ফুটবল প্রধানত ক্লাবকেন্দ্রিক খেলা। সারা বছর খেলোয়াড়রা ক্লাব নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। ক্লাবের সাথে তাদের কোটি কোটি ডলারের চুক্তি হয়। কোটি ডলারে খেলোয়াড় কেনা-বেচা হয় ক্লাবগুলোর মধ্যে। জাতীয় দলের খেলা থাকলে ক্লাব থেকে ছুটি নিয়ে যেতে হয়। ক্লাবগুলো তাদের দেশীয় ও মহাদেশীয় বিভিন্ন লিগ ও টুর্নামেন্টে খেলে। এবার আমরা জানবো ফুটবল বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় পাঁচটি লিগ সম্পর্কে। যে লিগগুলোতেই খেলেন বিশ্বের সেরা ফুটবলাররা।
সাধারণত সব পেশাদার ফুটবল লিগেরই ফিকশ্চার একই ধরনের হয়ে থাকে। প্রতিটি দল অন্য সবগুলো দলের বিপক্ষে দু’টি করে ম্যাচ খেলে। একবার নিজের মাঠে, আরেকবার প্রতিপক্ষের স্টেডিয়ামে গিয়ে। যেমন লিগে ২০টি দল থাকলে একটি দল বাকি ১৯ দলের বিপক্ষে ৩৮টি ম্যাচ খেলবে। লিগ শেষে পয়েন্ট টেবিলের সেরা দলটি পায় চ্যাম্পিয়ন খেতাব।

প্রিমিয়ার লিগ, ইংল্যান্ড
ইংল্যান্ডের পেশাদার ফুটবলের সর্বোচ্চ আসরের নাম ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ। কখনো ইপিএল কখনো বা শুধু প্রিমিয়ার লিগ নামেই ডাকা হয় এটিকে। ২০টি দল নিয়ে হয় এই লিগ। প্রতি বছর আগস্টের মাঝামাঝিতে শুরু হয় প্রিমিয়ার লিগ, শেষ হয় পরের বছর মে মাসে। তোমাদের মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে যে, ৩৮টি ম্যাচ খেলতে এত দীর্ঘ সময় লাগবে কেন? এর প্রধান কারণ- একই সাথে ইউরোপের ফুটবল ক্লাবগুলোকে কয়েকটি লিগ খেলতে হয়। যেমন প্রিমিয়ার লিগ চলাকালেই ক্লাবগুলোকে ফাঁকে ফাঁকে খেলতে হয় এফএ কাপ, ইএফএল কাপ কিংবা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ম্যাচগুলো। ইউরোপে একই সাথে কয়েকটি টুর্নামেন্ট চলার রীতি বহু বছরের। এ ছাড়া মাঝখানে কয়েক দিনের শীতকালীন বিরতি থাকে।
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের বর্তমান নামকরণ করা হয়েছে ১৯৯২ সালে। ১৮৮৮ সালে শুরু হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে পুরাতন পেশাদার এই লিগ। আগে নাম ছিলো ফুটবল লিগ। খেলতো মোট ৭২টি ক্লাব। পরে লিগটিকে তিনটি স্তরে ভাগ করে সর্বোচ্চ স্তরকে প্রিমিয়ার লিগ নামকরণ করা হয়। যেখানে খেলে দেশের সেরা ক্লাবগুলো। প্রিমিয়ার লিগে এবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে (২০১৯-২০ মৌসুম) লিভারপুল এফসি। যে ক্লাবটিতে খেলেন মিসরের মোহাম্মাদ সালাহ, সেনেগালের সাদিও মানে। তবে সবচেয়ে বেশি ১৩ বার শিরোপা জিতেছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। এই লিগের উল্লেখযোগ্য আরো কয়েকটি ক্লাব হলো, ম্যানচেস্টার সিটি, চেলসি, আর্সেনাল, লেস্টার সিটি। প্রতি বছর এই লিগের সেরা চারটি ক্লাব খেলার সুযোগ পায় উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও ইউরোপা লিগে। আর পয়েন্ট টেবিলের সবচেয়ে নিচের তিনটি ক্লাবকে লিগ থেকে বিদায় নিয়ে পরের বছর খেলতে হয় দ্বিতীয় স্তরের চ্যাম্পিয়ন্সশিপ লিগে। আবার চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের সেরা হওয়া তিনটি দল খেলার সুযোগ পায় প্রিমিয়ার লিগে। মূলত নিচের দিকের ক্লাবগুলোকে শীর্ষ পর্যায়ে উঠে আসার সুযোগ দিতেই এই নিয়ম।

লা লিগা, স্পেন
দীর্ঘদিনের মেসি-রোনালদো লড়াইয়ের কারণে স্প্যানিশ লা লিগা বাংলাদেশের দর্শকদের কাছে বেশি আকর্ষণীয়। রিয়াল মাদ্রিদ আর এফসি বার্সেলোনার হয়ে দুই তারকার লড়াই ছিলো জমজমাট। গত বছর অবশ্য রোনালদোকে ইতালির জুভেন্টাস ক্লাবের কাছে ‘বিক্রি’ করে দিয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। লা লিগাতেও খেলে ২০টি ক্লাব। এর মধ্যে শেষ দিকের তিনটিকে প্রতি বছর রেলিগেশন নিয়মের জালে বন্দী হয়ে চলে যেতে হয় দ্বিতীয় স্তরের সেগুন্দা ডিভিশনে খেলতে, আর সেখান থেকে তিনটি প্রমোশন পায় লা লিগায়। ১৯২৯ সালে শুরু হওয়া লিগটিতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ৩৩ বার শিরোপা জিতেছে রিয়াল মাদ্রিদ। আর বার্সেলোনা জিতেছে ২৬ বার। গত বছর চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বার্সেলোনা (এই লেখা যখন লিখছি তখন চলতি ২০১৯-২০২০ মৌসুমের চারটি করে ম্যাচ বাকি, তোমরা এতদিন জেনে গেছ এই মৌসুমের চ্যাম্পিয়নের নাম)।
প্রতি বছর আগস্টের শেষ দিকে শুরু হয়ে পরের বছর মে মাসে শেষ হয় মৌসুম। মাঝখানে বড় ও নববর্ষের ছুটি থাকে। এ বছর অবশ্য করোনাভাইরাসের কারণে তিন মাস বিরতি ছিলো সবগুলো লিগেই। যে কারণে পিছিয়ে গেছে লিগ। লা লিগার ফাঁকে স্পেনের ক্লাবগুলো অংশ নেয় স্প্যানিশ সুপার কাপ, কোপা ডেল রে’তে। লা লিগার সেরা চারটি দল প্রতি বছর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ও ইউরোপা লিগে খেলে।
২০১৩-২০১৯ টানা সাত মৌসুম ইউরোপের সেরা লিগ মনোনীত হয়েছে লা লিগা। মেসি-রোনালদো লড়াইয়ের কারণেই এই লিগের প্রতি দর্শকদের টান তৈরি হয়েছে গত দেড় দশকে। এই লিগের উল্লেখযোগ্য আরো কয়েকটি ক্লাব হচ্ছে- অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদ, সেভিয়া, রিয়াল সোসিয়েদাদ, গেটাফে, ভ্যালেন্সিয়া।

সিরি আ’ লিগ, ইতালি
১৮৯৮ সালে শুরু হয় ইতালির সর্বোচ্চ লিগ সিরি আ’। তবে বর্তমান ফরম্যাট চালু হয়েছে ১৯২৯ সালে। এই লিগের সিস্টেমও ইংল্যান্ড ও স্পেনের লিগের মতোই। গত বছর পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৩৫ বার এই লিগের শিরোপা জিতেছে জুভেন্টাস। তুরিন শহরের এই ক্লাবটিতেই এই মৌসুম থেকে খেলছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।
প্রতি বছর আগস্টের শেষ দিকে শুরু হয় লিগটি শেষ হয় পরের বছর মে মাসের শেষ সপ্তাহে। একই সময়ে পাশাপাশি কোপা ইতালিয়া ও সুপারকোপা ইতালিয়ার খেলাও চলে। এই লিগের উল্লেখযোগ্য ক্লাব হচ্ছে- এসি মিলান, ইন্টার মিলান, ল্যাজিও, রোমা। এই লিগের নাপোলি ক্লাবটিকে বিশ্ববিখ্যাত ক্লাবে পরিণত করেছিলেন আর্জেন্টাইন সুপারস্টার ডিয়াগো ম্যারাডোনা। ম্যারাডোনার পায়ের জাদুতে সাধারণ একটি ক্লাব থেকে শীর্ষ সারিতে উঠে এসেছিল নেপলস শহরের ক্লাব নাপোলি। ক্লাবটি দুইবারই মাত্র লিগ জিতেছে। ম্যারাডোনার সময়ে ১৯৮৭ ও ১৯৯০ সালে। ম্যারাডোনার সম্মানে ক্লাবটি ১০ নম্বর জার্সিটি আর ব্যবহার করে না।

বুন্দেসলিগা, জার্মানি
বুন্দেসলিগা চালু হয়েছে ১৯৬৩ সালে। ১৮টি দল নিয়ে চলে এই লিগ, সে হিসেবে প্রতিটি দলকে খেলতে হয় ৩৪টি ম্যাচ। বুন্দেসলিগায় গত ৮ মৌসুম ধরে টানা চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসছে এফসি বায়ার্ন মিউনিখ। জার্মানির দক্ষিণাঞ্চলীয় মিউনিখ শহরের ক্লাবটি সর্বোচ্চ ২৯ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বুন্দেসলিগায়। অন্যান্য লিগের মতো এখানেও রেলিগেশন ও প্রমোশন সিস্টেম রয়েছে। আছে সেরা ক্লাবগুলোর সরাসরি ইউরোপীয় ক্লাব প্রতিযোগিতায় খেলার সুযোগ। এই লিগের উল্লেখযোগ্য ক্লাব হচ্ছে বরুশিয়া ডর্টমুন্ড, আরবি লেপজিগ, বায়ার্ন লেভারকুসেন, শালকে জিরো ফোর, ইউনিয়ন বার্লিন ইত্যাদি।

লিগ ওয়ান, ফ্রান্স
ফ্রান্সের সর্বোচ্চ ফুটবল লিগটি এই সেরা পাঁচ লিগের মধ্যে আলোচনায় কিছুটা পিছিয়ে। এর কারণ এই লিগে বড় বড় তারকাদের খুব একটা দেখা যায় না। তা ছাড়া ইউরোপীয় ক্লাব প্রতিযোগিতায় (যেমন চ্যাম্পিয়ন্স লিগ) ফ্রান্সের ক্লাবগুলোর সফলতা কম।
১৯৩০ সালে শুরু হওয়া এই লিগে এখন খেলে ২০টি দল। এই লিগে প্রতি বছর ফ্রান্সের প্রতিবেশী ছোট্ট দেশ মোনাকোর একটি ক্লাবকে খেলার সুযোগ দেয়া হয়। চলতি বছর করোনাভাইরাসের কারণে লিগ স্থগিত হয়ে যাওয়ার পর পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থাকা প্যারিস সেন্ট জার্মেইকে (পিএসজি) চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়। এই ক্লাবে খেলেন ব্রাজিলের তারকা নেইমার, ফ্রান্সের কিলিয়ান এমবাপ্পে। সেন্ট এতিয়েন ক্লাব সর্বোচ্চ ১০ বার লিগ শিরোপা জিতেছে। পিএসজি জিতেছে ৯ বার।

Share.

মন্তব্য করুন