‘ঐ দেখো বাবা! বাড়িটা কত সুন্দর! ইস! আমাদের বাড়িটা যদি এমন হতো!’ বাবার হাত ধরে হেঁটে স্কুলে যাওয়ার পথে সায়মা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বাবাকে লক্ষ্য করে বলছে, কিন্তু বাবা মেয়েকে তাগাদা দিচ্ছেন, ‘মামণি দ্রুত চল, তোমাকে স্কুলে দিয়ে আমাকে অফিসে যেতে হবে।’ সায়মা মন খারাপ করে দ্রুত হাঁটতে থাকে। অনেক মেয়ে প্রতিদিন গাড়িতে করে স্কুলে আসা-যাওয়া করে। আর সায়মা প্রতিদিন বাবার সাথে হেঁটে স্কুলে আসে আবার ছুটির পর মায়ের সাথে হেঁটে বাড়ি ফিরে। রিকশাও চড়তে পারে না। এ সব ভেবে সায়মার সব সময় মন খারাপ থাকে। সবচেয়ে বেশি মন খারাপ হয় টিফিন আওয়ারে। প্রতিদিন রুটি সবজি অথবা নুডুলস খেতে সায়মার ভালো লাগে না। ক্লাসের অন্য মেয়েরা স্কুল ক্যাফে থেকে বার্গার, সেন্ডউইচ, চিকেন ফ্রাই কত কী খায়! এসব দেখে মন খারাপ হয় তার। স্বল্প বেতনের চাকরিজীবী বাবা মেয়ের মনের কথা বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকেন।
শুক্রবার সকালে বাবা বললেন, ‘মামণি! চল আজ আমরা ঘুরতে যাব।’ শুনে সায়মার আনন্দ দেখে কে! তারা শিশুপার্কে গিয়ে অনেক মজা করলো। ফেরার পথে বাবা সায়মাকে নিয়ে পাশের বস্তির গলিতে একটা ঘরের সামনে দাঁড়ালেন। মধ্য বয়স্ক এক মহিলা বেরিয়ে এসে সালাম দিলেন সায়মার বাবাকে। সায়মা এই মহিলাকে আগে কখনো দেখেনি। আসলে তিনি সায়মার বাবার অফিসে আয়ার কাজ করেন। মহিলাটি তাদেরকে ঘরে নিয়ে গেলেন। ছোট্ট একটি ঘরে মহিলার সংসার। সেখানে কোনো খাট বা চৌকি নেই মেঝেতে পাটি বিছিয়ে তিন মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে থাকেন। কয়েকটা পরিবারের জন্য একটা বাথরুম, একটা রান্নার চুলা, তিন মেয়ে পড়াশুনা করে তবে নেই কোনো চেয়ার-টেবিল। দুই কিলোমিটার দূরের একটা স্কুলে প্রতিদিন হেঁটে স্কুলে যায়। তারা কোনো টিফিন নিতে পারে না। তাদের করুণ অবস্থা দেখে সায়মার চোখেও জল এসে গেল। বিলকিস ও তার মেয়েদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রিকশায় উঠল সায়মারা। বাবা বলতে শুরু করলেন, ‘ওরা কত কষ্ট করে তাই না মামণি!’ হ্যাঁ বাবা! সায়মার ছোট্ট জবাব।
বাবা বললেন, ‘তোমার কিন্তু আলাদা ঘর, পড়ার জন্য চেয়ার টেবিল, ঘুমানোর খাট আছে, প্রতিদিন স্কুলে টিফিন নিয়ে যাও আর তাদের এইসব কিছুই নেই। সুতরাং তোমাকে আল্লাহ তায়ালা তাদের চেয়ে অনেক ভালো রেখেছেন।’ সায়মা বাবার কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে। বাবা বললেন, শোনো মামণি! একটি হাদীস বলি, “আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কারও দৃষ্টি যদি এমন লোকের উপরে পড়ে, যে তার তুলনায় ধন-সম্পদ ও স্বাস্থ্য সৌন্দর্যে শ্রেষ্ঠ। তখন তার উচিত তার চেয়ে নিম্নতম ব্যক্তির দিকে তাকানো।” (বুখারি- ৬০৪৩ নম্বর হাদীস)। এই হাদীসের ব্যাখ্যা হলো, ‘আমাদের চেয়ে যারা ধনী, তাদের আভিজাত্য, ভোগ-বিলাসী জীবনের দিকে তাকিয়ে আফসোস করা, লোভ করা উচিত নয় বরং আমাদের উচিত আমাদের থেকেও যারা গরিব, অসহায় তাদের দিকে তাকানো। আল্লাহ আমাদেরকেও ঐ বস্তির বাসিন্দা বানাতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তাদের থেকে ভালো অবস্থান দান করেছেন। সে জন্য আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত সবসময়। সুতরাং উপরের দিকে নয় তাকাও নিচের দিকে এবং দেখ কত মানুষ তোমার থেকে খারাপ অবস্থানে আছে।’ সায়মা তার ভুল বুঝতে পারলো। সে আর কখনো এমন কোনো আবদার করে না যা তার বাবার পক্ষে পূরণ করা সম্ভব না।

Share.

মন্তব্য করুন