হঠাৎ নদীর মাঝখান থেকে উঠে এলো এক পরি। সাড়ে দশ বছরের মেয়ে পুষ্প ছাড়া নদীর ঘাটে আর কেউ নাই। তখন সন্ধ্যাবেলা। কি মনে করে পুষ্প নদীর ঘাটে এসেছে তা সে নিজেও জানে না। বাবা-মা কাউকে বলে আসেনি। সাঁঝের বেলায় নদীর টলটলে জল পুষ্পকে আনন্দিত করে তুলছে। নীরবে দাঁড়িয়ে দেখছিল বাতাসের সাথে স্বচ্ছ জলের ঢেউ খেলা। ঠিক তখনই এক ঝলক হাসির ফোয়ারা নিয়ে উঠে এলো পরিটি।
পুষ্প ভয়ে একবার চোখ বন্ধ করল। মনে মনে ভাবল নিশ্চয়ই ওটা দাদুর গল্পের সেই জলপরি। জলপরি হাসল। সুন্দর ঝকঝকে চিকন দাঁত বের করে বলল, পুষ্পমণি তুমি ঠিকই ভেবেছ, আমি সেই জলপরি, তুমি যার গল্প অনেকবার তোমার দাদুর কাছ থেকে শুনেছ। পুষ্প অবাক হলো। পরিটি তার মনের কথা ঠিক ঠিক বলে দিলো! জলপরি পুষ্পর ঠিক সামনেই দাঁড়িয়ে। ভয়ে পেছন দিকে সরে দাঁড়াল পুষ্প। জলপরি অভয় দিয়ে বলল, তুমি ভয় পাচ্ছ কেন সোনামণি?

পুষ্প মুখ খুলল এবার। বলল, ভয় পাব না! আমার আম্মু বলেছে পরিরা উড়িয়ে নিয়ে যায়। তুমি যদি আমাকে নিয়ে যাও, তাহলে আমার আব্বু-আম্মু আমার জন্য খুব কান্নাকাটি করবে। এতোগুলো কথা এক নাগাড়ে বলে হাঁফিয়ে উঠল পুষ্প।

জলপরি আবার বলল, তুমি ঠিকই বলেছ, পরিরা তোমার মতো ফুটফুটে ছেলে-মেয়ে পেলে পরিদের দেশে নিয়ে যায়।
– উঃ সত্যি! আম্মুতো তাহলে ঠিকই বলেছে!
– হ্যাঁ, তোমার আম্মু ঠিক কথাই বলেছে। তবে…
– তবে কী জলপরি?
– ছেলেমেয়েরা যেতে না চাইলে, আমরা জোর করে কাউকে নিয়ে যাই না।
পুষ্প এবার অনেকটা সাহস পেল। মনের ভয়টা কমে গেল। তাই নির্ভয়ে জিজ্ঞেস করল, জলপরি তোমাকে তো আগে কোনদিন দেখিনি? আমরা তো এই ঘাটেই প্রতিদিন গোসল করি।
– কিন্তু আমি তোমাকে অনেকবার দেখেছি।
– দেখেছ? বিস্ময়ে-আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল পুষ্প।
– হ্যাঁ, খুব দেখেছি। তোমাকে না আমার দারুণ পছন্দ।
– তাহলে দেখা দাওনি কেন? অভিমানের সুরে জিজ্ঞেস করল পুষ্প।
জলপরি অনেকক্ষণ পর আবারও এক ঝলক হাসির ফোয়ারা ছড়িয়ে দিলো। তারপর বলল, পুষ্পমণি তোমরা দলবেঁধে গোসল করতে, তাই না?
– হ্যাঁ।
– সে জন্যই তো আমি দেখা দেইনি।
– তুমি সবার সামনে দেখা দাও না?
জলপরি বলল, ঠিক তাই। দেখ না, আজ একা একা বেড়াতে এসেছ, তাতেই দেখা দিলাম।
– জলপরি, আমার আব্বু-আম্মু না খুব পচা। আমাকে কখনোই একা একা নদীতে আসতে দেয় না।
– তারা ঠিক কাজটিই করে। নদীতে একা একা আসতে নেই।
জলপরির এ কথায় মুখ ভেংচালো পুষ্প। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, ইস্ আসতে নেই! তুমিও পচা। এরপর পুষ্প গলার স্বর বাড়িয়ে রাগত স্বরে বলল, একা না এলে আজ তোমার সাথে দেখা হতো?

জলপরি এক ঝলক হাসল। তারপর অস্থির হয়ে উঠল। হয়তো দেশে ফেরার সময় হয়েছে তার। তাই পুষ্পকে বিদায় জানাতে চাইল। কিন্তু পুষ্প নিজেই বলল, জলপরি, তুমি কি এখন চলে যাবে?
– হ্যাঁ, সোনামণি। আমি এখন আমার দেশে চলে যাব।
– জলপরি, তোমাদের দেশ কেমন?
– খুব সুন্দর, একেবারে স্বপ্নের মতো। হেসে হেসে বলল জলপরি।

– পুষ্প আবারও প্রশ্ন করল, জলপরি, আমাকে নিবে তোমাদের দেশে?
– তুমি কি সত্যি যেতে চাও, আমাদের দেশে? বলল জলপরি।
– সত্যি, সত্যি, সত্যি। তিন সত্যি দিয়ে অসম্ভব আগ্রহ প্রকাশ করল পুষ্প।

জলপরি বলল, তুমি না বললে তোমার আব্বু-আম্মু কান্নাকাটি করবে।

পুষ্প এবার ঝটপট উত্তর দিলো, জলপরি, তুমি খুব বোকা। আব্বু-আম্মু জানার আগেই তো আবার চলে আসব।

জলপরি এবার না হেসে পারল না। খিলখিল করে হাসল। হাসতে হাসতে দুটো পাখা বাড়িয়ে দিলো। দু-হাত দিয়ে পাখা দুটি জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করল পুষ্প। টুপ করে জলের সাথে মিশে গেল পুষ্প ও জলপরি।

দুই.
চোখ খুলতেই একটা স্বপ্নের মতো দেশ চোখে পড়ল পুষ্পর। কোথাও কোন ময়লা, আবর্জনা, ধূলিবালি, রোদবৃষ্টি, কাদা নেই। হইচই, কান্নাকাটি, ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি কিচ্ছু নেই। শুধু ফুল-ফল, পাখির রাজ্য।
জলপরির দেশে পুষ্পর চোখে পড়ল আরও একটা পরিকে। পরিটা তার মতোই ছোট্ট। জলপরি পুষ্পকে বলল, ওটা আমার মেয়ে, ওর নাম ফুলপরি। তুমি ওর সাথেই থাকবে। খেলা করবে।

ঘাড় নেড়ে জবাব দিলো পুষ্প, আচ্ছা।
ফুলপরি জলপরির দিকে তাকিয়ে বলল, মা-মণি ওকে নিয়ে এসেছ কেন?
– ও আমাদের দেশ দেখতে চেয়েছিল তাই। মেয়ের কথার জবাব দিল জলপরি।
ফুলপরি ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, ও আচ্ছা। এরপর পুষ্পর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, চল আমরা খেলতে যাই।
খেলাতে মন বসল না পুষ্পর। সে কেবল চারিদিকে তাকিয়ে দেখছে আর অবাক হচ্ছে। কতো সুন্দর দেশ! এতো বড় জায়গা! কিন্তু জলপরি আর ফুলপরি ছাড়া কাউকেই দেখা যাচ্ছে না! পুষ্পর মনে এসব ভাবনা ঘুরপাক খেতে লাগল।

ফুলপরি বুঝল খেলায় মনোযোগী নয় পুষ্প। তাই সে পুষ্পর হাত ধরে বলল, চল আমাদের বাগানটা থেকে ঘুরে আসি।

বাগান বাড়িটা বেশ দূরেই। তারপরও যেতে কষ্ট হলো না। কারণ ওরা যে রাস্তা ধরে হাঁটছে, সারা রাস্তায় কার্পেট বিছানো। কোথাও হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার ভয় নেই। পায়ে কাঁটা ফোটার শঙ্কাও নেই। ঘরের মেঝের মতো সুন্দর, পরিষ্কার রাস্তা দিয়ে ওরা হেঁটে চলল।

বাগানের ভেতরে ঢুকতেই একটা আওয়াজ কানে এলো পুষ্পর। কে যেন বলছে বাগান বাড়িতে আপুমণিদের স্বাগতম! এর খানিকপরেই অসংখ্য কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হলো- আপুমণিদের স্বাগতম, আপুমণিদের স্বাগতম।

পুষ্প এদিক-সেদিক তাকিয়ে দেখল, কোথাও কেউ নেই। বিস্ময়ে হতবাক হওয়া পুষ্প তাই জিজ্ঞেস করল, ফুলপরি, ওভাবে কারা কথা বলে?
– ফুলপরি বলল, কেন, তুমি এটা জানো না?
– নাতো।
– ফুলপরি হেসে বলল, ও তাই। তোমাকে তো বলাই হয়নি। তুমি জানবে কি করে।
– ব্যাপারটা খুলে বলতো ফুলপরি।
– ব্যাপার হলো, আমার সাথে বাগানের সমস্ত ফুল কথা বলে। সে জন্যই তো আমার নাম ফুলপরি।
পুষ্প অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ফুলপরির মুখের দিকে। ফুলপরি আরও বলল, শুধু ফুলেরা নয়, ওই যে গাছে গাছে পাখি দেখতে পাচ্ছ, ওরাও আমার সাথে কথা বলে।
পুষ্প দু-হাত প্রসারিত করে উল্লাসের ভঙ্গিতে বলল, উফ্ দারুণ।

পুষ্পকে অবাক হওয়া দেখে ফুলপরি খুব মজা পেল। সে ডাকল এক তোতাপাখিকে। সঙ্গে সঙ্গে পাখিটি তার হাতে এসে বসল। তারপর একটা ফুলের গায়ে হাত রেখে নাম জিজ্ঞেস করল। ফুলের মধ্য থেকে ঝটপট উত্তর এলো- ডালিয়া। পুষ্পকে আরও মজা দেওয়ার জন্য অন্য একটি ফুলের কাছে নিয়ে গেল। ফুলপরির কথা মতো ফুলটির নাম জিজ্ঞেস করল পুষ্প। সাথে সাথে ফুলটি উত্তর দিলো, আমার নাম রানি- গোলাপ।

পুষ্প আরও অবাক হয়ে বলল, উফ্ দারুণ! বলেই একই উচ্ছ্বাস নিয়ে ফুলপরির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, আরও কিছু?

– এখানে তুমি যা খেতে চাইবে তাই পাবে। যা করতে চাইবে, করতে পারবে। শুধু একটা জিনিস করা যাবে না।
– কি করা যাবে না, ফুলপরি? অনেক বেশি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল পুষ্প।

এবার তাচ্ছিল্যের সুরে ফুলপরি বলল, পড়ালেখা।
পড়ালেখা করা যাবে না শুনে পুষ্পর খুব আনন্দ লাগল। আসলেই পড়ালেখা খুব ঝামেলার। স্কুলে স্যারদের পিটুনি, বাড়িতে আব্বু-আম্মুর বকুনি। একদম ভাল লাগে না। এসব ভাবতে গিয়েই পুষ্পর মনে পড়ে গেল আম্মুর কথা। আম্মু বলেছে, পড়ালেখা না করলে বড় মানুষ হওয়া যায় না।

ফুলপরি পুষ্পর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ওমন করে কি ভাবছো?

পুষ্প সাফ সাফ জবাব দিলো, তোমাদের সব ভালো, শুধু একটা খারাপ।
– কোনটা খারাপ?
– পড়ালেখা করা যাবে না, এটা খুব খারাপ।
পুষ্পর কথা শুনে ফুলপরি হাসল। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ল। পুষ্পর রাগ হলেও ফুলপরির সাথে হাসিতে যোগ দিলো। দুজনেই অনেকক্ষণ ধরে হাসতে লাগল। একসময় হাসি থামিয়ে ফুলপরি গান ধরল-
আমি পরির দেশের ফুলপরি
আমি যা খুশি তাই করি ॥
খেলি ফুলের বনে-বনে
ফুলপাখিদের সনে
ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়াই ইচ্ছে মতো উড়ি ॥
আমার সবার সাথে ভাব
নাই কোনো অভাব
আমরা-আছি মিলেমিশে হাতে-হাত ধরি ॥

ফুলপরির গান শুনে মুগ্ধ হলো পুষ্প। নিজেরও একটা গান গাইতে ইচ্ছে করল। হঠাৎ একটা ছড়া-গান মনেও এসে গেল। পুষ্প গাইতে লাগল-
খোকা ঘুমাল পাড়া জুড়াল
বর্গী এলো দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেবো কিসে ॥
ধান ফুরাল পান ফুরাল
খাজনার উপায় কি,
আর ক’টা দিন সবুর করো
রসুন বুনছি ॥

তিন.
রাস্তার ধারে মন খারাপ করে বসে আছে পুষ্প। কারণ এক এক করে সাতটা দিন কেটে গেছে এখানে। পরিদের এই স্বপ্নের দেশ দেখতে দেখতে আর ফুলপরির সাথে থেকে বাড়ির কথা, আব্বু-আম্মুর কথা একদম মনেই পড়েনি পুষ্পর। আজ হঠাৎ আব্বু-আম্মুর কথা মনে পড়ে খারাপ লাগছে তার। তারা নিশ্চয়ই হন্যে হয়ে খুঁজছে। নিশ্চয়ই খুব কান্নাকাটি করছে।

জলপরি লক্ষ্য করল ব্যাপারটা। পুষ্পর মন খারাপ দেখে হয়তো তারও কিছুটা খারাপ লাগল। পরি হলেও সেও-তো একজন মা। জলপরি পুষ্পর কাছে এসে বলল, পুষ্পমণি, তুমি মন খারাপ করে বসে আছো যে?

জলপরির কথায় সাড়া দিলো না পুষ্প। কেবল চোখের কোণে জমে থাকা পানি মুছল। জলপরি পুষ্পর কষ্ট বুঝতে পারল। তাই কাছে গিয়ে দু-হাত দিয়ে মুখখানি উঁচু করে ধরে বলল, সোনামণি, কেঁদো না, তোমাকে কালই তোমাদের দেশে রেখে আসব।

পুষ্প মুখ খুলল। অনুরোধ করে বলল, প্লিজ তুমি আমাকে আজই আমাদের দেশে নিয়ে যাও।
– আজ না, পুষ্পসোনা। বলেই জলপরি খিলখিল করে হেসে উঠল।
সে হাসি ছড়িয়ে পড়ল পুষ্পর মনে। তাই কিছুটা প্রাণবন্ত মনে হলো তাকে। ঠোঁটের কোণে হাসিও ফুটে উঠল। হেসেই জিজ্ঞেস করল, জলপরি, আজ নিয়ে যাবে না কেন?
– আজ আমাদের এক আত্মীয় এখানে বেড়াতে আসবে?
জলপরির আত্মীয় বেড়াতে আসবে শুনে পুষ্প মনে মনে রোমাঞ্চ অনুভব করল। ভাবল পরিদেরও আবার আত্মীয়ও আছে। মুখে বলল, জলপরি তোমাদের আত্মীয়দের দেশ কোথায়?
– ঠিক তোমাদের দেশ যেখানে।
– তার মানে?
– মানে সোজা। আমরা জলের নিচে থাকি আর আমাদের আত্মীয় থাকে মাটির দেশে।
– তাই! তাহলে তারা তো স্থলপরি।
পুষ্পর বুদ্ধিমত্তায় হেসে গড়িয়ে পড়ল জলপরি। বলল, ঠিক বলেছ সোনামণি, তারা স্থলপরি।

স্থলপরিকে দেখার দারুণ আগ্রহ জান্মাল পুষ্পর মনে। জলপরিও বুঝতে পারল পুষ্পর মনোভাব। তাই সে মাথায় হাত রেখে আদর করতে করতে বলল, তাই আজকের দিনটা তোমাকে থাকতে বলেছিলাম।
পুষ্প ঘাড় নেড়ে বলল, আচ্ছা।

জলপরি পুষ্পর কপালে চুমো দিয়ে আদর করল। নানারকম ফলমূল জোগাড় করে খাবার জন্য প্রস্তুত করতে লাগল।

স্থলপরি যখন জলপরির দেশে এলো তখন চারিদিকে একটা মোহনীয় বাঁশির সুর শোনা গেল। ক্ষণে ক্ষণে কেবল সেই বাঁশির সুর বাজতেই থাকল। মন-মাতানো, হৃদয় জুড়ানো সুরের ছন্দ। পুষ্পর কাছে সাত দিনের চেনা জলপরির দেশটা একটু অন্য রকম মনে হলো এই মুহূর্তে।

স্থলপরিকে দেখতে অনেকটা জলপরির মতো মনে হলো। সব দিক দিয়েই ঠিক আছে। শুধু জলপরির নিচের অংশের আকৃতি অনেকটা মাছের মতো। আর স্থলপরি যেন মানুষের মতোই। তবে মন ভুলানো সেই হাসি দু’জনের মুখেই লেগে থাকে, ছড়িয়ে পড়ে। এ হাসি এক, একেবারে একই রকম।
– তুমি স্থলপরি? স্থলপরিকে লক্ষ্য করে বলল পুষ্প।
– হ্যাঁ, সোনামণি। পুষ্পর কথার জবাব দিয়ে স্থলপরি তার কাছে গিয়ে বসল। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাব জমে উঠল দুজনের। পুষ্পর কথায় মুগ্ধ হয়ে গেল স্থলপরি। তেমনি পুষ্পরও স্থলপরিকে পছন্দ হলো।

স্থলপরি মাত্র কয়েক ঘণ্টা সময় নিয়ে বেড়াতে এসেছে। তাই তার ফেরার সময় হয়ে গেল। বিদায় বেলায় পুষ্পকে নিয়ে যেতে চাইলে সে এক কথায় রাজি হয়ে গেল। পুষ্পর সম্মতি দেখে জলপরি নিষেধ করল না। তবে কিছুটা চিন্তিত দেখাল তাকে। স্থলপরি তার চিন্তার কারণ বুঝতে পারল। তাই বলল, তুমি চিন্তা করো না। পুষ্প বাড়ি যেতে চাইলে, সাথে সাথে আমি ওকে ওর বাড়িতে রেখে আসব।

জলপরি এক ঝলক হাসির ফোয়ারা ছড়িয়ে দিলো। বোঝা গেল তার চিন্তা উড়িয়ে দিলো সেই হাসির সাথে।
একটু পরেই জলপরির চোখে পানি জমে উঠল। ফুলপরি মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইল। পুষ্প বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে স্থলপরির পাখা দুটো জড়িয়ে ধরল। পুষ্পকে পিঠে নিয়ে শাঁ-শাঁ করে উড়ে চলল স্থলপরি।

চার.
স্থলপরির দেশে নামতেই পুষ্পর আনন্দ আর ধরে না। অনেক অচেনা কিছুর মধ্যে কি যেন তার কাছে খুব চেনা, পরিচিত মনে হচ্ছে। হ্যাঁ, মনে পড়ছে। একটা সুর। সেই মোহনীয় বাঁশির সুর। যে সুরটা স্থলপরি যখন জলপরির দেশে গিয়েছিল, ঠিক তখনই বেজে উঠেছিল। এখানেও সেই মন ভুলানো সুরের পরশ।

স্থলপরি পুষ্পকে একটা বড় বিল্ডিংয়ের মধ্যে নিয়ে গেল। পুষ্পর মনে হলো এটাতে শতশত রুম আছে। স্থলপরির হাত ধরে সে অনেকগুলো রুম পেরিয়ে পৌঁছাল একটা বড় রুমের সামনে। খানিকটা সংযত হয়ে প্রবেশ করল স্থলপরি। সাথে পুষ্পও।

রুমটার ভেতরে খুবই পরিপাটি করে সাজানো। পুষ্প চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো। তার কাছে মনে হলো সে যেন স্বর্গপুরির কোন রাজ্যে এসে গেছে। এদিক-সেদিক দেখতে দেখতে চোখ পড়ল একটা সোনার খাটের উপর। সেখানে শুয়ে আছে অন্য একটা পরি। হয়তো ঘুমিয়ে আছে। পুষ্প ভালো করে দেখল। মনে হচ্ছে পরিটার অনেক বয়স। চুলগুলো সাদা দেখাচ্ছে। পুষ্প নিশ্চিত হলো পরিটা বুড়ো।

স্থলপরি পুষ্পর হাত ধরে বলল, ওটা আমার দাদি। উনি ঘুম থেকে উঠলে তোমার সাথে পরিচয় করে দেব। পুষ্প মাথা নেড়ে উত্তর দিলো, আচ্ছা।

পুষ্পর ক্ষুধা পেয়েছে ভেবে স্থলপরি তাকে নিয়ে গেল ফল বাগানে। ফল বাগানে গিয়ে পুষ্পতো অবাক। অসংখ্য ফলের গাছ। নানা রকমের সারি সারি গাছ। গাছে গাছে ধরে আছে নানান ফল। দেখেই যেন মন ভরে যায়। স্থলপরি কিছু ফল পেড়ে পুষ্পর হাতে দিল। পুষ্প কিছুক্ষণ নাড়া-চাড়া করে খেতে লাগল।

স্থলপরি নিজের কিছু টুকিটাকি কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পুষ্প মনে মনে ভাবল পরিদেরও আবার কাজ করতে হয়। স্থলপরি জবাব দিলো, হ্যাঁ পুষ্পমণি, দুনিয়াটা কাজেরই জায়গা।

পুষ্প অবাক হলো। জলপরির মতো স্থলপরিও তার মনের ভাবনা বলতে পারল। সব পরিই হয়তো মনের কথা বুঝতে পারে। কেমন করে বোঝে? আমরা বুঝি না কেন? ইত্যাদি ভাবনা পুষ্পের মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।

স্থলপরি তার হাতের কাজ শেষ করে পুষ্পকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পুষ্প কি খেতে ভালেবাসে? কেমন খেলা পছন্দ করে? কেমন বিছানায় ঘুমোতে পারে? এসব বিষয় জেনে নিয়ে স্থলপরির মনে হলো পুষ্পটা আসলে তার মনের মতোই।

এসময় পুষ্পকে কিছুটা অন্য মুনস্ক দেখে স্থলপরি বলল, সোনামণি তোমার কি খারাপ লাগছে?
– একদম না।
– তবে যে মন খারাপ?
– এমনি।

স্থলপরি হাসির ঝলক ছেড়ে বলল, আসলেই তুমি খুব মিষ্টি মেয়ে।
– মিষ্টি না ছাই। আগে বল, তোমার দাদুর ঘুম ভাঙবে কখন?
– এই তো কিছুক্ষণের মধ্যেই…
স্থলপরির কথা শেষ না হতেই সেই বড় রুম থেকে নরম কণ্ঠে হাঁক ছাড়ল, কারা কথা বলেরে?

স্থলপরি বলল, ওই দেখো, দাদু ঘুম থেকে উঠেছে। এবার তুমি দাদুর সাথে খুব মজা করতে পারবে। পরিদের মধ্যে দাদু খুব মজার পরি।
পুষ্প হেসে বলল, তাই।

স্থলপরি আগের মতো করেই বলল, আর একটা কথা জানাই, দাদুপরি না সুন্দর সুন্দর গান জানে। তোমাকে দাদুপরির একটা গান শোনাচ্ছি।
স্থলপরি গাইতে লাগল-
এসো আমাদের স্বপ্নপুরি
সবার সাথে ভাব করি॥
নেই হিংসা দ্বেষ
নেই রেষারেষ
বাঁচার আনন্দকে এসো ভাগ করি॥
জগতের সব প্রাণী
মনে মনে একজানি
এসো সবাই সবার সেবা করি॥

গান শুনে পুষ্প হাততালি দিয়ে হাসল। এরপর দু’জনেই একসাথে হাসতে লাগল। দাদুপরি বাইরে এসে দু’জনকে প্রচ- রকম হাসতে দেখে নিজেও যেন আনন্দে দুলতে লাগল। যদিও পুষ্পকে দেখে অবাক হওয়ার কথা দাদুপরির। কিন্তু স্থলপরির এ রাজ্যে মানুষের আগমন তার কাছে স্বাভাবিক। তাই পুষ্পর কাছে এসে প্রথম সাক্ষাতেই ভাব জমিয়ে ফেলল দাদুপরি।

পাঁচ.
ভোরবেলায় দাদুপরির সাথে বের হয়েছে পুষ্প। দাদুপরি গত রাতে অনেক গল্প শুনিয়েছে তাকে। কত রকম গল্প! পরিদের গল্প। পরিরা কেমন করে মানুষদের সাথে মিশে চলাচল করে সেসব গল্প। দাদুপরির গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিল পুষ্প। রাতেই একবার বেড়ানোর কথা বলেছিল দাদুপরি।

সেই ভোর থেকে ঘুরছে। দাদুপরি আর পুষ্প। গভীর অরণ্যে উঁচু-উঁচু পাহাড়ের চূড়ায়, পাহাড়ের পাদদেশে, ঝরনার ধারায়, অতল সমুদ্রের উপর দিয়ে, যেখানে বেড়ানো তো দূরের কথা কোনদিন কল্পনাও করেনি পুষ্প। দাদুপরি সেই সব অচেনা, অজানা, রহস্যময় জায়গা দেখালেন। সেই ভোর থেকে সকাল। তারপর দুপুর। আর এখন বিকেল। ঘুরতে ঘুরতে খুব ক্লান্ত দুজন। বসে পড়ল একটা বড় পাথরের উপর। যেখানে দুটো পাহাড় এসে সমতল ভূমির সাথে মিলিত হয়েছে। প্রবল একটা ঝরনাধারা পাথরের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। সেইখানে বসে পড়ল দুজন। একজন পরি যার বয়স পরিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। আরেকজন মানব সন্তান যে সাড়ে দশ বছরের একটা বালিকা। দুজনই খুব ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত।

দাদুপরি বলল, পুষ্প সোনামণি, চলো এবার আমরা কিছু খেয়ে নেই।
পুষ্প অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, দাদুপরি এখানে আমরা খাবার পাব কোথায়?
দাদুপরি হাসল। তারপর বলল, তুমি একটা কাজ কর।
– কী কাজ?
– কাজটা হলো, তুমি কিছু সময় চোখ বন্ধ করে থাক।
– তা কত সময়?
– এই ষাট পর্যন্ত গুনতে যত সময় লাগে।
– তাহলে কী হবে?
– পুষ্পমণি দেখোই না কী হয়।
– খুব কি মজার কিছু হবে, দাদু?
– তোমার জন্য দারুণ মজার।
– প্রচ- রকমের মজার কা- হবে?
– প্রচ- মজার।
– তাই। এই নাও আমি চোখ বন্ধ করলাম। কৌতূহলে, আবেগে চোখ বন্ধ করল পুষ্প। এবং গুনতে থাকলো এক, দুই, তিন, চার,…ছাপ্পান্ন, সাতান্ন, উনষাট, ষাট। গোনা শেষ হওয়ার সাথে সাথে চোখ খুলল পুষ্প। একী কা-! পুষ্পর সামনে প্যাকেট ভরা মিষ্টি, ঝুড়ি ভরা ফল, আরও নানারকম খাবার। পুষ্প দাদুপরির দিকে তাকাল। দাদুপরি হেসে বলল, সোনমণি খাও।
– তুমি এসব কোথায় পেলে?
– কেন বাজার থেকে কিনে এনেছি।
– এতো তাড়াতাড়ি…

পুষ্পর কথা শেষ না হতেই দাদুপরি বলল, তুমি পরিদের ব্যাপার বুঝবে না। এখন খাও।
– তুমি খাবে না?
– অবশ্যই।
দাদুপরির সাথে খাওয়া শেষ করল পুষ্প। তারপর দু’জনে ফিরল বাড়ির দিকে। পাহাড়-অরণ্য পেরিয়ে মহাসাগরের উপর দিয়ে চলছে তারা। চোখ বন্ধ করে আছে পুষ্প। বাতাসের শাঁ-শাঁ শব্দে কান ঝাঁ-ঝাঁ করছে। শরীর প্রচ- রকম ঠা-া হয়ে আসছে। কৌতূহলবশত সামান্য সময়ের জন্য চোখ খুলে তাকাল পুষ্প। উপরে আকাশ। নিচে অথৈ জলরাশি। ভয়ে উহ: করে উঠল সে। দাদুপরি টের পেয়ে সাহস দিয়ে বলল, ভয় নেই সোনামণি।

বাড়ি এসে স্থলপরিকে খুঁজতে লাগল পুষ্প।
স্থলপরি আড়াল থেকে লক্ষ্য করল পুষ্প তাকে না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠেছে। একবার। দুইবার। স্থলপরি বলে ডাকাডাকি করল। স্থলপরির আরও বেশি মায়া বেড়ে গেল পুষ্পর প্রতি। তাই তার অস্থিরতা আর সহ্য করতে পারল না। আড়াল থেকেই পুষ্প বলে ডেকে উঠল। পুষ্প দৌড়ে স্থলপরির কাছে গেল।
স্থলপরি পুষ্পকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করতে করতে বলল, দাদুর সাথে ঘুরে বেড়াতে কেমন লাগল?
– খুব মজা।
– বনে, পাহাড়ে গিয়ে তুমি ভয় পাওনি তো?
– একটু না।
– সাগরের মাঝখানে গিয়ে ভয় পাওনি?
– মোটেই না।
– বাহ! তুমি খুব সাহসী মেয়ে।
– আমাদের স্কুলের নাসিমা ম্যাডাম বলেছেন, মেয়েদের খুব সাহসী হতে হবে।
– তাই নাকি।
– হু।
– তোমাদের ম্যাডাম আর কী কী বলেন?
– অনেক কিছু। এতো মনে থাকে?
– গান শোনান না?
– হ্যাঁ, সুন্দর সুন্দর গান গেয়ে শোনান।
– তাই, শোনাও না একটা গান।
– পুষ্প স্থলপরির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, গাইব?
– স্থলপরি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। পুষ্প ‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ দেশের গানটি গেয়ে শোনাল।

পুষ্পর এখানে আসাও বেশ কয়েকদিন হলো। এতদিন খারাপ কাটেনি তার। দাদুপরির সাথে বেড়ানো। গল্প করা। স্থলপরির আদর সোহাগ পুষ্পকে যেন অন্যসব কিছু থেকে ভুলিয়ে রেখেছে। আজ দুপুরে হঠাৎ দাদুপরি বলেছে, সে তার ছোট মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাবে। সাথে পুষ্পকেও যেতে হবে।
দাদুপরির ছোট মেয়ে থাকে আকাশপরির দেশে। বাবা-মার কাছে আকাশপরির গল্প শুনেছে পুষ্প। কাল ভোরে সেই পরির দেশে যাবে সে।
উফ! কী দারুণ মজা হবে।
সারারাত ঘুম হয়নি পুষ্পর। খুব ভোরে স্থলপরি দু-হাতে তৈরি করে দিলো পুষ্পকে।
পুষ্প বলল, স্থলপরি তোমার সাথে আবার কবে দেখা হবে?
স্থলপরি দু-চোখ মুছে বলল, তুমি ফিরে আসলেই দেখা হবে, সোনামণি।
– আর যদি না আসি ?
কিছুক্ষণ দম বন্ধ করে স্থলপরি বলল, কোনদিন দেখা হবে না। বলেই দ্রুত সরে গেল। পুষ্প সে দিকে তাকিয়ে জামা দিয়ে চোখ মুছল। অল্প কিছু সময় পরে দাদুপরির পিঠে চড়ে পুষ্প উড়ে চলল আকাশপরির দেশে।

ছয়.
পুষ্পমণি, আমরা কিন্তু আকাশপরির দেশে চলে এসেছি। দাদুপরির এ কথায় চোখ খুলল পুষ্প। চারিদিকে তাকাল। ওমা, এ যে পরির রাজ্য! যতদূর চোখ যায় সবখানে পরিদের আনাগোনা। লালপরি। নীলপরি। সাদাপরি। হলুদপরি। সুখপরি। দুখপরি।
– দাদু এতো পরি এখানে?
– সোনামণি, এ যে আসল পরির রাজ্য।
– তাহলে জলপরি আর তোমাদের রাজ্য কি নকল?
-তা হবে কেন, ওটাও আসল। তবে এখানেই সবরকম পরিদের দেশ।
– ও আচ্ছা।

কিছুক্ষণ পর দাদুপরির মেয়ে এসে হাজির। মেয়েকে কাছে পেয়ে আবেগে জড়িয়ে ধরল দাদুপরি। পুষ্পর মনে হলো মানুষের মতো, পরিদেরও মন আছে। আছে মায়া মমতা। আপনজনকে কাছে পেলে পরিরাও আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে।

পুষ্পর বুকের ভেতর কেঁপে উঠল। একবার। দু’বার। কয়েকবার। ইস! আজ কতদিন হলো মা-বাবাকে ফেলে এসেছি। পুষ্পর মনের মধ্যে কালোমেঘ জমে উঠল।

পুষ্পকে না পেয়ে তারা কি খুব কান্নাকাটি করছে। খোঁজ-খবর করছে বিভিন্ন জায়গায়। ছেলে ধরারা ধরে নিয়ে গেছে, এই ভাবনায় কি অস্থির হচ্ছে? না, কী করছে তার বাবা-মা? এসব ভাবনা পুষ্পর মন ভীষণ খারাপ হলো। চারিদিক থেকে ভেসে আসছে বিভিন্ন রকম গানের সুর। নিশ্চয় পরিরা গান করছে। শোনা যাচ্ছে খিলখিল হাসির আওয়াজ। পরিরাই হাসছে। উপর থেকে ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছে পরিরা। নানারকম আয়োজন এই পরির রাজ্যে। কিন্তু এসব কিছুই যেন পুষ্পর মনকে আনন্দ দিতে পারছে না। মা-বাবাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে তার। পুষ্পদের পাড়ায় শিমু, মায়া, সুমন, শাকিল, তানি ওদের কথাও খুব মনে পড়ছে। শিমু ও মায়া পুষ্পর সহপাঠী। তিনজন একসাথে স্কুলে যাওয়া-আসা করে। আসা-যাওয়ার পথে গল্প করে। খুনসুটি করে। হইচই করে। কত মজা হয়।
সেদিন ও শিমু আর মায়া সুমনকে সাথে নিয়ে সময় হওয়ার আগেই স্কুলে রওনা দিয়েছিল। শাকিল গিয়ে ওদের বাধা দিল। ঝগড়া হলো। শেষে মিলমিশ করে দিয়ে একসাথে স্কুলে গেল। পুষ্পকে সবাই মানে। সহপাঠী থেকে শুরু করে স্কুলের প্রায় সব ছেলে-মেয়েই। শিক্ষকরাও কম আদর করে না। স্কুলের মেধাবী ছাত্রী বলেই হয়তো তার এত পাওনা। এসব কিছুই পুষ্পর মনকে বারবার খারাপ করে দিচ্ছে। হঠাৎ মনমরা পুষ্পর প্রতি খেয়াল হলো দাদুপরির। মেয়েকে দেখিয়ে বলল, ওকে চিনিস মা?
– ওতো দেখছি মানব সন্তান।
– ঠিকই ওর নাম পুষ্প। তোকে সব বলব। আগে ঘরে চল। দাদুপরির মেয়ে পুষ্পকে কোলে নিয়ে আদর করল। বুকের সাথে চেপে ধরল। নিঃসন্তান পরিটি হয়তো কিছু সুখ পেল।
ঘরে নিয়ে নানারকম খাবার খেতে দিলো পুষ্পকে। পরিরাজ্যের খাবার-দাবার খেতে খুব মজা। খাবারের মধ্যে ফলমূল আর মিষ্টিই বেশি। কিছু অচেনা ফল যা পুষ্প কোনদিন দেখেনি, সেগুলো খেতে দারুণ মজা। পুষ্প খুব সময় নিয়ে খেলো। দাদুপরির সাথে খেতে খেতে কিছুক্ষণ আগের খারাপ মনটা এখন অনেকটাই ভালো।

পরির রাজ্যে রাত নামল। ঝিলিমিলি আলোর ঝলকানিতে রাতের আঁধার নামল না। চারিদিকে হইচই। পরিদের ছুটোছুটি। পুষ্প দাদুপরি আর তার মেয়েপরির সাথে বারান্দায় বসে গল্প করছিল।
পরিদের ওমন ছুটোছুটি দেখে পুষ্প দাদুপরিকে জিজ্ঞেস করল, দাদু, ওই পরিগুলো ও রকম করছে কেন?

দাদুপরি উত্তর দেয়ার আগেই পুষ্পর কথার জবাব দিলো তার মেয়েপরি। বলল, আজ রাতে পরিদের উৎসব হবে।
– কেমন উৎসব?
– নাচ, গান, অভিনয় আরও কত কী।
– আমি পরিদের উৎসব দেখব।
– অবশ্যই দেখবে। বলল দাদুপরি। বলতে বলতেই সামনের রাস্তা দিয়ে একজন ঘোষকপরি ঘোষণা করতে করতে যাচ্ছে। পরিরাজ্যের সবাইকে জানানো যাচ্ছে যে, আজ মধ্যরাতে পরিরাজ্যের মুক্ত দিবস উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান শুরু হবে। পরিরাজ্যের রানি সকল পরিকে অনুষ্ঠানে হাজির থাকতে অনুরোধ করছেন…

ঘোষণাকারী ঘোষণা করতে করতে চলে গেল। পুষ্প ঘোষণা শুনে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের আজ মুক্ত দিবস? দাদুপরির মেয়ে বলল, হ্যাঁ।
পুষ্প আবারও জিজ্ঞেস করল, তোমরা কি একসময় বন্দি ছিলে?

পুষ্পর এ কথার জবাব দিলো দাদুপরি। দাদুপরি সকল পরিরাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে বয়সী। পরিরাজ্যের অনেক ইতিহাস তার জানা। পরিদের অনেক ঘটনার সে সাক্ষী। তাই পুষ্পর প্রশ্নের উত্তর দিতে দাদুপরি গল্প বলা শুরু করল।

অনেক অনেক বছর আগের কথা। এই পরিরাজ্য খারাপ পরিদের দখলে ছিল। তারা ছিল ভয়ঙ্কর রকমের পরি। তাদের দেশ ছিল অন্য গ্রহে। কিন্তু অন্যায়ভাবে তারা এই রাজ্য দখল করে রেখেছিল। এখানকার কোনো পরিকে তারা সম্মান করত না। কারো কথা শুনত না। কোনো রকম সুযোগ সুবিধা দিতো না। এই রাজ্যের সোনা-মুক্তা-হীরাগুলো তাদের রাজ্যে নিয়ে যেত। কেউ কিছু বললে তাকেও ধরে নিয়ে গলা টিপে মেরে ফেলত। এ রকম অত্যাচারে দিনদিন পরিরাজ্যের সব আনন্দ মিশে যেতে লাগল। নিজেদের রক্ষা করার জন্য তারা চিন্তিত হলো। একসময় একত্রিত হলো পরিরাজ্যের সব পরি।
খারাপ পরিদের অত্যাচার থেকে মুক্ত হওয়ার শপথ নিলো। শুরু হলো এ রাজ্যের পরিদের বেঁচে থাকার লড়াই। খারাপ পরিরা তাতে রেগে উঠল। আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল তারা। মেরে ফেলল অনেক পরিকে।

– তারা এতো ভয়ঙ্কর পরি ছিল! বলেই পুষ্প আবার জিজ্ঞেস করল, তারপর কী হলো?

– একসময় পরিদের প্রবল বাধার মুখে টিকতে পারল না তারা। আজকের এই দিনেই এদেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল খারাপ পরিরা। মুক্ত হলো পরিরাজ্য।

– পুষ্প বলল, জানো, আমাদের দেশও পরাধীন ছিল। ১৯৭১ সালে নয় মাস যুদ্ধ করে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।

দাদুপরি বলল, তোমাদের দেশের কথাও আমরা শুনেছি। আমরা যেটুকু জানতে পেরেছি, বলছি শোনো-
পূর্বপাকিস্তান আর পশ্চিমপাকিস্তান মিলে ছিল পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র। তোমরা বাঙালি। তোমরা ছিলে পূর্বপাকিস্তানে। তোমাদের দেশে ছিল অনেক সম্পদ। আবার জনসংখ্যাও ছিল বেশি। তারপরও পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরাই ছিল শাসনকর্তা। তারা ভালো মানুষ ছিল না। বাঙালিদের ওপর জুলুম করতো। ধন-সম্পদ নিয়ে যেত তাদের দেশে। শুধু কি তাই! বাঙালির মাতৃভাষা ছিল বাংলা। তারা সেই বাংলাভাষা কেড়ে নিয়ে উর্দুভাষা চালু করতে চাইল। কিন্তু মেনে নিলো না পূর্বপাকিস্তানের মানুষ। জীবন দিয়ে ছিনিয়ে আনল বাংলাভাষায় কথা বলার অধিকার। মাতৃভাষা ফিরে পেলেও অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পায়নি তারা। দিনে দিনে জুলুম আরও বাড়তে থাকল। ফলে জেগে উঠল বাঙালি। শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিলেন। তিনি হলেন বঙ্গবন্ধু। তোমাদের জাতির পিতা। তাঁর ডাকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য তৈরি হলো অকুতোভয় বীর বাঙালি।
এতোটুকু বলে থামল দাদুপরি।
পুষ্প বলল, আরও বল, দাদুপরি।
দাদুপরি বলতে লাগল, একদিন গভীর রাতে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুকে ধরে নিয়ে গেল। আর নিরীহ বাঙালির ওপর চালাতে শুরু করল নির্যাতন। হত্যা করতে লাগল শতশত মানুষ। বসে রইল না বীরের জাতি বাঙালি। যার যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধ শুরু করল। নয় মাস চলল সেই যুদ্ধ। ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহিদ হলেন। অপমানিত হলেন দুই লক্ষ নারী। কিন্তু কিছুতেই পরাজয় বরণ করল না মুক্তিসেনারা। প্রাণপণে যুদ্ধ চালিয়ে গেল। অবশেষে হার মানল পশ্চিম পাকিস্তানের খারাপ লোকগুলো। পুষ্পসোনা, এভাবেই তোমরা স্বাধীন হয়ে গেলে। পেলে তোমাদের প্রিয় দেশ- বাংলাদেশ।
কথা শেষ করল দাদুপরি।
পুষ্প দাদুপরির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, তুমি এতো কিছু জানো, দাদুপরি।
– হু। মাথা নেড়ে বলল দাদুপরি।
পুষ্প বলল, এসব আমরা স্কুলের বইতে পড়েছি। তোমাদের যেমন আজ মুক্ত দিবস, আমাদেরও আছে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস। আরও অনেক দিবস আছে আমাদের। আমরা সেদিন শহিদ মিনারে ফুল দেই। নানারকম অনুষ্ঠান করি।
– আচ্ছা, আচ্ছা। বলল দাদুপরি।
এবার দাদুপরির মেয়ে তাদের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার জন্য দুজনকে তৈরি হতে বলল।

সাত.
রাতের গভীরতা বাড়ার সাথে সাথে উৎসবে পরিদের ভিড় বাড়তে লাগল। পরিদের মিলনমেলা। নাচ-গান-অভিনয়। দেখার মতো পরিদের সাজ-গোজ। ঘোষণাপরি ঘোষণা করল-পরিরাজ্যের রানি কিছুক্ষণের মধ্যে উৎসবে যোগ দিবেন। তারপর শুরু হবে অনুষ্ঠান। পুষ্পর কাছে মনে হলো, এ এক অবাক করা জগৎ! আশ্চর্য জীবন-যাপন!

রানি আসতে খুব দেরি হলো না। সবার সামনে সোনার সিংহাসনে বসল রানিপরি। পরিরাজ্যের রানিকে এই প্রথম দেখল পুষ্প। এতো সুন্দরী পরি এর আগে দেখেনি সে। রানি সিংহাসন ছেড়ে দাঁড়াল। সাথে সাথে দাঁড়িয়ে গেল উপস্থিত সব পরি। রানি কথা বলতে শুরু করলে সব কোলাহল থেমে গেল। একেবারে নীরব। কোথাও কোন শব্দ নেই। পুষ্প বুঝতে পারল পরিরাজ্যের এই পরিরানিকে সবাই ভয় পায়। অসম্ভব রকম সম্মান করে পরিরানিকে।

পরিরানির কথা বলা শেষে শুরু হলো গান। তখনো সব পরি দাঁঁড়িয়ে। সকলেই একসাথে গান গাচ্ছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। পুষ্পর মনে পড়ে তারাও স্কুলে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে সুর করে গায়-
আমার সোনার বাংলা
আমি তোমায় ভালোবাসি॥
চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস
আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি॥
পরিরা কী গান গাইছে তা বুঝতে পারে না পুষ্প। সমস্বরে গাচ্ছে। গান শেষে জমে উঠল মজার উৎসব। বাঁশির সুর। নানা সুরের গান। হরেক রকমের নাচের আসর। এক বর্ণাঢ্য আয়োজন চলছে অবিরাম।

রাত সবে ভোর হলো। পরিদের নাচ-গানের আসর শেষ। শেষ হলো না পুষ্পর ভালো লাগা। তাই এতোক্ষণ যে ঘোরের মধ্যে ছিল, সে রকমই মুগ্ধতায় ডুবে থাকল। পাশেই আছে দাদুপরি। পুষ্পর দিকে কয়েকবার তাকিয়ে হাসল। হয়তো পুষ্পর ভালো লাগার ব্যাপারটা দাদু বুঝতে পারল।

দাদুপরি নিজেও এখন অন্য জগতে। স্থলপরির দেশ থেকে আকাশপরির দেশে। যদিও সেও পরি। কিন্তু আকাশপরিদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। নাচে-গানে আকাশপরিরা অন্যসব পরিদের থেকে আলাদা। তাদের মতো মন ভুলানো নাচ-গান পরিরাজ্যের আর কোথাও পাওয়া যায় না। দাদুপরির দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় তা জানে। মানতেই হয়।

আরও কিছুক্ষণ পর পুষ্পর ঘোর কাটল। শরীর আড়মোড়া দিয়ে দাদুপরির কোলের উপর ঢলে পড়তে গিয়ে ফের সোজা হয়ে বসল।
– দাদুপরি, এই পরিরা এত সুন্দর করে নাচ-গান করে।
– তোমার ভালো লেগেছে?
– চমৎকার।
– তাই।
– হুম।
– তুমি নাচতে জানো না, পুষ্পমণি।
– ভালো পারি না।
– তারপরও পারো তো?
– পরিদের মতো এত সুন্দর পারি না।

দাদুপরি পুষ্পর গালে আদর করে ছুঁয়ে দিয়ে বলল, সোনামণি, তুমি পরিদের মতো নাচবে কেন? তুমি নাচবে মানুষ পরিদের মতো।

দাদুপরির এ কথায় পুষ্প শুধু হাসল। কিছুই বলল না। বোঝা গেল সে খুব খুশি। দাদুপরি পুষ্পকে নিয়ে উঠতে যাচ্ছিল। হঠাৎ সেখানে হাজির হলো একদল সাদাপরি। তাদের সবার পোশাকগুলো ধবধবে সাদা। তাছাড়া সাদাপরিদের চুলও সাদা। চোখ সাদা। ভুরু সাদা। এ জন্য তারা সাদাপরি। সাদাপরির দল প্রথমে দাদুপরির সাথে দু’চারটা কথা বলল। তারপরই সবাই উৎসুক হলো পুষ্পর প্রতি। বোঝা গেল পুষ্পর জন্যই তারা এসেছে।

পুষ্পকে তিন-চারটা পরি ঘিরে দাঁড়াল। তাতে পুুষ্প ঘাবড়াল না। কারণ বেশকিছু দিন হলো পুষ্প পরিদের সাথে আছে। জলপরির দেশে থেকেছে। স্থলপরির বাড়িতে কয়েকদিন কেটেছে। আর আকাশপরির এখানেও এসেছে দু’দিন হলো। তাই পরিদের অনেক ব্যাপার-স্যাপার পুষ্পর জানা। তা ছাড়া দাদুপরি রয়েছে তার সাথে। সাদাপরিদের ভয় পাবার বিষয় মাথায় ঢুকলো না পুষ্পর।
– এতো দেখছি মানুষপরি সই! একপরি আরেক পরিকে চিমটি কেটে বলল। কথাটা পুষ্পর উদ্দেশে বলা তা সকলেই বুঝল। নিশ্চয়ই তোমরাও বুঝেছ ?
আর সব পরি হেসে লুটোপুটো খেয়ে একজন আরেকজনের শরীরের ওপর গড়িয়ে পড়ল। পরিদের এই হাসা-হাসি সম্পর্কে জানে পুষ্প। প্রথম থেকেই দেখে আসছে পরিরা কথায় কথায় হাসে। তাদের এই রিনিঝিনি হাসির শব্দে পুষ্পের মনেও হাসির ঢেউ ওঠে। কিন্তু ওদের মতো এতো হাসতে পারে না পুষ্প।

পুষ্প সুন্দরী বালিকা। এক কথায় পুষ্পর পিঠে দু’টো ডানা লাগিয়ে দিলে তাকে পরিদের সাথে পার্থক্য করা কঠিন ব্যাপার। তাই সাদাপরিদের একজন মানুষপরি বলে ভুল করেনি।
সাদাপরিরা পুষ্পকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। পুষ্প স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, তোমরা কি সাদাপরি?

– ওমা, মানুষপরি কেমন সুন্দর করে কথা বলে। বলল এক পরি।
– আমরা সাদাপরি, তুমি কী করে জানলে? বলল আরেক পরি।

পুষ্প দু’চোখ বন্ধ করল। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। তারপর চোখ খুলে দুষ্টুমির ভঙ্গিতে বলল, আমি বুঝতে পেরেছি, তোমরা সাদাপরি।
– ওরে সই এতো খুব বুদ্ধিমতী। বলল অন্য এক পরি।
-চল, আমরা ওকে নিয়ে বেড়িয়ে আসি। প্রস্তাব দিলো এক পরি।
-চল, চল তাই করি। বলল আরেক পরি।

সাদাপরিদের আবেদন পুষ্পকে নিয়ে বেড়াতে যাবে। দাদুপরি অমত করল প্রথমে। কিন্তু সাদাপরিরা দাদুপরিকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইল। তাই দাদুপরি, পুষ্প আর সাদাপরির দল আকাশপরির রাজ্য ঘুরে বেড়ানোর জন্য রাজি হলো। (চলবে)

৮.
পুষ্প কিছুক্ষণ আগে জানতে পেরেছে জলপরি, ফুলপরি, স্থলপরিরা বেড়াতে এসেছে আকাশপরির দেশে। শোনার পর থেকে ওর মধ্যে আনন্দের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। গতকাল সারাদিন ঘুরে বেড়িয়েছে। সারাপরিদের সাথে ঘুরতে ঘুরতে মজার অভিজ্ঞতা হয়েছে। দারুণ ভালো লেগেছে। আকাশপরির দেশটা যেন এক অন্য জগৎ! সাদাপরিরা তাকে অনেক জায়গায় নিয়ে গেছে। অনেক কিছু দেখিয়েছে। নীলপরি। লালপরি। হলুদপরি। সুখপরি। দুখপরি। এমন কী রানিপরির সিংহাসনেও গিয়েছে। তবে দেখা হয় নাই রানিপরির সাথে। রানিপরি নাকি খুব ব্যস্ত থাকে। পরিরাজ্যের সবকিছুই যে তাকে দেখাশোনা করতে হয়। সাদাপরিদের একজন খুব বেশি আদর করেছিল। গতকাল সারাদিনের মজাটাই ছিলো অন্যরকম। কত গান, কত আয়োজন, কত আনন্দ এই পরিদের জীবনে। সারাক্ষণ ঘুরে ঘুরেও ক্লান্ত হয়নি পুষ্প। পরিরা আসলে এক মজার প্রাণী। স্কুলে বিজ্ঞানের প্রাণিজগৎ অধ্যায় পড়াতে গিয়ে রবিউল স্যার বলেছিলেন, ‘প্রাণীদের মধ্যে মানুষ সবচেয়ে বুদ্ধিমান আর শ্রেষ্ঠ।’ পুষ্পর মনে হয় তাহলে প্রাণিজগতের সবচেয়ে মজার আর আনন্দময় প্রাণী হলো পরিরা। দুষ্টুপরির কথাও শুনেছে সে। দুষ্টুপরিরা মানুষদের ক্ষতি করে। পরশু রাতে যখন পুষ্প উৎসবে যাচ্ছিল তখন দুষ্টুপরির দল পিছু নিয়েছিল। দাদুপরি থাকায় বিপদ হয়নি। তাই সাদাপরিদের সাথে একা যেতে দেয়নি। দাদুপরিও গিয়েছিল।
– পুষ্পমণি, একেবারে শুয়ে পড়েছ?
দাদুপরির কথায় উঠে বসল পুষ্প। উল্লাসের সাথে জিজ্ঞেস করল, দাদুপরি, ওরা কোথায়?
– ওই তো আসছে?‘
পুষ্প সম্মুখে তাকিয়ে দেখল সত্যি সত্যি জলপরি, ফুলপরি আর স্থলপরি। পুষ্পকে দেখে সবাই হাসছে। হাসতে হাসতে জলপরি বলল, কেমন আছো সোনামণি?
ঘাড় বাঁকিয়ে জবাব দিলো পুষ্প, খুব ভালো।
স্থলপরি বলল, পরিদের এ রাজ্য কেমন লাগছে?
– ভারি সুন্দর। হেসে বলল পুষ্প।
ফুলপরি বলল, চল, আমরা ঘুরতে যাই।

ফুলপরির কথায় রাজি হলো পুষ্প। দুজনে হাত ধরে হাঁটছিল। ঠিক সেই মুহূর্তেই এক পরি এসে হাজির। পুষ্প একটু একটু চিনতে পারল পরিটিকে। কোথায় যেন দেখেছে বলে মনে হলো। হ্যাঁ মনে পড়েছে সেদিন পিছু নেয়া দুষ্টুপরিদের দলে এ পরিটিও ছিল। ভয় ভয় করতে লাগল পুষ্পর। পরিটি প্রথমে ফুলপরির কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত রাখল। পুষ্পর দিকে আড়চোখে তাকাল কয়েকবার। ফুলপরিকে বলল, চল তোমার বন্ধুকে নিয়ে বেড়িয়ে আসি। ফুলপরি তাতে রাজি হলো না। তাতে খুশি হলো পুষ্প। পুষ্প কিছু বলতে যাবে ঠিক সেই মুহূর্তেই একদল পরি উপর থেকে নামল। নেমেই ঘিরে ধরল ওদের। ঝটপট পুষ্পকে ধরে ফেলল। ফুলপরি কিছু বলার সময় পেল না। শাঁ-শাঁ, শোঁ-শোঁ শব্দে উড়ে গেল পুষ্পকে নিয়ে। পুষ্পর সামান্য চিৎকার শোনা গেল। তারপর নিমেষেই অদৃশ্য। ফুলপরি নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। খবর পেয়ে দৌড়ে এলো জলপরি, স্থলপরি, দাদুপরি এবং অন্য পরিরা। দাদুপরির মেয়ে ফুলপরির কাছ থেকে আক্রমণ করা পরিদের বর্ণনা শুনল। এ সময় জলপরিকে খুবই অস্থির দেখাল। মেয়েপরি তাকে শান্ত থাকতে বলল। দাদুপরির সাথে পরামর্শ করে এবং ফুলপরির বর্ণনা শুনে মেয়েপরি নিশ্চিত হলো এটা সেদিনের সেই দুষ্টুপরিদের কাজ।
ফুলপরি আরও বেশি মন খারাপ করে বসে রইল।

৯.
দুষ্টুপরিরা পুষ্পকে যেখানটায় নিয়ে গেল তার চারপাশে কোনোরকম পরির আনাগোনা নাই। চারিদিকে নীরব-নিঃশব্দ। পাঁচজন দুষ্টুপরি পুষ্পর সামনে দাঁড়িয়ে। পুষ্প সবার দিকে তাকাল। কারো মুখে কথা নাই। হাসি নাই। গম্ভীর চেহারা। পরিদের এমন ভাব এই প্রথম দেখল পুষ্প। দাদুর গল্প বলা সেই খারাপ পরিদের কথা মনে ভেসে উঠল। খারাপ পরিরা রাজকুমারীকে ধরে নিয়ে বন্দি করে রেখেছিল। অনেকদিন পর রাজকুমার তাকে উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। দাদুর সেই গল্পটা বেশ বড়। পুষ্প আজ সত্যিকারেই সেই খারাপ পরিদের কাছে বন্দি। পুষ্প আবারও তাকাল দাঁড়িয়ে থাকা দুষ্টু পরিদের দিকে। আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে। পুষ্পই মুখ খুলল, তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে এসেছ?

কেউ কোনো কথা বলল না। এমনকি নিজেদের জায়গা থেকে কেউ একটু নড়াচড়াও করল না। পুষ্প তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। সবাই নির্বিকার। খাট চেহারার এক পরি পুষ্পর মুখের দিকে তাকাল মাত্র। পুষ্প তার দিকে তাকিয়েই বলল, আমাকে তোমরা কেন ধরে এনেছ? খাট চেহারার দুষ্টুপরি গম্ভীর মুখে বলল, তোমার কোনো ভয় নাই। পুষ্প অস্থিরতার সাথে বলল, আমি বাড়ি যাব।

পুষ্পর কথা শেষ হতেই কে যেন বলে উঠল, অবশ্যই বাড়ি যাবে, আর আগে এখানে কিছুদিন থেকে যাও। পুষ্প ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে চাইল কে কথা বলল। কিন্তুু তার আগেই বিশালদেহী দুষ্টুপরিদের সর্দার পুষ্পর সামনে এসে দাঁড়াল। পুষ্প ভালো করে তাকিয়ে দেখল পরিটিকে। পরিতো নয় যেন আস্ত একটা ডাইনি। দাদির কাছ থেকে পুষ্প অনেক-অনেক গল্প শুনেছে। তার মধ্যে ডাইনি বুড়ির গল্প শুনে পুষ্পর খুব ভয় লেগেছে। ডাইনিরা নাকি ঘাড় মটকে রক্ত খায়!
ভয় পেয়েও নিজেকে শক্ত করে রাখল পুষ্প। ডাইনিপরির মুখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ়কণ্ঠে বলল না, তোমাদের এখানে থাকব না। তোমরা দুষ্টুপরি।
ডাইনিপরি পুষ্পর কথা শুনে জোরে হাসতে হাসতে বলল, তুমি তো দেখছি খুব সাহসী। পুষ্প কিছু না বলে ডাইনিটির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সর্দার ডাইনিপরি বিশ্রিভাবে হাসতেই থাকল। পরিদের হাসি এমন ভয়ানক হয় এবারই প্রথম দেখল পুষ্প। সর্দার গম্ভীর মুখে পাঁচ পরিকে উদ্দেশ করে বলল, এটা যেন তোদের ল্যাং মেরে উড়ে না যায়। যে সাহস দেখলাম ওর!

বাইরের পাহারা জোরদার করতে আর পুষ্পকে কিছু খেতে দিতে বলে সর্দার ডাইনিপরিটি পুষ্পর পেছন দিক দিয়ে চলে গেল। পুষ্প যে ভয়ানক বিপদের মধ্যে পড়েছে সে তা বুঝতে পারল। তবে ভয়ে অস্থির হলেও একেবারে চুপসে গেল না সে। পুষ্পর মনে পড়ল বাংলা ক্লাসে অহিদুল স্যার পড়িয়েছিলেন,

বল দেখি এ জগতে ধীর বলি কারে,
বিপদে যে স্থির থাকে, ধীর বলি তারে।

লাইন দুটি বারবার আবৃত্তি করেছিলেন স্যার। আর নিজের বিপদের সময় কিভাবে স্থির থেকে বিপদকে জয় করেছেন তা সুন্দর করে বলেছিলেন। পুষ্পও তাই নিজের অস্থিরতা কাটিয়ে স্থির হতে চাইল। এ বিপদকে জয় করতেই হবে। এখন প্রয়োজন উপস্থিত বুদ্ধির। পুষ্প চারপাশ ভালো মতো দেখে নেয়। এখান থেকে পালানোর কোন পথ আছে কিনা। আপাতত আশপাশে কেউ নাই। গম্ভীর পরিরা হয়তো সর্দারের কথা মতো বাইরে পাহারা দিতে গেছে। পুষ্প যেখানে বসেছিল সেটা একটা কাঠের চেয়ারের মতো মনে হলো। কিন্তু আসলেই ওটা কাঠের তৈরি কিনা সন্দেহ হলো পুষ্পর। পাশেই কিছু ফলমূল রাখা আছে একটা টুলের ওপর। পুষ্পর খুব ক্ষুধা পেয়েছে। তবু কিছু খেলো না। চারপাশটা ভালভাবে দেখতে লাগল।

ইতোমধ্যেই সাদাপরির দল দাদুপরির কাছে এসে হাজির হল। তারাও সন্দেহ করল এটা ওই দুষ্টুপরিদের কাজ।
– আর দেরি করা যায় না, চলো রওনা হই। বলল জলপরি।
– ঠিকই বলেছো। বলল স্থলপরি।
– দেরি হলে সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। বলল এক সাদাপরি।
– ওরা খুবই দুষ্টু। মানব সন্তান পেলে মেরে ফেলতে চায়। বলল মেয়েপরি।
– মানুষের ওপর কি ওদের খুব রাগ? জিজ্ঞেস করল ফুলপরি।
– হবে হয়তো। জবাব দিল দাদুপরি।

খবরটি রানিপরির কাছেও পৌঁছে গেছে। আগে থেকেই দুষ্টুপরিদের প্রতি ভীষণ রাগ রানির। কারণ এই দুষ্টুপরিরা দিনের পর দিন পরিরাজ্যে অশান্তি ডেকে আনছে। উৎসবের দিনেও তাদের জন্যই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হয়। গুটি কয়েক নষ্ট পরির জন্যই যত ঝামেলা। দু-একটি দুষ্টুপরিকে যে শাস্তি দেয়া হয়নি, তাও বলা যায় না। কিছুদিন আগেও একপরিকে রাজ্য থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপরও তারা সুযোগ পেলে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। রানিপরি সৈন্যপরিদের ডাকল। দুষ্টুপরিদের হাত থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করার নির্দেশ দিলো। সেই সাথে দোষীদের শাস্তি দেওয়ার আদেশ করল রানি।

রানির আদেশ পেয়ে সৈন্যপরিগণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অভিযান পরিচালনার জন্য সিনিয়র এক সৈন্যকে প্রধান করে টিম গঠন করা হলো। পরিরাজ্যের কোথায় কোথায় দুষ্টুপরিদের আস্তানা থাকতে পারে তা খুঁজে বের করার পরিকল্পনা করল সৈন্যপরির দল।
সৈন্যপরিদের অভিযানের কথা শুনে খুশি হলো দাদুপরি। শুরু হলো দুষ্টুপরিদের হাত থেকে পুষ্পকে উদ্ধারের চেষ্টা।

১০.
পুষ্প কিছু খেয়ে-দেয়ে দেখল দুষ্টুপরিরা ঘুমোচ্ছে। একবার ভাবল সে দৌড়াবে। কিন্তু পরেই চিন্তা করল, দৌড়ালে এখান থেকে সে যেতে পারবে না। একে তো পথ চেনা নাই। তারপর ওরা টের পেলে ধরে আনতে বেশি সময় লাগবে না। পায়চারি করতে করতে মনে হলো নিশ্চয় দাদুপরিরা তাকে খুঁজতে বেড়িয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো, এখানে যে সে আছে তাদের তো জানা নাই। এ দিকটায় আসলেও হয়তো টের পাবে না। কারণ এটা একটা গুপ্ত আস্তানা। অনেকটা গুহার মতো। একটা মাত্র পথ আছে এখান থেকে বের হওয়ার। আর বের হওয়ার পথটা পেরুলেই ফাঁকা জায়গা। পুষ্পর ভাবনা দাদুপরিরা বড়জোর ওই ফাঁকা জায়গা পর্যন্ত এসে ফিরে যাবে। কারণ ওখান থেকে এই গুপ্ত আস্তানার অস্তিত্ব টের পাওয়া খুবই কঠিন।

হঠাৎ পুষ্পর মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। ওই ফাঁকা জায়গা পর্যন্ত তাকে যেতে হবে। যত সময় সম্ভব হয় ওখানটায় অবস্থান করবে। তারপর দুষ্টুপরিরা টের পেলেও অসুবিধা নাই। পুষ্প তার মাথার ক্যাপটা ফেলে রেখে আসবে। ভাগ্য ভালো হলে দাদুপরির দল এদিকে আসলে ক্যাপটা চোখে পড়লেই চিনতে পারবে। তখন নিশ্চয়ই অভিযান চালিয়ে এই গুহার খোঁজ তারা বের করবেই।

পুষ্প দেখলো আস্তানা থেকে বের হওয়ার পথে যে দুষ্টুপরিটা রয়েছে, সে আসলে ঘুমিয়ে আছে। সুযোগ পেয়ে পুষ্প ওর পাশ দিয়ে আস্তে করে বেরিয়ে গেল। অনেকটা এগিয়ে গিয়ে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াল। কিছু সময় পর দুষ্টুপরিরা টের পেয়ে পুষ্পকে ভেতরে নিয়ে গেল। যাবার সময় পুষ্প সবার অগোচরে মাথার ক্যাপটা ফেলে রাখল।
ভেতরে গিয়ে দেখল বিশালদেহী সর্দার মতো দাঁড়িয়ে আছে। দুষ্টুপরি পাঁচজনকে আচ্ছামতো গালাগালি করল। দুষ্টুরা গম্ভীর মুখে শুধু শুনেই গেল। যেন সর্দারের বিরুদ্ধে তাদের কিছুই বলার নাই। সর্দার পুষ্পর কাছে এসে ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করল, কেন বাইরে গিয়েছিলে?
– এমনি। স্বাভাবিকভাবে জবাব দিলো পুষ্প।
– এমনি কেন? আরও জোরে বলল ডাইনিটা।
– এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো, তাই ।
– দম আটকে গেলেও এখানেই থাকতে হবে।
– না, থাকব না। জেদের সুরে বলল পুষ্প।
বলার সাথে সাথেই ডাইনিপরিটা খুব জোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো পুষ্পর গালে। মাথা ঘুরে পড়ে গেল পুষ্প। সর্দার সেদিকে না তাকিয়ে দুষ্টুপরিদের সতর্ক করে দিয়ে চলে গেল।

১১.

সৈন্যপরির দলসহ দাদুপরিরা সমস্ত পরিরাজ্য তন্নতন্ন করে খুঁজে এদিকটায় চলে এসেছে। ফাঁকা জায়গাটিতে জড়ো হয়েছে সবাই। কেউ কেউ বলছে এদিকে কোনো আস্তানা নাই। কেউ কেউ বলছে থাকতেও পারে। হঠাৎ দাদুপরির চোখে পড়ল পুষ্পর ফেলে রাখা ক্যাপটা। ফুলপরি দৌড়ে ক্যাপ হাতে নিয়ে বলল, এটা দেখছি পুষ্পর ক্যাপ। সবাই অনুমান করল হয়তো আশপাশে কোথাও পুষ্পকে আটকে রাখা হয়েছে।

টিমের প্রধান পরি সৈন্যপরিদের চারিদিক ভালো ভাবে তল্লাশি করার নির্দেশ দিলো। সৈন্যদের আরও নির্দেশ দিলো, কোনো রকম গুপ্ত আস্তানার নিশানা টের পেলেই যেন তার কাছে সংবাদ পাঠানো হয়। সৈন্যরা চলে গেলে জলপরি, স্থলপরি, দাদুপরি, ফুলপরি, মেয়েপরিরা টিম প্রধানের পাশাপাশি পায়চারি করতে লাগল। দু-একটা শলা-পরামর্শও করছে তারা। ইতোমধ্যে এক সৈন্যপরি এসে জানাল দুষ্টুপরিদের আস্তানার সন্ধান পাওয়া গেছে।
সৈন্যপরি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ওই পাশটায় একটা সরুপথ অনেক দূর পর্যন্ত চলে গেছে।
টিম প্রধান বলল, দেখে কেমন হয়। কোন পরিদের যাতায়াত আছে বলে কি আন্দাজ করা যায়?
– যায় বলেই অনেকটা শিওর হয়েছি।
– হুম। ঘাড় নাড়ল টিম প্রধান।
– সৈন্যরা আদেশের অপেক্ষায় আছে। বলল সৈন্যপরি।
– দশ-বারোজনকে ভেতরে ঢুকে পড়তে বল, বাকিরা চারিদিকে পাহারায় থাকুক। ওরা যেন পালাতে না পারে। সৈন্যপরি আদেশ নিয়ে চলে গেল।

সৈন্যপরিদের উপস্থিতি টের পেয়ে গুহাপথ আটকে ফেলেছে দুষ্টুপরির দল। প্রবেশপথ থেকে ফিরে সৈন্যপরিরা বড় বড় পাথর নিয়ে আটকানো দরজায় আঘাত করতে লাগল। দরজা ভাঙতে খুব বেশি দেরি হলো না। তাড়াতাড়ি করে ভেতরে ঢুকল দশ-বারোজন সৈন্যপরি। প্রথমেই দুষ্টুপরিদের বেঁধে ফেলল। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে ঢুকল ডাইনিপরির গোপন কক্ষে। ততক্ষণে প্রধানসহ পুরো টিম ভেতরে ঢুকে পড়েছে। ডাইনিটাকে শক্ত করে বেঁধে সবগুলো দুষ্টুপরিকে একসাথে করল। পুষ্পকে ডাইনিটার ঘরেই পাওয়া গেল অচেতন অবস্থায়। জলপরি, দাদুপরি, দুজনে জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করল পুষ্পর। অল্প সময় পরেই পুুষ্প জেগে উঠল। সৈন্যপরিদের প্রধান পুষ্পকে দেখে গেল। দুষ্টুপরিদের রানির কাছে পাঠানো হবে। রানিপরি নিজে ওদের শাস্তি ঘোষণা করবে। দাদুপরিসহ সবার কাছ থেকে সৈন্যদল বিদায় নিলো। ফুলপরি পুষ্পর গলা জড়িয়ে ধরল। স্থলপরি বলল, তুমি কি খুব ভয় পেয়েছ, পুুষ্প?
– খুব বেশি না।
– তাই। একসাথে উপস্থিত সব পরি হেসে উঠল।
দাদুপরি পুষ্পর মাথায় হাত রেখে বলল, পুষ্পমণি, বাড়ির কথা মনে পড়ছে না?
পুষ্প বলল, খুব মনে পড়ছে। দাদুপরি, মেয়েপরি, স্থলপরিসহ উপস্থিত সবাই পুষ্পকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার জন্য জলপরিকে অনুরোধ করল। ফুলপরি বারবার চোখ মুছল। বায়না ধরল পুষ্পকে রেখে আসতে সেও যাবে। সে তো এখন আর কম উড়তে পারে না।

জলপরির পিঠে চড়ে উড়ে যাচ্ছে পুষ্প। বহুদিন ধরে ফেলে আসা বাড়ির পানে উড়ে চলছে। আকাশপরির দেশ থেকে সাত-সমুদ্র তেরো-নদী। পাহাড়-পর্বত-অরণ্য পেরিয়ে ছুটে চলছে। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। এক সময় পুষ্পর মনে হলো তার হাত আলগা হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে পিঠের উপর থেকে সরে যাচ্ছে সে। জলপরির সে দিকে খেয়াল নাই। সে শুধু শাঁ-শাঁ শব্দে সামনে এগিয়ে চলছে। পুষ্পর হাত খুব বেশি আলগা হয়ে গেল। জলপরির পিঠ থেকে খসে পড়ল পুষ্প। সে যেন শোঁ-শোঁ করে নিচের দিকে গভীর অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। আর মা মা করে চিৎকার করছে।

পুষ্পর মা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলেন, পুষ্প কী হয়েছে রে?
পুষ্প কেঁদে-কেঁদে, কেঁপে-কেঁপে বলল, মা পরিরা কই?
মা হাসতে হাসতে বললেন, কি যা-তা বলছিস?
-সত্যি মা, জলপরি, ফুলপরি, স্থলপরি, দাদুপরি, আরও কত পরি।
-পুষ্প তুই কি স্বপ্ন দেখছিলি।
ঘুমঘুম কণ্ঠে জড়তা নিয়ে পুষ্প বলল, ক-ই, ক-খ-ন!

সমাপ্ত

নুরুল ইসলাম বাবুল
সহকারী শিক্ষক
বিলচান্দক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফরিদপুর, পাবনা।
মোবাইল নম্বর: ০১৭১৪ ৫৫৯৪০৩

Share.

মন্তব্য করুন