মায়াপুর জংশনের বড় রাস্তা ধরে অনেকটা পথ পেরোলেই দেখা মিলে গুটিকয়েক ঘর-বসতির, বন-বনানী আর অরণ্যে ঘেরা প্রায় জনমানবশূন্য এ অঞ্চলে মাত্র কয়েক বছর হলো মানুষের আনাগোণা হয়েছে। সাথে পাশ কেটে বহুদূর চলে গেছে ডাকাতিয়া নদী। এমনই এক নদী ভরা বর্ষা মৌসুমেও থাকে নিষ্প্রাণ।
মায়াপুর জংশনের পরের জংশন হলো কলিমপুর জংশন; সপ্তাহের দুদিন এখানে বিরাট বাজার বসে । আশেপাশের দশ-বারো গ্রামের মানুষেরা তাদের মাঠের ফসল আনে। শুধু ভালো দাম পাবার আশায়; যারা বিক্রেতা তারাই আবার খদ্দের। কারণ সমগ্র বরিশালে তখনো কোনো এমন বাজার হয়ে উঠেনি। নিত্যদিনের সদাই থেকে শুরু করে গৃহস্থলির নানা জিনিসপত্রের জন্য এ বাজারই একমাত্র আশ্রয়, সবই মিলতো এক জায়গায়। তখন ছিলো পায়ে হাঁটার রাস্তা। আশেপাশের গ্রাম থেকে দুরত্বও ছিলো বেশ, কথিত আছে মায়াপুর জংশন হতে করিমপুর জংশন হয়ে যেতেই সূর্য মাথার উপর এসে দুপুর হয়ে যেতো। বাজার সারাদিন থাকতো বলেই রক্ষা।
বঙ্গদেশের শতশত নাম না জানা অচেনা গ্রামের মতোই ছিলো মায়াপুর জংশনের গ্রামটি; এ গ্রামের নাম নিয়ে কারোরই কোনোকালে মাথাব্যথা ছিলো না। তবুও সবার এত কালের যাওয়া আসায় কখনো নামের দরকার হয় নি। যদিও তখন সেখানে হাতেগোনা কয়েকবছরই হয়েছিলো সেখানকার বসতি গড়ে ওঠার বয়স। বসতি গড়ে ওঠার দু’য়েক দশক পরই গ্রামটি লোকমুখে পরিচিত হয়ে ওঠলো বিচিত্র এক নামে।
‘আলমডাঙ্গা’ নামটি শুনতেই সাধারণ কোনো মানুষের নাম মনে হলেও, আদতে ছিল তার উল্টো। তখনকার এক প্রচ- সাহসী মানুষের নামেই এই গ্রাম। গ্রামের মাতবর আলী হোসেনের মুখে এ কথা শুনেই চোখ পিটপিট করে তাকালো সকল ছেলেমেয়ে। চোখেমুখে তৃপ্তির হাসি। সকলে মাতবর আলী হোসেনের কথা শুনছে আর উৎসাহ নিয়েই গোগ্রাসে গল্প গিলছে যেনো।
মরিয়ম উত্তেজনা ধরে রাখতে না পেরে বললো, ‘থামলে কেন দাদু, কি হলো?’
তার কথা বলামাত্রই মাগরিবের আযান হতে চলেছে। মাতবর আলী হোসেন মিয়া সেদিকে খেয়াল রেখে বললেন, ‘সোনামণিরা আগামীকাল আবার বসবো আমরা, আজকের মতো আমাকে বিদায় দাও।’ তার কথা শেষ হওয়া মাত্র যেনো চারদিকের বাতাস ভারি হতে লাগলো সবার কাছে। আগ বাড়িয়ে কেউই আর জোর করেনি। সবারই জানা এখন তিনি নামাজে যাবেন; সব ছেলেদের তার সাথে নিয়ে যাবেন মসজিদের দিকে আর মেয়েদের নামাজে যেতে বলবেন। সবাই তাকে সালাম দিয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও বিদায় নিলো। সবার মুখে দীর্ঘশ্বাস দেখে তিনি মুচকি হাসলেন, এটি তার কৌশল; তিনি ভালো করেই জানেন এ বয়সী ছেলেমেয়েদের জানার আগ্রহ প্রবল। তাদের শুধু জানার আকাক্সক্ষা; এটা কি, ওটা কি, কিভাবে- এসবের উত্তর দিতে পারলেই তাদের স্বস্তি।
গ্রামের সকলের কাছে মাতবর হিসেবে পরিচিত হলেও, ছোটোদের কাছে তিনি পরিচিত দাদু বলে। নিত্য নতুন গল্পের আসর জমিয়ে ছোটো ছেলে মেয়েদের কাছ থেকে ভালো কাজ আদায় করে নেয়া। তাই প্রতিদিন আছরের নামাজের পর মাগরিব পর্যন্ত সবার সাথে সময় ভাগ করে নেন ঐ গ্রামের বটতলায়। সবাই এ মিটিংয়ের নাম দিয়েছে দাদুর আসর।
পরদিন দাদুর আসর শুরু হবার সাথে সাথে রাফসানের অভিযোগ দিলো যে, ‘রিফাত শুধু বলে ও নাকি আমার চেয়ে সুন্দর? তুমি ওকে বলে দাও আমিই বেশি সুন্দর।’ একটানে বলে কথা শেষ করলো রাফসান।
এদিকে রাফসানের কথাশুনে রিফাত ভয় পেতে লাগলো এই বলে যে পাছে দাদু আবার রাফসানকে সুন্দর বলে দেন। তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠলো। মাতবর হোসেন আলী দুজনের অবস্থা বুঝে বললেন, ‘শোনো দাদুরা, মানুষ হলো আশরাফুল মাখলুকাত, মানে সৃষ্টির সেরা জীব। সবাই সমান। কেউ কারো থেকে কম না। আল্লাহ তাআলা সবাইকে মেধা দিয়েছেন, শক্তি দিয়েছেন, সৌন্দর্য্য দিয়েছেন এগুলো কাজে লাগিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। যে আল্লাহর আদেশ মান্য করে জীবন গড়বে সেই-ই হবে সফল।’
মাতবর হোসেন আলীর কথাগুলো ছেলেমেয়েদের কানে বাজে। তারা মুগ্ধ হয়ে শোনে। দাদুর কথা শেষ হবার আগেই তারা চেপে ধরলো গতকালের গল্পটা শেষ করতে।
হোসেন আলীর বয়স বেড়েছে। যুবক বয়সে বাবার ব্যবসার সব হিসাব নিকাশ নাকি তার মুখে মুখেই থাকতো। এখন তার বয়স হয়েছে, সব মনে থাকে না। তিনি চোখ বুজে মনে করতে লাগলেন কোন গল্পটা বলছিলেন। আওড়াতে লাগলেন গল্পের কোথায় ছিলেন। দাদুর এ ভুলে যাবার রোগটির কথা জানে শুধু এ গ্রামের ছোটো ছেলেমেয়ের দল। সবারই এক অভিযোগ যে, গ্রামের সবকিছুই যিনি নিয়ন্ত্রণ করেন, তিনিই কিনা তাদের গল্প ভুলে যান। এ চাপা অভিমান নিয়ে আকিফা বলেই ফেললো, ‘এভাবে ভুলে থাকার অভিনয় করলে আর কখনোই আসবো না।’
এমন সব ছোটো ছোটো অনুযোগে হোসেন আলীকে নতুন গল্প বানানোর পায়তারা করতে হয়।
আচ্ছা মনে পড়েছে, ‘আলমডাঙ্গার গল্প শুনছিলাম আমরা ঠিকতো?’
সবাই একযোগে বললো, ‘ঠিক।’
সবার চোখে বিস্ময়। নিজ গ্রামের জন্মের কাহিনি শুনছে তারা তাই আগ্রহ একটু প্রবলই। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে গল্প শুনছে, এক অপার কৌতুহল যেনো সবাইকে আষ্টেপৃষ্টে ধরে রাখছে। দাদুর গল্পে আসরে বুঁদ হয়ে আছে সবাই।
‘কলিমপুর জংশন হতে সোজা রাস্তায় ঘন জঙ্গল আর বাঁশঝাড় পেরিয়ে মিনিট বিশেক হাঁটলেই চোখে পড়ে মাঝারি অগভীর নদী। তার একপাশে ছিলো অরণ্য আর অন্যপাশে বিরাট মাঠ। ঘন জঙ্গল হতে হরেক রকম প্রাণীদের আনাগোনা থাকতো যেনো অভয়ারণ্য। নদীর পানি ছিলো স্বচ্ছ, আজলা ভরে পানি খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলার মতোই স্বাদ। সারাদিন পাখিদের কিচিরমিচির আর বুনো প্রাণীদের কোলাহলে মুখর থাকলো জঙ্গলটি। আর প্রায়ই নদী পার হয়ে ডাঙ্গায় উঠে আসতো হরিণ, বনগাই, বানর, সজারু, শেয়াল ইত্যাদি বিচিত্র প্রাণী।’ বলেই থামলেন হোসেন আলী।
মুহূর্তেই রাকিবের প্রশ্ন, ‘ওখানো কি কোনো মানুষ থাকতো না?’
হোসেন আলী আবার শুরু করলেন, ‘কলিমপুর জংশনে তখন লোকের আনাগোনা বেড়েছে, জমজমাট হতে লাগলো ব্যবসা বাণিজ্য। গরুর গাড়ির চল সবেমাত্র শুরু হয়েছে। খুব অবস্থা সম্পন্ন না হলে এই বাহন ব্যবহার করতে পারতো না। তখনকার দিনে কেউই না খেয়ে থাকতো না। গোলায় ধান ছিলো, পুকুরে ছিলো মাছ, খামার ভরা গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি সবই।
যার কিছুই থাকতো না তার ঘরে অন্তত একটি গরু ছিলো। তাদেরও দু’বেলা পেটপুরে খাওয়া হতো। হাটে যাওয়া আসার সুবিধার্থে সবাই কলিমপুর জংশন দিয়েই আসা-যাওয়া করতো। খোলামাঠের একপাশে বয়ে চলা নদী আর তার বিপরীতেই অপার সম্পদে ভরপুর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। তখনকার মানুষেরা বসতি স্থাপন করতো পানি সুবিধা আর ভালো জমি দেখেই। সেই তখন থেকেই বসতি ওঠা শুরু করেছে আলমডাঙ্গায়।’
‘আলমটা কে ছিলো দাদু?’ বলেই নাফিজার জিজ্ঞাসু চোখ এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।
‘বলছি, বলছি শোনো, আলমডাঙ্গা দেখতে দেখতে অর্ধশত মানুষের আবাস হয়ে উঠলো, এখানে বসতি করার সুফল তারা অল্পদিনেই পেতে লাগলো। আশে পাশের গ্রাম হতে এ গ্রামের জমির উর্বরতা ছিলো কয়েকগুণ বেশি।
ডাকাতিয়া নদীর সাথে সরাসরি বড় নদীর যোগসূত্র থাকার কারণে হরেক রকম মাছে ভরপুর থাকতো এই নদী। তাই সে সময় ডাকাতিয়া নদীর মাছের একটা কদর ছিলো। চারদিকে নাম ডাক করতে লাগলো আলমডাঙ্গার মানুষেরা। বিশেষ করে ব্যবসা বাণিজ্যে।
রাফসান দাদুর কথার মাঝেই বলে উঠলো, ‘সাহসী মানুষটার কি হলো?’
দাদু মৃদু হেসে বললেন, ‘গল্প তো অনেক বাকি আছে দাদুভাই, বলছি শোনো।’
এই বলে দাদু আবার শুরু করলেন, ‘নতুন বসতি গড়ে ওঠার কারণে দেখা গেলো, আশেপাশের গ্রাম হতেও মানুষ আসছে ঘরবাড়ি করতে, একে অন্যের রক্ত সম্পর্কের না হলেও সময় গড়ানোর সাথে সাথে আপন হয়ে উঠলো একে অপরের। সবাই সবার কাজে এগিয়ে আসছে। গ্রামগঞ্জের মানুষ খুব ধর্মভীরু হয়। মিলেমিশে থাকাটাও মনে করে ইবাদাত। গ্রামের প্রবীণ লোক আর মাওলানা ধাঁচের মানুষ আলম। গ্রামে তিনি আলম মাওলানা নামে পরিচিত। সাহায্য পরামর্শ কিংবা কারো প্রতি কারো অভিযোগ থাকলে সবই তিনি মিটমাট করে দিতেন। গ্রামের সবার নজরে তিনি ছিলেন অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র।’
রিফাত কথা থামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তাকে আর কেন শ্রদ্ধা করতো?’
দাদু বলতে লাগলেন, ‘গ্রামের সবাই যেমনই হোক না কেন, কেউ গরীব বা ধনী; সবার মাঝে ছিলো একতা। তাদের মাঝে যে সম্পর্ক গড়ে তার মূল কারিগর ছিলেন আলম মাওলানা। ধনী-গরীব সবার সহযোগিতা নিয়েই তিনি গ্রামে করেছেন দোচালা ঘরের মসজিদ, মক্তব আর বাল্যশিক্ষার স্কুল। এ গ্রামে তখনকার দিনে অনেক দূর হতে মাস্টার এসে পড়াতেন। প্রতিদিন সকালে মক্তবের ছোট-ছোট ছেলেমেয়েদের কুরআন পড়ার সমুচ্চারিত আওয়াজে চারদিক মুখর হয়ে থাকতো।’
এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। মসজিদ থেকে ভেসে আসছে মুয়াজ্জিনের সুমধুর আজানের সুর। দাদু সবাইকে সাথে নিয়ে চললেন মসজিদের দিকে।

নামাজ শেষে সবাইকে বিদায় দিয়ে মজলিসে গিয়ে বসলেন আলী হোসেন। তার সাথে আছেন গ্রামের গণ্যমান্য বক্তিবর্গ আর নানা বয়সের যুবকেরা। সাধারণত গ্রামের এসব মজলিসে তরুণ-যুবকদের রাখা হয় না। প্রাপ্তবয়স্করাই উপস্থিত থাকে। গ্রামের নানা অভিযোগ-অনুযোগ, শলা-পরামর্শ, সিদ্ধান্ত ও অনেকরকম কাজের প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু হয় মজলিস হতেই। দেখা যায়, সপ্তাহে দু-তিনবার বসে এ মজলিস। মাঝে মাঝে এ মজলিস চলে এশার নামাজের আগ পর্যন্ত। সবার নির্ভয়ে মতামত, ভালো-খারাপ দিক বিবেচনায় মুখর হয়ে ওঠে মজলিসের পরিবেশ। সবার এ স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও নানা বয়সের মানুষের আলোচনা-সমালোচনায় নেয়া হয় সিদ্ধান্ত। এ প্রথাটি প্রথম শুরু করেছিলেন মাওলানা আলম। মসজিদের উঠোনে হারিকেনের মৃদু আলোয় হোসেন আলী চোখ বন্ধ করলেন। তার সামনে ভেসে ওঠে তার তরুণ বয়সের দিনগুলোর কথা।
তখন সবেমাত্র উনিশে পা দিয়েছেন হোসেন আলী। তার সমবয়সী আজম ব্যাপারি, মুসা সওদাগর, আনোয়ার বাদশাসহ আরো অনেকের ডাক পড়লো মজলিসে। মাগরিবের পর আলম মাওলানার পেছনে দাঁড়ানো যুবকদের দেখে গ্রামের অন্যান্য মুরব্বিদের মাঝে গুঞ্জন উঠলো। পরিস্থিতি আন্দাজ করে আলম মাওলানা বললেন, ‘বিব্রত হওনের কুনো কারণ নাই, হেরা হগলেই আমগো গেরামের পোলা, হেরাই আমগো ভবিষ্যত। আমরা হগলে মিইলা কাজ করমু। গেরামের ভালা-মন্দ সামনে হেরাই দেখভাল করবো।’
সেই থেকে শুরু এ মজলিসে আনাগোনা বাড়ছে তরুণদের। গ্রামের সব সমস্যা সমাধানে কাঁধে কাধ মিলিয়ে লড়ছে সবাই। সবাই যেনো কাজ করে যাচ্ছে মায়ের মতো ধারণ করা গ্রামের জন্য।
আজ তেমনি এক পরিস্থিতির মুখোমুখি তারা। শহরের বড় একটা কোম্পানির লোকজন এসেছিল সকালে। তারা প্রস্তাব দিয়ে গেছে কারখানা স্থাপনের জন্য নাকি নদীর পাড়ের জমি কিনে নিতে চাই। জমির মালিক হলো সালাম ব্যাপারিসহ কয়েকজন। জমি তাদের হলেও গ্রামের প্রায় সবাই ঐ জমিতে চাষাবাদ করে। কোম্পানির মানুষজনকে সরাসরি কিছু বলেনি তারা, সবাই ভাবছে ভালো-মন্দ বিবেচনা করেই তবে সিদ্ধান্ত নিবে তাই আজকের মজলিস ডাকা হয়েছে।
অন্যদিনের তুলনায় আজকের পরিবেশ থমথমে। জোসনার আলো যেনো পুরো আকাশ বেয়ে ঠিকরে পড়ছে চারদিকে। দূর হতে ভেসে আসা শিয়ালের ডাক আর থেকে থেকে ডেকে ওঠা বন্যপ্রাণীরা যেনো নিস্তব্ধতাকে চাপা দিতে চাইছে প্রাণপণ। প্রকৃতির চাপা কোলাহল আর জোসনার আলো ছাপিয়ে সবার নিরবতা ভাঙলেন মাতবর হোসেন আলী, তিনি জমির মালিকদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘কি ভাবছো সালাম ব্যাপারি, তোমাদের উপরই নির্ভর করতাছে জমির ভবিষ্যৎ।’
সালাম ব্যাপারি বললো, ‘আমগো কথা বাদ দাও, সবার কথা ভাইবা চিন্তা করা দরকার।’
বর্গা চাষি ওসমান বললো, ‘ম্যালা টাকাই দিবো কইতাসে, তা পাইলে কয়েকবছর কোনো চাষ না কইরাই আরামসে কাটাই দেয়া যাইবো।’
মাতবর হোসেন আলী ধমকের সুরে বললেন, ‘এইডা কি কইলা মিয়া, কাজকাম না কইরা চলমু কেমনে? আমাগো বাপ-দাদার পেশা-ভিটা ছাইড়া কদ্দুর আগাইতে পারুম? আমাগে ভবিষ্যৎ তো এ মাটির লগে বান্ধা।’ বলেই থামলেন তিনি।
কলেজ পড়ুয়া শামীম ভীতসন্ত্রস্ত কন্ঠে বললো, ‘সবাই যদি মত দেন আমার একখান কথা আছে।’
মাতবর হোসেন আলী অভয় দিয়ে বললেন, ‘কও বাপজান।’
কথা বলার সুযোগ পেয়ে তার চোখ যেনো জ্বলজ্বল করে উঠলো, বললো, ‘কোম্পানি যেখানে কারখানা বানাইবো ওইডা আমগো পেট চালানোর পথ। আমার জানা মতে, ঐ জায়গার লগে আশেপাশের সব জমি, গাছপালা ও নদীর পানিও আমাগো কাজে লাগবো না। কারখানার ময়লা পানি আর কালো ধোঁয়া সব কিছুরে ধ্বংস কইরবো। আপনেরা পাশের উপজেলা দেহেন, ঐ জায়গা প্রথমে আছিলো ফসলের ভা-ার এহন শুধু কারখানা আর কারখানা। শেষ পর্যন্ত ওখানকার মানুষেরা পথ না পাইয়া গ্রাম ছাড়া হইসে। কোম্পানিগুলা বড় মাইনষের। একবার সুযোগ পাইলে আমাগো আর রক্ষা নাই। শেষে বাপ দাদার মাটি হারামু আর গ্রাম ছাইড়তে অইবো।’ একটানা কথা বলে দম ছাড়লো সে। কথাগুলো বলতে পেরে যেন বুক থেকে পাথর নেমে গেলো।
শামীমের কথায় নড়েচড়ে বসলো সবাই। সবাই আসন্ন ভয়াবহতা সম্পর্কে জেনে যেনো কিছুটা দমে গেলো। মাতবর আলী হোসেন সবার মনোযোগ কেড়ে বললেন, ‘কি কও ভাইসব, তোমরা কি পাশের উপজেলার মতো অবস্থা হওন দিবার চাও? আইজকা নিজেরা খাইটা চলতাছি আর এইডাই ঠিক। খাল কাইট্যা কুমির আইনা যেনো পরে সব না হারাই ঐ কয়ডা ট্যাহার লাইগা। এবার তোমরা বুইঝা লও।’
কেউ আর মাতবর হোসেন আলীর সাথে অমত করলো না। তারা জানে গ্রামের ভালো-মন্দ তিনি বোঝেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারো বলা শুরু করলেন, ‘হুনো আরেকডা কথা, আমাগো দাদা আলম মাওলানাও এ কারণে জীবন দিসিলো। তিন-চার দশক আগে এ গ্রামে যহন শহর থেইকা মানুষ আইলো জমি দখলের লাইগ্যা, আলম মাওলানাসহ অনেকে বাধা দিসিলো। কোম্পানির লোকজন যহন জোর কইরা জমি দখল করবার চাইলো তহন বাধলো দাঙ্গা। পরে পুলিশ আইসা সব মিটমাট কইরা দিলেও আলম মাওলানার উপর এক সপ্তাহ পর হামলা হয়। আর হামলা করসিলো আমাগো গেরামের মানুষ রাহু ডাকাইত। কোম্পানির ট্যাহার কাছে বেইচ্যা গেসিলো রাহু। শেষে কি অইলো? আলম মাওলানার নামে গেরাম অইলো আর রাহু গেলো জেলে। আইজ আলম মাওলানার জানের বিনিময়ে আমরা এ মাটি কামড়াইয়া পইড়া আছি। তার রক্তের দাম কিছুডা মেটাইতে হইলেও জমি ছাড়ন যাইবো না।’
মূহুর্তেই এক আবেগঘন পরিবেশ নেমে এলো চারপাশে। তার সাথে যেনো পাল্লা দিতে থাকলো ঝিঁঝি পোকার ভারি আওয়াজ। কাছেই আযান হচ্ছে, বাতাসে কেটে কেটে আসছে মুয়াজ্জিনের সুর।
‘হাইয়্যা আলাল ফালাহ,
হাইয়্যা আলাল ফালাহ।’

পরদিন সকাল ১০টায় কোম্পানির প্রতিনিধি দল আসলো আলোচনা করতে। মাতবর হোসেন আলীরা আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়েই ছিলেন সকলে। তার বাড়ির দাওয়ায় করেছেন আপ্যায়নের ব্যবস্থা। এ কথা ও কথা বলার পর বড় কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ভাবলেন আপনারা?’
মাতবর হোসেন আলী বললেন, ‘স্যার, এইডা আমাগো বাপ-দাদার জমি, কেমনে ছাড়ি বলেন, আমাগো দাদাজান এ গেরামের লাইগা জীবন দিছিলেন। এ মাটি ছাইড়্যা যামু কই? কি কাম করমু?’
অফিসার নিশ্চয়তার সুরে বললেন, ‘এ জমির বিনিময়ে লাখ বিশেক টাকা পাবেন। এত কষ্ট করে ফসল ফলাইতে হবে না। গ্রামের সবাইকে কারখানায় কাজ দিবো। এখানকার রাস্তাঘাট, স্কুল কলেজ আরো উন্নত করে দিবো, শহরের মতোই হয়ে যাবে সব, এসবের দায়িত্ব আমাদের।’

মাতবর হোসেন আলী বললেন, ‘স্যার, এ জায়গা আপনাগো কাছে কারখানার জমি মনে হইতে পারে তয় আমগো কাছে এ জায়গা আমাগো মা, আমগো খাওন দেয়, দেখভাল করে। ট্যাহার বিনিময়ে আমাগো নাড়ির টান বেইচ্যা দিতে পারুম না। দরকার হইলে জীবন দিয়া হইলেও মাটি আঁকড়ায়া থাকুম।’
মাতবর হোসের আলীর অনড় অবস্থান দেখে, প্রতিনিধি দল আর কথা বাড়ালো না, অগত্যা শূন্য হাতেই ফিরে গেলো।
সেদিন বিকেলে তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন নদীর পাড়ে, আনমনে কি যেনো ভাবছিলেন। পেছন থেকে একঝাঁক ছেলেমেয়ের দাদু ডাক শুনে চমকে উঠলেন। মাতবর হোসেন আলি বুঝতে পারলেন গল্প বলার সময় হয়েছে, এখন বটতলায় গিয়ে বসতে হবে।
তার সামনেই প্রজাপতির মতো নাচতে নাচতে ছোটো ছেলেমেয়েরা যাচ্ছিলো অপার আনন্দে। তার মনে হচ্ছিলো তার সামনে একটা প্রজন্ম উদিত হচ্ছে দীপ্তিমান সূর্যের মতো যারা আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে।

Share.

মন্তব্য করুন