চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে অদ্রি। খুব চটপটে। লেখাপড়ায় মনোযোগী। বুদ্ধি আছে বেশ। এতো ছোট বয়সে সহি কুরআন পড়ায় পারদর্শী হয়ে উঠেছে। পাঞ্জাবী পড়ে মাথায় টুপি দিয়ে যখন ওস্তাদজির কাছে কুরআন পড়তে যায় তখন তার নমনীয়তা দেখে প্রাণটা জুড়িয়ে যায়। সবাই বলে মাশাআল্লাহ।
ছেলেটা খুব ভালো।
টিভিতে কার্টুন দেখতে দেখতে হোমওয়ার্ক সেরে ফেলে। নিজের পড়াশুনাও গুছিয়ে করে। তেমন একটা পিড়াপিড়ি করতে হয়না।
অদ্রি যেমন মেধাবী তেমন চালাক চতুর। ক্লাশে তার আগে কেউ পড়া বলতে পারে না। তাই শিক্ষকগণ তাকে খুব পছন্দ করে। সে শিক্ষকদের আদর কেড়ে নিতে জানে। তৃতীয় শ্রেণিতে উঠতেই অদ্রি ক্লাশ পায় দিবা শাখায়। শ্রেণিকক্ষের পশ্চিমের জানালা দিয়ে আসা উত্তপ্ত রোদের প্রচন্ড তাপে একদিন তার মাথা গরম হয়ে যায়। তার উপরে আছে ক্লাশক্যাপটিনের শাসনের বাড়াবাড়ি। তাই সে প্রধান শিক্ষকের কাছে ক্যাপটিন পরিবর্তন ও পর্দা টানানোর জন্য আবেদন লিখে জমা দেয়। এতোটুকু ছেলে এমন একটি আবেদন করতে পারে এটা ভেবেই প্রধান শিক্ষক অবাক হন। এবং সাথে সাথে স্কুলের সকল কক্ষের জানালায় পর্দা লাগানোর ব্যবস্থা করেন। পরিবর্তন করেন ক্যাপটিনকেও।

অবসর পেলে অদ্রি ছোটদের ছড়া ও গল্পের বই পড়ায় ডুবে যায়। রঙিন মলাট যুক্ত শিশুতোষ ছড়া ছবির বই পড়তে নাকি তার খুব ভালো লাগে। বইমেলা থেকে উপহার স্বরূপ অনেক বই কিনে দেন তার বড় খালা। তাইতো বড় খালাকে অদ্রি সোনা মা বলে ডাকে। এই সকল বই পড়ে পড়ে এই বয়সেই অদ্রি হয়ে উঠেছে বইপ্রেমী।

কখনো কখনো একটা বিশেষ কারনে তার মেজাজ চুলায় রাখা ফ্রাইপেনের মতো উত্তপ্ত হয়ে যায়। আর তা হলো, দিদিকে বাবাই বেশি আদর করে। মা তাকে বেশি লাই দেয়। যা চায় তাই দেয়। নিজের মেয়ে নেই বলে সোনা মা তাকে আহ্লাদ দিয়ে একেবারে মাথায় তুলছে। আর ওকে ডাকে নেংটি ইঁদুর। আমেরিকা থেকে ফোন দিয়েই দাদী জানু বলে ডাকে দিদিকে। সে ছোট বলে তাকে কেউ আদর করে না। এটা তার ধারনা। এজন্য মনের দুঃখে সে বেলকুনিতে গিয়ে কেঁদে বুক ভাসায়।

আসলে সংসারে নিত্যদিনের সব কাজে অদ্রি হাজির হয় এবং কাজগুলো সমাধানের চেয়ে ঝামেলা পাকায় বেশি। এটা তার বয়সের দোষ। কাজের প্রতি অতি আগ্রহের কারনে কেমন করে যে ঝামেলাটা লেগে যায় তা সে নিজেও জানেনা। তাদের বাসায় আসা সকল মানুষের একটাই প্রশ্ন অদ্রি কি ঘুমায় না? কারণ আজ পর্যন্ত কেউ তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখেনি। বরং সকল কথার উত্তর তার জানা। সকল আলাপে তার কাছ থেকে আসে বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর। যা অনেক সময় বয়সের সাথে মানানসই হয়ে ওঠেনা। বাংলা, ইংরেজী ও হিন্দী ভাষায় পারদর্শী ছেলেকে রীতিমত ভয় পায় অনেকে।
কোন কথায় কখন আটকে যেতে হয় তার কাছে কে জানে।
অদ্রির মা একজন স্কুল শিক্ষিকা। চাকরী, সংসার, ছেলেমেয়ে দেখাশুনার ফাঁকে ফাঁকে লেখালেখির অভ্যাস আছে তার। অবসর পেলে ছড়া, ছোটগল্প লেখেন তিনি।
সেদিন দুপুরে অদ্রি বিছানায় শুয়ে কাঁদছিলো। খেতে ডাকলে খুব জোড় গলায় খাবোনা! শব্দটি বেরিয়ে এলো তার মুখ থেকে । অবাক হয়ে মা জানতে চাইলেন –
কেন ? কি হয়েছে?
ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো অদ্রি।
মা তার পাশে বসলেন। এবং আদর করে ছেলেকে টেনে তোলার চেষ্টা করলেন।
অদ্রি এবার মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগলো। আম্মু তুমি পাখির ছানাটিকে মেরে ফেলোনা প্লিজ।
মা কিছুই বুঝতে পারলেন না। কি হয়েছে ছেলেটার? মাথা নষ্ট হয়ে গেলো নাকি? কি বলে এসব? কোথায় পাখির ছানা? আমি তাকে মারবোই বা কেন?

তোমার বালিশের নিচে যে গল্পটি লিখ রেখেছো তা আমি পড়েছি। তোমার গল্পে পাখির ছানাটি বাসা থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙ্গে গেছে, মা পাখিটা তাকে কিছুতেই বাসায় তুলতে পারছেনা। তাই সে বার বার উড়ে উড়ে ছানাটির কাছে আসছে। তারপর কোথা থেকে একটি কাক এসে ছানাটি ছোঁ মেরে নিয়ে গেলো।
কেন? তুমি ছানাটিকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারতেনা? এতো সুন্দর ছোট্ট একটি পাখির ছানাকে তুমি কাকের খাবার বানালে?
মা অবাক হয়ে গেলেন। গল্পে লেখা পাখির ছানার জন্য তার সন্তানের এতো মায়া?
এবার ছলছল হলো মায়ের আখি। নিজেকে সামলে নিয়ে ছেলেকে কথা দিলেন –
যাও পাখির ছানাটি তার বাসায় রেখে আসলাম।
এবং ছানা ও তার মায়ের আনন্দ দেখে আমরাও আনন্দিত হলাম। এবার গল্প ঠিক আছে?
চোখ মুছতে মুছেতে অদ্রি হেসে বললো।
আর এমন গল্প কোনোদিন লিখবে না। প্রমিজ করো।
মা প্রমিজ করলেন- আর কখনো মায়ের কাছ থেকে পাখির ছানা আলাদা করার গল্প লিখবেন না তিনি । সব সময় পাখির ছানাকে তার মায়ের বুকে ফিরিয়ে দেবন। যেন বড় হয়ে সে উড়তে পারে।
এক লাফ দিয়ে কলম আর গল্প লেখা কাগজটি নিয়ে এলো অদ্রি।
কাটো! এই লাইনগুলো কাটো!
সত্যি চোখ মুছতে মুছতে মা তার নিজ হাতে সযতেœ লাইগুলো কেটে দিলেন। আর মনে মনে দোয়া করলেন।
বেঁচে থাকো বাবা। মানুষ হও।

Share.

মন্তব্য করুন