ছয়টি ঋতুর দেশ আমাদের বাংলাদেশ। ঋতুর পরিক্রমায় বাংলাদেশে এখন গ্রীষ্মকাল। গ্রীষ্মকাল বাংলা মাসের প্রথম ঋতুু। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মিলে এ দুই মাস গ্রীষ্মকাল। বৈশাখ শেষে বাংলার প্রকৃতিতে এখন জ্যৈষ্ঠের উপস্থিতি। সূর্যের প্রখর তাপে হাওর-বাওড়, নদীর জল শুকিয়ে মেঘ জমাট বাঁধে বর্ষার প্রস্তুতি সাজে। গ্রামবাংলার পথে প্রান্তরে শোভা পায় সোনালু ফুল। চারদিক টসটসে লালে ছাপিয়ে দেয় লীলাবতী কৃষ্ণচূড়া! এই দুই ফুলের নয়নকাড়া সৌন্দর্য জ্যৈষ্ঠকে করে আরও মনভোলানো। সাজো সাজো মহিমায় প্রকৃতির আনাচে-কানাচে ভরে ওঠে নানা জাতের বাহারি সুস্বাদু ফলে। এমন ফলের অধিক সরবরাহ থাকায় সবার কাছে মাসটি ‘মধুমাস’ নামেই পরিচিত। উল্লেখ্য, জ্যৈষ্ঠ মাস মধুমাস, ফলের উৎসবের মাস। পাকা জামের মধুর রসে মুখ রাঙা করার মাস জ্যৈষ্ঠকে তাই মধুমাস বলা হয়। এ মাসে ফলের রাজা আম, মুখ রাঙানো জাম, আমাদের জাতীয় ফল কাঁঠাল, লিচু, তরমুজ, আতা, আনারস, ফুটি, জামরুল, গোলাপজাম, লটকনসহ আরও কত রকমের ফল পাওয়া যায়। শহর-বন্দর-গ্রামে যেখানেই যাই দমের হাওয়ায় মিষ্টি একটা গন্ধ পাই। যা প্রাণকে সুবাসিত আবেশে ভরিয়ে তোলে। রসালো ফলের সহজলভ্যতার কারণে জ্যৈষ্ঠ মাস তাই মধুমাস। ইতিহাসের পাতা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, অন্যান্য বাংলা মাসের মতো জ্যৈষ্ঠেরও নামকরণ হয়েছে তারার নামে। সে তারার নাম ‘জৈষ্ঠা’ সাতাশ তারার মধ্যে আঠারোতম। এ মাসের বিশিষ্টতা হলো, একদিকে প্রকৃতি তেতে ওঠে, গরমে কাতর হয় সকলে। অন্যদিকে উদার প্রকৃতি মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য নানারকমের পসরা সাজিয়ে রাখে। এভাবেই আমাদের মানসিক পরিতৃপ্তি সাধন করে। রসনা পরিতৃপ্ত হয়। জ্যৈষ্ঠের প্রকৃতি আগে-ভাগেই ডালি সাজিয়ে রেখেছে দেশীয় রসালো ও সুস্বাদু আম, লিচু, কাঁঠাল, কালো জাম, আনারস, করমচা, জামরুল, আতা, তরমুজ, ফুটি, বাঙ্গি, বেল, খেজুর ইত্যাদি দিয়ে। গ্রামীণ কৃষক বলি আর শহুরে নাগরিক, বাঙালির কাছে এসব ফলের কদর কত তা কি-না চিরকালই অনির্ণীত থেকে যাবে। এখন ফলে ফলে ভরে আছে তরু শাখা থেকে বিপণি বিতান পর্যন্ত। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের আবহাওয়া উষ্ণপ্রধান। এ দেশে তাপমাত্রা সাধারণত ১০ থেকে ৩২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে থাকে। বছরব্যাপী কম-বেশি বৃষ্টিপাত হয়। গ্রীষ্মের পর থেকে বৃষ্টি শুরু হয় যা, পুরো বর্ষাকালজুড়ে বজায় থাকে। বর্ষার পর বর্তমানে শরতেও প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। এ জন্য শরৎ-হেমন্ত ঋতুকে এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এ দেশের মাটি উর্বর। তাই অনেক ধরনের ফল এ দেশে জন্মে। তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত অনুকূলে থাকলে সে বছর বিভিন্ন ঋতুতে প্রচুর ফল উৎপাদন হয়।

এ দেশে বেশির ভাগ ফল উৎপাদিত হয় গ্রীষ্ম-বর্ষাকালের চার মাসে। ফাল্গুনে আমসহ অনেক ফলগাছে ফুল আসে, বৈশাখ থেকে বৃষ্টির বারিধারায় মাটি সিক্ত হয়, তাপদাহ শেষে জলের পরশে ফলের পরিপুষ্টি ঘটে। জ্যৈষ্ঠে তাপ বৃদ্ধিতে পুষ্ট ফলের ভেতরে টক অম্ল মধুর রসে পরিণত হয়। ফলের খোসার রঙ বদলে যায় ও ফলে মিষ্টতা আসে। যেসব কারণে গ্রীষ্ম ঋতুতে জন্মানো প্রায় সব ফলই হয় মিষ্টি, সুঘ্রাণযুক্ত ও সুদর্শন। হয়তো ফলরসিকরা এ জন্য গ্রীষ্ম ঋতু বিশেষ জ্যৈষ্ঠ মাসকে ‘মধুমাস’ নামে অভিহিত করে থাকেন। গ্রীষ্ম বলা হলেও আসলে এ মৌসুমে উৎপাদিত অনেক ফলের বিস্তৃতি থাকে বর্ষাকাল পর্যন্ত। নাবি জাতের আম বর্ষা ঋতু এমনকি ভাদ্র মাস পর্যন্ত পাওয়া যায়। অথচ আম জ্যৈষ্ঠ মাসের প্রধান ফল। এ দেশে উৎপাদিত ফলের প্রায় ৬০ শতাংশ উৎপাদন হয় বৈশাখ থেকে শ্রাবণের মধ্যে অর্থাৎ চার মাসে। বাকি ৪০ শতাংশ ফল উৎপাদিত হয় বাকি আট মাসে। এ জন্য জ্যৈষ্ঠ মাসকে বলা হয় ফলের মাস। তাই জ্যৈষ্ঠ মাসে এ দেশে পেয়ারা, পেঁপে, কলা, নারিকেল, সফেদা, তালশাঁস, লেবু, আম, কামরাঙা, ড্রাগন ফল, ডেউয়া, জাম, কাঁঠাল, তৈকর, প্যাশন ফল, কাজুবাদাম, গোলাপজাম, বাঙ্গি, চুকুর, লিচু, আঁশফল, তরমুজ, ফলসা, করমচা, গাব, হামজাম, বৈঁচি, লুকলুকি, জামরুল, গাব, বেতফল, মুড়মুড়ি, খেজুর, ননিফল, আতা, শরিফা ইত্যাদি ফল পাওয়া যায়। ফলের মাসে এ পল্লীবাংলার ঘরে ঘরে বসে নানা রকম ফলাহারের আয়োজন। জ্যৈষ্ঠ মাসে হয় জামাই ষষ্ঠী অনুষ্ঠান যে অনুষ্ঠানের প্রধান উপকরণ নানা রকমের প্রচুর ফল। গ্রামের হিন্দু রমণীরা বৈশাখ মাসজুড়ে নানা রকম ব্রত পালন করেন। এসব ব্রতের অন্যতম অনুষঙ্গ নানা রকম ফল। বাড়িতে বাড়িতে এ ঋতুতে তৈরি করা হয় ফল থেকে নানারকম খাদ্যসামগ্রী। চাঁপাইনবাবগঞ্জে পাকা আমের গোলা দিয়ে যবের ছাতু খাওয়া, গাজীপুরে পাকা কাঁঠালের গোলা দিয়ে চিতোই পিঠা খাওয়া, আমসত্ত্ব বানানো, আমের পলশি শুকানো ইত্যাদি এ দেশের অন্য এক ফল সংস্কৃতির স্বাক্ষর বহন করে। বাঙালির চিরায়ত রীতি অনুযায়ী জ্যৈষ্ঠ মাসেই মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনিকে ফল দিয়ে আদর-আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে থাকেন গ্রামে বাস করা বাবা-মায়েরা। লেখাপড়া, চাকরি কিংবা ব্যবসার কারণে যারা শহরে থাকেন, তারাও গ্রামে ফেরেন মধুমাসের মধুর রসে মুখকে রাঙিয়ে তুলতে। আবার অনেক সময় দেখা যায় মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনি না আসতে পারলেও তাদের জন্য ফল পাঠিয়ে দেয়া হয়। এ সময় দেশী ফলের উৎপাদন অনেক বেড়ে যায়। কমবেশি সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে। অন্যদিকে ফল পচে অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে এ আশঙ্কায় অনেক অসাধু বিক্রেতা ফলকে তাজা দেখাতে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে, যা মানব শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ অপতৎপরতা বন্ধে সবাইকে সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি শরীর গঠনে দেশী ফল পুষ্টিমানের দিক দিয়ে বিদেশী ফলের চেয়ে অনেক ভালো। অনেকে অসচেতনতার কারণে বিদেশী ফলকে প্রাধান্য দিলেও তাদের এ ধারণা ভুল। সব শেষে এ কথাটিও মনে রাখতে হবে, আমাদের বিভিন্ন কর্মকা-ের ফলে দেশের অনেক অপ্রচলিত ফল হারিয়ে যেতে বসেছে। দেশী জাতের ফল সংরক্ষণের মাধ্যমে দেশীয় ঐতিহ্য ধরে রাখাও আমাদের কর্তব্য ও দায়িত্ব। এখন প্রকৃতিতে রঙ বাহারি ফলের মৌ মৌ গন্ধে ভরে আছে চারপাশ। গাছে গাছে সবুজ কচি পাতার ফাঁকে দোল খায় সিঁদুর রাঙা আম, জাতীয় ফল কাঁঠাল। পাকা আম-কাঁঠালের বর্ণময় শরীর দেখে চোখ জুড়ায়, মনভরে ও খেলে স্বাদ মেটে। থোকায় থোকায় গাছের শাখায় কী সুন্দর! দোল খায় কালো জাম।

আমাদের পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের ‘মামার বাড়ি’ কবিতায় ‘ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ/পাকা জামের শাখায় উঠি, রঙিন করি মুখ।’ সত্যিই, জামের ডাল ধরে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে জাম পাড়তে কার না সুখ হয়? মধুমাসের ফলগুলোর মধ্যে অন্যতম স্থান দখল করে আছে লিচু। ‘লিচুচোর’ কবিতাটি আমরা সবাই-ই পড়েছি তাই না? ‘… পুকুরের ঐ কাছে না/ লিচুর এক গাছ আছে না…।’ লিচু ফলটি গন্ধ ও স্বাদের জন্য সবার কাছে খুবই জনপ্রিয়। আরও আছে সাদা, লালচে সাদা দেশি জাতের জামরুল। এ ফলও জ্যৈষ্ঠের তৃষ্ণা মেটায়। গাঢ় সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে বাতাসে দোল খাওয়া থোকায় থোকায় জামরুল দেখলেই মনটা ভরে যায়। সত্যি কথা বলতে কি, ছয় ঋতুর বাংলাদেশ যার রূপের শেষ নেই। জ্যৈষ্ঠ তার মধুর রসে বাঙালিকে দেয় প্রাণ সঞ্জীবনী। আর তাই তো জ্যৈষ্ঠ হলো মিষ্টি ফলের রসে ভরা মধুমাস।

Share.

মন্তব্য করুন