এক বনে এক বাঘ আছে। বনটি অনেক বড়। বনের মধ্যে অনেক পশু-পাখিতে ভরপুর। বাঘ বড় প্রাণী। বাঘের কথা সবাই হাড়ে হাড়ে মেনে চলে। মানুষ পেলে সে খেয়ে ফেলে। বনের পাশে চোদ্দগ্রাম। বাঘ গ্রামের মানুষের অশান্তির প্রধান কারণ। যে কোন সময় দূর্ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। বিদঘুটে পরিস্থিতি ও বাঘের অত্যাচারে গ্রামের মানুষ বিশগ্রামে প্রস্থান করে। নতুন করে ঘর বাড়ি তৈরি করে স্থাযী বসবাস করতে শুরু করে। চোদ্দগ্রামে বাঘ রাউন্ডের পর রাউন্ড দেয়।
গাছগাছালি ও পাখপাখালি ছাড়া একটিও প্রাণী নেই। বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে তার। কি খাবে? পথে
কোন মানুষ যাতায়াতও করো না। খেয়ে আধটু না হয় তৃপ্তি মেটাবে। ক্ষিধা থামতে না পেরে পাগল হয়ে যাচ্ছে সে। বনে এসে যাকে তাকে খেয়ে ফেলছে তবুও ক্ষিধা নিবারণ হয় না। বাঘ মনে মনে গুণগুণ করছে। আমি যদি বনের এভাবে সব প্রাণী খেয়ে ফেলি তাহলে তো একটাও প্রাণী থাকবে না। তখন তো আমি বড়ই বিপদে পড়বো। কার সাথে চলাফেরা করবো। একা হয়ে যাবো। একা একা একটুও ভালো লাগবে না। বাঘ বিড়বিড় করতে করতে বন ছেড়ে অনেক দূরে মানুষ খুঁজতে বের হলো। পথে একটি মুরগী পেল, গাপুসগুপুস করে খেয়ে নিলো। ক্ষিদে কোনমতে মিটছে না। বাঘ বলে- আগেই ভালো ছিলাম। যখন মানুষজন ছিলো। প্রতিদিন একটা করে মানুষ খেতাম আমার ক্ষিধা মিটে যেত। সারাদিন শান্তিতে ভালোভাবে দিনটি কেটে যেত। আর এখন খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। হাসিখুশি হারিয়ে ক্ষিধাতে ছটফট করছে বাঘটি অনাহারে! মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্রনায় পাগল হয়ে যায়। স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেললো। বনের বাঘ বনে ফিরে এলো। একদিন আনমনা হয়ে বাঘটি হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর একেবারে বিশগ্রামে চলে এলো।
লোকজন বাঘ দেখে হতভম্ব হয়ে গেল। এইতো সেই দুষ্টু বাঘ, মানুষ খেকো। পালারে সবাই, আমাদের খেতে এসেছে! সবাই ভয়ে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। কিন্তু বাঘটিতো এখন মানুষকে কিছুই বলছে না। বাঘ পাগল হয়ে গেছে। স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। বনের পশু ছাড়া কিছু খায় না। সে মানুষের বন্ধু হতে চায়। কিন্তু কেহ তাকে আধটুও প্লেস দেয় না। দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়; মানুষ খেকো, হতচ্ছাড়া, যা দূর হ! সে হাঁটতে হাঁটতে আরো দূরে বিশগ্রামের বনে চলে গেল। সেখানেও পশুপাখিরা নোংরা, বোকা, মানুষ খেকো বলে বলে তাড়িয়ে দিলো। বাঘটি বলছে- আমি এত নোংরা রাবিশ হয়ে গেছি। আমার কোথাও একটু ঠাঁই হচ্ছে না। কি ভুল করেছি আমি? কি ভুল করেছি?
বন থেকে চলে আসলো পথে একটি শেয়ালের সাথে দেখা হয়ে গেল। শেয়ালটি বাঘকে খুব ভালোবাসতো।
বাঘের কথা শুনতো। কিন্তু এই মুহূর্তে শেয়াল পণ্ডিত  বাঘের সাথে কোন কথা বললো না। ‘পাগল পাগল’ বলে মুখ বাঁকিয়ে চলে যায়। বাঘটি তখন খুব জোরে জোরে কাঁদতে লাগে। আমি কি পাপ করেছি? আজ আমাকে সমাজের মানুষ সবাই হেয় প্রতিপন্ন, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। কেহ ঠিক ভাবে কথা বলে না। দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। অবশেষে সে তার সব অতীতের কথাগুলো মনে করতে লাগলো। অভিনয় করে জীবন চলে না। বাস্তবতায় কিছু করতে হবে। পথে যেতে যেতে একটি বিল পেল। খুব পিপাসা লেগেছে। আগে অনেক পানি ছিলো এখন প্রায় শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম। পিপাসা মিটালো। সে বিলে মাছ আছে। মানুষেরাও অনেকে মাছ ধরতে আসে। আরো অনেক মানুষ সেখানে আসে। কেহ মাছ ধরে, কেহ বক ধরে।
বাঘ মুহুর্তে- একটি বক ধরে নেয় মনের সুখে খায়। খেতে খেতে বকের হাড় গলায় বেঁধে যায়। বাঘ শ চেষ্টা করেও হাড়টি বের করতে পারে না। গলা প্রচণ্ড ব্যথা করে। বাঘটি ওখানে ঝুপটি মেরে বসে পড়ে।
পথে একটি পথিক হেঁটে যাচ্ছে। ডাক দিয়ে বলছে তুমি সময়মত এসেছো। বাঘের কথা শুনে পথিক ভয় পেয়ে গেল। ভয় পেয়ো না, আমি এখন মানুষ খাই না। ভয় পেয়ো না। গলা প্রচণ্ড ব্যথা করছে। একটি বক খেতে খেতে বকের হাড় গলায় বেঁধেছে। ভাই ছুটিয়ে দাও না। কথা দিলাম তোমায় পুরষ্কৃত করবো।
‘না না, তুমি বক খেতে পেরেছো আমাকে খেতে কতক্ষণ!’
‘না ভাই আমি মানুষ খাই না।’
‘ও তাহলে ঠিক আছে।’ পথিক গলার হাড় ছুটিয়ে দিলো। এখন বাঘটি মানুষকে বললো- ‘তোকে খাবো। দ্রুত তৃপ্তি মেটানোর জন্য প্রস্তুতি নে। খুব পথে পথে হেঁটেছি। মানুষের গন্ধ আমার শিরায় শিরায়। অভিনয় আর করতে চাই না। এবার তোকে খেয়ে এই অভিনয়ের সমাপ্তি টানবো।’
‘বাঘ কথা দিয়েছিলে। আমাকে খাবে না পুরুষ্কৃত করবে।’
‘আরে ছাড় কথা! কতজন কত কথা দেয়। এই যুগে কি কেউ কোন কথা রাখে আমিও রাখি না। সবাই আমারে কয় পাগল। দেখলাম মানুষরা পাগলদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয় আমার প্রজাতিরাও তাড়িয়ে দেয়। কি বৈষম্য? কেউ ভালো না স্বার্থপরে ভরা ভুবন। আজ তোকে খাবই। অনেক দিন থেকে মানুষ খাই না।
হালুম হালুম…।’
‘শোন বাঘ মামা, আমার কথা শোন, তারপর না হয় খাও।’
‘আচ্ছা বল।’
‘শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করে দাও; মরেই যাবো যখন, তুমি যখন খেয়েই ফেলবে। আমার ইচ্ছে- তুমি কেমন করে বকটি খেলে স্বচক্ষে দেখতে চাই। বক খেয়ে তারপর আমায় খেয়ো। কোন আফসোস থাকবে না।’ অবুঝ বাঘ মানুষের এমন কথায় গলে গেল।
‘বেশ!’ বাঘটি একটি বক ধরে খেতে লাগলো এক সময় আবার বকের হাড় বাঘের গলায় বিঁধে গেল। বাঘটি তখন পথিকের কাছে আবার সাহায্য চাইলো।
‘দেখ ভাই, ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করো। আমার এই হাড় ছুটিয়ে দিলে। বছরের পর বছর তোমার গোলাম হয়ে থাকবো, দয়া করো! আমার প্রচণ্ড কষ্ হচ্ছে।’
পথিক বললো- বেইমান কোথাকার! তুই সত্যি একটা পাগল, ঠকবাজ, প্রতারক, মানুষ খেকো। অভিনয় কোন প্রাণী করতে পারে না। অভিনয় তো করি আমরা, মানুষেরা। আরে দুষ্টু বাঘ, আমি মানুষ। পশমের হলেও তারতম্য আছে। শুনে রাখ- ভালো মানুষেরা একবারই ভুল করে, দ্বিতীয় বার করে না। বাঘটি ব্যথার তীব্র যন্ত্রণায় মাটিতে লুটিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
(প্রচলিত রূপকথা অবলম্বনে)

Share.

মন্তব্য করুন