কোন কাজ করতে গিয়ে শুরুতেই হোচট খেলে যাদের মন খারাপ হয়, মনে হয় আমাকে দিয়ে হবে না- এই লেখা তাদের জন্য। আজ জানাবো এমন কয়েকজন ক্রিকেটারের কথা- যারা জঘন্য শুরুর পরও মেধা আর অধ্যবসায় দিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন টেস্ট ক্রিকেটের অভিজাত আঙিনায়। খেলা শেষ করেছেন উজ্জল-ঝলমলে একটি ক্যারিয়ার নিয়ে।
আর এই গল্পে সবার আগে আসবে শ্রীলঙ্কার সাবেক অধিনায়ক ও টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান মারভান আতাপাত্তুর নাম। আতাপাত্তুর টেস্ট অভিষেক ও তার পরবর্তী কয়েকটি বছর রীতিমতো দুঃস্বপ্ন। ১৯৯০ সালে ভারত সফরে চন্ডিগড়ে টেস্ট ক্রিকেট দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অভিষেক মারভান আতাপাত্তুর। প্রথম টেস্টের দুই ইনিংসেই শূন্য রানে আউট, যাকে বলা হয় ‘পেয়ার’। কেউ মজা করে বলেন চশমা। এরপর আতাপাত্তু বাদ পড়েন দল থেকে। ঘরোয়া ক্রিকেটে ভালো করার কারণে দুই বছর পর আবার ডাক পান দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে(১৯৯২)। কলম্বোয় এবার প্রথম ইনিংসে ০, দ্বিতীয় ইনিংসে তার নামের পাশে যোগ হয়েছে ১ রান। সেটিও অবশ্য আম্পায়ারের ভুলে। কারণ রানটি ছিলো লেগবাই, কিন্তু আম্পায়ার বুঝতে পারেননি। আম্পায়ারের সেই ভুল না হলে প্রথম দুই টেস্টেই ‘পেয়ার’ পাওয়ার বিরল রেকর্ড হয়ে যেত এই ডানহাতি ব্যাটসম্যানের।
দুই বছর পর(১৯৯৪) আবার আতাপাত্তুকে ডাকা হয় ভারত সফরে- যেখানে তার দুঃস্বপ্নের শুরু। আশা ছিল এবার হয়তো সেই ভারতের মাটিতেই ভাগ্য ফেরাতে পারবেন; কিন্তু আহমেদাবাদে খেলতে নেমে আবারো পেয়ার। প্রথম ইনিংসে খেলেছেন ১০ বল, দ্বিতীয় ইনিংসে ৭টি। যথারীতি আবার তাকে ছুড়ে ফেলা হয় জাতীয় দলের বাইরে। প্রথম তিন টেস্টে রান ১, তাই এই পর্যায়ে এসে টেস্ট খেলার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলেন আতপাত্তু। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে পারফরর্ম করে গেছেন নিয়মিত। ঘরোয়া ক্রিকেটে রান করা আর ক্রিকেট মেধার কথা চিন্তুা করেই তাকে আবার জাতীয় দলে ডাকা হয় তিন বছর পর ১৯৯৭ সালে। নিউজিল্যান্ড সফরে এক টেস্টে সুযোগ পেয়ে দুই ইনিংসে রান ২৫ ও ২২। শ্রীলঙ্কা তখন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন দল, সেই দলে এই রান আহামরি কিছু নয়। তবু পরের মাসে দেশের মাটিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে আবার সুযোগ দেয়া হয়। কলম্বো টেস্টেও প্রথম ইনিংসে আবার শূন্য। পরের ইনিংসে ২৫। তবু এই সিরিজে দুটি টেস্টে তাকে সুযোগ দেয়া হয়। পরের টেস্টে দুই ইনিংসে ১৪ ও ৭ রান।
আতাপাত্তুর টেস্ট ক্যারিয়ার যে তবু টিকে ছিলো সে জন্য সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দিতে হবে শ্রীলঙ্কার নির্বাচকদের। অত্যন্ত্য মেধাবী ক্রিকেটার ছিলেন বলেই হয়তো তারা ছেলেটিকে নিয়ে হাল ছাড়েননি। একের পর এক সুযোগ দিয়ে গেছেন। প্রথম সতের ইনিংসে যার সর্বোচ্চ রান ২৯, ছয়টি শূন্য। তাকে যে তারপরও দলে রাখা হয়েছে সেটিই বিস্ময়কর। তবে যে ভারত সফরে দুঃস্বপ্নের ক্যারিয়ার সেই দেশটিকেই ঘুরে দাড়ানোর মঞ্চ হিসেবে বেছে নেন আতপাত্তু। সেটি ১৯৯৭ সালের শেষ দিকের কথা। অভিষেকের পর ততদিনে চলে গেছে সাত বছর। এর মাঝে অবশ্য ওয়ানডে দলে খেলেছেন মাঝে মধ্যে। সেটিও যে উল্লেখ করার মতো কোন পারফরম্যান্স ছিলো তা নয়। ওয়ানডের প্রথম দশ ইনিংসে সর্বোচ্চ রান অপরাজিত ১৯।
মোহালি টেস্টে ভারতের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে খেলেন ১০৮ রানের ইনিংস। দ্বিতীয় ইনিংসে ৩১ রান। নাগপুরে পরের টেস্ট বৃষ্টিতে ভেসে গেলেও মুম্বাইয়ে তৃতীয় টেস্টে আবার খেলেন ৯৮ রানের ইনিংস। টেস্ট ক্রিকেটেও যে রান করা সম্ভব সেটি হয়তো তখনই বুঝতে পারেন আতাপাত্তু।
তাই পরের মাসেই জিম্বাবুয়ে সফরে গিয়ে পেয়ে যান ক্যারিয়ারের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি(২২৩)। এরপর বিশ্ব ক্রিকেটে শুর হয় নতুন এক আতাপাত্তুর পথ চলা। সব মিলে ক্যারিয়ারে করেছেন ছয়টি ডাবল সেঞ্চুরি। সে সময় টেস্টে ছয় বা তার বেশি ডাবল সেঞ্চুরি ছিল আর মাত্র চার জনের (ব্র্যাডম্যান, হ্যামন্ড, লারা ও মিয়াঁদাদ)। বোঝাই যাচ্ছে কাদের পাশে নিয়ে গেছেন আতপাত্তু নিজেকে। এর পর অবশ্য আরও সাত জন যোগ হয়েছে এই তালিকায়।
আতাপাত্তু তার টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে হোবার্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খেলেছেন ৮০ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। সব মিলে টেস্ট ক্যারিয়ারে ৯০ ম্যাচে ৩৯ গড়ে করেছে ৫৫০২ রান। ৬টি ডাবলসহ মোট সেঞ্চুরি ১৬টি। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, ২৬৮ ওয়ানডেতে ১১ সেঞ্চুরিতে শ্রীলঙ্কার সাবেক এই অধিনায়কের রান ৮৫২৯।
আতাপাত্তুর সাথে একই দিনে টেস্ট অভিষেক সাঈদ আনোয়ারের। ১৯৯০ সালের ২৩ নভেম্বর ফয়সালাবাদে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। অভিষেক যেমন একই দিনে, ক্যারিয়ারের শুরু ও শেষটাতেও দারুণ মিল দুজনের। টেস্ট অভিষেকের আগেই অবশ্য সাঈদ আনোয়ার ২৫টি ওয়ানডে খেলেছেন পাকিস্তানের হয়ে। তবে সেটাতে আহামরি কোন পারফরম্যান্স না হলেও মারকুটে ব্যাটিংয়ে নাম কুড়িয়েছেন; কিন্তু টেস্ট অভিষেকেই পেয়ার জোটে তার কপালেও। তাই তো ওয়ানডে ব্যাটসম্যানের তকমা লাগিয়ে বাদ দেয়া হয় টেস্ট দল থেকে। দ্বিতীয় বার সুযোগ পান তিন বছরেও বেশি সময় পর। আবারো ব্যর্থ! নিউজিল্যান্ড সফরে গিয়ে অকল্যান্ড টেস্টে দুই ইনিংসে ১৬ ও ৭। তবে কী মনে করে যেন আরেকটি সুযোগ দেয় তাকে টিম ম্যানেজমেন্ট। এই সুযোগটা দারুণভাবেই কাজে লাগান পাকিস্তানের ইতিহাসের অন্যতম সেরা এই ব্যাটসম্যান। ওয়েলিংটন টেস্টের একমাত্র ইনিংসটাকে সেঞ্চুরি থেকে ডাবল সেঞ্চুরিতে রূপ দিতেই চলছিলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক রানআউটে থামতে হয় ১৬৯ রানে। সিরিজের তৃতীয় টেস্টে ৬৯ ও ০। মাস ছয়েক পর শ্রীলঙ্কায় এক ম্যাচে ৯৪ ও ১৩৬ রানের দুটি ইনিংস খেলে টেস্ট ক্রিকেটে সাঈদ আনোয়ারের রাজকীয় প্রত্যাবর্তন।
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাননি সাঈদ আনোয়ার। ব্যাটের ঝলকে লিখে চলেছেন একেকটি মহাকাব্য। ২০০১ সালে মুলতানে বাংলাদেশের বিপক্ষে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপের ম্যাচটি তার ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট। একমাত্র ইনিংসে খেলেন ১০১ রানের ইনিংস। তিন দিনেই পাকিস্তান ম্যাচটি জিতে নেয় ইনিংস ও ২৬৪ রানে। সেদিনই মারা যায় তার একমাত্র কন্যা বিসমাহ। কন্যার মৃত্যু আমূল পাল্টে দেয় এই ক্রিকেটারের জীবন। খেলার চেয়ে ধর্ম-কর্মে মনোযোগী হয়ে পড়েন। অনেক দিন দূরে ছিলেন ক্রিকেট থেকে। এরপর ফিরে কিছুদিন ওয়ানডে খেলেছেন তবে টেস্ট আর খেলা হয়নি। প্রথম ইনিংসে পেয়ার পাওয়া সাঈদ আনোয়ারের টেস্ট ক্যারিয়ার শেষ হয়েছে সেঞ্চুরি দিয়ে, কী অদ্ভূত তাই না! সব মিলে ৫৫ টেস্টে ৪৬ গড়ে রান ৪০৫২। ১১টি সেঞ্চুরি।
ওয়ানডের সাঈদ আনোয়ার অবশ্য আরো উজ্জল। সেটি আমাদের লেখার বিষয় নয় তবুও জানি রাখি ২৪৭ ওয়ানডেতে ২০ সেঞ্চুরিতে পাকিস্তানের সাবেক এই অধিনায়কের রান ৮৮২৪। অনেকগুলো বছর ওয়ানডেতে তার ১৯৪ ছিলো ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান।
এই তালিকায় আরেকজন নামও আসতে বাধ্য। তিনিও যে টেস্টে পেয়ার দিয়ে শুরু করে ক্যারিয়ার শেষ করেছেন মহাতারকা হিসেবে। ইংল্যান্ডের গ্রাহাম গুচ। ১৯৭৫ সালে অ্যাশেজ সিরিজের প্রথম টেস্টে অভিষেক। পেয়ার পাওয়ার পর দ্বিতীয় টেস্টেও খেলেছিলেন। সেটির দুই ইনিংসে করেন ৬ ও ৩১। এরপর দল থেকে বাদ। দ্বিতীয়বার ডাক পেয়েছেন ৩ বছর পর। শেষ পর্যন্ত ক্যারিয়ার শেষ করেছেন ১১৮ টেস্টে ২০ সেঞ্চুরিতে ৮৯০০ রান করে।

Share.

মন্তব্য করুন