খেলার মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে আছে অয়ন। আজ তার মন খুব খারাপ। স্কুল ছুটির পর এখনো সে বাড়ি যায়নি। ম্যাথ ক্লাস টেস্ট এ সবাই যেখানে কুড়িতে কুড়ি পেয়েছে সেখানে ও পেয়েছে মাত্র দুই। শিপন স্যারের একটা বকাও মাটিতে পড়েনি।এ নিয়ে দশের ঘর ছাড়ালো।ম্যাথ না মিলাতে পেরে আরও যে কতদিন জারি খেতে হবে কে জানে!এখন বাড়িতে যেতেও ভয় লাগছে। এদিকে রতনের সাথেও তার হয়েছে তুমুল ঝগড়া। গত ক্লাসে রতন ঠাট্টা করে হেসেছিল বলে অয়ন তার খাতার পাতা ছিঁড়ে দিয়েছিল। আর তাতে রতন আরও ক্ষেপে যায়। দু’জন দু’জনার শার্ট তো ছিঁড়ে ছিলই বরং প্যান্ট ধরে টানাটানি শুরু হয়েছিল। শেষমেশ রফিক স্যর এসে এই দুইজনকে সবার সামনে কান ধরিয়ে পঞ্চাশবার উঠবস্ করিয়ে তবেই মুক্তি দিয়েছিল। স্যার না থাকলে সেদিন হয়ত দু’জনের স্কুলব্যাগ দুটোরও অস্তিত্ব থাকতো না। মা অবশ্য সেই ব্যাপারে জেনেছিল। কানে হাত গেলেই এখনও ব্যথাটা অনুভব হয়। বাবা জানলে হয়ত স্কুলে যাওয়াই বন্ধ করে দিত আর বলত, ‘অনেক কিছু করেছ বাবা, আর স্কুলে গিয়ে কাম নেই। এই যে কাঁচি নাও আর মাঠে গিয়ে বলদের জন্য এক বস্তা ঘাস কেটে নিয়ে আস।’ অথবা এত কিছু না বলে সরাসরি মুখ ফসকে বলে দিতে পারে, ‘মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্তই।’ বিকেলের পাখিরা তখনও ঘরে ফেরেনি। পাখিদের মধ্যও হয়তবা দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। তা না হলে বাঁশঝাড়ে বসে এত কেন চিৎকার চেঁচামেচি করে! ঝগড়া কি তাদের ঘরে ফেরার সুখ দেয়? অয়নের ভাবনার মাঝে কে যেন তার মাথায় নিঃশব্দে একটা টোকা দিল। অয়ন চমকে উঠে পেছনে তাকাল। কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। অথচ অয়নের ভুল হবার কথা নয়। কিছুক্ষণের মধ্য ̈ই আরেকটা টোকা। এবার অয়ন থামল না। আশপাশে খুঁজে হঠাৎ আমগাছের উপরে চোখ গেল। একি! কচি বয়সের দুরন্ত একটা ছেলে আমগাছের ডালে উপুড় হয়ে ঝুলে আছে। অয়ন ভয় পেয়ে গেল।‘এই তুমি ওখানে কী করছ? পড়ে যাবে তো। তাড়াতাড়ি নিচে নেমে এসো।’-অয়ন কথাটা বলতে না বলতেই ছেলেটা গাছের ডাল থেকে হাত ছেড়ে দিল। আর অমনি ধপাস করে মাটিতে পড়ল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ আবার উঠে দাঁড়িয়ে অয়নের সামনে এসে বলল, আমি যখন তোমার মাথায় টোকা দিয়েছিলাম, তখন তুমি ভয় পেয়েছিলে, তাই না?’অয়ন একটা স্বস্থির নিষ্শাষ ফেলে বলল, ‘না, পাইনি।’‘কেন পাওনি?’‘জানি না, তার আগে বল তুমি গাছ থেকে ওই ভাবে হাত ছেড়ে দিলে কেন? যদি ব ̈থা পেতে? পা দুটি যদি ভেঙে যেত তখন কী করতে?’‘ও, তার মানে তুমি আমার পা ভাঙা নিয়ে চিন্তিত ছিলে, এক কথায় অয়ন ভয় পেয়েছিল।’অয়ন চমকে উঠে বলল, ‘তুমি আমার নাম জানলে কী করে?’‘আমি শুধু নাম না, তোমার সবকিছুই জানি। তুমি আজ ক্লাসে তোমার নিজের নাম লিখতে ভুল করেছিলে। ‘অয়ন’ না লিখে লিখেছিলে ‘অযন’। স্যার যখন তোমায় বকা দিচ্ছিল তখন আমি বাইরে ডাবগাছের মাথায় বসে পানি খাচ্ছিলাম আর হাসতে হাসতে গাছ থেকে পড়েও গিয়েছিলাম। এই যে দেখো আমার পা-টা ভাঙা।’ এই বলে ছেলেটা নিচু হয়ে তার পা-টাকে টান দিয়ে খুলে অয়নের সামনে মেলে ধরল। আকাশে যেন অমনি বিজলি চমকে উঠল। অয়ন আর ঠিক থাকতে পারল না। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।অয়নের যখন জ্ঞান ফিরে তখন সে নিজেকে নদীর ঠিক মাঝখানে নৌকার মাঝে পড়ে থাকতে দেখল। তখন চারদিকে বাতাস হু হু করে বইছে। নদীতে ঢেউ ফুলে ফেঁপে উঠছে। আর সেই ঢেউয়ে নৌকা দুলছে আপন মনে। তার মাথার কাছেই বৈঠা হাতে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অদ্ভুত ছেলেটা। অয়ন কাঁচুমাচু করে বলল, ‘তুমি কে?’‘ডাহুক, আমায় তুমি ভয় পেয়ো না। আমার জন্মের সময় আমাকে দেখতে নাকি ডাহুক পাখির মত লাগত, তাই মা আদর করে আমার নাম রেখেছে ডাহুক। আমি তোমার মত মানুষ না হলেও ভালো একজন বাচ্চা ভূত। আর আমার এখনও সব ̧লো দাঁত গজিয়ে ওঠেনি। এই যে দেখ..।’- ডাহুক তার পঁয়তাল্লিশটা দাঁত অয়নকে দেখিয়ে আবার বলল, ‘বয়সটা যদিও বিশ এর ঘর ছাড়ায়নি তবে মা বলেছে আমি নাকি পেকে গেছি। তাই আমার ফিডার খাওয়া বারণ করা দিয়েছে।’‘কিন্তু তুমি কোথায় থাকো? আর এখানে কেন? আমার সাথে তোমার কী কাজ?’- বলল অয়ন।‘আমরা তোমাদের এই গ্রামেই থাকতাম। ঐ যে ছোট দীঘিটা দেখতে পাচ্ছ তার ঠিক পাশেই আম গাছটার মাথায়। তোমাদের এই মাঠেই আমরা খেলতাম। কিন্তু তোমার বাবা ও কাকু একদিন…’- বলতে বলতেই থেমে গেল ডাহুক।‘আমার বাবা ও কাকু তোমাদের কী করেছে?’‘আমাদের অস্তিত্বকে ধ্বংস করে দিয়েছে।’‘কী বলছ তুমি? এটা কিভাবে সম্ভব? আর তারা এ কাজ কেন-ই বা করতে যাবে?’‘জিদ। সব কিছু জিদের কারণে করেছে। পৌষ মাসের শেষটায় তোমার বাবা একদিন পালং তৈরির জন্য আম গাছটার পাশে জামগাছটা কেটে ফেলে। আর তাই দেখে তোমার কাকু পরদিন আমাদের থাকার প্রিয় আম গাছটাকেই টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলে।’ ‘হুম। আমি এটা জানি। এ নিয়ে উনাদের মাঝে থেকে যেন উড়ে এসে লাগল আ ̧ন। তাতে গমক্ষেত তো পুড়ল পুড়লই, আমার বাপটাকেও ছাই বানিয়ে নিয়ে গেল। অবশ্য খানিক পরেই বুঝতে পারি এই কাজটা কে করেছে!’‘কে করেছিল?’- রাগত স্বরে বলল অয়ন।‘তোমার কাকু। তোমার কাকুর আমগাছটা কেটে ফেলার পর থেকেই এই সব কাণ্ড-লীলা আরও দ্বিগুণ হারে বেড়ে যায়। তোমার বাবা কোন কথা না বলে বাগান থেকে মিষ্টি বরই গাছটা রাতের অন্ধকারে কেটে দীঘির জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল। তোমার কাকু এতে তেলে বে ̧নে জ¦লে ওঠে। এমন একটা কাণ্ড ঘটিয়ে দিল তাতে তার বুক কাঁপল না একটুকুও। ভাই ভাই যুদ্ধে শুধু কপাল পুড়ল আমার।’- ডাহুক কথা ̧লো বলতে বলতে হু হু করে কেঁদে উঠল।‘তোমার কি প্রতিশোধ নিতে ইচ্ছে করেনি?’ অয়ন বলল।‘ইচ্ছে করেছিল। মনে হচ্ছিল যেন সেই মুহূর্তেই তোমার বাবা ও তোমার কাকুর ঘাড় মটকে দিয়ে আসি। কিন্তু পারিনি।’‘কেন?’‘তোমাদের দিকে তাকিয়ে। তোমরা ভাই বোনেরা আমার মত বাবা হারা হয়ে যাবে, এই ভেবে।অয়ন ড্যাব ড্যাব করে কেবল তাকিয়ে আছে ডাহুকের দিকে। শরীরে তার হালকা কাঁপুনি। মনে হচ্ছে নৌকা থেকে ছিটকে পড়ে যাবে পানিতে।‘এখন তুমি কী করবে?’- নিচু স্বরে কথাটা বলে ফেলল অয়ন।‘চলে যাবো। অনেক দূরে চলে যাবো। যেখানে মানুষ নামের কোন খারাপ প্রাণী বাস করে না সেখানে।’

Share.

মন্তব্য করুন