বনানী এগারো নম্বর সড়কের ডি ব্লকের আশি নম্বর বাড়ির সামনে ফুটপাথ ঘেঁষে একটি আমগাছ। রাজশাহী থেকে আনা একটা আম চুষে খেয়ে জানালা দিয়ে আঁটিটি বাইরে ফেলে দেন বাড়ির মালিক। বাড়ির মালিক অদেখার জগতে চলে গেছেন প্রায় উনিশ বছর আগে। সেই ফেলে দেওয়া আঁটিটি গাছ হয়েছে। সেই গাছটিও বড় হয়েছে। সেও পঁচিশ-ত্রিশ বছর হয়ে গেলো।
কিন্তু প্রায় সময়ই দেখা যায় ডেসকো ও মিউনিসিপ্যালিটির নির্দয় অত্যাচারে গাছটির শাখা-প্রশাখা ক্ষত-বিক্ষত। গাছটি যখনই তার সমস্ত প্রাণশক্তি প্রয়োগ করে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়, তখনই আসে তার ওপর ডেসকো ও মিউনিসিপ্যালিটির কাছ থেকে আঘাত। সময় সময় কোনো অংশের বড় বড় ডাল কেটে ফেলে গাছটিকে শাখা-প্রশাখাহীন করে দিয়ে চলে যায়। মিউনিসিপ্যালিটি ছাড়াও কিছু অসাধু ডিস ও ইন্টারনেট ব্যবসায়ী রাতের আঁধারে প্রায়ই ক্যাবল টানার সুবিধার্থে চালায় নির্দয় অত্যাচার গাছটির ওপর। মাঝে মাঝে শহরকে সুন্দর করার অভিপ্রায় নিয়ে মিউনিসিপ্যালিটির লোকেরা কাজ করার নামে নতুন ঢাকার রাস্তার দুই পাশের লাগানো গাছগুলোকে রাতের আঁধারে দস্যুর মতো কেটে ফেলে।
যে সমস্ত গাছগুলো রাস্তার দু’ধারের বাড়ির সামনে লাগানো, ঐ সমস্ত বাড়ির লোকেরা এই গাছগুলোকে সন্তানের মতো যত্ন করে বড় হতে সাহায্য করেন। তাদের বুকেও রক্তক্ষরণ হয়। গাছগুলোর আঘাত তাদের গায়ে এসে লাগে। তেমন একটি গাছ এই আমগাছ। বছরের পর বছর ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার পরও সুমিষ্ট আমের ফলন ফলিয়ে পথচারী ও বাসার মালিকের পরিবারকে প্রতি মৌসুমে আম উপহার দেয়।
সন্তানের মতো গাছের জন্য তাদের মায়া ও ভালোবাসা নিরন্তর বর্ষিত হয়। বাড়িমালিকের সন্তান-সন্ততি স্ত্রী বেঁচে আছেন। তারাও এই গাছটিকে নিজস্ব সন্তান মনে করে যত্ন তদারকি করে কোনো রকম বাঁচিয়ে রেখেছেন। গাছটিও আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েও তার বুকের সুধাভা- থেকে নিঃসৃত মধুর মতো ফলন দিচ্ছে।
গত দুই বছর ধরে শহরের পৌরসভার উন্নয়নের নামে এই গাছটি বারবার আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। ভয় ছিলো হয়তোবা এই গাছে আর ফলন আসবে না। মরে যাওয়ারও আশঙ্কা ছিলো। আল্লাহর রহমতে এতো কিছুর পরও বাড়ির লোকদের নজরদারিতে গাছটি বেঁচে আছে।
একদিন বাড়ির গৃহকর্ত্রী সকালবেলা সম্মুখের জানালা দিয়ে দেখলেন, গাছটির ছোট ছোট শাখার ভেতরে সুষমা ছড়িয়ে কিছু কলাগাছের পাতার মতো সবুজ পাতা গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের আকারে দেখা যাচ্ছে। আরও কয়েকদিন পর দেখা গেলো, এই পাতাগুলো নেই। প্রতিটি শাখায় শাখায় লম্বা ডাঁটা বেরিয়েছে আর তার শিরা-উপশিরায় ছোট ছোট মুকুল মুখ বের করে জানান দিচ্ছে আমগাছের গর্ভধারণে প্রথম আগমনী চিহ্ন। খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন তিনি। বাড়ির সবাইকে ডেকে আনলেন জানালার কাছে। ঐ দেখো, আমগাছে ফুল এসেছে। তার নিজের কাছেই মনে হলো যেনো তিনি নিজেই জন্মধাত্রী। বাড়ির সবাই মিলে গাছের রূপান্তর দেখে খুশিতে আত্মহারা। গাছের বড় পাতাগুলো লুকিয়ে গেছে ডাঁটার আড়ালে। পুরো গাছটিকে মনে হচ্ছে মস্ত বড় একটা ফুলের ঝাড়, বাড়ির সামনে শোভাবর্ধনের জন্য লাগানো হয়েছে। কয়েকদিন পর গৃহকর্ত্রী প্রচুর আগ্রহ নিয়ে আবার জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। হঠাৎ দেখেন অসংখ্য লম্বা লম্বা ডাঁটাগাছের ভেতর থেকে বের হয়ে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে আছে। এবং ডাঁটাগুলো শিরায় শিরায় অসংখ্য ছোট ছোট ফুল। আগের দেখা ফুলের ঝাড়ের মতো এখন আর গাছটি নেই। ঊর্ধ্বমুখী ডাঁটাগুলোতে জড়িয়ে আছে ছোট ছোট আমের কুুঁড়ি।

Share.

মন্তব্য করুন