লাবিব গাছ থেকে পড়ে হাত ভেঙে ফেলেছে। কী দুর্ভাগ্য ছেলেটার! সকল দুর্যোগ যেন তার উপরেই নামে। এইতো সেদিন কাঁঠাল গাছের নিচে বৌচি খেলতে গিয়ে মস্ত একটা মটকা ডাল সোজা ভেঙে পড়েছে তার মাথায়। তারপরে কী হুলুস্থ’ুলে কা-!
সোজা হাসপাতালের বেডে কেটে গেল দুই সপ্তাহ। ঘর থেকে বের হলেই কোনো-না-কোনো অলুক্ষণে কা- ঘটবেই। আরেকদিন মাঠে খেলতে গিয়ে ঘটেছে আরেক ঘটনা। ঝোপের আড়ালে ক্রিকেট বল খুঁজতে গিয়ে পায়ের তালুতে বিঁধেছে অসংখ্য কাচের টুকরো। তারপর আবার ডাক্তার! ইদানীং সে বিভিন্ন ডাক্তারের একজন নিয়মিত প্যাশেন্ট হয়ে গেছে! যাই হোক, ডান হাতে ব্যান্ডেজ উঠেছে বলে ছেলেটা কিন্তু দমে যায়নি। মা ঘর থেকে বের হওয়া একদম বারণ করে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু পুকুরপাড়ে গিয়ে একটা আছাড় না খেলে যে তার আবার রাতে ঘুম ভালো হয় না সেটা মোটামুটি সবাই জানে। গতকাল সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে এবং রাতে প্রচ- ঝড়ের তা-বে অনেক গাছপালাও দুমড়ে-মুচড়ে পড়েছে। সকাল-সকাল লাবিব ঘুম থেকে উঠেই কাউকে কিছু না বলে মাতব্বরি দেখিয়ে আমগাছ তলায় গিয়েছে আম কুড়াতে। যেই কাঁচা দু’টো আম কুড়িয়েছে অমনি গাছ থেকে আরেকটি আমের ঝোকা সোজা এসে পড়লো তার ভাঙা হাতের উপর। তারপরে আর যায় কোথায়! এক চিৎকারে সোজা অজ্ঞান। পরে অবশ্য কাকু গিয়ে শেষ উদ্ধারের কাজটুকু করে আপাতত বিশ্রাম নেয়।
সামনে ঈদ। টিপু মামা বাড়িতে এসেছে লাবিবকে দেখতে। মামাকে দেখেই লাবিব আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। কারণ টিপু মামা মানেই অনেকগুলো গল্পের বই। লাবিব এবার ক্লাস থ্রি-তে উঠেছে। দুষ্টুমিতে সেরা হলেও গল্পের বই কিন্তু সে খুব ভালোবাসে। তার নানুবাড়ি অনেক দূরে হওয়ায় সবসময় সে মামার কাছে যেতে পারে না। আর মামার বাড়ি মানেই মস্ত একটা লাইব্রেরি ঘর, যেখানে অজস্র গল্পের বইয়ে ঠাসা। লাবিব মনে মনে একটা ফন্দি এঁটে রাখল। পরদিন সকালে মামা যখন চলে যাবার জন্য প্রস্তুত হলো ঠিক সেই সময় লাবিব ধরে বসল এক বায়না। সেও মামার সাথে নানুবাড়ি যাবে। মা চমকে উঠল। একি বলছে লাবিব! যে ছেলের ভাঙা হাত এখনো জোড়া লাগেনি, যাকে একমুহূর্ত ঘরে রাখা যায় না সে কিনা যাবে নানুবাড়ি! কিন্তু কার কথা কে শোনে? মামার সায় দেওয়াতে লাবিব যেন ঘাড়ে চড়ে বসলো। সবার অগোচরে নিজের ব্যাগে কাপড়-চোপড় গুছিয়ে ফেললো। শেষমেশ লাবিবের জিদটাই সত্যি হলো। নানুবাড়িতে সবাই যে তার খুব খেয়াল রাখবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। মামা বিষয়টাকে খুব স্বাভাবিকভাবেই নিতে বলল সবাইকে। মায়ের ইচ্ছে করলেও লাবিবের সাথে যেতে পারল না, কেননা সামনে ঈদ আর তাই বাড়িতে কাজের চাপে দম ফালানোর উপায় নেই।
সকাল দশটা পনেরো মিনিটে পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ট্রেনটা সিলেট থেকে ছেড়ে যাবে। মামা মাকে কথা দিল যে, ঈদের পরের দিনই লাবিবকে দিয়ে যাবে। এবার ঈদটা লাবিব তার নিজের বাড়িতে করবে না বলে বাবা খুব দুঃখ প্রকাশ করল। মামা আর লাবিব যখন স্টেশনে পৌঁছালো তখনও ট্রেন আসতে চল্লিশ মিনিট বাকি। স্টেশনে প্রচ- ভিড়। প্ল্যাটফর্মের এক কোনায় দাঁড়িয়ে মামা-ভাগ্নে খোশ গল্পে মেতে উঠলো। কিভাবে লাবিব তার হাত ভেঙেছে, কেন এত দুষ্টুমি করে, ঈদের দিন তারা কী করবে, নানুবাড়ি গিয়েও দুষ্টুমি করবে কি না, এইসব আর কী!
আকাশে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে। এমন সময় ঝকঝক করে দ্রুতগামী ট্রেনটা স্টেশনে এসে হাজির হলো। সঙ্গে সঙ্গে জাগ্রত হলো সকল শ্রেণীর মানুষ। কোলাহলে পরিপূর্ণ স্টেশন। ট্রেনে ওঠার জন্য মামা লাবিবের হাত ধরে ভিড় ঠেলে মাঝের বগিটার দিকে গেল। লাবিবের যেহেতু হাত ভাঙা তাই মামা সতর্কতার কোন কমতি রাখলো না। তবুও ট্রেনে উঠতে গিয়ে হঠাৎ মামার হাত ফস্কে কিভাবে যে লাবিব বেরিয়ে গেল আর তারপরেই মিলিয়ে গেল জনসমাগমে তা একটুকুও টের পেল না। এদিকে লাবিব তার মামার হাত ভেবে অন্য লোকের হাত ধরে সোজা চলে গেল সামনের এক বগিতে। মামার যখন খেয়াল হলো যে লাবিব উনার হাতের কাছে নেই আকাশে তখনই বিদ্যুৎ চমকে উঠল। এক লাফে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল মামা। তারপর পাগলের মতো ছোটাছুটি করে খুঁজতে লাগলো আর চিৎকার করতে লাগলো লাবিব, লাবিব…। এদিকে লাবিব তার মামাকে খুঁজে না পেয়ে একাই ট্রেনে উঠে পড়েছে। সে ভেবেছে মামা নিশ্চয়ই খোঁজাখুঁজি করে তার কাছে ঠিক আসবে। যদি সে নেমে পড়ে হয়তো ভিড়ের মধ্যে মামাকে আর খুঁজে পাবে না। এদিকে তার মামা ট্রেনের কয়েকটা বগি তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছে। লাবিব কোথাও নেই। স্টেশনের বাইরে ছোট্ট একটা মনোহারী দোকানে কয়েকটা ছেলের মধ্যে লাবিব আছে মনে করে সেই দিকেই দৌড়ে ছুটে গেল মামা। কিন্তু এতেও বৃথা!
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। মামা কিন্তু ট্রেনে উঠল না। হয়তো এই ভেবেই যে, লাবিব স্টেশনের কোন এক কোনায় দাঁড়িয়ে তার মামার জন্য অপেক্ষা করছে। কেবল চারদিকে পাগলের মতো লাবিবকে খুঁজল। ছেলেটাকে না পেয়েই উনি ট্রেনে উঠে যাবে! ভাবতেই বুক ফেটে কান্না চলে এলো। কোন মুখে উনি বাড়ি যাবেন! এত্তটুকুন একটা বাচ্চা ছেলে কিভাবে হাত থেকে বেরিয়ে যায়? সবই হয়েছে নিজের অসতর্কতার জন্য। নিজেকে নিজেই ধিক্কার দিতে লাগল মামা।
ঘণ্টাখানেক পার হয়ে গেছে। ট্রেন চলেছে দুর্বার গতিতে। লাবিবের মুখখানা শুকনো হয়ে গেছে সেই কখন! সে ঠিকই বুঝতে পেরেছে তার মামা তাকে না পেয়ে ট্রেনে ওঠেনি। যদি উঠেই থাকতো তাহলে এতক্ষণে তাকে পেয়ে যেত। ট্রেন পরের স্টেশনে থামলো। লাবিব কিন্তু আর দেরি করলো না। দৌড় দিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল। টিকিট কাউন্টার এর কাছাকাছি মাঝবয়সী একটা লোককে দেখে কাছে গিয়ে লাবিব বলল, ‘আমাকে একটু সাহায্য করবেন?’
হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা টুকটুকে চেহারার লাবিবকে দেখে লোকটির মায়া হলো। তারপর একটু মিষ্টি হাসি হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, তোমার নাম কী?
লাবিব।
বিপদে পড়েছ বুঝি? আমাকে সবকিছু খুলে বলতে পারো। দেখি তোমায় কিভাবে সাহায্য করতে পারি।
লাবিব একদমে পুরো ঘটনাটা খুলে বললো।
বেলা বারোটা ছুঁই-ছুঁই। মামা এখনো স্টেশনের মাঝখানে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন মামা বলে ডাক দিল। একটা শীতল হাওয়া ঘূর্ণিঝড়ের মতো যেন হৃদয় ছুঁয়ে গেল। অশ্রুভেজা দু’চোখ মুছে পিছন ফিরে মামা দেখল মিষ্টি হাসি হেসে দাঁড়িয়ে আছে তার আদরের, ভালোবাসার লাবিব।

Share.

মন্তব্য করুন