কিছু বকুলফুল তার চাই। এ ফুলগুলো সে তার মাকে দেবে। মাকে এর চেয়ে আর ভালো উপহার তার দেয়ার নেই। বকুলের গন্ধে ছোট্ট ঘরটি ম ম করবে। এখানেই তাদের রাজ্যের সুখ উপলব্ধি হবে।
এই যে, কিছু ফুলের জন্য পেরেশানি। যার পেরেশানি তার নাম তানজিম। মায়ের একমাত্র ছেলে। বারো বছর বয়স। মৌয়ামারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। রোল দুই।
মা রাবেয়া খাতুন। বিধবা। তানজিমের যখন দু’বছর বয়স তখনই তার বাবা মারা যায়। তানজিম তার মায়ের কাছ থেকে বাবার মৃত্যু সম্পর্কে যা শুনেছে তার বিবরণটা এরকম- তার বাবার নাম মতিয়ার রহমান। পেটানো শরীর ছিলো। অন্যের ক্ষেতে দিনমজুরি দিয়ে সংসার চালাতেন। খালিপেট, অর্ধপেট করে দিনাতিপাত করতে চাচ্ছিলেন। কিছুটা সঞ্চয় করতেও চাচ্ছিলেন। ছেলে জন্মেছে। সে যেনো অন্যের বাড়িতে তার বাবার মতো মজুরি না খাটে।
খালিপেট, অর্ধপেট করে চলতে যেয়ে পেটে গ্যাস্ট্রিক থেকে কঠিন এক আলসার হয়। আলসারের চিকিৎসার জন্য রংপুর মেডিক্যাল কলেজে অনেকবার গিয়েছিলেন। কত্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা। অনেক ঔষধ-পত্র খেতে হয়েছিলো। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। বরঞ্চ যেটুকু সঞ্চয় করেছিলো তা ফুরোয়ে অনেকের কাছে চিকিৎসা সহায়তার জন্য দ্বারস্থ হতে হয়েছিলো।
গ্রামের লোকজনের সহযোগিতায় কিছুদিন চিকিৎসা চললেও উন্নতি হয়নি। রংপুর মেডিক্যালের ডাক্তার বলেছিলেন ভারতের মাদ্রাজে নিলে ভালো হতে পারে। কিন্তু মাদ্রাজ যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট, ভিসা ছাড়াও অনেক টাকা লাগবে। একজন দিনমজদুরের পক্ষে তা একেবারেই অসম্ভব।
কী যে দুর্দিন নেমে এলো সংসারে! সারাদিন পেট চেপে ধরে বাবারে-মারে বলে চিৎকার করতেন। এভাবে ভুগতে ভুগতে একদিন মারাই গেলেন। ঋণের বোঝা ছিলো সংসারে। দু’বছরের ছেলেকে নিয়ে পাশের মোল্লাবাড়িতে সাংসারিক কাজের সহযোগী হয়ে সংসারের হাল ধরেন রাবেয়া।
এই মোল্লাবাড়ির ছেলে আফসারুল আমিন মৌয়ামারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। পিতৃহীন তানজিমকে অনেক স্নেহ করেন। তারই তত্ত্বাবধান ও আন্তরিকতায় লেখাপড়া চলে তানজিমের। মেধাবী, নিরীহ প্রকৃতির ছেলে তানজিম। তবে মায়ের কাজের মজুরি দিয়ে ভালো কোনো জামা, কাপড় পরতে পারে না। তার সহপাঠীরা দামি কাপড় দিয়ে স্কুল ড্রেস বানিয়ে পরে। কিন্তু সে মোটা, কমদামি কাপড়ের ড্রেস পরে।
অন্য সহপাঠীরা বাড়িতে গেলে মা এসে ফ্যান ছেড়ে মুখে তুলে খাওয়ায়। কিন্তু তানজিম বাড়ি ফিরে নিজে নিজেই ঢেকে রাখা খাবার খায়। তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করে নিজেকে। বন্ধুদের বাড়িতে বিদ্যুৎ আছে, টিভি আছে, অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল আছে। মায়েদের শর্ত থাকে, যদি পড়াশুনো শেষ করো তবে মোবাইলে গেম খেলতে পারবে, ইউটিউব দেখতে পারবে। আছে প্রাইভেট শিক্ষক। কিন্তু রাত ন’টার আগে তানজিমের মা বাড়িতে ফেরেন না। তাই কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে একা একা পাঠ তৈরি করতে হয় তাকে। মা এলেও কি আর পাঠ তৈরিতে সাহায্য করতে পারবেন? থাকেন ক্লান্ত। মা যে বেশিদূর পড়েননি।
এই যে, একা একা পাঠ তৈরি করা, স্কুলে আফসার স্যারের সহযোগিতা পাওয়া ইত্যাদি তানজিমের ফলাফলকে প্রথম করে। কিন্তু স্কুলের প্রধান শিক্ষক মকছুদার রহমানের ছেলে তানজিমের সাথে পড়ে। তুলনামূলক ফলাফল কম করলেও প্রভাব খাটিয়ে এক রোল করে দেন তিনি।
রমজান মাস। তানজিমদের বাড়ির কিছুটা দূরে জামে মসজিদ। মসজিদে ইফতারি হয়। তারাবি হয়। ফজরেও নামাজি সমাগম হয় অনেক। তানজিম রোজা রাখছে নামাজও পড়ছে মসজিদে জামাতে।
জামে মসজিদের পূর্বপাশ ঘেঁষে একটি হেফজখানা। মসজিদ আর হেফজখানার মাঝখানে একটি বকুলফুলের গাছ। দক্ষিণ দিক দিয়ে রাস্তা। উত্তর দিকে অজুখানা। বকুলগাছটির নিচে মসজিদ ও মাদরাসার সিঁড়ি।
তানজিমের বন্ধুরা রমজানের মাঝামাঝি সময়ে বাজারে গিয়ে ঈদের নতুন নতুন পাঞ্জাবি-পাজামা ও টুপি কিনে। সাথে নিয়ে আসে আতর। এই আতর মেখে তারাবি পড়তে আসে। তানজিমের পাশে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে তারা। নামাজ শেষে নতুন পাঞ্জাবি-পাজামা আর আতর নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। আর বলে যে, তাদের উপবৃত্তির টাকা দিয়ে বাবা-মাকে ঈদের উপহার কিনে দিবে।
তানজিমও স্কুল থেকে উপবৃত্তির টাকা পেয়েছে। কিন্তু মা সে টাকা দিয়ে তানজিমকে ড্রেস বানিয়ে দেন। বন্ধুদের বাবা-মাকে ঈদের উপহার দেয়ার কথায় তানজিমের মনেও অনেক শখ হয় তার মাকে একটা শাড়ি কিনে দিবে। কিন্তু মা তা হতে দেননি। তানজিমের মন খুবই খারাপ।
তানজিম মনমরা হয়ে মসজিদে যায়, নামাজ পড়ে, ফিরে আসে। রাতে সে বাংলা বই পড়ছিলো। একটি কবিতার ব্যাখ্যায় পড়ে বকুলফুলের মালা ও সুবাস সম্পর্কে। তখনই মনে জাগে বকুলফুলের সুবাস যেহেতু অনেক তাহলে আমি ঈদের দিনে মাকে তরতাজা কিছু বকুলফুল উপহার দিবো। মা নিশ্চয়ই সুবাসমাখা বকুলফুল পেয়ে খুশি হবেন।
বকুলফুল ফোটে রাতে। আর ঝরে যাওয়াও শুরু করে ভোর রাত থেকে। সারাদিন টুপটাপ করে ঝরে পড়ে। মৌয়ামারী গ্রামে মাত্র একটিই বকুলের গাছ তাও আবার মসজিদ আর হেফজখানার মাঝখানে। তানজিম এখান থেকেই ফুল সংগ্রহ করবে বলে মনস্থির করে।
সিঁড়ি বেয়ে ওঠা-নামা করে মুসল্লি ও হেফজখানার ছাত্ররা। দিনের বেলা যে ফুলগুলো ঝরে পড়ে তা পায়ে পিষ্ট হয়ে যায়। তাই ভোর রাতের প্রথম ঝরে পড়া বকুলফুল সংগ্রহ করবে বলে পরিকল্পনা করে তানজিম। ঈদের দিন ভোরবেলা। মসজিদের মাইকে আজানের পরপরই তাকবির পাঠ করছেন মুয়াজ্জিন। মাকে ডাক দিয়ে বিছানা ছাড়ে তানজিম। বলে যে নামাজে যাচ্ছে। ছোট্ট ঘরটির খোঁয়াড় পেরিয়ে দ্রুতই পা বাড়ায় মসজিদের দিকে।
মসজিদ আর হেফজখানার মাঝখানের সিঁড়িতে সদ্য ঝরে পড়া অনেকগুলো বকুলফুল। হালকা শিশির লেগে আছে। চোখ চিকচিক করে ওঠে তানজিমের। মুহূর্তকাল দেরি না করে বেছে বেছে বেশ কিছু ফুল দু’হাতে তুলে নেয়। আর একটু দেরি হলেই হেফজখানার ছাত্র ও মুসল্লিগণ সিঁড়ি বেয়ে মসজিদে প্রবেশ করবে কিংবা অজুখানার দিকে যাবে। আর পিষ্ট হয়ে যাবে সুবাসমাখা ফুলগুলো।
মসজিদের এক কোণে রেখে দেয় ফুলগুলো। তারপর অজুখানায় যেয়ে প্রয়োজন সেরে অজু করে দু’রাকআত সুন্নত আদায় করতে করতে আরম্ভ হয়ে যায় ফরজের জামাত। এক রাকআত চলে যেয়ে দ্বিতীয় রাকআত শুরু হলে জামাতে শামিল হয় তানজিম। কারণ প্রয়োজন সারতে খানিক দেরি হয়েছিলো।
দু’রাকআত ফরজ শেষ হলে সালাম ফিরিয়ে ইমাম সাহেব তাকবির পাঠ করা শুরু করেন। কয়েকজন কিশোর ঈদের দিনের প্রথম খুশিতে কোলাকুলি করবে। তাই মসজিদের সেই কোণে গিয়ে কোলাকুলি শুরু করে। নিচে যে কিছু বকুলফুল আছে সেদিকে একটুও খেয়াল করেনি তারা। ক’য়েকটি কিশোরের পদভারে পিষ্ট হয়ে যায় পরম ভালোবাসায় কুড়িয়ে আনা ফুলগুলো। খানিক শিশিরে ভেজা ছিলো বলে পায়ে অন্যরকম লেগেছিলো। যখন দেখলো যে পায়ের নিচে কিছু বকুলফুল তখন ভাবলো যে কেউ হয়তো ওগুলো কোনো কাজের জন্য এনেছিলো।
তারা কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করে ফুলগুলোকে পিষ্টকরণের জন্য।
বাকি এক রাকআত আদায় করে সালাম ফিরিয়ে মসজিদের সেই কোণায় যায় তানজিম। দেখে যে এখানেও কারা যেনো তার রেখে দেয়া বকুল ফুলগুলোকে মাড়িয়ে তছনছ করেছে। মনের আকাশে জমে গেলো কালবোশেখির মেঘ। দু’চোখ দিয়ে ঝরে পড়া শুরু করলো কষ্টাশ্রু।
অদূরে দাঁড়িয়ে এসব দেখছিলো সেই কিশোরেরা। তারা নিজেদের অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য মাফ চাইতে যাবে কিন্তু হনহন করে মসজিদের সিঁড়ি বেয়ে বেরিয়ে পড়ে তানজিম। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিলেন আফসার স্যার। আফসার স্যার তানজিমকে ঈদ মোবারক বললেন। কিন্তু সে ঈদ মোবারকের তেমন কোনো জবাব না দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে যায় তানজিম। স্যার হতভম্ব। যে ছেলে অনেক বিনয়ী, সে আজ তার অভিবাদনের জবাব না দিয়ে এভাবে চলে গেলো!
সেই কিশোরেরা স্যারকে বললো যে, তানজিমের রেখে দেয়া বকুলফুলগুলো তারা অজান্তেই পায়ে মাড়িয়েছে। ঘরে ঢুকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে তানজিম। মা নামাজ আদায় করছিলেন। নামাজ শেষে কাজে যেতে হবে তাকে। আজ ঈদের দিন। মোল্লাবাড়িতে অনেক কাজ করতে হবে। সালাম ফিরিয়ে ছেলেকে বুকে নিয়ে বলেÑ কেনো কাঁদছে সে? কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার জন্য আজকের ঈদের উপহার কিছু সুবাসমাখা বকুলফুল কুড়ানো আর সেগুলো কারো পায়ে মাড়ানোর কথা বলে তানজিম। মা তাকে সান্ত¡Íনা দিয়ে বলেন যে, তিনি তার ছেলের এ আগ্রহে অনেক খুশি হয়েছেন। আর আল্লাহর কাছে দোয়া করেন যেনো আল্লাহ তাকে বিশাল বড় মানুষ করে আর মা’র জন্য ঈদের অনেক উপহার কিনতে পারে।
‘তানজিম, তানজিম।’
আফসার স্যারের কণ্ঠ শুনে হকচকিয়ে ওঠে তানজিম। ভয়ে বুকটা দুরু দুরু করে। কারণ স্যারের ঈদ মোবারক বলার উত্তর দেয়নি। কত্ত বড় বেয়াদবি হয়েছে!
ছেলের চেহারা আর কান্নাকাটি দেখে বুঝে যে, সে হয়তো এখন ভালোভাবে কথা বলতে পারবে না। তাই নিজের থেকে মাস্টার সাহেবের কথার উত্তর করেন।
‘জে মাস্টার সাব। কন। তানজিমতো ঘরে আইসা কানতাছে। ও নাহি কিছু বকুলফুল আমারে দেবো বইলা কুড়াইছিলো। তা কারা য্যানো পাড়াইয়া দিছে।’
এরকম কথা বলতে বলতে রাবেয়া ঘরের খোঁয়াড় পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখে যে, আফসার স্যার দু’হাতের অঞ্জলিতে তরতাজা কিছু বকুলফুল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
‘বাজান, আয়, দ্যাখ। স্যার তরতাজা বকুলফুল নিয়া আইছে।’

Share.

মন্তব্য করুন