শেষ হয়ে গেল বাংলাদেশ ক্রিকেটের একটি বড় অধ্যায়। অধিনায়ক হিসেবে নিজের শেষ ম্যাচটি খেলে ফেলেছেন মাশরাফি বিন মুর্তাজা। সিলেটে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ দিয়ে শেষ হয়েছে মাশরাফির নেতৃত্বের যুগ। সিরিজের তৃতীয় ম্যাচের আগের দিন বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক জানিয়ে দেন- তৃতীয় ম্যাচেই তিনি শেষ বারের মতো টস করতে নামবেন বাংলাদেশের হয়ে।
অবশ্য আভাসটা আগেই পাওয়া যাচ্ছিল। সিরিজের শুরুতেই ক্রিকেট বোর্ড জানিয়েছিল এই সিরিজের পর আর মাশরাফিকে অধিনায়ক হিসেবে রাখা হবে না। তারা পরবর্তী ২০২৩ বিশ্বকাপকে সামনে রেখে এখনই নতুন অধিনায়ক ঠিক করতে চায়। বয়স ও ফিটনেসের কথা চিন্তা করলে মাশরাফির পক্ষে ২০২৩ সালের বিশ্বকাপে খেলা সম্ভব নয় সেটি বোঝাই যাচ্ছে। তাই ক্রিকেট বোর্ড এখন থেকেই পরবর্তী অধিনায়ক নিয়ে চিন্তা করছে। (ইতোমধ্যে তারা ওয়ানডের নতুন অধিনায়ক হিসেবে তামিম ইকবালকে দায়িত্বও দিয়েছে।)
তাছাড়া গত কিছুদিন ধরে মাশরাফির ফর্ম ঠিক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সাথে মানানসই ছিলো না। গত ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে ৮ ম্যাচ খেলে পেয়েছেন মাত্র ১টি উইকেট। এরপর বিপিএলেও ভালো কিছু করতে পারেননি। তাই মাশরাফিকে নিয়ে সারাদেশের ক্রিকেট সমর্থকরা ছিলো বিভক্ত। ‘কেন যাচ্ছেন না?’- এমন প্রশ্নও উঠছিলো।
বিদায়ী ম্যাচে মাশরাফিকে সর্বোচ্চ সম্মান দেখিয়েছে ক্রিকেট বোর্ড ও জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা। সিরিজে জিম্বাবুয়েকে রীতিমতো উড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। তিন ম্যাচের প্রতিটিতেই তিনশোর উপর রান এসেছে। তামিম ইকবাল ও লিটন দাসের দুটি করে সেঞ্চুরি। শেষ ম্যাচে দুজনে গড়েছেন বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ রানের উদ্বোধনী জুটির রেকর্ড(২৯২)।
১৯৯৯ সালে এই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই ১৭০ রানের জুটি গড়েছিলেন মেহরাব হোসেন অপি ও শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ। এতদিন সেটিই ছিলো ওয়ানডেতে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ রানের উদ্বোধনী জুটি। ২১ বছর আগের সেই রেকর্ড ভেঙে দিলেন তামিম ও লিটন। তারা করেছেন ২৯২ রান। আগের ম্যাচে তামিমের করা বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডেতে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ ১৫৮ রানের রেকর্ড ভেঙে এদিন লিটন খেলেন ১৭৬ রানের ইনিংস। তাই মাঠে সেরাটা দিয়েই অধিনায়ককে বিদায় জানাতে চেষ্টার কমতি ছিলো না ক্রিকেটারদের। খেলা শেষে মাঠের মাঝখানেই তামিম ইকবাল কাঁধে তুলে নেন মাশরাফিকে। এরপর সবাই পরেন মাশরাফির ২ নম্বর জার্সি- যার বুকে লেখা ছিল ‘থ্যাংক ইউ ক্যাপ্টেন’। ক্রিকেট বোর্ডের পক্ষ থেকে বিশেষ ক্রেস্ট উপহার দেয়া হয় বিদায়ী অধিনায়ককে।
অধিনায়ক মাশরাফি নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় অধ্যায়গুলোর একটি হয়ে থাকবেন। আগে অধিনায়কত্ব পেয়েও বারবার ইনজুরির কারণে খেলার বাইরে চলে যেতে হয়েছে। শেষ দফায় ২০১৪ সালে এই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই টি-টোয়েন্টি ও ওয়ানডে অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তাকে। তারপর থেকেই সীমিত ওভারের ক্রিকেটে- বিশেষ করে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের উত্থান। এরপর টাইগারদের গর্জন শুনেছে বাংলাদেশ। সাধারণ একটি দল থেকে সারা বিশ্বে সমীহ জাগানিয়া দল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ।
ভাঙা চোর একটি দল যে শুধুমাত্র একজন নেতার কারণে দাপুটে হয়ে উঠতে পারে তার জলন্ত প্রমাণ মাশরাফির বাংলাদেশ। যে দলটাই আগে বড় দলগুলোর বিরুদ্ধে খেলতে নামলে হারার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামতো। মাশরাফি তাদের মনে এই বিশ্বাসটা এনে দিয়েছেন – যেকোন দলের দলের বিপক্ষে আমরা জিততে পারি। এখন যেমন বাংলাদেশ যেকোন দলের বিপক্ষে খেলতে নামলে জয়ের আশা নিয়ে মাঠে নামে, ২০১৪ সালের আগের বাংলাদেশর কথা যদি তোমরা চিন্তা করো তখন কিন্তু সেটি ছিলো না। মাশরাফির জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় পাল্টে গেছে পুরো দলটি।


প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে বাংলাদেশ(২০১৫)। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে খেলেছে(২০১৭), এশিয়া কাপের ফাইনালে খেলেছে(২০১৯)। এখানেই শেষ নয় ২০১৫ বিশ্বকাপের পরপরই দেশের মাটিতে ওয়ানডে সিরিজে হারিয়েছে তিন পরাশক্তি- পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে। যা এক সময় বাংলাদশের ক্রিকেট ভক্তরা কল্পনাও করতে পারতো না। মোট ৮৮টি ওয়ানডেতে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছেন মাশরাফি, যার মধ্যে ৫০টিতে জিতেছে দল। হেরেছে ৩৬টিতে। সাফল্যের হার ৫৮ শতাংশ, যা বিশ্বের অনেক নামী দামি অধিনায়কের রেকর্ডবুকে নেই। ২৮ টি-টোয়েন্টিতে নেতৃত্ব দিয়েছে জয় এনে দিয়েছেন ১০টিতে। একটি মাত্র টেস্টে নেতৃত্ব দিয়েছেন দলকে। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে টেস্টের মাঝপথেই ইনজুরি আক্রান্ত হয়ে চলে যান মাঠের বাইরে। এরপর আর ফিরতে পারেননি টেস্ট ক্রিকেট। তার নেতৃত্ব দেয়া সেই একমাত্র টেস্ট ম্যাচটিতে কিন্তু জয় পেয়েছিল বাংলাদেশ!
এত সাফল্যের পরও একটি শিরোপার আফসোস ছিলো দর্শক-সমর্থকদের। সবাই চাইছিলো ক্রিকেটে এতকিছু এনে দেয়া মাশরাফির হাতে অন্তত একটি শিরোপা উঠুক। অবশেষে সেই খরা কেটেছে ২০১৯ সালের মে মাসে। ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়ার আগে আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় একটি সিরিজ খেলেছিল বাংলাদেশ। যেখানে ফাইনালে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে প্রথম কোন বহুজাতিক আসরের শিরোপা জেতে বাংলাদেশ। সেই শিরোপা এসেছে মাশরাফির হাত ধরেই।
তবে জয় কিংবা শিরোপার চেয়েও মাশরাফি অনন্য হয়ে থাকবেন তার নেতৃত্বের জাদুকরী ক্ষমতার কারণে। নেতৃত্বের দিক থেকে তাকে তুলনা করা হয় পাকিস্তানের বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক ইমরান খানের সাথে। দলকে একটি পরিবার হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন মাশরাফি। মাঠে কিংবা ড্রেসিং রুমে অথবা জাতীয় দলের বাইরেও প্রতিটি ক্রিকেটারের সাথে তার ছিল আন্তরিক সম্পর্ক- কখনো বন্ধু, কখনো সতীর্থ আবার কখনো অভিভাবক হয়ে যেতেন মাশরাফি। সবার বিপদে আপদে আগলে রাখার যে দায়িত্বশীলতা তা সত্যি বিরল। তামিম ইকবাল কিংবা লিটন দাসদের ক্যারিয়ারে যখন খারাপ সময় গেছে, চারদিকে সমালোচনা উঠেছে দল থেকে বাদ দেয়ার জন্য তখন বরাবরই মাশরাফি তাদের পাশে দাড়িয়েছেন। সমর্থন সহযোগিতা দিয়ে গেছেন, জুগিয়েছেন সাহস।
তবে সব কিছুরই একদিন শেষ হয়। মাশরাফির নেতৃত্বের যুগও তাই চিরস্থায়ী হওয়ার ছিলো না। খেলোয়াড় মাশরাফি হয়তো আরো কিছুদিন থাকবেন আমাদের মাঝে। জাতীয় দলে কিংবা ঘরোয়া ক্রিকেটে ছুটবেন বলহাতে; কিন্তু নেতা মাশরাফি যুগ শেষ হয়ে গেল। তিনি যা এনে দিয়েছেন এদেশের ক্রিকেটে তা চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

Share.

মন্তব্য করুন