‘ফুয়াদ, স্ট্যান্ড আপ। শুনলাম তোকে নাকি ভূতে ধরেছে? তয় আমবাগানের ভূত নাকি জাম বাগানের ভূত?’
একেবারে শেষ বেঞ্চের শেষ কোনায় ফুয়াদ নামে যে ছেলেটা বসে আছে আকবর স্যার তাকেই জিজ্ঞেস করলেন। ফুয়াদ জানালার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো। এ ক্লাসে সে নবভূত উপাধিতে ভূষিত হয়েছে। প্রথম যে ব্যক্তি তাকে এ সম্মানে সম্মানিত করেছিল সেই ব্যক্তিটি দাঁড়িয়ে বলল, ‘না স্যার পুকুরপাড়ের ভূত। কারণ তাকে আমি মাঝে মধ্যেই পুকুরপাড়ে বসে কারও সাথে কথা বলতে দেখি।’ এই কথা শুনে ক্লাসের রোল নম্বরের সিরিয়ালে হাফসেঞ্চুরি করা বাট্টু দাঁড়িয়ে বলল, ‘স্যার মেছো ভূত আর না হয় গেছো ভূত হতে পারে। তবে আমি ১০০% শিওর না।’ স্যার বলল, ‘চুপ করো বাছাধন। তোমার অতো শিওর হয়ে কাজ নেই। কালকের পড়া শিখেছো কিনা সেটা শিওর হলেই চলবে।’
‘শিখেছি। তবে হোমওয়ার্ক করেছি কিনা সেটা শিওর না।’
মেয়েদের মধ্য থেকে নিপা বলল, ‘স্যার ফুয়াদকে নিশ্চয়ই প্রজাপতি ভূত ধরেছে। ওই যে দেখেন এখনো তার হাতে একটা প্রজাপতি।’ এই কথা শুনে স্যার বলল, ‘একজাক্টলি, তুই ঠিক কথা বলেছিস। তবে যে ভূত-ই হোক না কেন ওর ঘাড় থেকে আগে ভিমরতি ভূত দূর করতে হবে।’ স্যারের কথায় একসঙ্গে সায় দিল ক্লাসের সবাই। শুধু টেনশনে মাথা চুলকিয়ে ডাবলু কিছুই বুঝল না। তাই সে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভিমরতি ভূত কি দেশি না বিদেশি স্যার? ইয়ে মানে এর আগে কখনো শুনিনি তো।’
‘তোর মাথা। মু-ুটাকে জিজ্ঞেস কর। জীবনে তোর মতো গাধা আর একটিও দেখিনি।’- নিজের মাথায় নিজেই একটা চড় বসিয়ে দিয়ে স্যার বলল,
‘ফুয়াদ, কামিং।’
কিছুটা ইতস্তত বোধ করে লাস্ট বেঞ্চ থেকে বেরিয়ে স্যারের সামনে এসে দাঁড়ালো ফুয়াদ।
‘তোর হাতে ওটা কী?’
‘প্রজাপতির ডানা।’
‘ওটা দিয়ে করবি কী? খাবি না মাথায় দিবি?’
‘একটা প্রজাপতি রোবট বানাবো স্যার।’
এই কথা শুনে স্যারের চোখ কপালে গিয়ে ঠেকলো। বলে কি এই ছেলে! পাগল কি তুই হয়েছিস নাকি আমাকে বানাচ্ছিস কোনটা? তোর হোমওয়ার্কের খাতাটা বের করতো দেখি?
ফুয়াদ মাথা নিচু করে খাতাটা সামনের দিকে এগিয়ে দিল।
সর্বনাশ! খাতায় এসব কি এঁকেছিস? যত সব কার্টুন-ফার্টুন। মনে হচ্ছে এক্ষুনি বের হয়ে আমার
মাথাটাই চিবিয়ে খাবে।
ভয় পাবেন না স্যার। ওটা একটা প্রজাপতির বডি। ওটা দেখে দেখেই প্র্যাকটিক্যালি বানানোর ট্রাই করছি।
কচু বানিয়েছিস? তোর হোমওয়ার্ক কই? আমি কি এইসব করতে দিয়েছিলাম? তুই যে দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছিস তা কি বুঝতে পারছিস না? আগের স্কুল থেকে তাহলে এগুলোই শিখে এসেছিস? তোকে আমাদের স্কুলে ভর্তি করানোটাই হয়েছে সব থেকে বড় ভুল। নে দ্রুত হাত পাত।
ফুয়াদ কোন উত্তর দিতে পারল না। শেষমেশ কাক্সিক্ষত সেই হাতের তালুতে চপাট চপাট করে দুই ঘা খেয়ে নির্ধারিত আসনে গিয়ে অবস্থান নিল।
এভাবেই ক্লাসের হাফ টাইম মীরাক্কেলের এপিসোড দিয়ে শেষ হয়। বাকি হাফ টাইমে পড়া দেয়া-নেয়া চলে। প্রতিটি এপিসোডের সেরা অভিনেতার ভূমিকায় থাকেন আকবর স্যার। প্রায় পঞ্চাশ জন দর্শকসহ জোকসের প্রধান বিষয়বস্তু হল ফুয়াদ। ক্লাস শেষে সবাই বাড়ি চলে যায় শুধু এই একটি ছেলে একা একা জানালার ধারে বসে বাইরের আকাশকে দেখে আর নীরবে চোখের জল ফেলে।
ক্লাস থ্রি থেকে ফোর-এ উঠেছে ফুয়াদ। এই আনন্দঘন স্কুলে সে নতুন। তার বাবা প্রশাসনের চাকরির সুবিধার্থে রংপুর থেকে জয়দেবপুরে বদলি হয়ে এসেছে দু’মাস আগে। নতুন স্কুলে ভর্তি হয়েই সবার কাছে এভাবে সে উপহাসের পাত্রে পরিণত হবে তা কখনো কল্পনা করেও দেখেনি কোনদিন। ওর বারবার আগের স্কুলটির কথা খুব মনে পড়ে। পুরনো বন্ধুদের, স্যারদের ও খুব মিস করে। একদিন ওর প্রিয় হেলাল স্যার তাকে বলেছিল, ‘‘মুখস্থ করলে জীবনে কিছুই শিখতে পারবে না ফুয়াদ, যদি তুমি বুঝে বুঝে না পড়। এ প্লাস পেলেই জীবনে সবকিছু পাওয়া হয়ে যায় না, কথাটা মনে রাখবে।’ কোথায় সেই হেলাল স্যার? আজ উনার কথা খুব মনে পড়ছে।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ফুয়াদ আজ দেরি করে স্কুল থেকে ফিরেছে বলে মা খুব চিন্তিত। বাসায় আসার পর থেকেই প্রজাপতির দুইটা পাখা নিয়ে সেই যে ল্যাব রুমে বসেছে আর ওঠা-উঠি নেই। মা দুধের গ্লাস নিয়ে ফুয়াদের কাছে গিয়ে বলল, ‘এত বিষণ্ণ হয়ে আছো কেন ফুয়াদ?’
এমনি মা।
আজও কি স্যার তোমায় বকেছে?- ফুয়াদের মুখ থেকে কোন উত্তর না আসায় মা আবার বলল, তোমার উচিত আগের মত পড়াশোনায় মন দেয়া। তার আগে দুধটুকু খেয়ে নাও তো।
মা আমি হেরে যাচ্ছি। আমি আর পারছি না। আমাকে কেউই বুঝতে চায় না। আমি প্রজাপতি নিয়ে গবেষণা
করছি বলে আমাকে সবাই হাতুড়ে গবেষক বলে ঠাট্টা বিদ্রƒপ করে। এত অল্প বয়সে রোবটের কথা মাথায় আনতেও বারণ করে দিয়েছে রোকন স্যার। আজকে আকবর স্যার বলেছে, আমার মাথায় নাকি ভূত চেপেছে। ইদানীং সবাই আমাকে বিজ্ঞানী না বলে অজ্ঞানী বলে ডাকে।
ফুয়াদের কথা শুনে মা হেসে দিয়ে বললো, সবাই তোমাকে উপহাস করলেও কই আমি তো করি না। একদিন তুমি অনেক বড় হবে। আমাকে সবাই বিজ্ঞানীর মা বলে ডাকবে। তুমি কি তোমার মার কথা বিশ্বাস করো না ফুয়াদ?
মায়ের সান্ত¦নায় ফুয়াদের মন ভরে উঠলো। হেসে দিয়ে বললো, মা, ছোটবেলায় তুমিতো সেরা খুদে বিজ্ঞানী হয়েছিলে। তাহলে যখন বিজ্ঞান চর্চা শুরু করেছিলে তখন তোমাকে নিয়েও কি সবাই বিদ্রƒপ করত?
হ্যাঁ, আমার বাবা পর্যন্তও করত। কিন্তু আমি সেসবে কান দিতাম না। আমি কি আর তোমার মত মায়ের কাছে গিয়ে মনের কথা বলতে পারতাম!
ফুয়াদ তার মাকে আহ্লাদে জড়িয়ে ধরল। তারপর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, মা তুমি অনেক জ্ঞানী। তুমি না থাকলে আমি গত বছর বিজ্ঞান মেলায় অংশগ্রহণ করে সেরা ট্রফিটা কখনো পেতাম না। তুমি কি আমাকে এই কথা বলা প্রজাপতিটি বানাতে সাহায্য করবে না?
মা হেসে দিয়ে ফুয়াদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেছে কিন্তু ফুয়াদ স্কুলে আসে না। আকবর স্যার ক্লাসে এসেই পেছনের বেঞ্চটার দিকে তাকায় আর ফুয়াদকে খুঁজে বেড়ায় নীরবে। ভূতে ধরা সেই অজ্ঞানী ছেলেটার জন্য পুরো ক্লাসটাই যেন হাহাকার করছে। কেউ আর উচ্চস্বরে হাসা-হাসি করার মত কোন কারণ খুঁজে পায় না। আজ ক্লাসে এসেই আকবর স্যার ছাত্রদেরকে বলল, ‘তোরা কি ফুয়াদের কোন খবর জানিস? ছেলেটা অসুস্থ হয়েই পড়লো নাকি! তা ছাড়া সে তো ক্লাস কখনো এভাবে ফাঁকি দেয় না।’
ক্লাসের ফার্স্টবয় রেদওয়ান বলল, ‘স্যার ফুয়াদ আর কখনো আমাদের স্কুলে আসবে না। আজ সকালে তাকে ফোন করেছিলাম। সে তার মায়ের সাথে রংপুরে পুরনো স্কুলে ফিরে গিয়েছে।’
সঙ্গে সঙ্গে কে যেন পিছন থেকে বাঁশির মতো মিহি স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো, ‘ঠিক বলেছো, একদম ঠিক বলেছো। ফুয়াদ চলে গেছে। কিন্তু আমি রয়ে গেছি।’
সবার চক্ষু চড়কগাছ। এ কে কথা বলছে? বিস্ময়ে সবাই একসঙ্গে পেছন ফিরে তাকালো। এ তো মানুষ নয়, যেন জ্যান্ত একটা প্রজাপতি!

Share.

মন্তব্য করুন