বন্ধুরা, তোমরা একদিন অনেক বড় মানুষ হবে। দেশের বিভিন্ন বড় বড় পদে বসে হাল ধরবে আমাদের এই দেশমাতৃকার। করবে সমাজের উন্নয়ন। অনেক অনেক সমস্যার সম্মুখীন হবে তোমরা। সেই সময়ের যাবতীয় বিষয়াবলির উত্তম প্রশিক্ষণ নেয়ার তো এখনই সময়। আর সেই প্রশিক্ষণ বা আগামীর পথচলার অন্যতম পাথেয় হচ্ছে তোমাদের ভেতরে নৈতিকতার জ্ঞান। নৈতিকতা বিষয়টি হচ্ছে, ভালো কাজ করা। ভালো বিষয়ে চিন্তা করা। খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকা। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনের সাথে ভালো ব্যবহার করা। কাউকে কষ্ট না দেয়া। মিথ্যে কথা না বলা। চুরি না করা বা কাউকে না ঠকানো। ভালো-মন্দ জ্ঞান ইত্যাদি। এই এগুলোই হচ্ছে নৈতিকতা।
আমাদের মাঝে মহান আল্লাহ তায়ালা অনেক নবী-রাসূল প্রেরণ করেছিলেন নৈতিকতার শিক্ষা দান করে, অনৈতিকতার বিপক্ষে বিজয়ী করে ভালো মানুষ তৈরি করে জান্নাত লাভের উপযোগী করে গড়ে তুলতে। নবী-রাসূলগণ চলে গেছেন। কিন্তু তারা রেখে গেছেন তাদের ওপর মহান আল্লাহর নাজিলকৃত বাণীসমূহ। আর তাদের জীবনাদর্শ। আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)ও রেখে গেছেন আল-কুরআন ও স্বীয় সুন্নাহ। এগুলো থেকেই আমরা পাঠ নিচ্ছি নৈতিকতার, জান্নাত লাভের উপায়ের।

কুরআন-হাদিসের বাণীসমূহ আমরা পরিবার থেকে, মসজিদ-মাদ্রাসা থেকে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পেয়ে থাকি। সেই বাণীসমূহ মনোহরীরূপে পৃথিবীর আগামীর বিপ্লবীদের কাছে উপস্থাপন করেন সুসাহিত্যিক ও নৈতিক কবিগণ। আর সেখানেই তোমরা ছন্দে, ছড়ায়, সুরে, ঝংকারে আত্মস্থ করে ফেলো। নিজেদের অমূল্য সেসব বাণীর ছাঁচে গড়তে চাও। এরকম একজন বিপ্লবী ও নৈতিকতার ভিতগঠনের সুরেলা আহ্বানের অগ্রনায়ক আমাদের দুখু মিয়া। দুখু মিয়া মানে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি শুধু একজন কবিই নন বরং অন্যতম একজন গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী। তার শিশুতোষ ছড়া-কবিতা ও গল্প-নাটক তোমরা পড়েছ। জেনেছ কী রকম তার ছড়া-কবিতা ও গল্প-নাটক শিক্ষণীয় ও গ্রহণীয়। তিনি যে সঙ্গীতগুলো রচনা করেছেন সেগুলো সব সেরা ইসলামী সঙ্গীত। তার ইসলামী সঙ্গীত আমাদের বাঙালি মুসলিম সমাজে সর্বাগ্রে বিবেচিত হয়। তোমাদের জন্যও তিনি আদর্শ কিছু ইসলামী সঙ্গীত লিখে গেছেন। শিশুদের তার ইসলামী সঙ্গীতের মাধ্যমে নৈতিকতা, ভদ্রতা, নম্রতা, বদান্যতা অন্যের উপকারের প্রতি কৃতজ্ঞশীল হওয়া, নবী-রাসূলদের প্রতি পরম শ্রদ্ধাশীল হওয়া ইত্যাদির মধুর আহ্বান তিনি জানিয়েছেন।
আল্লাহ তায়ালার বাণী, ‘আর আমি তো লোকমানকে হেকমত দিয়েছিলাম (এবং বলেছিলাম) যে, ‘আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করো। আর যে শুকরিয়া আদায় করে, সে তো নিজের জন্যই শুকরিয়া আদায় করে এবং যে অকৃতজ্ঞ হয় (তার জেনে রাখা উচিত) আল্লাহ অমুখাপেক্ষী, প্রশংসিত।’ (সূরা লুকমান)
অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা আমাদের তার প্রতি কৃতজ্ঞচিত্ত হতে বলেছেন। আমরা তাঁর দয়ায় বাঁচি, রিজিক পাই, সুস্থ থাকি। আমাদের জন্যই তিনি পৃথিবীর সব নেয়ামত সৃষ্টি করেছেন। কিভাবে আমরা আল্লাহর শুকর গুজার করব তাও তিনি পবিত্র কুরআনের প্রথম সূরা আল ফাতিহার প্রথম আয়াতে শিখিয়ে দিচ্ছেন এভাবে, ‘সমস্ত প্রশংসা সেই মহান আল্লাহর, যিনি বিশ্বজগতের প্রতিপালনকারী।’
আমাদের তাই গানের প্রথম সুর ও কথা যেন আল্লাহর তরে হয় সে জন্যই অনন্য গীতিকার কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘এই সুন্দর ফুল’ নামক অতুলনীয় হামদে লিখেছেন-
‘এই সুন্দর ফুল সুন্দর ফল মিঠা নদীর পানি
(খোদা) তোমার মেহেরবানি।
শস্য শ্যামল ফসল-ভরা মাটির ডালিখানি
(খোদা) তোমার মেহেরবানি।।

তুমি কতই দিলে রতন
ভাই বেরাদর পুত্র স্বজন,
ক্ষুধা পেলেই অন্ন জোগাও
মানি চাই না মানি।।
(খোদা) তোমার মেহেরবানি।।’

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই কেয়ামত স¤পর্কে জেনেছ। কী ভয়াবহ এক বিপদের কাল তাই না? সেই কেয়ামত মাঠে যদি আমি আমার আমলনামা ডান হাতে পাই তবে কি কোন দুশ্চিন্তা থাকবে বলো? তবে সেই আমলনামা ডান হাতে পাওয়া আর আল্লাহর কাছে সারাজীবনের আমলের হিসেব দেয়ার পর পার পাওয়া কত্তখানি কঠিন তা ভেবেছ নিশ্চয়। এরকম কঠিনকালে আমরা আল্লাহর রহমতের নামের বরকতে পার পেতে চাই। তিনি যদি রহম করে আমাদের পার করে দেন তবে তা হবে চরম সাফল্য। আর যদি কারো ওপর রাগান্বিত হয়ে প্রকৃতই হিসাব চান তবে তার জন্য জান্নাত যাওয়া সম্ভবপর নয়। তাই আমাদের প্রিয় গানের বুলবুল নজরুল শোনাচ্ছেন-
‘রোজ- হাশরে আল্লাহ আমার করো না বিচার।
বিচার চাহি না, তোমার দয়া চাহে এ গুনাহগার।।
আমি জেনে শুনে জীবন ভরে
দোষ করেছি ঘরে পরে
আশা নাই যে যাব তরে বিচারে তোমার॥’
(রোজ হাশরে আল্লাহ)

হে আগামী দিনের নকিব, আমাদের মাঝে এই সত্যদিন কে নিয়ে এসেছেন? কে প্রতিষ্ঠা করেছেন সঠিক সাম্যবাদ? কে দিলেন নারীদের সর্বোত্তম মর্যাদা? কে শেখালেন মমত্ব পশু-পাখির তরে? তিনিই তো পেয়ারা নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর আগমনে মক্কার জালিমদের গায়ে জ্বালা বেড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু সেই আলোকবর্তিকা বা শান্তির দূতকে স্বাগত জানিয়েছিল মদিনার মানুষজন। তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিল এই মহামানবের মর্যাদা। এমন মহামানব একজনই সারা পৃথিবীতে। তাঁর সমকক্ষ মহামানব আর আসবে না দুনিয়ায়। এরকম একজন মহামানবের আগমনী সঙ্গীত কিরূপ ছিল তা তোমাদের প্রিয় কবি ও শিল্পী নজরুল- ‘তোরা দেখে যা’ নামক না’তে রাসূলে গেয়ে শোনাচ্ছেন-
‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে।
মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে।।
যেন ঊষার কোলে রাঙা রবি দোলে।
………………..
মানুষে মানুষে অধিকার দিল যে জন,
‘এক আল্লাহ ছাড়া প্রভু নাই’ কহিল যে জন,
মানুষের লাগি চির- দীন বেশ নিল যে জন,
বাদশাহ ফকিরে এক শামিল করিল যে জন।’
হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর আগমনে সারা পৃথিবী কী রকম সাজে সেজেছিল তাও আমাদের সুরেলা কণ্ঠে নজরুল জানাচ্ছেন-

‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ
এল রে দুনিয়ায়।
আয়রে সাগর আকাশ বাতাস, দেখবি যদি আয়।।

ধূলির ধরা বেহেশতে আজ
জয় করিল দিল রে লাজ
আজকে খুশির ঢল নেমেছে ধূসর সাহারায়।।’
(ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ)

জান্নাতপ্রত্যাশী নি®পাপ কচিকাঁচারা, রাসূলে আকরাম (সা.) আমাদের মাঝে খুশির সংবাদ নিয়ে আসলেন। আসলেন সমতার বিধান নিয়ে। আরো এসেছেন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার স¤পূর্ণ উপাদান সমেত। আর সে উপাদানসমূহকে প্রিয় কবি দুখু মিয়া বলেছেন, ‘সওদা’। আমাদের কী করা উচিত সেই বিষয়ে গানে গানে বলছেন নজরুল-
‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এল নবীন সওদাগর।
বদনসীব আয়, আয় গুনাহগার, নতুন করে সওদা কর।।’
(ইসলামের ঐ সওদা)

আমাদের সঠিক পথ চেনালেন প্রিয় রাসূল মুহাম্মদ (সা.)। আমাদের ভালোবেসে জাহান্নামের পথ থেকে সরিয়ে এনে জান্নাতের পথিক করেছেন তিনিই। আমাদের তাই ভালোবাসার মানুষ সবার আগে একজনকেই বানানো উচিত। কেননা তিনিই সারাজীবন এই উম্মতের জন্য কতটা করেছেন ত্যাগ!
কত সহ্য করেছেন মুশরিক-কাফিরদের অসহনীয় অত্যাচার। তাঁর (নবী) প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে গান লিখে গেয়ে তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছেন নজরুল-

‘মোহাম্মদ নাম যতই জপি, ততই মধুর লাগে।
নামে এত মধু থাকে, কে জানিত আগে।।

ঐ নামেরই মধু চাহি
মন-ভোমরা বড়ায় গাহি
আমার ক্ষুধা-তৃষ্ণা নাহি
ঐ নামের অনুরাগে’
(মোহাম্মদ নাম যতই জপি)

ছোট্ট বন্ধুরা, ঈদ আসলে খুউব আনন্দ হয় তাই না? আসলেই তো ঈদ মানেই আনন্দ বা উৎসব। তবে এ উৎসব কোন বল্গাহীন উৎসব নয়। এই উৎসবে আনন্দ হয় এই জন্য যে এগুলো আমাদের মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত উপহার। ঈদের সময় আমরা আল্লাহর কাছে যা চাই, তিনি তাই দেন। এটাও ঈদের অন্যতম আনন্দের। যদিও আমরা ভুলে যাই এই ইবাদাতময় উৎসবের আমেজ। করি আতশবাজি ও হই-হুল্লোড়। কিন্তু এসব ঈদের কোনো অনুষঙ্গ নয় বরঞ্চ নিজ পবিত্র উৎসবকে স্বকীয়তা হারানোর দিকে ঠেলে দেয়ামাত্র। আমাদের ঈদ সত্যি অনন্য ও নিষ্কলুষ। এই ঈদে আমরা খোঁজ খবর নেই গরিব-দুঃখী মানুষের। আমাদের স¤পদে তাদের যে ন্যায্য পাওনা তা বুঝে দেই। একসাথে নামাজ পড়ি। কোলাকুলি করি। এসব ভ্রাতৃত্বকে করে মজবুত। বলতো আমাদের কি ঈদ ‘ও মন রমজানের ঐ’ গানটি ছাড়া পালিত হয়? কখনওই না। গানটি আমাদের প্রায় সকলেরই মুখস্থ। গানটিতে কী রকম দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষদের মূলস্রোতের সাথে আনন্দে ভাগাংশী হতে বলেছেন। তাদের অংশ তাদেরকে বুঝে দিতে বলেছেন কবি। ওটা কোন দয়া বা করুণা নয়। তাদের অধিকার।এরকম নৈতিকতাকে মজবুত করার বেশ কিছু শিশুতোষ ইসলামী গান নিয়ে নজরুল এক প্রকা- স্থান দখল করে নিয়েছেন বাংলার আপামর মানুষের হৃদয়ে।
আসো আমরা নৈতিকতার শিক্ষা গ্রহণ করি। সুখী, সমৃদ্ধশালী এক নতুন পৃথিবী গঠনে হই আগুয়ান।

Share.

মন্তব্য করুন