বাড়িতে কেউ এলে ডোর বেলটি বেজে ওঠে- ডিং ডিং ডিং। মিষ্টি মিষ্টি সুরে যেন বলে, আমি এসেছি- এসেছি। হ্যাঁ, কেউ এলে তো এাঁ বাজবেই, ও আমি ভালো করেই জানি।
মনে মনে বলি, বেশ করেছো- এসেছো। মা-বাবা ভাইয়া নয়তো কাজের ছেলে রতন দরজা খোলে। আমি তো খুলতে পারি না- সবার চেয়ে ছোট যে, শুধু তাকিয়ে থাকি, পলিথিনে ঝুলানো বাক্সের দিকে তাকাই। হাততালি দিয়ে বলি, মিত্তি মিত্তি।
ভাইয়া হা হা করে হাসে। চেঁচিয়ে বলে, ধুর বোকা, মিত্তি নয়। বলো, মিষ্টি মিষ্টি।
ঐ হলো, বড় হলে আমিও সব তোমাদের মতো ঠিকঠিক বলতে পারব। এখন তো মিত্তি খাওয়া। পেট ভরে এখন মিত্তি খাব।
আমি মায়ের হাতের বাক্সের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ি।
গম্ভীর গলায় বাবা বলেন, ভেরি ব্যাড, ভেরি ব্যাড। খুব খারাপ।
আমার ছোট্ট বুকের ভেতরটাতে কান্না জমতে থাকে। সবকিছুতে গম্ভীর হওয়া, সবকিছুতে ধমক। বড়রা একটু মিষ্টি করে কথা বলতে পারে না? আর খারপটাই বা কিসে হলো? খাব না আমি? কেউ নিয়ে আসে টফির প্যাকেট, কেউ বিস্কিট, কেউ বা সন্দেশ। সব কিছুই আমার ভালো লাগে।
বাড়িতে সারাটা দিন রান্না হয়। কড়াইর মাঝে চড়চড় করে তেল, মাছ ভাজার ছ্যাঁক ছ্যাঁক শব্দ হয়, রান্নাঘর থেকে চিকন ধোঁয়া উড়ে আসে। বিচ্ছিরি লাগে, ভারি বিচ্ছিরি। ওসব আমি খেতেও চাইনি। আমি মন খারাপ করে বসে থাকি। ছোট্ট ধবধবে মিনি বেড়ালটা পাশে বসে ডাকতে থাকে- মিয়াও মিয়াও। একটানা আওয়াজে বলে, অভি-অভিষেক মন খারাপ করো না। আমাকেও তো কেউ ভালো করে খেতে দেয় না। পাতের নিচের কাঁটাকুটো, তাই খেতে গেলেও সবাই তাড়া করে।
আমি মিনি বেড়ালের গোঁফের দিকে তাকিয়ে থাকি। বারান্দার এক কোণ থেকে লেপচু কুকুরের আওয়াজ শুনি। ঘেউ ঘেউ। গলায় ওর চওড়া বেল্ট। যত্ন করে সাবান দিয়ে রতন ওকে রোজ ধুইয়ে দেয়। সাদা ধবধবে পশমে ঢাকা ওর সারা শরীর। টমির জন্য রোজ মাংশ রাঁধা হয়, ও গব্গব্ করে খায়। ভারি আনন্দে আছে ও।
মিনি বেড়ালটির জন্য আমার কান্না পেতে থাকে। আসলেই তো, টমির মতো ওকে কেউই ভালবাসে না। ছোটকাকু দারুণ ভালো। বলে, অভিকে শুধু পরিজ আর ডিম সেদ্ধ দিয়েছ কেন? চম্চম্ আর রসগোল্লা দাও।
আমার মা, কুন্তলা যার নাম, বলেন, দু’টো মিষ্টি খেলে অসুখ করবে নাকি! খাও বাবা একটাই খাও, লক্ষ্মী ছেলে।
প্লেটে মা রসে ডোবা টুসটুসে রসগোল্লা টুপ করে ফেলে দেন।
মা চামচ দিয়ে রসগোল্লা অল্প করে কেটে আমার মুখে দিতে দিতে বলেন, খাও- এমনি করেই খেতে হয়। খাও তো দেখি সোনা।
ও মা! ভীষণ রাগ হয় আমার। ওভাবে খেলে তো ফুস্ করতেই ফুরিয়ে যাবে। মায়েরা খামোখাই বড় হয়েছে। কেন বুঝতে পারেন না- রসগোল্লা চুষে চুষে রস খেতেই মজা। তারপর একটু একটু করে অনেকক্ষণ ছানা খাব। নাহ্, গব্গব্ করে রাক্ষসের মত খেতে হবে।
আসলে বড়রা ভীষণ বোকা। অভির মত অনেক কিছু ওরা বুঝতে পারে না। ওরা কোনদিনও ছোট হবে না, তাই তো অনেক কিছু বুঝতেও পারবে না আর। ছোটকাকুই আমার বড় প্রিয়। বাড়িতে ঢুকেই আমার গোটা শরীরটাকে লুফে নেয়। মুখে বলে, কি রে আগামী দিনের নাগরিক, ভালো আছিস তো!
কাকুকে গুছিয়ে বলতে পারি না- আমি একটুও ভালো নেই কাকু। তুমি এসেছ এই তো ভালো হয়ে গেছি। এখন একদম ভালো।
আগামী দিনের নাগরিক- কথাটি আমার কানে মিষ্টি মিষ্টি সুরে বাজে। ঠিক জলতরঙ্গের মতো। মনে হয়, আমি যেন বকুল বনে বসে আছি।
আগামী দিন, আগামী দিন- ঠোঁট নেড়ে আমি আস্তে আস্তে উচ্চারণ করতে থাকি। বড় মামা ঠা ঠা করে হাসতে হাসতে বলেন, ডালকে বলো দাল, রুটিকে বলো উটি, মাছকে বলো মাস। আগামী দিন কথাটি আর বলতে হবে না। বড় হও, তাহলে এমনিই শিখবে।
ঠিক আছে, আমি তো জোরে জোরে বলছি না। মনে মনে বলি- আগামী দিন, আগামী দিনের নাগরিক। বড়মামা মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসেন। ঢুকেই আমার মাথার কোঁকড়ানো চুলগুলো নেড়েচেড়ে এলামেলো করে দেন। বলেন, কি রে ইডিয়ট। কখনও আবার বলেন, কিরে রাসকেল, ভালো আছিস তো? মনে মনে দারুণ রাগ হয় আমার। ওগুলো তো ভালো কথা নয়, বাজে কথা। আগামী দিনের নাগরিককে কেউ ওসব কথা বলে?
ভাবতে গিয়ে বড় ভালো লাগে আামর। আগামী দিনগুলো বুঝি ভারি চমৎকার। গাছে গাছে ফুলের মেলা। মিষ্টি গন্ধে চারদিক ম’ ম’ করবে। ছোট কাকু প্রায়ই বাড়িতে ফুলের তোড়া নিয়ে আসেন। জল ভরা কাচের জারে ফুলের ডাঁটাগুলো ডুবিয়ে বলে, এগুলো ফুল না আরো কিছু, ধ্যেৎ, একটুও গন্ধ নেই। দ্যাখ দ্যাখ অভি, আগামী দিনগুলোতে ফুলের তোড়াগুলো দেখিস মিষ্টি গন্ধে আবার ভরে উঠবে।
এক এক সময় বাবা-মাকে এতো ভালো লাগে আমার! সবার কথা ওরা ভাবেন, সবার দুঃখে মন খারাপ করেন। সবাই বলে, অভির মা, অভির বাবা। আমার মা-বাবা তো তাই ওরা ভীষণ ভীষণ ভালো!
বাবা চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলেন, নাহ, পত্রিকাটি হাতে নিলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। রোড এ্যাক্সিডেন্টে কতজন মারা গেছে জানো?
‘ক’জন গো?’
বাবার গম্ভীর গলা- ‘বারো জন।’
মা দুঃখী দুঃখী গলায় বলেন, ‘ইস, কী খারাপ লাগছে।’
মা-বাবার কথাগুলো শুনে মনটা কখন ভিজে যায়; তক্ষুণি রান্নাঘরে শোরগোল ওঠে।
‘কি কি, ব্যাপার কি?’
অভির বেড়ালটি চার টুকরো রুই মাছ ভাজা খেয়ে নিয়েছে। শুধু কি একদিন? ও তো হর-হামেশা চুরি করে এটা ওটা খায়। সেদিন এক বাটি দুধে মুখ দেয়নি?
অতএব তাড়াও ওকে।
বাবা-মা-রতন সবাই ওকে ধরতে ছুটোছুটি করে। আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। কিছুই বলার নেই আমার। বাবা শিখিয়েছে, বড়দের কাজে ছোটদের কথা বলতে নেই।
বেশ ঠিক আছে, আমি একদম কথা বলব না। কিন্তু বেড়ালটি অমন করে আমার দিকে তাকি তাকিয়ে আছে কেন? ও চেনা বাড়িটি ছেড়ে যে যেতে চাইছে না। বুকের ভেতর থেকে রাশি রাশি কান্না গলায় এসে আটকে থাকে। চোখের কোল ভারি হয়ে আসে। কেউ আমাকে দেখে না, বস্তাবন্দি বেড়ালটিকে নিয়ে সবাই ব্যস্ত। রতন লাফিয়ে লাফিয়ে ওকে ফেলতে অনেক দূরে চলে যায়।
সে রাতে আমি দুধ-পাউরুটি, ডাল-ভাত-মাছ কিছুই খাইনি। কেউ বুঝতে পারল না- বেড়ালটির জন্য আমার বুকের ভেতরটাতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে। বাবা গমগমে গলায় বললেন, খাবে না কেন, শরীর খারাপ? হবে না? গারাদিন খালি কোক আর চিপস্ খাওয়া।
মা কপালে-গলায় আদুরে হাত বুলিয়ে বলেন, কি হয়েছে রে অভি? জ¦র? আই তো, কি হলো রে?
আমার কি হয়েছে বড়রা কেউ বুঝবে না। মিনি বেড়ালটার জন্য বুকের ভেতরটা টনটন করছে। মন খারাপের এই দিনগুলোর মাঝে জন্মদিন এলো। হঠাৎ করেই আমি হেসে উঠি। আকাশ বাতাস, গাছের সবুজ পাতা, রঙিন ফুল, মাটিতে মুখ লুকিয়ে থাকা দূর্বাঘাস সবাই কলকল করে বলে ওঠে, জন্মদিন। অভি, শুভ জন্মদিন।
এই কথাগুলো বড়রা কেউ শুনতে পায় না। শুধু আগামী দিনের নাগরিক, আমি শুনতে পাই। ফুরফুরে বিকেলে বন্ধুরা আসে। আমি চিকন কাজের নকশা করা জামা পরি। ঝকঝকে কাগজের মোড়কে অনেকে আমাকে উপহার দেয়। উড়োজাহাজের মতো কেকটি কাটা হয়। আমার নাকে-ঠোঁটে ক্রিম লেগে একাকার হয়ে যায়।
সবাই হাসতে থাকে, অভিকে মিনি বেড়ালের মতো দেখাচ্ছে। এইরে, বেড়ালের মতো গোঁফ হয়েছে তোমার।
বুকের ভেতরটা এই হাসিখুশির মাঝেও টনটন করে ওঠে। মিনি বেড়ালটা কোথায় আছে এখন? ও কি খেতে পাচ্ছে? মা প্লেট ভর্তি ঘন দুধের পায়েস নিয়ে আসে। আমি একটুও খেতে পারি না, সব খিদে আমার হারিয়ে গেছে, বমি পাচ্ছে। কানের কাছে শুধু ঝমঝম করে বাজতে থাকে, মিয়াও মিয়াও। সবাই চলে গেলে মা হঠাৎ করে বলেন, আমার নাকফুলটা কই? ড্রেসিং টেবিলে খুলে রেখেছিলাম তো।
নেই নেই, কোথাও নাকফুল নেই। মায়ের মুখটি মলিন, মুক্তোর নাকফুলটি নেই বলেই বুঝি মাকে বড় দুঃখী দুঃখী লাগছে।
কে নেবে আর, রতন ছাড়া নাকফুলটি কে চুরি করবে? বাবা বললেন, রতনই নিয়েছে, হানড্রেড পার্সেন্ট শিওর।
রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে দেন আমার ভীষণ রাগী বাবা। আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ধুপধাপ মারের আওয়াজ শুনি। আমার চোখের সামনে ডানা মেলে লালপরী, নীলপরী আর হলদে পরীরা নেচে বেড়ায় না, খোঁপায় ওরা ফুল পরে না। চাঁদনি রাত হাসে না। নীল তারাগুলো টিপটিপ করে না। আমি শুনতে থাকি রতনের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। জন্মদিনের উপহারগুলোকে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে। চাই না আমি জন্মদিনে আনন্দ করতে। মায়ের খুশি খুশি গলা ভেসে আসে, এই যে পেয়ে গেছি, পেয়ে গেছি। দরজা খোল।
বাবার সারা শরীর দিয়ে ঘাম ঝরছে। মুখে বলেন, ঠিকঠাক মতো গুছিয়ে রাখতে পারো না?
মা-বাবা রতনকে আদর করে একবারও বলল না, আমাদেরই দোষ হয়েছে রে। আমরা ঠিকমতো গুছিয়ে রাখি না। তোকে আমরা শুধু শুধু মেরেছি।
অনেক রাতে ছোটকাকু হইহই করে আসে। চেঁচিয়ে বলে, আমাদের আগামী দিনের নাগরিক কি ঘুমিয়ে গেছেন?
আমি ধবধবে বিছানায় উঠে বসি।
কাকু বলেন, কি হে লিটল মাস্টার- শুভ জন্মদিন। হ্যাপী বার্থ ডে।
কাকুর আদর পেয়ে আমার আরও বেশি বেশি কান্না পায়।
বলতে ইচ্ছে করে- কাকু, রতন শুধু শুধু মার খেল কেন? নরম পশমের মত মিনি বেড়ালকে সবাই মিলে তাড়াবে কেন?
বড়রা যে কি করে বুকের দুঃখ-কষ্ট ফুঁস মন্তর দিয়ে উড়িয়ে দেয় কে জানে! আমি অভি তো তা পারি না। সকাল হলে আবার চা তৈরি হবে, ঘিয়ে ভাজা পরোটা আর ডিমের ওমলেট হবে। পত্রিকা পড়ে পড়ে চায়ে চুমুক দিয়ে বড়রা বলবে, ইসস বাস উল্টে গিয়ে আবার দশজন মারা গেছে। তারপরই ওরা সব ভুলে যায়। কিন্তু আমি অভি তা পারি না, আমি যে আগামী দিনের নাগরিক। আমার সামনে রোদ ভরা চাঁদমাখা দিনগুলো হাসে। মনে মনে প্রশ্ন করি সবাইকে, তোমরা কুকুরকে ভালোবাসো, আমার মিনি বেড়ালকে কেন ভালবাসো না? নাকফুল নিজেরা রেখে রতনকে মারলে কেন?
ভাবতে ভাবতে আমি অভিষেক অনেক বড় হয়ে যাই। কুকুরকে আর আমি কুকুল বলি না, ডালকেও দাল বলি না, মিষ্টিকেও মিত্তি নয়। আমি স্বপ্ন দেখতে থাকি। রাশি রাশি স্বপ্ন।
হঠাৎ শুনি মিয়াও মিয়াও কান্না। ভাইয়া যেমন বড় ক্যাসেটে ঝমঝম করে গান বাজায়, ঠিক সেরকম চারপাশ থেকে মিনি বেড়ালের কান্না ভেসে আসে। এই মাঝ রাতে কুউ-কু-কুউ-কু করে কোকিল ডাকে। সারাদিন মুখ বুজে কাজ করে রতন। সেও কলকল করে হাসতেই থাকে।
তবে কি আগামী দিনের নাগরিকের জন্য আলোয় ভাসা দিনগুলো পায় পায় আসছে?
স্নিগ্ধ নীল রং বাতি জ¦লা ঘরে চোখ মেলে তাকাই। সবাই ঘুমোচ্ছে। টিকটিক করে ঘড়ির কাঁটা কথা বলছে।
আসতে আসতে পথে তো দিনগুলো থমকে যাবে না? ভয়ে আমার বুক দুরু দুরু কাঁপে। আকাশে তো দ্রিম দ্রিম করে মাদলের মতো মেঘ ডেকে উঠবে না? ঝড়-বৃষ্টি একসাথে নেমে পথকে কাদা আর নোংরা জলে ভরিয়ে দেবে না?
বাহ্, আমি ছোট্ট অভি-অভিষেক শুনি, দূর থেকে ভেসে আসা গান- আসছি, হে অবিষেক, আগামী দিন তোমার কাছে আসছি।
ঐ তো- বকুল ফুলের গন্ধমাখা আগামী দিন আসছে। আগামী দিনের নাগরিক অভির কাছে ঝকঝকে কাচের পেয়ালার মতো আগামী দিনগুলো তীরের মতো ছুটে আসছে।
ভীষণ ঘুম পায় এবার। বাইরে চাঁদমাখা রাত হাসতে থাকে।

Share.

মন্তব্য করুন