কুরবানি ঈদের পরদিন নানাভাই এসে হাজির। কথা ছিল তিন চারদিন পরে আসবেন। তাই নানাভাইকে দেখে আমরা চমকে গেলাম। খুশিতে সবাই টগবগ করতে লাগলাম। আমাদের নানার কোনো আপন ভাই নেই। তিনি আমাদেরকে বলেছেন আমরা যেন উনাকে ভাই বলে ডাকি। তাই আমরা নানাকে বোনাস হিসেবে নানাভাই ডাকি। এতে তিনিও ভীষণ খুশি। নানাভাইকে দেখে আম্মা একটা মুচকি হাসি দিলেন, পথে আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো?
নানাভাই মুখ থেকে মাস্কটা খুলে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ। ভালো মতোই এসেছি।
নানাভাই আমাদের সবাইকে ডাকলেন, অ্যাই, তোরা সব কোথায়?
আমরা নানাভাইয়ের কাছে দৌড়ে গেলাম। তিনি কত কিছু এনেছেন আমাদের জন্য। নানাভাই হ্যান্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ধুয়ে ঘরে ঢুকলেন। নানাভাইকে পেলে আমরা আনন্দে মেতে উঠি। এবার আমাদের আনন্দ দেখে কে? ঈদের আনন্দটা যেন আরো বহুগুণ বেড়ে গেল।

বিকেলে খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা নানাভাইয়ের সাথে বারান্দায় আড্ডায় বসলাম। উনার সাথে গল্প করতে আমাদের খুব ভালো লাগে। আমাদের আড্ডায় চাচাতো ভাইবোনরাও এসেছে। সবার বড় আবিদ ভাই বলল, নানাভাই, এবার গল্প শুরু করেন।
আমিও বললাম, হ্যাঁ নানাভাই, শুরু করেন।
নানাভাই একটা পান মুখে দিয়ে চিবুতে লাগলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে, শুরু করছি। যেহেতু এখন সবার ঘরে ঘরে ঈদের আমেজ চলছে, তাই আমি আজ ঈদের গল্প করব। গল্পটা আমার ছোটবেলায় ঘটেছিল।
রিফাত বলল, খুব ভালো হবে নানাভাই।

নানাভাই শুরু করলেন, অনেকদিন আগে আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। আমার সাথে আরো অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু থাকতো সবসময়। আমরা ছিলাম দুষ্টের শিরোমণি আর খুবই দুরন্ত। বলতে গেলে আমাদের জ্বালায় পুরো গ্রাম অতিষ্ঠ ছিল। দিনভর ছোটাছুটি করতাম। গ্রামের সবার বাড়ির আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, ডাব ইত্যাদির স্বাদ আমাদের জিবে ছিল। একবার কুরবানি ঈদের আগের দিন ঠিক করলাম আমরা চুরি করে ডাব খাব।

সিয়াম ফিক করে হেসে উঠল। তারপর বলল, তোমরা তাহলে চোর ছিলে, নানাভাই?

নানাভাইও একটা মলিন হাসি দিয়ে বলতে শুরু করলেন, গাছটা ছিল আমাদের স্কুলের পাশে। ইয়া বড় বড় নারিকেল হতো। পরদিন কুরবানি ঈদ অথচ আমরা কচি ডাব খাওয়ার জন্য ওঠেপড়ে লাগলাম। বয়স আর কত হবে, তখন কি আমরা এতো কিছু বুঝি নাকি? যথারীতি রাতের বেলা আমরা চলে গেলাম গাছের নিচে। আমার সাথে রহমত, কাদের, বুরহান, নান্টু ও আরো কয়েকজন।

বিশাল বড় গাছ। উপরে তাকালেই মাথা ঘুরে। নান্টু বলল, গাছ থেকে ডাব পেড়ে বিলের ধারে বসে খাব। রহমত বলল, গাছে ওঠে বড় বড় ডাবগুলো আনতে হবে। কাদের বলল, গাছে ওঠে নিচের দিকে তাকানো যাবে না, এতে মাথা ঘুরবে। এরকম সবাই একটা একটা করে বুদ্ধি দিতে লাগল। আমি বললাম, কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে? মানে কে গাছে উঠবে? আমার কথা শুনে সবার টনক নড়ল। বুরহান বলল, কেন তুই উঠবি। তোর মতো কেউ গাছে চড়তে পারে নাকি?

কথাটা শুনে আমি গাছে না উঠেই আকাশ থেকে পড়লাম। এতো রাতে গাছে উঠা কি ঠিক হবে?
বুরহানের কথাটা অবশ্য ঠিক। আমার মতো কেউ গাছে চড়তে পারে না। তখন যদি গাছে উঠার উপর কোনো প্রতিযোগিতা হতো, আমি নির্ঘাৎ চ্যা¤িপয়ন হতে পারতাম। শেষ পর্যন্ত অনেক গাঁইগুঁই করে আমাকে রাজি করালো। এই ফাঁকে বুরহান সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে হাজির। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বলতে দা আর গ্লাস। এগুলো ছাড়া তো আর ডাব খাওয়া যায় না।

তখন সুনসান রাত। আশেপাশে মানুষজন নেই। শুধু থেকে থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনা যাচ্ছে। সবার চেহারায় খুশি খুশি ভাব। রহমত আর নান্টুর দায়িত্ব হচ্ছে দুই দিকে নজর রাখা যেন কেউ আসতে থাকলে সাথে সাথেই খবর দেয়। বাকি সবাই একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রইল যাতে দূর থেকে কেউ দেখতে না পায়। আমি দোয়া কালাম পড়ে গাছে উঠতে লাগলাম। গাছে উঠে যে-ই একটা ডালে পা রেখে আরাম করে বসেছি, তখনই রহমত চেঁচিয়ে উঠল, ‘দুইজন লোক আসতাছে।’ তখন নান্টু আর রহমতও একটা ঝোপের আড়ালে লুকালো। এদিকে গাছে আমি আরাম করে বসে আছি।
আমিও দেখতে পেলাম লোক দুটি ক্রমশ এগিয়ে আসছে। তাদের আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। লোক দুটি উসখুশ করতে লাগল। বারবার এদিক সেদিক তাকাচ্ছিল। কী আশ্চর্য ! আমি যে গাছটায় উঠেছি তারাও সেই গাছটার নিচে এসে বসল। জোছনার আলো তাদের মুখে মেখে আছে।

এখন ¯পষ্ট দেখা যাচ্ছে তাদেরকে। একজনের নাকের নিচে হালকা গোঁফ, অন্যজনের শরীরটা
পাটখড়ির মতো চিকন। আমার কেন জানি খটকা লাগল। লোক দুটি মনে হয় অন্য কোনো গ্রামের।

আমি উপর থেকে ¯পষ্ট শুনতে পেলাম গোঁফওয়ালা লোকটা বলল, ঈদের আগের দিন রাইত বাইর হওয়া ঠিক হয় নাই রে। তারপর পাটখড়ির মতো চিকন লোকটা কী বলল তা শুনতে পেলাম না, যদিও কানটা যথেষ্ট খাড়া করে রেখেছিলাম।

তারপর একটা তুলকালাম কা- ঘটে গেল। নান্টু আর রহমত মনে হয় বিষয়টা বুঝতে পেরেছিল। তারা দুজন চুপিচুপি তারেক ভাইকে নিয়ে এলো। তারেক ভাই এলাকায় খুবই সম্মানিত ব্যক্তি। তাঁর বাড়ি একটু দূরেই। তার সাথে আরো তিন চার জন লোক এলো। এদিকে ঝোপের আড়াল থেকে বাকিরাও বেরিয়ে এলো। তারাও এতক্ষণ ঘটনাটা পরখ করছিল। নান্টু ছুটে গেল স্কুল মাঠ থেকে পাটের দড়ি আনতে। পাট চাষীরা সম্ভবত শুকাতে দিয়েছিল। এদিকে লোক দুটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।

তখন চোরের খুব উপদ্রব ছিল। কথা নেই, বার্তা নেই তারেক ভাই ও অন্যরা মিলে লোক দুটিকে নারিকেল গাছের সাথে বেঁধে ফেলল। পাটখড়ির মতো শুকনো লোকটা হাউমাউ করে কেঁদে ফেলবে ফেলবে ভাব। আমি কিন্তু গাছের উপরেই। চুপচাপ বসে আছি আর নিচে কী হচ্ছে তা মঞ্চনাটকের মতো সব দেখছি। নান্টুদের চেঁচামেচিতে আরো অনেক লোক জমে গেল। আশেপাশের বাড়ি থেকে আরো অনেকে এলো। তারেক ভাই লোক দুটির কাছে সারাংশ জানতে চাইল, বাড়ি কোথায়? কতদিন
ধরে এই কাজ করো?

লোক দুটির কেউ কোনো কথা বলল না। মুখে যেন তালা মেরে বসে রইল। হাত দুটি গাছের সাথে পিছনের দিকে বাঁধা। তারেক ভাই বুরহানকে বলল বড় দেখে একটা লাঠি আনতে। বুরহান দৌড়ে গিয়ে একটা লাকড়ি আনলো। তারপর তারেক ভাই লাকড়িটা দিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তি ব্যয় করে গাছে একটা বাড়ি দিল। তখন লোক দুটি ঘটনার সারাংশ রেখে ভাবসম্প্রসারণ করতে লাগল। আমি গাছের উপর থেকে যা বুঝলাম তা হলো তারা নিতান্তই গরিব। পেটের দায়ে চুরি করে। আজ এসেছিল যদি কোনো গোরু চুরি করতে পারে। আমাদের গ্রাম থেকে তিন চার গ্রাম পর তাদের বাড়ি। আরো কতগুলো কথা লোক দুটি যেভাবে বর্ণনা করল এতে উপস্থিত সবার মনটা মোমের মতো গলে গেল।

তারেক ভাইয়ের মনে একটু মায়া দয়া বেশি। সে লোক দুটিকে ছেড়ে দিল। আর চুরি করবে না, কাজ করে খাবে- এরকম কয়েকটা উপদেশও দিল। বাকিরা অবশ্য কেউ কেউ সামান্য কিল থাপ্পর দিয়েছিল। পরদিন যেহেতু কুরবানি ঈদ ছিল, তাই চোর দুটিকে মাফ করে দেওয়া হয়।

আস্তে আস্তে ভিড়টা কমতে লাগল। সবাই চলে যাওয়ার পর আমি গাছ থেকে নেমে পড়লাম। সেদিন আর আমাদের ডাব খাওয়া হলো না। চোরদের গাছের সাথে এভাবে বেঁধে রাখে- এমন একটা বেইজ্জতি দৃশ্য দেখে আমরা সবাই ভালো হয়ে গেলাম। এরপর থেকে আমরা আর কারো ক্ষতি করিনি।

রিফাত বলল, নানাভাই, ঘটনাটা কি সত্যি? নাকি বানিয়ে বানিয়ে বলেছ?
নানাভাই বললেন, একদম সত্যি। এ ঘটনা তোদের মাও জানে। বিশ্বাস না হলে তোদের মা’র কাছে জিজ্ঞেস করে দেখ।
তারপর নানাভাই হে হে করে একটু হাসলেন। আবিদ ভাই বলল, নানাভাই, আরেকটা বলো। তোমার গল্পগুলো আমাদের খুবই ভালো লাগে।
নানাভাই বললেন, আরেকটা?
সবাই সমস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ, আরেকটা।
নানাভাই আবার নতুন গল্প শুরু করলেন, আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। হাড় কাঁপানো শীত ছিল তখন। আমাদের বাজারে সেদিন জসিম কাকার দোকানে হালখাতা ছিল। ওই হালখাতায় আমাদের অনেকগুলো টাকা দেওয়ার কথা। আমার আব্বার ছিল জ্বর। যে কারণে আমাকে যেতে হয়েছিল হালখাতা করতে।

দুটি রসগোল্লা খেয়ে যে-ই না বাড়ি ফিরছি তখন লতিফ নানার সাথে দেখা। আপন নানা না। নানার আপন ভাই। উনাকে দেখে ভালো লাগল। নানা আমাকে বললেন যে আজকে রাতে নাটক হবে ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’। যে কারণে আমাকে থাকতে বললেন তিনি। আগে গ্রামগঞ্জে শীতকালে নাটক হতো।

আমিও উনার কথামতো নাটক দেখতে বসে গেলাম। রাত দুইটার সময় নাটক শেষ হলো। নানা অনেক জোরাজুরি করলেন উনার সঙ্গে যেতে। কিন্তু আমি রাজি হলাম না। তারপর বাজার পার হয়ে অনেকটা চলে এলাম। জঙ্গলটা পার হলাম ভয়ে ভয়ে। আমার সাথে কোনো টর্চলাইট ছিল না।
চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এত রাত হয়ে গেছে অথচ এখনো আমি বাড়িতে যাইনি। মনে হচ্ছে বাড়িতে গেলেই উত্তম মধ্যম কিছু খেতে হবে। তারপর নদীর ঘাটে এলাম। এপারে শুধু একটা নৌকা।
নদীতে আড়াআড়িভাবে দড়ি টানানো থাকতো। দড়ি ধরে টেনে টেনে নৌকা চালানো হতো। আমি নৌকায় উঠে দড়িতে হাত রাখলাম। নৌকায় ছিল অনেক পানি। আমি তা খেয়াল করিনি। মাঝ নদীতে আসতেই নৌকা ডুবে গেল। আমি পাতলা একটা ছেলে, আমাকে নিয়ে নৌকা কীভাবে ডুবে যায়? এ হতেই পারে না। আমার গায়ে ছিল শীতের ভারী ভারী কাপড়। যে কারণে সাঁতরাতে কষ্ট হচ্ছিল। মাঝ নদী থেকে সাঁতরিয়ে ওপারে যাওয়া অনেক দমের ব্যাপার। তাছাড়া আমি তখন ভয় পাচ্ছিলাম।

নৌকাটা কি ভূতে ডুবালো নাকি? এখন কি তাহলে আমাকে নদীর পানিতে ডুবিয়ে মারবে? আমি ভয়ে কাঠ হয়ে গেলাম। এত রাতে তো কোনো মানুষই জেগে নেই যে ডাকলে আসবে। আমি ভাবতে
লাগলাম নানার সাথে চলে গেলেই বরং ভালো হতো। অনেকক্ষণ ধরে সাঁতরাচ্ছি , এখনো মাটি পাচ্ছি না কেন? এদিকে আমার ভয়ে জান বেরিয়ে যাচ্ছে। হে আল্লাহ রক্ষা করো। হঠাৎ কি মনে করে যেন পা ফেললাম মাটিতে। দেখি হাঁটু পানি। ধুর! এতক্ষণ ধরে তাহলে হাঁটু পানিতে সাঁতার কাটছি। আর একটু হলে তো ভয়ে মরেই যেতাম। তারপর পাড়ে এসে উঠলাম। শীতে শরীর কাঁপছে। আরো অনেকটা পথ এখন হেঁটে যেতে হবে। আমি হাঁটছিলাম আর রাতকানা রোগীর মতো সব অন্ধকার দেখছিলাম।

নুসাইবা বলল, তারপর কী হলো নানাভাই? নানাভাই বললেন, তারপর আমি যখন বাড়ি গেলাম, সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে যেন আমি কোনো বড় রকমের অপরাধ করেছি। মজার ব্যাপারটা হলো আমি কারো প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলাম না। একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছিলাম। তাই কেউ আমাকে বেশি ঘাঁটায়নি। সকালে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর উঠল। দাদা ফকির ডেকে আনলেন এবং আমার সারা শরীরে ফুঁ দিল সেই ফকির। ফকির বলল যে আমার গায়ে নাকি কালা বাতাস লেগেছে। শুনে আমার ভীষণ রাগ হলো।

রাতুল বলল, কালা বাতাস কী, নানাভাই?
নানাভাই বললেন, কালা বাতাস মানে ভূত প্রেতের নজর পড়া। আগেকার দিনে এসব কুসংস্কার চালু ছিল। আমার গ্রামের নদীটার কথা এখন কিছু বলি তোদের। ওই নদী আমার অস্তিত্বে মিশে আছে।

কত সাঁতার কেটেছি। কত মাছ ধরেছি। আহা! আমার নদী। দুঃখের বিষয় নদীটা এখন মৃত।
সিয়াম বলল, নদী মৃত মানে কী, নানাভাই?
নানাভাই হেসে বললেন, নদী মৃত মানে এখন নদীতে বেশি পানি হয় না, বড় বড় নৌকা চলে না। যে নদী আগে আমরা নৌকা করে পার হতাম, সেই নদী এখন গোরু-ছাগল অনায়াসে পার হয়ে যায়।

নানাভাই একটু থেমে আবার বললেন, ও ভালো কথা, তোরা সবাই সাঁতার জানিস তো?
সবাই চেঁচিয়ে বলল, জি নানাভাই।

Share.

মন্তব্য করুন