সৃষ্টি বিপুল বিস্ময়কর। এককথায়, বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের যে আকাশ তাকে এক ধরনের আপনি ভরে ফেলেছেন আপনি। তো আপনার এই লেখালেখির শুরুটা কেমন করে হলো?
: হা হা, আমার জন্ম তো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ১৯৫০ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাত সোয়া ১১টায়। মানে আর ৪৫ মিনিট পর নতুন বছরে পড়বে। বড় হয়েছি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেখানে আমার একজন শিক্ষক ছিলেন। মুহাম্মদ মুসা। আমি নানা ডাকতাম। তিনি আমাকে ছোটবেলা থেকে বই পড়তে দিতেন। আমি যখন সেভেন-এইটে পড়ি (আমার শৈশব অবশ্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কাটেনি) তখন মাঝে মাঝে তাঁর কাছে যেতাম, তখন উনি আমাকে বই পড়তে দিতেন। ওই যে আমার ভেতরে সাহিত্যের প্রতি প্রবল আগ্রহের সৃষ্টি হলো- তারপরই সাহিত্যপাঠ, বিশেষ করে শিশুসাহিত্য, প্রেমেন্দ্র মিত্র’র ঘনাদা’র গল্পগুলো পড়তাম। তারপর দেব সাহিত্য কুটিরের পরিলিখা সিরিজ, কাঞ্চনজঙ্ঘা সিরিজ, তিব্বত ফেরত তান্ত্রিক, হেমেন্দ্র কুমার রায়ের যক্ষের ধন…। একটা ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম। যে ওই মুদ্রিত অক্ষরগুলো আমাকে নিয়ে গেলো একদম অজানা অচেনা রহস্যময় এক জগতে, হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা। আমার কাছে মনে হয়েছে বই হলো একটা সত্যিকারের মাধ্যম, যার ভেতর দিয়ে উইদাউট ভিসা, উইদাউট পাসপোর্ট, উইদাউট পেমেন্ট, আমি পৃথিবীর যে কোন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পারি। এই আমি সুযোগটা নিলাম যে, আমাকে বই পড়ে মানস ভ্রমণ করতে হবে এবং আমি সেটা শুরু করলাম। প্রেমেন্দ মিত্রই হলেন মূল, যিনি আমাকে অনুপ্রাণিত করেন শিশুসাহিত্যে। তাঁর ঘনাদা সিরিজগুলো পড়ে, অদ্ভুত অদ্ভুত সব জায়গায়- সাখালিন দ্বীপ, মানস সরোবর, তিব্বত, লাদাখ এগুলো ঘুরে বেড়াতাম। আমি এক সময় সার্কের অডিও ভিজুয়াল এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের প্রধান সমন্বয়কারী ছিলাম। তখন সার্ক কান্ট্রিগুলোতে ব্যাপক ঘুরতে হয়েছে আমাকে পেশাগত কারণে। তখন আমি এই তিব্বত এবং সেই সমস্ত অঞ্চলগুলো, যেগুলো বইতে পড়েছি, ভুটানের রহস্যময় জায়গাগুলোও ঘুরে দেখেছি। আমার হচ্ছে কী- আমার বেশির ভাগ লেখার মধ্যে রয়েছে রহস্য খোঁজার প্রবৃত্তি। ওই ছোটবেলায় ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে বসে ওই যে শিশুসাহিত্যের মোহে পড়ে গেলাম এবং সেই যে জালে জড়িয়ে গেলাম। যে কারণে পরবর্তীতে আমার মনে হলো, আমিও তো লিখতে পারি। ক্লাস নাইন-টেনে পড়া অবস্থায় লিখতে শুরু করলাম। ৬৬-৬৫-তে লেখালেখি। এবং শুরু হলো ছাপা, কচিকাঁচার আসরে। এই শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে…। মনে হলো, আসলে আমি লিখি আসলে নিজের জন্য। সত্যি কথা বলতে কী, আমি একদম আমার পাঠক হয়ে লিখি। আমি মনে করি কি লিখে আমি আমাকে এবং আমার বেঁচে থাকাটাকে অর্থপূর্ণ করতে পারছি।

: আপনার প্রথম বই ‘দ্বীপের নাম মধুুবুনিয়া’। সবারই প্রথম বই প্রকাশের একটা অনুভূতি থাকে। আপনার এই বইটি প্রকাশকালের অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাটা কেমন ছিলো?
: শোনো, এই প্রসঙ্গে আমি বলছি, সবাই তো বলে বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা হলেন চিত্তরঞ্জন সাহা। তার সঙ্গে কিন্তু আরেকজন লোকও ছিলেন। ওনার নাম হচ্ছে তাজুল ইসলাম। ‘বর্ণ মিছিল’ নামে একটা প্রকাশনা সংস্থা ছিলো তার। তিনি কিন্তু একটা টেবিল নিয়ে বই বিক্রি করা শুরু করেছিলেন। আমার তখন বইতে লেখালেখি বেরিয়ে গেছে। তো আমার এক বন্ধু ইকবাল। ওকে বললাম- ইকবাল, বই বের হলে কেমন হয়? আমার খুব বই বের করতে ইচ্ছা করছে। মানে দুই মলাটে আবদ্ধ হতে ইচ্ছা করছে। জানি না আমার ললাটে ছিলো কি না দুই মলাটে আটকানোর। তো গেলাম তাজুল ইসলাম ভাইয়ের কাছে। ও বললো, শিশুদের বই, ওতো অনেক খরচের ব্যাপার। ব্লক-টøক লাগে। কচিকাঁচা পত্রিকাটি ছাপা হতো তার প্রেসে। তো বললাম, আপনার কোন প্রকার ছবি আঁকতে হবে না। আমি পুরনো ব্লকগুলো বের করে দেবো, আসলে আমি কচিকাঁচা আসরের গল্পগুলো দিয়ে বই বের করতে চাইছিলাম। উনি বললেন যে, করো তাহলে। এই আমি গুদামে ঢুকে আমার ব্লকগুলো বের করে দিয়েছি আমার মনে হয় আমার লেখার গুণগত কারণে বইটি বের হয়নি, খুব সস্তায় মুফতে বইটি বের করতে পারবে বলে প্রকাশক খুশি ছিলেন। এবং বইটি বেরিয়ে গেলো। ওই সময় করুণাময় গোস্বামীর বই বের হয়েছিলো ওখান থেকে, ‘সঙ্গীতের কথা’ আর আমার ‘দ্বীপের নাম মধুবনিয়া’। আশ্চর্য ব্যাপার হলো, সেই বইটিতে ফ্ল্যাপ লিখেছিলেন শামসুর রাহমান। শামসুর রাহমান কিন্তু জীবনেও কারো জন্য কোন কিছু লেখে না, এরকম। ফ্ল্যাপ লেখেন না। আমার সাথে রাহমান ভাইয়ের খুব ঘনিষ্ঠতা ছিলো। রাহমান ভাই আমাকে খুব ¯েœহ করতেন। তিনি আমার প্রথম বই দেখেছেন। উত্তেজনায় আহসান হাবীবকে দিয়ে কাভার করালাম। রাহমান ভাইকে বললাম, কিছু লিখে দিতে হবে। উনি বললেন, ‘না আমি তো লেখি-টেখি না।’ তারপর তো অসাধারণভাবে আমার বইয়ের ব্যাক কাভারে কিছু লিখে দিলেন। এরকম লিখলেন, ‘যাদের গল্প শুনে ঘুম পায় না, ঘুম চলে যায়। তাদের জন্য মোহময় ভাষায় আলী ইমাম লেখে।’ ওই আমি প্রথম লেখায় স্বীকৃতি পেয়ে গেলাম। আমার প্রথম বই বেরিয়ে গেলো। দ্বীপের নাম মধুবনিয়া। আমার সব সময় গল্পের প্রতি খুব ঝোঁক। রহস্য, রোমাঞ্চ, অভিযান, পরিভ্রমণ- এই বোধ থেকে আমার মনে হলো যে, শিশুসাহিত্যে শিশুরা আমার লেখা পছন্দ করছে। তারা অভিযান কাহিনীতে আকৃষ্ট। এই হলো আমার প্রথম বই।
যেদিন বইটা হাতে পাই- আমার চোখে আনন্দের অশ্রু। পানি এসে গেলো চোখে। তাজুল ভাই বললো, তোমার চোখে কিছু পড়েছে নাকি, পানি বেরুচ্ছে কেন? সত্যি কথা বলতে কী মাহাথির, এখনও সেই সম পরিমাণ আবেগটা রয়েছে আমার। আবার যখন নতুন করে বই প্রকাশ হয় আমার, সেই কিশোর যুবক বয়সে চলে যাই, অনুভূতিটাকে নিঙড়ে নিই। মুচড়ে নিই। এইতো বেঁচে থাকা। বেঁচে থাকার যে আনন্দ উদ্ভাষণ। আমার মনের ভেতর যে দুঃখগুলো আছে, কষ্টগুলো আছে, ব্যথাগুলো আছে, যন্ত্রণাগুলো আছে, সেগুলো কিন্তু লিখে বই প্রকাশের মাধ্যমে আমি একদম রঙিন ডানার প্রজাপতির মতো হতে পারবো। এই আনন্দে এখনো আছি।

: আপনার লেখালেখির এই দীর্ঘপথে পাঠকের ভালোবাসাটাকে কিভাবে উপভোগ করেন?
: আমি আসলে নিভৃতচারী প্রকৃতির। প্রচ- ভিড়। আমি ভিড়ের মাঝে চট করে নিজের জগতে চলে যাবো। আমি হচ্ছি সেই রবার্ট ফসিলের বিখ্যাত কবিতার মতো অনেকটা- Miles to go before I sleep. মানে, আমাকে যেতে হবে অনেক দূর, ঘুমিয়ে পড়ার আগে। আমি একাগ্রভাবে এগিয়ে যাই, এগিয়ে চলি। এবং আমি ঘুমিয়ে পড়ার আগে আবার কাজ শুরু করি। আমার কাছে এক ধরনের স্বকীয় চেতনা আছে। স্বকীয় চেতনা হলো সেন্টদের, মানে তীর্থ যাত্রীরা, একাগ্রচিত্তে তারা যায়। যে কারণে আমি জাপানে গিয়ে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। জেনিজম। তুমি যে কাজটা করবে একাগ্র মনোসংযোগ দিয়ে সেই কাজে আত্মসমর্পণ করো। এটা আমাকে, আমার জীবনটাকে একদম নাড়িয়ে দিলো। আমি এই বোধে এতটা অনুপ্রাণিত যে, আমি সবসময় মনে করি, এই জাগতিক মানুষ-পরিবেশ এগুলো কিচ্ছু না। যেতে হবে তোমাকে অস্তিত্বের জন্য যেতে হবে অনেক দূর। হা হা, সেই ফুজিয়ামা পাহাড়ে ওঠার মত ব্যাপার আর কী। জাপানের জেনিজমের এই বোধটি আমাকে জাগিয়ে তুললো। আরেকটি জিনিশ আছে পানি, পানির মধ্যে পাথর আছে। জেনিজম এক জায়গায় বলছে, ‘তুমি পানির প্রবাহের মতো তরঙ্গায়িত হও, পাথরের মত দার্ঢ্য হও, মানে দৃঢ় হও এবং সবুজ শ্যামলিমা শ্যাওলার মত তুমি কোমল হও।’ জাপানিরা একে কিন্তু জীবন-দর্শন মনে করে। এই বোধ থেকেও আমি আমার জীবনটাকে মনে করি মন্দ না তো! এটি একটি ব্যাপার। আর ভুটানে… ভুটানে আমি থি¤পু নগরীতে গিয়ে দেখলাম- অনেক পাহাড়ি উঁচুতে সেন্টরা থাকেন। জিজ্ঞাসা করলাম আমার পরিদর্শককে- এরা কী করে। বললো, আট-দশ বছর ধরেই এরা এই উপরের ঘরেই থাকে। নিচ থেকে খাবার পাঠানো হয় এদের জন্য। ওরা ওইখানে সাধনা করে। আমার কাছে আদর্শ মনে হলো। আমিও সে রকম আমার নিজের ঘরটাকে সাধনার জায়গা করে ফেলেছি। আত্মমগ্ন হয়ে যাই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত, প্রকাশিত হবো এই বোধ থেকে। তো, আমার ভিতর এই বোধ দু’টো কাজ করতো। জেনিজম ও সেন্টদের…। এই জন্য আমি জাগতিক বিভিন্ন সং¯পর্শে কম চলি।

: টিভি তো খুব ব্যস্ততার জায়গা। আপনি সেখানেও ছিলেন। লেখালেখির সাথে কিভাবে সমন্বয় করলেন?
: টেলিভিশন স¤পর্কে একটা বিখ্যাত উক্তি আছে ইতালিয়ান ফিল্ম ডিরেক্টর ফেদোরিকা ফিলোনির। তাকে বলা হলো, টেলিভিশন স¤পর্কে আপনার অনুভূতি কী? তিনি বললেন, ইডিয়ট- এটা মূর্খদের বাক্স। টিভি হচ্ছে- Bad for self, good for others.

: আপনার সায়েন্স ফিকশন এবং বিজ্ঞান সাহিত্যে বিপুল কাজ। এই যে বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখি- আপনার ভেতর এই আগ্রহটা এলো কেমন করে?
: আমি ব্যাপারটা একটু ব্যাখ্যা করি। বিজ্ঞান কল্পকাহিনির দু’টো ধারা আছে। একটা হলো, নানা রকম সায়েন্টিফিক তাত্ত্বিক আলোচনা। এক্ষেত্রে আমাকে কিছু রুশ বিজ্ঞান সাহিত্য আলোড়িত করেছিলো। পরবর্তীকালে আর্থার সি ক্লার্ক। ইনি আমার একজন প্রিয় লেখক। আর্থার সি ক্লার্ক কিন্তু বিজ্ঞান কল্পকাহিনিকে নতুন মাত্রা দিলেন।
সেই ১৯৬০ সালে ¯পুটনিক পত্রিকায় একটা যন্ত্রের কল্পনা করলেন, যা আকাশ থেকে ঘুরবে এবং পৃথিবীতে ছবি প্রেরণ করবে। পরবর্তীতে যেটা স্যাটেলাইট বা ভূ-উপগ্রহ। এটা কিন্তু কল্পনা করেছিলেন আর্থার সি ক্লার্ক। তো পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীরা তা বের করলেন। যেমন জুলভার্ন তার গল্পে ২০,০০০ ফিট সমুদ্রের নিচে সাবমেরিনের মাধ্যমে যাওয়ার ধারণা দেন। অথচ তখন সাবমেরিন আবিষ্কারই হয়নি। এরপর প্রথম যখন সাবমেরিন আবিষ্কৃত হলো তার নাম রাখা হলো নটিলাস। অর্থাৎ লেখকের কল্পনায় আগে আসবে পরে তা বাস্তবিত হবে। আমার কাছে তখন মনে হলো, লেখকের যে মানসিক ক্ষমতা, যেমন স্টিফেন হকিং কিভাবে মোটর নিউরন রোগে জরাগ্রস্ত হয়ে গেলো, সে কিন্তু মস্তিষ্ক সক্রিয় রেখে পৃথিবীর বিগ ব্যাং, টাইম স্কেল সব বের করলো। কত শত কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং-এর জন্ম। ছোট্ট একটি জায়গায় বসে মস্তিষ্কের চর্চা করে। মানুষের ব্রেনে মস্তিষ্কের কর্টেক্স সেলগুলো এত তীক্ষè, ওটাকে যদি ইউজ করা যায় না! তেমনি স্টিফেন হকিংয়ের শরীর অবশ কিন্তু মস্তিষ্ক ঠিক আছে, হুইল চেয়ারে বসে বসে অঙ্ক করে করে টাইম স্কেলটাকে প্রকাশ করলেন। আমার কাছে মনে হচ্ছিলো কী…! বিজ্ঞান কল্পকাহিনিগুলো পড়তে পড়তে তখন আমি ভাবলাম, ভবিষ্যতের পৃথিবীর অসাধারণ রূপরেখা এই কল্পনার মধ্য দিয়েই আসবে। যা কল্পনা করবো লিখবো। এখন আমি প্রচুর লিখছি স্পেস জার্নির উপরে। নিশ্চয় আগামীতে দেখা যাবে মানুষ যাচ্ছে। এই জন্য আমি মনে করি, বিজ্ঞান কল্পকাহিনি আমাকে উদ্বেলিত করেছিলো, আলোড়িত করেছিলো। এখনও করে প্রচুর লিখি আমি। আমি ওইসব তাত্ত্বিক আলোচনার চাইতেও কল্পনার অবাধ বিস্তার দিয়েই বেশি লিখি।

: বর্তমানে যে করোনাভাইরাস, এই ভাইরাস ছাড়াও কেউ কেউ কল্পনা করছেন যে অ্যান্টার্কটিকার বরফ যদি গলতে থাকে তাহলে সেখানে ফ্রিজিং হয়ে থাকা প্রাণীগুলোর দেহাবশেষ বাতাসে মিশতে থাকবে। এবং সেই গলিত দেহ থেকে মারাত্মক কোনো জীবাণু সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। এছাড়া নানান ভাবেই তো পৃথিবীর ধ্বংসের অনেক কারণ থাকতে পারে। এটা একটা আন্দাজ। তো বিজ্ঞান কী করতে পারে পৃথিবীকে ভালো রাখার জন্য? কী মনে করেন আপনি?
: আমার কাছে মনে হয়েছে কী, এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। আর কোন গ্রহে কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এত কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদিও সন্ধান পাওয়া গেছে, প্রাণ পাওয়া যায়নি। ওই যে মঙ্গল গ্রহ, ওখানে একটু মিথেন পাওয়া গিয়েছিলো। আর বলছিলো যে প্রাণীও হয়তো হতে পারে। কিন্তু না, কোথাও কোনো প্রাণী নেই। কোত্থেকে আসছে আমাদের পৃথিবীতে? মাত্র কয়েক কোটি বছর আগে। অ্যামিবা জলজ একটি প্রাণী। রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় এককোষী থেকে বহুকোষী প্রাণী হয়েছে। এখন যে ভাইরাসটা এসছে এটা কিন্তু জৈবিক কারণে। এই প্রাণসত্ত্বা পৃথিবী থেকে বিলীন হয়ে যাবে। আমাদের বুদ্ধি কম বলেই আমরা উত্তেজিত হয়ে পড়ছি। আমরা যে রোগে আক্রান্ত হচ্ছি এগুলো তো সাময়িক। সামগ্রিকভাবে কোটি কোটি বছরের তুলনায় এই ঘটনাগুলো ক্ষুদ্র। এসব আবার বিলীন হয়ে যাবে। এখন যেটা হচ্ছে, আমরা প্রকৃতিকে বিনষ্ট করেছি প্রকৃতি আমাদের থেকে প্রতিশোধ নিচ্ছে।

: বিজ্ঞান কল্পকাহিনি শিশুকিশোর মনস্তত্ত্বে কেমন প্রভাব ফেলতে পাওে বলে মনে করেন?
: সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, চিন্তা করার ক্ষমতা। দামাস্কাসের বিখ্যাত তলোয়ারও যদি ফেলে রাখা হয় তাহলে মরচে পড়ে যায়। আমরা যদি আমাদের মস্তিষ্ককে ব্যবহার না করি মরচে পড়ে যাবে। বলা হয় কী, হিউম্যান ব্রেন সুপার ডুপার ক¤িপউটারের চেয়ে অনেক তীক্ষè। আমরা যে চিন্তা করি এবং সাধারণভাবে যা ভাবতে পারি, মানুষের ভিতর যে চিন্তাশক্তি, ব্রেন সেল… অসাধারণ। সেটাকে সমৃদ্ধ করার জন্য তথ্য আহরণ করতে হবে। এই আর কী।

: এখন কিছু গতানুগতিক প্রশ্ন করি। বিশ্বসাহিত্যে আপনার প্রিয় লেখক কে?
: প্রেমেন্দ্র মিত্র এবং তাঁর ঘনাদার গল্পগুলো এত এত এতবেশি প্রিয় আমার! আর বুদ্ধদেব বসু। গদ্যের জন্য বুদ্ধদেব বসু।

: বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যে আপনি নিজে ছাড়া অন্যদের কার কার লেখা আপনার ভালো লাগে?
: বাংলাদেশে শিশুসাহিত্যে শওকত আলী আর জাফর ইকবাল। মুহম্মদ জাফর ইকবাল। স্মার্ট, প্রাঞ্জল আর ঋজু ভঙ্গিতে শিশুসাহিত্য চর্চা করছেন।

: হুমায়ূন আহমেদ?
: আ.. হুমায়ূন আহমেদ আমাকে অতটা আকৃষ্ট করে উঠতে পারেননি হয়তো। হুমায়ূন আহমেদের ভিতর এক ধরনের সবকিছুর ভেতরেই কেমন একটা রসিকতা, ফ্যান্টাসি করার প্রবণতা আছে। আমার কাছে মনে হয় হুমায়ূন আহমেদ কিভাবে যেন গভীরতায় না গিয়ে হালকা ভাবে চলে গেছেন। গভীরতাটা আমি খুঁজছিলাম। জাফর ইকবালের অনেক লেখায় এই গভীরতাটা আছে।

: আপনি দিনে বা রাতে, কখন লিখেন?
: সময় পেলেই লিখি।

: তরুণ সাহিত্যক, যারা আপনাদের মত লিখতে চান, তাদের জন্য আপনার কী পরামর্শ?
: ওই একই কথা। পড় পড় পড়। পড়া ছাড়া, বই ছাড়া আর কোনো ব্যাপারে যুক্তি নাই।

: শিশু-কিশোরদের নিয়ে কাজ করছে কিশোর পাতা। এই পত্রিকাটি স¤পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাই।
: কিশোর পাতা পত্রিকাটি আমার মন কেড়েছে। বিকজ এর প্রেজেন্টেশন; কী বলার চাইতে কেমন করে বলা, মেকআপ, নান্দনিকতা, স্মার্টনেস, কন্টেন্ট- সব মিলিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত একটা ভাব আছে। আমি কিশোর পাতা পত্রিকাটিকে এর আকর্ষণীয় মেকাপ, নান্দনিকতা ও বিষয়বস্তু মিলিয়ে বলতে পারি, এটাকে ঘিরে কিন্তু একটা বলয় গড়ে উঠবে। বলয় গড়ে উঠবে কিশোরপাঠক-পাঠিকাদের। তাদেরকে নিয়মিতভাবে, নান্দনিকভাবে পৃথিবী, বিজ্ঞান, শিশুসাহিত্য- এসবের বৈচিত্র্যময় দিকগুলোর ভেতর দিয়ে জীবনের গভীরতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে গেলে একটা গোষ্ঠী গড়ে উঠতে হয়। অতীতে পত্রিকাকে ঘিরেই কিন্তু অনেক গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। এই পত্রিকা দিয়েই প্রেমেন্দ্র মিত্র’র সায়েন্স ফিকশন আমাদের বাংলাসাহিত্যে ঢুকেছিলো। পত্রিকাকে ঘিরেই কিন্তু গড়ে উঠতে পারে বিশাল চিন্তা-চেতনার গোষ্ঠী। আমি মনে করি, কিশোর পাতা পত্রিকাটির কর্তৃপক্ষ সেই চেষ্টাই করছেন। যাতে অনুসন্ধিৎসু, কৌতূহলী, আগ্রহস¤পন্ন, লেখক-পাঠক গড়ে উঠতে পারে।

Share.

মন্তব্য করুন