বাস স্টেশনে এসে থামলো। কালো জ্যাকেট, জিন্সের ধূসর প্যান্ট আর চামড়ার বুট পরা কাঁধে ব্যাগওয়ালা যুবকটি বাস থেকে নেমে ল্যাম্প পোস্টের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
তখন রাত বারোটা চল্লিশ। টিকিট কাউন্টার আর এই ল্যাম্প পোস্টের খুদে আলো ব্যতীত অন্য কোনো আলো নেই। সে ভালো করে তাকিয়ে দেখে কয়েকটি বন্ধ দোকানের ভেতরেও আলো জ্বলছে তবে সেই আলোর পরিধি দরজার বাইরে নয়।
গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার পূর্বে এই ল্যাম্প পোস্ট, এই টিকিট কাউন্টার, দোকানপাট এখানে এসব কিছুই ছিল না। শহুরে পথ যাত্রীদের গাড়ি পাওয়া যেত শঙ্কের ওপারে। যারা শহরে যেত তারা রিকশা বা ট্যাক্সিতে চড়ে ওপারে উঠতো।
এটা সেই সাপের মত বিলের বুক চিঁড়ে ছুটে চলা মাটির সরু রাস্তা। গ্রীষ্মের মৌসুমে গরু-মহিষ আর রাখালের গায়ে মিশে এই রাস্তার ধুলাবালি। বর্ষার মৌসুমে ভরে থাকতো কাদায়। এখন এর ওপর পিচঢালা দীর্ঘ মাইল। এসব ভাবতে ভাবতে ল্যাম্প পোস্টের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকে বয়স সাতাশেক এ যুবক।
এখান থেকে তিন মাইল দূরে পাহাড়ের গায়ে তার বাড়ি। এত রাতে রিকশা বা ট্যাক্সি কোন কিছুর দেখা নেই। পূর্বে কতবার কতরাত একলা বা যৌথ এখানে হেঁটে এসেছিলো! তবে আজ তার পক্ষে তিন পা হাঁটাও অসম্ভব।
এমন সময় দক্ষিণ দিক থেকে রাস্তা বেয়ে নিচে লণ্ঠন জ্বালানো একটি রিকশা আসছে। সে হাত বাড়িয়ে রিকশাটি থামায়।
ক্ষীণ বৃদ্ধ ঘন সাদা মুখভর্তি দাড়ি রিকশাওয়ালাটি বলে, কই যাইবা?
– চাচা, বেলগাঁও…। যাবেন? সে তাকে চাচা সম্বোধন করে জবাব দেয়।
– হঁ, যাইমো।
– ভাড়া কত?
বৃদ্ধ একটু মাথার উষ্ক চুল খুঁচে বলল, রাইতে তো ভাড়া বেশি। আমি যহন ওই দিহে যাইমো আশি টাহাই দিও। বিনয়ের সাথে সে আশ্বাস দেয়, ‘না, সমস্যা নাই প্রয়োজনে বাড়িয়ে নিয়েন’ এ বলে সে রিকশায় চড়ে বসে। রিকশাওয়ালা রিকশাকে টেনে রাস্তার দিকে নিয়ে যায়।
রাতের আঁধারে রিকশা ধীরে ধীরে চলছে। অনেক দিন পর রাতে গ্রামের পথে চলার অনুভূতি, জোনাকির মিটিমিটি আলো জ্বলার দৃশ্য। তাকে আবারো আপন করে ডাকছে টিলার ওপরে দোচালা জীর্ণঘর, মা-বাবা খেলার সাথী আলেয়া, সলিম, মঞ্জুর…। এত দিনে সবাই তার মত যুবক। হয় তো আলেয়াও অন্য ঘরে নিজ সাংসারিক কাজে ব্যস্ত। তলে ভরা খেলার সরঞ্জাম নিয়ে বটতলায় ধুলাবালি বা বউ বউ খেলা। সবাই মিলে চড়ার পাশে কানামাছি, গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা কত খেলায় না খেল তো। অন্ধকারের আড়ালে পুরনো স্মৃতি মনে করে সে এক পলক মৃদু হাসে।
তাদের দুটো গরু ছিলো। গরু দুটির ঘাস কাটা আর দেখভাল করাই ছিলো তার একমাত্র কাজ। তবেই এই কাজটাও ছিলো তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে। প্রায় ঘাস না কেটে খেলাধুলা নিয়ে সে ব্যস্ত থাকতো। তাই সেই দায়ে মাঝে মধ্যে বাবার পিটুনি, ঘরের বাইরে রাতকাটানো ইত্যাদি তার জীবনের কিছু অংশ হিসেবেই ছিলো।

একদিন বিকেলে ঘাস না কেটে আলেয়াকে নিয়ে নাজিমদের বাগানে আম চুরি করতে গিয়ে ছিলো। বাড়িতে ফিরে এসে বাবার হাতে এমন মার খেয়ে ছিলো সেদিন থেকে গ্রামে তার খবর কেউ জানে না। এমনকি মা বাবা, আলেয়া, সলিম, মঞ্জুরও।

আজ সতেরো বছর পর গ্রামে তার ফিরে আসা। আজও কেউ জানে না সে ফিরে আসছে বা কখনো ফিরে আসবে। তাই তার জন্য এতো রাত জেগে কেউ বসে থাকবে না। তাকে একলা অন্ধকারের অনিশ্চিতভাবে সেই জীর্ণ ঘরের দোয়ারের সামনে দাঁড়াতে হবে।

– সাব, আপনে আসছেন কোত্থেইকে? রিকশাওয়ালা জিজ্ঞেস করে।
– ঢাকা থেকে।
– মাইনষের কাছে হুনছি চট্টগেরাম থেইক্যা ঢাহা না কি মেলা দূর!
– হ্যাঁ, অনেক দূর।

রিকশায় যাত্রী উঠলে মনে হয় গ্রামের রিকশাওয়ালারা কথা না বলে পারে না। টিভি কিংবা কোন লাইভ প্রোগ্রামের মতো তাদের মুখে দিয়ে অনর্গল প্রশ্ন বেরিয়ে আসে। তাই কিছুক্ষণ পর পর এই বৃদ্ধও প্রশ্ন ছুড়ে, আপনের বাড়ি কি ঢাহা?
– না এখানে, বেলগাঁও। তবে অনেক বছর ধরে ঢাকায় আছি।
– ও, আমার বাড়িও তো ওইহানে টিলায়। ঢাহা কিসের চাকরি করেন?
– চাকরি না। তবে আমার একটা পোশাক শিল্পের ব্যবসায় আছে।
– বিয়াশাদি করছেন নি?
– না… চাচা। ঢাকা যাওয়ার পর থেকে গ্রামের সাথে তার অনেক দিনের যাতায়াত এই ভাব নিয়ে বলে, গ্রামে এখনো ঘরবাড়িও করিনি। তবে কিছু জায়গাজমি নিয়ে আগে ঘর তুলতে হবে। তারপর..।
– অ…
সে সঙ্কোচিত ভাবে রিকশাওয়ালাকে বলে, তো, চাচা মনে কষ্ট নিবেন না। আপনার কি কোন ছেলেমেয়ে নেই?
– আছে বাজান আছে ,খালি দেহা নাই।
– ও, তারা কি আপনার দেখাশোনা করে না?
– কাছে থাইকলে কি করতো না?
– মানে? বুঝলাম না।
বৃদ্ধ নীরবে কয়েকবার প্যাডেল মেরে বুকভরা কষ্টের অনুভূতি বলে, আমার একডা পোলা ছিলো থাইকলে এতো দিনে আপনেদের মতই বড় হইতো। তেমন ইনকাম ছিলো না বইলে পোলারে মেলা কামে লাগাইতাম। আর আমার পোলাডা খালি খেলা আর খেলা কোন কাচকাম করতে চাইতো না। তাই একবার গোসসায় তারে ঘরে ধইরা আইনা মারছি। এরপর পোলা পালাইয়া কোথ্থায় গেলো অনেক খুঁইজে এহনো দেহা পাইনি। আর বুড়া বয়সে এই ভাড়া রিকশা চালায়ে বুড়া আর বুড়ির জীবন কোন রহম পার করতেছি।
রিকশার যাত্রী প্রবল জানার আগ্রহে জিজ্ঞেস করে
– আপনার ছেলের নাম কী?
– খুর্শিদ আলম।
– আপনার?
– ইসেলাম মিয়া। ক্যান বাজান আমার নাম ক্যান?
তখন সে আর কোন উত্তর দেয় না। রিকশা থেকে এক লাফ দিয়ে নেমে পড়ে। বৃদ্ধ রিকশাওয়ালার গলা জড়িয়ে ধরে চিৎকার দিয়ে বলে আব্বা আমি তোমার সেই খুর্শিদ, আমিই তোমার খুর্শিদ। তোমার এই অবস্থা কেন?
বৃদ্ধ খুর্শিদের মুখের দিকে এক নজর তাকায়। তারপর ক্রন্দন সুরে বলে, বাজান খুর্শিদ আমার খুর্শিদ আলম- তুই তোর মা বাপরে ছাইরা ক্যামনে যাইতে পারলি? আমাগো ছাইরা এতো দিন তুই কই ছিলি? কই ছিলি বাজান? একবারও কি এই মা বাপের কথা মনে পড়লো না? বৃদ্ধ হাত দিয়ে ছেলের কপাল টেনে কয়েকবার চুমু খায়। তখন দু’জনের চোখ মুখ অশ্রুতে ভিজে ওঠে। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে আর কাঁদে কারো কান্না থামে না।

Share.

মন্তব্য করুন