অরিন ও অন্তরা

পড়ন্ত বিকেলে পিয়ারীকে সাথে নিয়ে বাসার পাশের আম গাছটার নিচে
খেলতে যায় শিমু। কখনো বর বউ খেলা কখনো বা রান্না বান্না খেলা
আবার কখনো বা বুড়ো চু-কিত কিত খেলা, খেলার সংগী সাথী বেশি
হলে খেলার ধরণ ও পাল্টায় ওরা।
পিয়ারী বলল
‘খালাম্মা মার কাল থেকে ভিষণ জ্বর, মা কাজে আসতে
পারবে না, মা আমাকে কাজের জন্য পাঠিয়েছে।
শিমুর আম্মু বলল
না- তোমার আর কাজ করতে হবে না। তুমি স্কুলে
যাও।
শিমু পড়ার ঘর থেকে পেরিয়ে এসে বলল পিয়ারী
আমি স্কুল থেকে ফিরে এসে বিকেলে তোমার মাকে
দেখতে যাবো।
পিয়ারী আচ্ছা বলেই চলে গেল।
বিকেলে পিয়ারীদের বাসায় গেল শিমু। ও দেখলো বুয়া
জ্বরে কাতরাচ্ছে।
শিমুকে দেখে ধড়ফড়
করে উঠে বসলো বুয়া,
সে বলল
শিমু আপু আপনি
আইছেন?
হ্যাঁ আপনার শরীর
খারাপ জেনে দেখতে
এলাম। ডাক্তার
দেখিয়েছেন?
না।
এটা আপনি ঠিক করেননি?
সন্ধ্যায় যাবো ডাক্তারের কাছে।
ডাক্তার দেখাবার টাকা আছে?
যা আছে চলে যাবে।
পিয়ারী বাসায় আসেনি এখনো?
না ও স্কুল শেষ করে এক বড় ভাইয়ের কাছে সপ্তাহে
দু’দিন প্রাইভেট পড়ে। ছেলেটা খুবই ভালো, গরীবের
কষ্ট বোঝে, ও টাকা পয়সা নেয় না।
এভাবে হবে না আপু?
তাহলে এখন কি করবো শিমু আপু?
পিয়ারীর ভালো রেজাল্ট করতে হবে তাই ওকে
ঠিকমত লেখাপড়া করতে হবে। তার জন্য ভালো
টিউটর মাস্টারের প্রয়োজন।
কিন্তু আপু!
কোন কিন্তু নয়, টাকা পয়সা যা লাগে আমি দেব।
কিন্তু আপু! এত টাকা আপনি পাবেন কোথায়?
ওসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি শুধু
ওর দিকে খেয়াল রাখবেন।
আপু, আপনি এত কিছু করছেন জানতে পারলে আমার
চাকুরীটাই চলে যাবে।
বললেই হলো, কিভাবে চাকুরী যায় আমি দেখবো।
শিমু বুয়ার হাতে দু’শ টাকা গুজে দিয়ে বলল, ফল
ফুলরী কিনে খাবেন। আমি তো সংগে আনতে
পারলাম না।
শিমু পথে নামে। বুয়া উঠতে যায়। কিন্তু পারে না।
পিয়ারী শিমুদের বাসার কাজের বুয়ার মেয়ে সেও
শিমুর সাথে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। তবে স্কুল ভিন্ন।
পিয়ারীর প্রাইভেট টিউটর নেই, পড়াশুনা দেখিয়ে
দেওয়ার ও তেমন কেউ নেই। তারপরেও ওর রোল
১।
ঠিক সন্ধ্যার সময় খেলা শেষে বাসায় ফেরে ওরা
পিয়ারী মায়ের সাথে বাসায় যাবে, বাসায় যেয়ে প্রায়
রাত বারোটা পর্যন্ত পড়াশুনা করবে সে তার মাঝে এক
সময় রাতের খাবার খেয়ে নেবে। সকাল হলে কিছুক্ষণ
পড়াশুনা করে স্কুলের দিকে পা বাড়াবে। পিয়ারীর মা
শিমুদের বাসায় কাজ করতে যাবে। এই ওদের নিত্য
দিনের রুটিন,
বিকেলে সময় পেলে
শিমুর সংগে মাঝে
মধ্যে খেলতে যায়
পিয়ারী। ওর বাবা
নেই। তার কাছেই
মানুষ। জন্মের পরও
বাবাকে দেখেনি,
নিরুদ্দেশ, বেঁচে
আছে না মরে গেছে
তাও জানে না ওরা। রাতে খাওয়া শেষে শিমুর
আম্মুকে আলাদা ডেকে শিমুর আব্বু শাহেদ আলী
বলল-
দেখো শিমুর আম্মু আমি ক’দিন ধরে লক্ষ করছি
আমাদের শিমু কাজের বুয়ার মেয়ের সাথে খেলতে
বের হচ্ছে, এটা বড় দৃষ্টিকটু এবং বেমানান, আর
তাছাড়া কাজের বুয়ার ছেলে মেয়েরা অধিকাংশ
চোর-ছ্যাছড়া হয়ে থাকে তোমরা ওকে আশকারা দিয়ে
এমন মাথায় তুলছ, না জানি কখন কোন ক্ষতি করে
বসে। শিমুর আম্মু এক গাল হেসে বলল
“নানা শিমুর আব্বু, আমাদের পিয়ারী তেমন মেয়েই
নয় আর তাছাড়া পিয়ারী মেধাবী, সে লেখাপড়ায়
অনেক ভালো, হয়তো ভালো গাইডের অভাবে এগুতে
পারছে না।”
শাহেদ আলী এক ধরনের রাগ দেখিয়েই বলল “ঐ
বিশ্বাস নিয়েই থাকো, শুধু এটুকু বলে রাখি বুয়ার
মেয়ের কি হবে এটা আমার জানার বিষয় নয়। কিন্তু
শিমুর যদি লেখাপড়ার বিঘ্ন হয় তাহলে আমি কিন্তু
তোমাদের কাউকে ছাড়বোনা।
আবারও শিমুর আম্মু এক ধরনের কৃত্রিম হেসেই বলল‘আচ্ছা সে তখন দেখা যাবে। এখন ঘুমিয়ে পড়োতো।
সকালে আবার অফিসে ছুটতে হবে। পরদিন সকালে
পিয়ারী শিমুদের বাসায় এল, ওকে দেখেই শিমুর আম্মু
বললকিরে পিয়ারী তুই এত সকালে কেন? তোর মা এলো
না যে?
শরীর দুর্বল, গা হাত পা কাঁপছে।
যখন সন্ধ্যা সমাগত, তখন বাসায় ফেরে শিমু। হঠাৎ
আব্বুর সামনে পড়ে গেল সে।
আব্বু জিজ্ঞাসা করলো, এই অসময়ে তুমি কোথায়
গিয়েছিলে শিমু?
শিমু আমতা আমতা করে বলল,
পিয়ারীদের বাসায়।
হঠাৎ ক্ষেপে যেয়ে শিমুর আব্বু বলল, পিয়ারী, পিয়ারী,
পিয়ারী, ঐ পিয়ারীই তোমার মাথাটা খাবে।
শিমুর আম্মু এসে ওকে ভিতরে নিয়ে গেল। কদিন ধরে
পিয়ারী আর শিমুদের বাসায় খেলতে আসে না।
হয়তো পড়াশুনার চাপ
নতুবা অন্য কিছু।
পিয়ারীর মা কাজে
যোগ দিয়েছে।
শরীরটা এখনো পুরো
সুস্থ নয়। একদিন
স্কুল থেকে ফেরার
পথে দেখা হল
পিয়ারীর সাথে।
পিয়ারীকে কাছে টেনে
নিয়ে শিমু বলল-কি ব্যাপার পিয়ারী? তুমি আমাদের
বাসায় এখন আর খেলতে আস না কেন? তোমার কি
ভীষণ পড়ার চাপ? পিয়ারী কিছু বলল না।
শিমু বলল- কি ব্যাপার কিছু বলছো না যে?
এবার পিয়ারী আমতা আমতা করে বলল-
আমি খেলতে গেলে তোমার আব্বু তো ভীষণ রাগ
করে।
কে তোমাকে এসব কথা বলেছে?
আমি সব জানি।
শোন, তুমি খেলতে না আসো দুঃখ নেই। কিন্তু তুমি
ভালো করে লেখাপড়া চালিয়ে যেও। তোমাকে প্রমাণ
করতে হবে বুয়ার ছেলেমেয়েরাও লেখাপড়া শিখে
মানুষ হতে পারে।
পিয়ারী ঘাড় নাড়ালো।
শিমু আবারো বলল, তুমি টাকা পয়সার জন্য চিন্তা করো
না, ও বিষয় আমি দেখবো, শিমু ঘাড় নেড়ে চলে গেল।
একদিন সন্ধ্যায় পিয়ারীর মা কাজ শেষ করে বাসায়
যাওয়ার পথে শিমু তাকে বলল, আপু দাঁড়ান?
চেয়ে দেখলো শিমু দাঁড়িয়ে, পিয়ারীর মা বলল-
আপু কিছু কবেন?
শিমু-এক হাজার টাকার দুখানা নোট পিয়ারীর মার
দিকে এগিয়ে দিয়ে বললআপা, এই দুই হাজার টাকা রেখে দেন।
পিয়ারীর মা আরো বিচলিত হয়ে বলল, নানা আপু,
একি করছেন, খালাআম্মা, খালুজান জানলে আমার
কাজটাই চলে যাবে।
শিমু এক রকম জোর করেই বুয়ার হাতে টাকাটা গুজে
দিয়ে বলল-
কিছু হবে না, সব আমি দেখবো।
শিমু বাসায় ফিরলে আম্মু অনেকটাই ধমকের সুরে
বলল-
শিমু, তোমার আব্বু কিন্তু তোমার উপর খুব রেগে
আছে, তুমি পিয়ারীর সঙ্গে আর বেশি মিশো না, শিমু
বললো-
তুমিও একথা বলছো আম্মু?
আম্মু আর কথা বাড়ালো না।
পরদিন সকালে অফিসে যাওয়ার পথে শিমুর আব্বু
দেখলো মানি ব্যাগে
দুই হাজার টাকা
নেই।
রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে
শিমুর আম্মুকে ডেকে
বলল-
আমি তখনই
বলছিলাম, এসব চোর
ছ্যাছড়া বাসায় রাখতে
যেও না। শুনলে না
আমার কথা। মানি ব্যাগ থেকে দু’হাজার টাকা চুরি
হয়ে গেছে। এ সব ঐ পিয়ারীর কাজ। পিয়ারীই চুরি
করেছে এ টাকা।
ধীর পায়ে আব্বুর সামনে এসে দাঁড়ালো শিমু। তারপর
জোরালো কন্ঠে বলল, পিয়ারী টাকা চুরি করেনি আব্বু,
মানি ব্যাগ থেকে টাকা নিয়েছি আমি।
তুমি টাকা নিয়ে কি করেছ?
টাকাটা আমি পিয়ারীকে দিয়েছি।
কেন তুমি টাকা নিয়ে পিয়ারীকে দিয়েছো?
ওর লেখাপড়ার জন্য টাকাটা খুব দরকার।
তাই বলে তুমি টাকাটা আমাকে না বলে নেবে?
এটা আমার অন্যায় হয়েছে আব্বু। তবে পিয়ারীকে
টাকাটা দিয়ে আমি ভুল করেনি।
শিমুর আব্বু রাগে কাঁপতে লাগলো।
শিমুর মাকে উদ্দেশ্য করে বলল-
তোমার মেয়েকে বোঝাও শিমুর আম্মু। নইলে আমি
কিন্তু ওর পড়াশুনা বন্ধ করে দোব।
কেন তুমি এসব করতে গেলে শিমু। এসব কথা বলতে
বলতে শিমুকে পাশের ঘরে নিয়ে গেল আম্মু।
এর কয়েক মাস পর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার
ফলাফল প্রকাশিত হলো। পিয়ারীর ফলাফল দেখে
সবার চক্ষু ছানা বড়া। পিয়ারী A+পেয়েছে ও
ট্যলেন্ট পুলে বৃত্তি এবং শিমুও A+ পেয়েছে কিন্তু
সাধারণ গ্রেডে বৃত্তি।
শিমুর আব্বুর কন্ঠ ভারী হয়ে এল। একবার শুধু বলল,
শিমুর আম্মু, আজ বুঝলাম শিমু কাজটা মন্দ করেনি।

Share.

মন্তব্য করুন