আফ্রিকার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের আটলান্টিক উপকূলে অবস্থিত নামিব মরুভূমি পৃথিবীর সবচেয়ে শুকনো অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি। পৃথিবীতে সবচেয়ে প্রাচীন মরুভূমি নামিব। এটি সবচেয়ে শুষ্ক ও নির্জন মরুভূমি।
মরুভূমিটির বয়স ৪০ মিলিয়ন বছর অতিক্রম করেছে, এবং প্রাচীনকালে এখানে ডাইনোসর বাস করত।
নামিব দক্ষিণ আফ্রিকার একটি উপকূলবর্তী মরুভূমি। নামিব-এর মূল শব্দ নামা এবং এর অর্থ বিশাল স্থান। স্থানীয় নামা ভাষায় নামিব অর্থ একটি জায়গা যেখানে কিছুই নেই।
টাওয়ারের মত বালির পাহাড়, রুক্ষ পর্বত এবং নুড়ি পাথর ছড়ানো মঙ্গলগ্রহের সাথে সাদৃশ্যময় এই মরুভূমি। নামিব অ্যাঙ্গোলা, নামিবিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার আটলান্টিক উপকূল বরাবর ২০০০ কিলোমিটার বা ১২০০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত।
অ্যাঙ্গোলার কারুনজাম্বা নদী থেকে নামিবিয় ও পশ্চিম কেপিতে ওলিফ্যান্টস নদী পর্যন্ত দক্ষিণে বিস্তৃত। নামিবের উত্তর-পশ্চিম অংশ, যা অ্যাঙ্গোলা-নামিবিয়া সীমান্ত থেকে ৪৫০ কিলোমিটার বা ২৮০ মাইল প্রসারিত। এটি ম্যাকাডিস ডেসার্ট নামে পরিচিত।
এর দক্ষিণাংশের পার্শ্ববর্তী মরুভূমি হলো কালাহারি। আটলান্টিক উপকূলের পূর্বদিকে, নামিব-এর উচ্চতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায়, যা গ্রেট এসকর্পমেন্টের পাদদেশ থেকে ২০০ কিলোমিটার বা ১২০ মাইল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
গ্রীষ্মকালে, দিনের বেলা নামিবের তাপমাত্রা প্রায় ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হতে পারে, যা রাতে শূন্যেরও নিচে নেমে যায়। তাপমাত্রার এই ওঠা-নামা নামিবকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিকূল জায়গার একটি করে তুলেছে।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে কিছু বিস্ময়কর প্রজাতি এই শুষ্ক অঞ্চলকে নিজের ঘর বানিয়ে নিয়েছে, ফলে এখানে একটি অদ্ভুত ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যা অভিজ্ঞদেরও কিংকর্তব্যবিমুঢ় করে দিয়েছে।
নামিব মরুভূমির সবচেয়ে শুষ্ক অংশে বছরে গড়ে মাত্র ২ মি.মি. বৃষ্টিপাত হয়। কখনো কখনো কিছু অংশে বছরে একবারও বৃষ্টি হয় না। কিন্তু এই রুক্ষ পরিবেশেও অনেক প্রাণী যেমন অরিক্স, স্প্রিংবক, চিতা, হায়েনা, উটপাখি এবং জেব্রা বাস করছে। একেক প্রাণী একেক উপায়ে উচ্চ তাপমাত্রায় টিকে থাকার জন্য নিজের শরীরকে তৈরি করেছে।
উটপাখি নিজের গায়ের তাপমাত্রা বাড়িয়ে দেয় যাতে শরীর থেকে অতিরিক্ত পানি বের না হয়ে যায়। দক্ষ পর্বতারোহী হার্টম্যান মাউন্টেইন জেব্রা রুক্ষ পরিবেশের সাথে নিজেকে অভিযোজিত করে নিয়েছে। অরিক্স কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত পানি না খেয়ে থাকতে পারে।
এইরকম নানা উপায়ে প্রাণীকূল এই পরিবেশের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।
নামিবের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের একটি হচ্ছে, আটলান্টিকের উপকূলে ৫০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের উঁচু বালির পাহাড় যেখানে পরিত্যক্ত মরিচা ধরা জাহাজের ধ্বংসাবশেষ পড়ে থাকে। দক্ষিণে এঙ্গোলা থেকে মধ্য নামিবিয়া পর্যন্ত এই উপকূলে অসংখ্য তিমির মৃতদেহও দেখা যায়। তাই একে কঙ্কাল উপকূল বলা হয়। এই উপকূল প্রায়ই ঘন কুয়াশায় ঢাকা থাকে।
আটলান্টিকের ঠান্ডা বেঙ্গুয়েলা স্রোত থেকে উৎপন্ন বাতাসের সাথে মরুভূমির গরম বাতাসের সংঘর্ষের ফলে তৈরি হয় এই ঘন কুয়াশা, যা জাহাজের নাবিকদের জন্য ভয়ংকর এক বিভীষিকা। এই কুয়াশায় পথ হারিয়ে অসংখ্য জাহাজ উপকূলে আছড়ে পরে যা অভিযাত্রীদের মৃত্যু ডেকে আনে।
১৪৮৬ সালে, আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল দিয়ে যাওয়ার সময় বিখ্যাত পর্তুগীজ অভিযাত্রী ডিয়োগো কাও এই কঙ্কাল উপকূলে থামে। নামিবের প্রতিকূল আবহাওয়া এবং রুক্ষ বালির পাহাড় খুব দ্রুতই কাও এবং তার সাথীদের আবার সমুদ্রে ফিরে যেতে বাধ্য করে। যাওয়ার আগে তারা কঙ্কাল উপকূলকে ‘নরকের দুয়ার’ আখ্যা দিয়ে যায়।
নামিবের অনেক বিস্ময়কর জিনিসের মধ্যে সবচেয়ে অদ্ভুত এবং রহস্যময় হচ্ছে একটি ভূ-প্রাকৃতিক ব্যাপার যা ফেইরি সার্কেল বা ফেইরি রিংস নামে পরিচিত। এটি হচ্ছে ঘাস আবৃত গোল কতগুলো আকৃতি যার ভিতরে পুরোপুরি খালি।
ঘাসের একটি মাত্র প্রজাতিই বালির উপরে এই বৃত্ত তৈরি করেছে। এইরকম বৃত্ত কেন তৈরি হচ্ছে এর কোন সদুত্তর আজও পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানীরা নানা ভাবে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন এর রহস্য উদ্ধারের জন্য।
নামিব মরুভূমির স্থানীয় হিম্বা জাতির লোকেরা ভাবেন, এগুলো তাদের দেবতা মুকুরুর পায়ের ছাপ। অন্যান্য অনেক স্থানীয়রা ভাবেন এগুলো কোন ইউএফও বা স্পেসশিপের চিহ্ন।
বৈজ্ঞানিকভাবে এখনো পর্যন্ত এর সঠিক কারণ কেউ বের করতে পারেনি। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নামিবিয়া, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানীরা একজোট হয়েছেন এই রহস্য সমাধানে।
পতঙ্গবিদ ইগুয়েন মারিস, এর পেছনে দুটো কারণ থাকতে পারে বলে ধারণা করেছেন। প্রথমত, নামিব অত্যন্ত শুষ্ক একটি জায়গা। এখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পাওয়া যায় না। তাই ধারণা করা হচ্ছে যে, উইপোকা এই বৃত্ত তৈরি করেছে যার ফলে মাটির নিচে তারা পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি এবং পুষ্টি উপাদান জমা করে রাখতে পারে।
বৃত্তের ভেতরের অংশে কোন গাছ না থাকায় ঘাসের মূল সহজেই মাটিতে পানি ধরে রাখতে পারছে যা পরবর্তীতে উইপোকাদের চাহিদা পূরণ করছে।
দ্বিতীয়ত, এটি নামিবের গাছপালার একটি নিজস্ব ব্যবস্থা যেখানে ঘাসের মূল নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগীতা করে একটি গোলাকার খালি জায়গা তৈরি করছে, যেখানে তারা সহজেই নিজেদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান জমা করে রাখতে পারছে।
অনেক দিন বৃষ্টিপাত না হলে এই ঘাসের বৃত্ত শুকিয়ে যায়। কিন্তু বৃষ্টি হলেই সাথে সাথে জাদুর মত এই বৃত্ত আবার দেখা দেয়। এই ফেইরি সার্কেল সমতল ভূমি এবং উচু বালির পাহাড়, দু’জায়গাতেই পাওয়া যায়।

Share.

মন্তব্য করুন