বিস্ময়কর সৃষ্টি অরোরা। অরোরা কেমেরু জ্যোতিও বলা হয়। মেরু অঞ্চলের আকাশে দৃশ্যমান অত্যন্ত মনোরম এবং বাহারী আলোকচ্ছটাকে এক সময় অতিপ্রাকৃতিক বলে বিবেচনা করা হলেও বর্তমানে তা নিতান্তই প্রাকৃতিক ঘটনা বলে প্রমাণিত। মেরুজ্যোতি দেখতে অতি প্রাকৃতিক কোন ব্যাপার মনে হয় বলে প্রাচীনকাল থেকেই মেরু অঞ্চলের বাসিন্দারা একে এক রহস্যময় শক্তি হিসেবে মনে করতো। অধিকাংশ মানুষ মনে করতো এটি স্বর্গীয় আলো, যা স্বর্গ থেকে শুরু হয়ে পৃথিবীতে এসে শেষ হয়েছে, এই পথ ধরেই মৃত্যুর পরে আত্মা স্বর্গের সন্ধান লাভ করে। সবুজ রঙের প্রভাকে তারা ভাবতো তাদের ভবিষ্যতের সুখ ও উন্নতির আভাস। আর এর রঙ লাল হলেই তাদের মনে হতো ভবিষ্যৎ হবে দুর্যোগময়, সংকটপূর্ণ। লোহিত মেরুপ্রভাকে যুদ্ধের পূর্বাভাস হিসেবেও দেখা হতো। বর্তমানে এসব ধারণার পরিবর্তন হয়েছে।
উত্তর গোলার্ধে এটি অরোরা বোরিয়ালিস এবং দক্ষিণ গোলার্ধে অরোরা অস্ট্রালিস হিসেবে পরিচিত। সাধারণভাবে বলতে গেলে, বায়ুমণ্ডলের থার্মোস্ফিয়ারে থাকা অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন পরমাণুর সাথে ম্যাগনেটোস্ফিয়ার থেকে আসা চার্জিত কণিকাসমূহের সংঘর্ষের ফলেই অরোরা তৈরী হয়। মেরুজ্যোতি সাধারণত দেখাযায় ৮০ থেকে ১৬০ কি.মি. উচ্চতায়। কোনোটি আবার ১০০০ কি.মি. উঁচুতেও দেখা যায়। মহাকাশের এই বিস্ময়কর দৃশ্যগুলো কোনোটি বৃত্তাকার পর্দার মতো, কোনোটি ছড়িয়ে পড়া আলোর মতো, আবার কোনোটি পাখার আকৃতির আলোক বিচ্ছুরণের মতো দেখায়।
অরোরার সৃষ্টি হয় অনু সমূহের সংঘর্ষের ফলে। সংঘর্ষের কারণে পরমাণু বা অণুসমূহ কিছু শক্তি লাভ করে চার্জিত কণিকাসমূহের কাছ থেকে যা অভ্যন্তরীণ শক্তি হিসেবে সঞ্চিত হয়। এসব অভ্যন্তরীণ শক্তি যখন আলোক শক্তি হিসেবে বিকরিত হয়, তখনই মেরুজ্যোতি দেখা যায়। এসব ইলেক্ট্রন সাধারণত পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র বরাবর পরিভ্রমণ করায় শুধুমাত্র মেরু অঞ্চলেই অরোরা দৃশ্যমান হয়। উল্লেখ্য যে বিভিন্ন রঙের অরোরা সৃষ্টি হতে পারে। মেরুজ্যোতির রঙ নির্ভর করে কোন গ্যাসীয় পরমাণু ইলেক্ট্রন দ্বারা উদ্দীপ্ত হচ্ছে, এবং এই প্রক্রিয়ায় কত শক্তি বিনিময় হচ্ছে তার উপর। অরোরার সবচেয়ে পরিচিত রঙ যা অধিকাংশ সময় দেখা যায় তা হলো সবুজাভ-হলুদ, তারজন্য দায়ী অক্সিজেন পরমাণু।
অক্সিজেন থেকে অনেক ক্ষেত্রে লাল রঙ এর অরোরাও তৈরী হয়। নাইট্রোজেন সাধারণত একটি নীল রঙের আলো দেয়। এছাড়াও অক্সিজেন এবং নাইট্রজেন পরমাণু অতি-বেগুনী রশ্মি নির্গত করে, যা শুধুমাত্র স্যাটালাইটের বিশেষ ক্যামেরা দ্বারা শনাক্ত করা যায়, খালি চোখে দেখা যায় না।
অরোরা দর্শনের সবচেয়ে ভালো স্থান হলো আলাস্কা, কানাডা, এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ার কিছু অঞ্চল। এসব স্থানে প্রায় নিয়মিতই মেরুজ্যোতি চোখে পড়ে। তবে মেরুপ্রভা সূর্যালোক থেকে অনেক ম্লান হওয়ায়, তা পৃথিবী থেকে দিনের বেলায় দেখা যায় না।
এছাড়াও কানাডিয়ান সীমান্তের কাছাকাছি যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরসীমায় সাধারণত বছরে কয়েক বার অরোরা দেখা যায়।
কিছু দুর্লভ মুহূর্তে, হয়তো প্রতি দশকে একবার, ফ্লোরিডাতে কিংবা সুদূর দক্ষিণে জাপানেও অরোরা দৃশ্যময়ান হয়।

Share.

মন্তব্য করুন