শরীরের সকল শক্তি এক করে ঠেলতে ঠেলতে রহিম মিয়া ট্রেনের ভিতরে ঢুকতে পারলো। শত শত মানুষের ভিড় ঠেলে ঈদের সময় ট্রেনে উঠতে পারাটাও ভাগ্যের ব্যাপার বটে। ঘরমুখো মানুষের ভিড়ে কমলাপুর রেলস্টেশনের ঈদের বাস্তব চিত্র এটি। প্রিয়জনদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে শহর ছেড়ে নাড়ির টানে গাড়িতে চাপে হাজার মানুষ। সেই সময় সবচেয়ে ভিড় হয় রেলস্টেশনগুলোতে। গায়ের শক্তি খাটিয়ে ধাক্কাধাক্কি করে উঠতে হয় ট্রেনে। ট্রেনে উঠতে পেরে রহিম মিয়া যেন বিশ্ব জয় করেছে। মনে একটা প্রশান্তি অনুভব করছে। লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে হালকা করছে। বসার মতো সিট কোথাও নেই। দাঁড়িয়ে হলেও বাড়ি যেতে পারবে সেটাই আনন্দের বিষয়। ইতোমধ্যে ট্রেন চলতে শুরু করেছে। রহিম মিয়ার মোবাইলটা বেজে উঠলো। ছেলের ফোন। ফোন রিসিভ করে বলতে শুরু করে ‘হ্যাঁ বাবা আমি ট্রেনে উইঠা পড়ছি। কোনো চিন্তা কইর না। আমি
আইতাছি’ বলেই রেখে দিলো। ফোনটা রেখে দিতেই মনে পড়লো সে বিরাট এক ভুল করে ফেলছে। তাড়াতাড়ি ট্রেনে উঠতে গিয়ে তার পুঁটলিটা সিএনজিতে রেখে এসেছে। সে এক দৌড়ে চলে এলো বগির দরজায়। জোরে দৌড়াতে গিয়ে সে একজনের গায়ের ওপর পড়েও গিয়েছিল। এ জন্য সেই লোকটি তাকে গালাগালি করছে। রহিম মিয়া দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে যে ট্রেন কমলাপুর থেকে চলে আসছে এয়ারপোর্ট স্টেশনে। রাত তখন ১০টা বাজে, চারদিক আলো-আঁধারে ছেয়ে আছে। থমকে দাঁড়ালো সে। এখন গিয়ে তো সিএনজিওয়ালাকে পাওয়া যাবে না। ঢাকার শহরে হাজার হাজার সিএনজি কোথায়
খুঁজবে। অগত্যা নিয়তির কথা ভেবে কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর কোনো উপায় থাকলো না তার। দু’ চোখ ভিজে উঠছে। তিলে তিলে জমানো কষ্টের টাকায় ছেলে-মেয়ের জন্য ঈদের নতুন জামা কিনেছিল। রিকশা চালিয়ে কী আর আয় করা যায়। পরিবারের খরচ মেটাতে আর ছেলে-মেয়েকে মানুষ করার জন্য ভূমিহীন রহিম মিয়া ঢাকা শহরে রিকশা চালায়। সপ্তাহে সপ্তাহে বাড়িতে টাকা দিতে হয়। এক ছেলে এক মেয়ে তার। ছেলে ক্লাস সেভেনে ও মেয়ে ক্লাস ফাইভে পড়ে। বেশির ভাগ সময় তাদের জামা-কাপড় হলিডে মার্কেটের পুরাতন কাপড়ের দোকান থেকে কিনে দেয়। নতুন জামা-কাপড় পরানোর মতো সাধ্য রহিম মিয়ার নাই। অবশ্য এ নিয়ে ছেলে-মেয়ের কখনো কোনো অভিযোগ নাই। তবে অনেক দিন ধরে মেয়েটা একটা নতুন লাল ফ্রক কিনে দিতে বায়না করছে। ছেলেটাও এবারের ঈদে একটা ভালো পাঞ্জাবির আবদার করেছিল। রহিম মিয়া ঢাকা শহরের কয়েকটা হলিডে মার্কেট ঘুরে মেয়ের জন্য একটা লাল ফ্রক ও স্যালোয়ার কিনেছে, আর ছেলের চাহিদা মতো কিনেছে পায়জামা ও পাঞ্জাবি। কেনার পরে যখন বাড়িতে ফোনে বলেছিল তখন ছেলে-মেয়ের আনন্দ আর দেখে কে! এতো কষ্টের কেনা জামার পুঁটলিটা আজ নিজের ভুলে সিএনজিওয়ালার কাছে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না রহিম মিয়া। বাড়িতে পৌঁছার পর ছেলে-মেয়ে যখন তাদের ঈদের জামা দেখতে চাইবে তখন কী জবাব দিবে? কোন মুখে তাকাবে তাদের মুখের দিকে! এই সব ভাবতে ভাবতে চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে। প্যান্টের লুকানো পকেটে হাত দেয়। কিছু টাকা আছে একটু পর পর হাত দিয়ে চেক করে। ঈদের সময় ট্রেনে পকেটমারদের দৌরাত্ম্য বাড়ে। অনেকের টাকা পয়সা খোয়া যায়। অনেক কষ্টে ঈদের জন্য তিন হাজার টাকা জোগাড় করেছে। ঈদের দিন সবার বাড়িতে ফিরনি পায়েস রান্না হয়। দুপুরে গোশত রান্না হয় প্রত্যেক ঘরে। ছেলে-মেয়েদেরও মন চায় ভালো-মন্দ খাবার খেতে। গত ঈদে ফার্মের মুরগি কিনে এনেছিল রহিম মিয়া। তখন মেয়েটা অভিমান করে বলেছিল, ‘বাবা সবার বাড়িতে গরুর গোশত, শুধু তুমি মুরগি কিনে আনো কেন? গরুর গোশত আনতে পারো না।’ তখন রহিম মিয়ার অন্তরটা কেঁপে উঠেছিল কিন্তু মুখে হাসির রেখা বজায় রেখে বলেছিল, ‘মা! সামনের ঈদে আমরাও গরুর গোশত খাব, ইনশাআল্লাহ।’ কথাটা শুনে মেয়েটা তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিল। ট্রেন চলছে ঝিক ঝিক শব্দে সেই শব্দের তালে তালে হারিয়ে যায় রহিম মিয়ারে নিঃশব্দের বুক ফাটা অভাবের কান্না। রহিম মিয়া মনে করার চেষ্টা করছে পুঁটলিতে কী কী জিনিস ছিল। ছেলে-মেয়ের নতুন জামা, বউয়ের জন্য একটা শাড়ি, এক কেজি করে কমলা ও আপেল। সেই সাথে মেয়ের জন্য ফিতা, ক্লিপ ও চুড়ি। আর কী! আর কী! ভাবছে। ও, হে ছোট একটা খাতা, যেখানে বাড়ির ও আত্মীয় স্বজেনের মোবাইল নাম্বার লেখা রয়েছে। এই সব হারানোর জন্য বারবার নিজেকে দায়ী করে ধিক্কার দিচ্ছে রহিম মিয়া। আশপাশের লোকজন ঘটনা শুনে কেউ বলছে বোকা নাকি তুমি পুঁটলি রেখে এলে কেন? কেউ আবার সান্ত্বনা দিয়ে বলছে, ‘আরে ভাই তোমার কপালে যা ছিল তা তো হবেই’ তবে ফিরে পাওয়ার তো কোনো আশা নাই। তবুও আল্লাহর কাছে হাত তুলে দোয়া করলো যেনো আল্লাহ তার গায়েখাটা হালাল টাকায় কেনা বাচ্চাদের ঈদের জামা ফিরিয়ে দেন। ট্রেন চলছে আপন
গতিতে সেই সাথে বাড়ছে রহিম মিয়ার টেনশন।
২.
সিএনজি চালক হোসেন গ্যারেজে ফিরতে দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছে। সেহেরি খেয়ে নামাজ পড়ে একটা ঘুম দিবে। তারপর সকাল ৭টার ট্রেনে যাবে গ্রামের বাড়ি। এখনো বিয়ে করেনি, গ্রামে মা-বাবা ছোট ভাই-বোন নিয়ে হোসেনের সংসার। বাবা কর্মক্ষম না থাকায় হোসেন বেশি দূর পড়ালেখা করতে পারেনি। সংসারের প্রয়োজনে ঢাকায় এসে সিএনজি চালায়। আয় রোজগার যা হয় আল্লাহর রহমতে সাংসারিক খরচ মিটিয়ে কিছু জমা করতে পারে। মালিকের সিএনজি চালায় তাই আয় একটু কম। তার চেষ্টা কিছু টাকা জমিয়ে একটা সিএনজি কেনা। গ্যারেজে জমা দেয়ার আগে সিএনজিটা পরিষ্কার করতে হয়। বাইরের সব পরিষ্কার করে ভেতরের সিট পরিষ্কার করলো। তারপর সিটের পেছনের খালি জায়গায় হাত দিতেই আঁতকে উঠলো হোসেন। একি! এটা আবার কার! আশ্চর্য হয়ে বের করলো। পাশে রেখে ভালো করে সিএনজিটা পরিষ্কার করে মালিকের কাছে চাবিটা বুঝিয়ে দিয়ে পুঁটলিটা নিয়ে মেস বাসার রুমে আসলো। ততক্ষণে মাইকে সেহেরি খাওয়ার জন্য মসজিদের মাইকে ডাকাডাকি শুরু হলো। চৌকির তলায় সেহেরির খাবার রেখে রেখে যায় বুয়া। মেসের সবাই রোজা রাখে না। যে কয়েকজন একটু রোজা নামাজ করে তাদের মধ্যে হোসেন একজন। যারা রোজা রাখে বুয়া তাদের খাবার রেডি করে খাটের নিচে রেখে যায়। হোসেন পুঁটলিটা খুললো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো একটি লাল ফ্রক, পাঞ্জাবি, শাড়ি। মানে ঈদে প্রিয়জনকে দেয়ার জন্য একজন খেটে খাওয়া মানুষের ঈদের শপিং। জামা কাপড়ের মান বলে দেয় কত কষ্টের টাকায় কেনা এই উপহার। হোসেনের মনটা ছটফট করতে থাকে এই ভেবে যে ‘বেচারা পুঁটলির মালিকের জানি কী অবস্থা’ এগুলো হারিয়ে ফেলায় সাথে হয়তো তাদের ঈদের আনন্দটাও হারিয়ে গেছে। কোনোভাবে যদি মালিকের সন্ধান পাওয়া যায় তবে তাকে পৌঁছে দেয়া যেত। কিন্তু কিভাবে পাবে মালিকের সন্ধান! হোসেন পুঁটলিটা চৌকির উপরে পুরোটা খুলে ফেললো। হঠাৎ একটা খাতা চোখে পড়লো। খাতাটা খুলতেই বেশ কিছু মোবাইল নাম্বার চোখে পড়লো। হোসেন পুঁটলির মালিক খোঁজার একটা সম্ভাবনা হাতে পেয়ে খুব খুশি হলো। বারবার নাম ও মোবাইল নাম্বার পড়ে বুঝতে পারলো এখানে পুঁটলির মালিকের নাম্বার নেই। তবে তার বাড়ির নাম্বার আছে বলে মনে হলো। এক জায়গায় লেখা বাড়ি ০১**। হোসেনের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এইটা পুঁটলির মালিকের বাড়ির নাম্বার। একটা ফোন দিয়ে নিশ্চিত হতে চাইল। রিং হচ্ছে কেউ ধরছে না। বারবার ট্রাই করছে হোসেন। অগত্যা হোসেন সেহেরি খেতে বসলো। এমন সময় একটা মিছকল এলো ঔ নাম্বার থেকে। খাবার শেষ করে হোসেন কল ব্যাক করলো। অপর পাশ থেকে অল্প বয়সী একটা ছেলে সুন্দর করে সালাম দিলো।
– ওয়ালাইকুম সালাম।
– শোনো! আমি ঢাকা থেকে বলছি। তোমাদের কেউ কি ঢাকায় থাকে? হোসেন জানতে চাইল।
– হ্যাঁ আমার বাবা! কিন্তু তিনি তো সন্ধ্যায় ট্রেনে উঠেছেন। বাড়ি আসছেন।
– অহ! আচ্ছা শোনো। তোমার বাবা ভুলে একটা পুঁটলি রেখে গেছেন। এখন কিভাবে কী করি বলতো।
– কিসের পুঁটলি আংকেল। বাবা তো কিছু বলছেন না। আমাদের সাথে তো কথা হয়েছে। – আচ্ছা! তোমার বাবা কোন স্টেশনে নামবেন, বলতে পারো।
– হ্যাঁ তিনি জামালপুর ইস্টিশনে নামবেন।
– আচ্ছা তাইলে তোমার বাবাকে বলবে আমার মোবাইলে ফোন দিতে। আমি সকাল ৭টায় ট্রেনে উঠবো। আমাদের বাড়ি নেত্রকোনায়। জামালপুর স্টেশনে আমার সাথে দেখা করলে পুঁটলি দিয়ে দিতে পারবো।
– আচ্ছা আংকেল। বলে সালাম দিয়ে ফোন রেখে দিলো।
ফোন শেষ করতেই রাকিবের মা জানতে চাইল ‘কিরে কে ফোন করছে? কী হইছে?’
– আম্মু! বাবা নাকি নতুন কাপড়ের পুঁটলি সিএনজিতে ফেলে রেখে আসছে।
– কস কী! তোর বাবাকে ফোন দিয়ে জিগা তো, হাছা না মিছা!
– হুম দিচ্ছি, বলে রাকির তার বাবার নাম্বারে ডায়াল করলো। কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসলো ‘এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।’
রাকিব ও তার মায়ের টেনশন বেড়ে গেল। বাবার সাথে যোগাযোগ করতে পারছে না। বারবার সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলছে। আসলে এদিকে রহিম মিয়ার মোবাইলে চার্জ শেষ হওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে। রহিম মিয়াকে ফোনে না পেয়ে পুরো পরিবার চিন্তায় পড়ে গেছে। আবার পুঁটলি হারানোর চিন্তা তো আছেই। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না রাকিবের মা জোসনা বেগম। মেয়ে হাফসা উঠে মা ও ভাইয়ের চেহারা দেখে জানতে চাইলো কী হইছে। মা তাকে বললো কিছু না মা তুমি ঘুমাও। না মা! বাবা আসার সময় হইছে এখন আর ঘুমাবো না। বাবা এলে পরেই ঘুমাবো। এই কথা শুনে মা কী করবে কিছু ভাবতে পারছে না। রাকিব বারবার ফোন করে যাচ্ছে কিন্তু সংযোগ বিচ্ছিন্ন।
‘আচ্ছা আম্মু আমি বাবাকে স্টেশন থেকে আগায়া নিয়া আসি’ বললো রাকিব।
মা বললেন ‘একলা যেতে পারবি?’ ‘হ্যাঁ পারবো, আর যাওয়ার সময় আমার বন্ধ হাসিবকেও নিয়ে যাব।’
‘আচ্ছা তাহলে যা।’ মা অনুমতি দিলেন।
বোনটাও যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতে থাকলে মা তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে থামালেন।
৩.
রাকিব ও তার বন্ধু হাসিব রেলস্টেশনে অপেক্ষা করছে। তখনো ফজরের আজান হয়নি। ট্রেন আসার অপেক্ষায়, যে গেট দিয়ে বাবা বের হওয়ার কথা সেই গেটের এক পাশে রাকিব ও অন্য পাশে বন্ধু হাসিব দাঁড়িয়ে প্রতিটি মানুষকে পর্যবেক্ষণ করছে। ‘ঐ তো বাবা!’ চিৎকার করে উঠলো রাকিব। বাবাকে দেখে রাকিব বুঝতে পারলো যে, কিছু একটা হয়েছে। চেহারাটা ছিল মলিন। খুব দুর্বলভাবে হাঁটছিল। কাছাকাছি আসতেই বাবা বলে ডাক দিলো রাকিব। এতো লোকের ভিড়ে হয়তো শুনতে পায়নি। হাত উঁচু করে নাড়তে নাড়তে বার কয়েক ডাক দিতেই তাকালো রহিম মিয়া। অপ্রত্যাশিতভাবে ছেলেকে দেখে খুবই খুশি হলো সে। পরক্ষণে তার পুঁটলির কথা মনে হতেই কান্না এসে গেল। রহিম মিয়া ভাবছে ‘কাল ঈদের দিন নিশ্চয়ই নতুন জামার গন্ধ নিতে পাগল ছেলেটা স্টেশনে অপেক্ষা করছে। কিন্তু তার এই ঈদের এক পুঁটলি খুশি তো হারিয়ে গেছে ঢাকার রাজপথে। সে কি আর ফিরে পাওয়া যাবে?’ ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছে রহিম মিয়া। কাছে আসতেই রাকিব জড়িয়ে ধরলো বাবাকে।
অভিমানের সুরে জানতে চাইলো ‘সেই কখন থেকে ফোন দিয়ে যাচ্ছি, বাবা! তুমি ফোন ধরছো না কেন?’
– মোবাইলের চার্জ শেষ, তাই বন্ধ হয়ে গেছে। তো তোরা এখানে আসলি কেন?
– তোমাকে ফোনে না পেয়ে ভাবলাম স্টেশনে চলে যাই।
– আচ্ছা ভালো করেছিস। তো হাফসা ও তোর মা কেমন আছে?
– ভালো। ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে রাকিব বললো ‘বাবা! তোমার পুঁটলি নাকি সিএনজিতে রেখে আসছো?’
– রহিম মিয়া আশ্চর্য হয়ে বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইল ছেলের দিকে। ‘কেমনে জানলে তুমি বাবা?’
– ঐ সিএনজিওয়ালা ফোন করেছিল।
– কস কী! কী বললো তার পর?
– বললো লোকটার বাড়ি নেত্রকোনা। তিনিও ঈদে বাড়ি যাবেন। আর তোমাকে ফোন দিতে বলেছে। তাই তোমাকে ফোনে না পেয়ে আমরা দুইজন এখানে চলে এলাম।
রহিম মিয়া কথাগুলো যেন বিশ্বাসই করতে
পারছে না। পুঁটলি ফিরে পাওয়ার একটা সম্ভাবনা তার মুখের বিষণœতাকে দূর করে দিলো। ‘কই ফোন দে তো’ বলে তাড়াহুড়ো করতে লাগলো।
রাকিব ডায়াল কলের লিস্ট থেকে নাম্বারটা বের করে ডায়াল করলো। ঐ পাশ থেকে একটা সালামের শব্দ আসতেই ফোনটা সে বাবার কাছে দিয়ে দিলো।
– হ্যালো! ভাই আমি রহিম গতকাল সন্ধ্যায় আপনার সিএনজিতে পুঁটলিটা ভুলে রেখে আসছিলাম। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললো।- হ্যাঁ ভাই! আমি পেয়েছি। আপনি একটু কষ্ট করে বারোটার দিকে জামালপুর স্টেশনে থাকবেন। আমাদের ট্রেন জামালপুর স্টেশনে পৌঁছবে বারোটা থেকে সাড়ে বারোটার মধ্যে। আমি পাঁচ নম্বর বগিতে আছি। আপনি বগিতে উঠে আমাকে ফোন দিবেন। আপনার পুঁটলি পেয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ।
‘দুপুর বারোটায় থাকতে হবে এখানে’ ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন রহিম মিয়া।
৪.
– এখন তো মাত্র সকাল ছয়টা! আরো ছয় ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে। রহিম মিয়া বললো ‘চল তোর ফুফুর বাসায় যাই। অনেক দিন হলো তাকে দেখি না। আর এমনিতেই তো দাওয়াত দিতে আসতেই হতো।’ স্টেশন থেকে বেশি দূরে নয় বাসে ঘণ্টাখানেক লাগবে। তাই রহিম মিয়া ছেলে ও ছেলের বন্ধুকে নিয়ে বোনকে দেখতে ও ঈদের দাওয়াত দিতে চলে গেল। আর ফোনে রাকিব তার মায়ের কাছে সব কিছু বললো যাতে কোনো চিন্তা না করেন। বারোটা বাজতে এখনো পঁচিশ মিনিট বাকি। এক পুঁটলি ঈদের খুশির জন্য অপেক্ষা করছে তিনটি মানুষ। এই বুঝি ট্রেন এসে গেলো। তাড়াতাড়ি সবাই স্টেশনে গিয়ে বসে রইল। অপেক্ষা আর অপেক্ষা। অপেক্ষা করা অনেক ধৈর্যের কাজ। লম্বা একটা হুইসেলের আওয়াজ শুনে রাকিব উত্তেজিত হয়ে উঠলো। সারা শরীরে যেন এক অ্যাডভেঞ্চার ভাব চলে এলো। সে লাফ দিয়ে ট্রেনে উঠে যেতে চাইলো। কিন্তু বাবা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি এখানেই থাক আমি খুঁজে নিয়ে আসি।’ তাই আর ট্রেনে ওঠা হলো না। রহিম মিয়া পাঁচ নম্বর বগিতে উঠে মোবাইলে কল দিতেই শেষ মাথায় রিং বেজে উঠলো।
– হ্যাঁ ওই তো সিএনজিওয়ালা। এক দৌড়ে হোসেনের সামনে এসে দাঁড়ালো সে।
– ভাই আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। এই উপকার আমার জীবনে কখনো ভুলবো না। এই যুগে এমন আমানতদারিতা কারো মাঝে পাওয়া যায় না।
– ভাই আপনার ধন্যবাদ দিতে হবে না। এটা আপনার ভুল কিন্তু আমি তো ভুল করতে পারি না। আপনার জিনিস আপনার কাছে ফিরিয়ে দিয়ে আমি মুক্ত হয়েছি। যদি পৌঁছাতে না পারতাম তবে মনে অনেক কষ্ট পেতাম। আমি জানি এই পুঁটলিতেই আছে আপনার ও আপনার পরিবারের ঈদের খুশি। হোসেন তার পুঁটলি ফেরত দিলো এবং সাথে আরো একটি ছোট উপহার দিলো রাকিব ও তার বোনের জন্য। ট্রেন আবার চলতে শুরু করলো। কৃতজ্ঞচিত্তে তাকিয়ে রইলো রহিম মিয়া। ঝিক ঝিক ঝিক শব্দ করতে করতে অদৃশ্য হলো দৃষ্টির সীমা থেকে।

Share.

মন্তব্য করুন