আজ নতুন ফ্লাটে উঠেছে এনিরা। তবুও তার মন ভালো নেই। মা-বাবা নতুন ঘর-দোর, আসবাব গোছাতে ব্যস্ত। দক্ষিণ জানালার পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে চেয়ে আছে এনি। মেঘের আড়ালে কোথায় লুকিয়ে আছে দাদাভাই। যদি একবার দেখা মিলতো। চোখ থেকে কষ্টের জল গড়িয়ে পরলো এনির।
এনির দাদার মৃত্যুর পর দাদি ছোট চাচার সাথে প্রবাসে থাকেন। আবাসন ব্যবস্থা উন্নত করতে এনিদের বাড়িটি দেয়া হয় বিল্ডার্স কোম্পানিকে। ঢাকার বুকে এনির দাদা দাদির স্বপ্নের বাড়িটি ছিলো ছবির মতো। নানা ফুল আর ফলে ভরা ছিলো সেখানে। ঢাসা পেয়ারা আর সতেজ কামরাঙায় মন কেড়ে নিতো সবার। এ বাড়ির লালছে করমচা আর মিষ্টি চালতার স্বাদ ছিলো সকলের চেনা। সতেজ পাতার ফাঁকে তাজা সবজির বাড়াবাড়ি ফলন দেখেই বোঝা যেতো কত যতেœর বাগান এটি। এনির দাদি প্রতিবেশী আর আত্বীয়দের এসব বিলিয়ে তৃপ্তি পেতেন। গোলাপ আর চাঁপার হাসিতে ঝলমল করতো বাড়িটি। রাতেরবেলা হাসনাহেনার গন্ধ মাখা হাওয়ায় দুলে ঘুমের পরি স্বপ্ন লেপে দিতো এনির চোখের পাতায়। এ বাড়ির মাটি আর প্রকৃতির মাখামাখিতেই হাঁটতে শিখেছে এনি। ঢাকায় জন্মেও সবুজের মমতায় বেড়ে ওঠা তার। প্রকৃতির চাদরে জড়ানো আবেশটুকু শক্তি ছিল তার বড়ো হবার। তাই এই বাড়িটিই ছিল এনির স্বর্গ রাজ্য। গত চার বছর আগে বাড়িটি যখন ছেড়ে যায়, কষ্টের কালো চাদরে ঢেকে যায় এনির মন। ঘাসফড়িং এর সাথে খেলা করা ফোকলা দাঁতের এই মেয়েটির বয়স তখন ছয়।
গত চার বছর ধরে ডানা ঝাপটানো ব্যাকুলতায় কিছুতেই ভালো থাকে না এনির মন। তাই এই বাড়িটির নতুন ফ্ল্যাটে উঠে হৃদয় কেঁদেই চলছে তার। সবুজে ঘেরা বাড়িটি লুকিয়ে আছে তার মনের গভীরে। ফ্লাটের বারান্দার দক্ষিণা বাতাসেও তার হৃদয় স্পর্শ করে না। জানালার অনাবিল প্রশান্তির হাওয়া, রোদ আর আলোর মায়াময় খেলা তাকে শান্ত করে না কিছুতেই। চকচকে নতুন ফ্ল্যাটে ভীষণ এক আভিজাত্যের ছাপ। বাবা মার দীর্ঘ দিনের নিগূঢ় পরিকল্পনায় বেশ দামি হয়ে উঠেছে ফ্ল্যাটটি কিন্তু এনির কাছে এ সব নিষ্প্রাণ মেকি মনে হয়। এত সুন্দর পরিপাটি গোছানো বাসা পেয়েও তার হৃদয় খুঁজে ফেরে সেই দাদির যতেœ সাজানো সবুজ পাতার মায়াময় ঘ্রাণ। দাদাভাই বেঁচে থাকলে বাড়িটি আগের মতোই থাকতো হয়তো। দাদাভাই এর কথা মনে হতেই আবার ভিজে উঠে এনির চোখ। কঠিন বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে এনি হারালো দাদা-দাদির আদর। সুদূর প্রবাসে থাকা দাদির চুম্বনটুকুও আজ আটকে যায় দূর আলাপন যন্ত্রের পর্দায়। যা তার স্নেহের ক্ষুধা বাড়িয়ে দেয় বহু গুণ। বিকেলে যখন ছোট ভাইকে নিয়ে ছাদে যায় এনি, আশেপাশের বাড়িগুলোকে অনেক ছোট মনে হয়। কত উঁচু তাদের বাড়ি অথচ চার বছর আগেও তাদের বাড়ির তুলনায় ওগুলো ছিল বিশাল বড়। মায়া মাখা রোদে পাকা উঠানে যখন ভাই বোন নিয়ে এনি খেলা করত, আশে পাশের বড় বড় বাড়ির জানালা দিয়ে ছেলেমেয়েরা চিড়িয়াখানায় আটকে থাকা প্রাণীদের মত দেখত তাদের। এনির খুব ভালো লাগতো। নিজেকে খুব স্বাধীন মনে হত। কিন্তু আজ সেও সুন্দর খাঁচার বন্দি পাখি। স্বপ্ন আকাশে উড়ার পথ বন্ধ। নিষ্ঠুর কঠিন ইমারতগুলো কেড়ে নেয় তার মতো হাজারো শিশুর সবুজ শিশুকাল।

ছোট্ট বেলার বাড়িটিতে পাতার ফাঁকে চালতার সাদা ফুলের উঁকি দেওয়ার সুখে গাছটির অহংকার যেনো বেড়ে যেতো বহুগুণ। কদম গাছের বড় ডালে জঞ্জাল কাকের বাসা দৃষ্টি এড়াত না কারো। বসতরত কাকেরা কা-কা আলাপনে কান ঝালাপালা করে দিতো। চৈতালি দুপুরের হাওয়ায় ভেসে আসতো আমের মুকুলের গন্ধ। গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে কচি আম কুড়িয়ে খেলা করা সেই দিন এনির জীবনে ফিরবে না আর কোন কখনো। পাখির আধ খাওয়া ফলে সয়লাব গাছের তলায় ঘুরে ঘুরে পেয়ারা আর কাঠবিড়ালির মিতালি দেখে ফোকলা দাঁতে এনি হেসেছে কত বার। তাকে দেখে কতবার কত বেজি দৌড়ে পালিয়েছে গর্তের কোণে তার কোন শেষ নেই। লাউ কুমড়ার পাতার ফাঁকে ছোট্ট চড়ুই এর শিকার খোঁজা, কিম্বা পাতার গায়ে লেগে থাকা বর্ষার জল টুপ করে মাটিতে ঝড়ে পড়া এসব এখন এনির চোখের ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। লাউ ডগা কেটে রান্না করে আদর করে কোলে বসিয়ে খাওয়াতেন দাদি। বিরক্ত লাগতো খেতে, তবু দাদির আদরে সোনা মুখ করে খেয়ে নিতো সব। আজ লাউয়ের ডগার সেই স্বাদ আর কোথায় পাবে এনি? জবা গাছের কালো পিঁপড়ার কামড় উপেক্ষা করেও ফুল কুড়িয়ে মালা গাঁথতো সে। বাবার কাছে বায়না ধরত লিচুর ডালের ছোট্ট টুনটুনির ছানা দেখার। এ সবই এখন স্মৃতির খাতায় আঁকা ছবি। শুকনো পাতাগুলো যেমন ফুরফুর করে বাতাসে উড়ে বেড়াতো ঠিক তেমনি এনির মনের বাতাসে এখনো উড়ে সেই বাড়িটির এঁদো মাটির সোদা গন্ধ। আজ এই ফ্লাটের নিষ্প্রাণ ইট, রড আর বালির নিচে চাপা পড়েছে এনির সোনালি শিশুকাল।
আজ তপ্ত ছাদের উপর দাঁড়িয়ে বহুদূর দেখা যায় বটে, তবে এনির স্মৃতির পাতায় আঁকা সেই রূপময় বাড়িটি কোমল হৃদয়ে হাহাকার জাগায়। নরম মাটির বুক চিড়ে বেড়ে উঠা এই দৈত্য বাড়িটি কেড়ে নিয়েছে এনির ছোট্ট উঠানটুকু। যেখানে মায়াবি চাঁদ জোছনার চাদর বিছিয়ে দিতো সারারাত। বার বার মনে হয় কি এমন হত যদি থাকতো ওই ছোট্ট বাড়িটি যেখানে নরম কাঁদায় সবুজ ঘাসে পা টিপে টিপে হাঁটত এনি। খুব কি ক্ষতি হত যদি থাকতো জানালার ফাঁকে কাঠবিড়ালির লুকোচুরির খেলা? নাই বা হত অট্টালিকা, তবু থাকতো সিক্ত ঘাসে লাল-কমলা শিউলির লুটোপুটি। কিম্বা যত্রতত্র বেড়ে ওঠা আগাছার বাড়াবাড়ি। থাকত তবু চড়ুই পাখির ফুরুৎ ফুরুৎ আনা গোনা। অথবা রাতে গাছের ডালে জ্বলজ্বলে চোখের লক্ষী পেঁচার ডাক।
প্রবল বর্ষায় আটকে থাকা পানিতে কাগজের নৌকা ভাসিয়ে মনে মনে দেশ বিদেশে ঘুরতো এনি। জলে ভিজে নৌকা উল্টে গেলে চোখের জলে বুক ভাসতো তার। তখন ধৈর্য্য নিয়ে মা আবার কাগজের ভাঁজে বুনে দিতেন স্বপ্নের বীজ। আবার নৌকা ভাসতো। মায়ের মমতায় বানানো কাগজের নৌকায় স্বপ্নের দেশে আর কোনো দিন যাওয়া হবে না এনির। দশ তলা দানব বাড়িটি কেড়ে নিলো তার স্বপ্নের নিলয়, শিশুবেলার সুখ। আজ এখানে প্রাচুর্য আছে ঠিকই সবুজ আর মাটির মাখামাখিটুকু নেই মোটেই। যখন তখন প্রজাপতির পেছনে ছুটে বেড়ানো এনির হৃদয়ে এখনো ভেসে বেড়ায় সেই কাগজের নৌকা।

Share.

মন্তব্য করুন