– চুপ, চুপ! আস্তে কথা বল।
একটু কড়া স্বরে বলে মামুন। সাথে সাথে জনি বলে, আর একটু হলে আমি চিৎপটাং।
– কেন, কী হলো?
তন্ময় জিজ্ঞেস করে।
– আস্তে কথা বলার জন্য এত জোরে! বাপরে শব্দের কী গতি!
হেসে দেয় তন্ময়। তখনি হেলে দুলে রাইয়ান এসে আরো জোরে হাসি দিয়ে বলে- কিহে মামুন সাহেব, আপনার রহস্য বাহির করিতে পারিয়াছেন?
– চুপ, চুপ!…
এবার কিন্তু শান্তকণ্ঠে বলে মামুন। তারপরই ডাক দেয়, দ্যাখ এখানে এসে ওটা কী?
– ভূত হবে হয়ত।
খুব হেঁয়ালির সাথে বলে তন্ময়। কথাটা শুনে একটু লাফ দিয়ে সরে ভয়ার্ত কণ্ঠে রাইয়ান বলে, কী বললি!
– ভূত বা ভূতের বাচ্চা-টাচ্চা হবে।
মুচকি হেসে জনি বলে, ভয় পেলি মনে হয়?
– সব সময় ফাইজলামি করিবেন না। ভালো লাগে না আমার ওইসব।
– আচ্ছা বলতো রাইয়ান তুই সাধু না চলিত ভাষায় কথাটা বললি?
একটু থমকে যায়। তারপর চিন্তা করে বলে, যা… ভুলেই তো গেলাম। জামান স্যারের কাছ থেকে জেনে পরে জানাব।
আবারও হেসে দেয় ওরা। মামুন এখনো জানালায় উঁকিঝুঁকি মারছে। এবার নিচু গলায় বলে, থাম তো তোরা। তোদের তো কোনো চিন্তাই নাই। ওই ছায়ামূর্তিটা কিসের ছিল, কেমন ছিল, তা নিয়ে তোদের কোনো আগ্রহই দেখছি না। এদিকে সবুজ ভাইয়ের জন্য একটা আইডিয়া বের করতে হবে না? তা নিয়েও তোরা…
কথাটা থামিয়ে তন্ময় বলে, ওটার সাথে সবুজ ভাইয়ের আইডিয়ার সম্পর্ক কী?
সবুজ ভাই পাড়ারই বড় ভাই।
কম্পিউটার প্রকৌশলী। ওদের খুব আদর করেন। শুধু আদরই করেন না, সফট্ওয়্যার প্রোগ্রামিংয়ের টিপসও দেন। পাড়ার ছোটদের জন্যে সফট্ওয়্যার ক্লাবও করেছেন। এরই মধ্যে ওরা ছোটখাটো প্রোগ্রামিং করতে পারে। সবই কমন প্রোগ্রাম। এখন তিনি বলেছেন প্রোগ্রামিংয়ের নতুন আইডিয়া বের করতে। নতুন কিছু করে অলিম্পিয়াডে যেতে হবে। জিততে হবে।
মামুনের তাগাদায় রাইয়ান বলে, তাইতো, আমাদের নতুন আইডিয়া বের করতে হবে। তন্ময়ের মতো অলস হলে হবে! আচ্ছা ভূত-টুত নিয়ে কোনো আইডিয়া করা যায় না? কিংবা তোদের ভয়-টয় নিয়ে!
অট্টহাসি দিয়ে উঠে সবাই। তন্ময় হাসতে হাসতেই বলে, ভিতু আমরা না তুই? সাথে সাথে জনি বলে, তোর ভয়ের কারণ জানার জন্য একটা সফট্ওয়্যার বানানো যেতে পারে।

মামুন, তন্ময়, জনি, রাইয়ান, চারবন্ধু। একই পাড়ায় থাকে, একই ক্লাসে পড়ে। তবে একই স্কুলে নয়। খুব ভাব চারজনের। কৈশোরের ঊষালগ্নে ওরা। সেভেনে পড়ে। এখন ওদের মনে আগ্রহ কৌতূহলের কোনো কমতি নেই। যুগের সাথে প্রযুক্তির কৌতূহলে কাছে পেয়েছে সবুজ ভাইকে। আবার দূর-দূরান্তে হারিয়ে যেতেও খুব ইচ্ছে ওদের। ইচ্ছে করে বাংলার দক্ষিণে সেই পাহাড় বনানীতে ঘুরে বেড়াতে। কিন্তু বয়স ওদের সমর্থন দেয় না। কী করবে এ গরমের ছুটিতে? ভেবে পায় না ওরা।
রাইয়ান বলে, এর জন্যও একটা আইডিয়া বের করতে হবে?
– করবি? চল্ ভূত ধরার জন্য জঙ্গলে যাওয়ার আইডিয়া করি। তুই জাপটে ধরবি, আমরা দেখব।
খোঁচা মেরে বলে জনি। সাথে সাথে তন্ময় বলে, চলরে সবাই পালিয়ে কক্সবাজার যাই। নতুন থ্রিল।
অমনি রাইয়ান তন্ময়ের বুক পিঠ চেপে ধরে বলে, দেখি ধুকধুক করে কিনা?
– ধ্যাৎ, আমি তোর মতো ভিতু না। তোরটা হাত দিয়ে দ্যাখ।
– দ্যাখ বাজে বলবি না। তোদের ভয় না থাকলে আমার আর কোনো ভয়ই নাই। আমি তাই তোরটা পরীক্ষা করছি। তারপর মামুন জনিরটা চেক করে কনফার্ম হবো তোরা ভয় পাস না। তখন আমিও ভয় পাবো না। বুঝলি বোকার হদ্দ।
মামুন একটু কড়া মেজাজে বলে, আমারটা লাগবে না।
নিজেরটা ধুক ধুক করে কিনা দ্যাখ আগে।
জনি বলে, কবিরাজ টবিরাজ ঠিক করে রাখ রাইয়ানের জন্য।
তন্ময় রাইয়ানের হাতটা ছড়িয়ে বলে, যাওয়ার কথা শুনেই ওর হার্টবিট বেড়ে গেছে। ওকে নেয়া যাবে না।
রাইয়ান একটু সরে বসে ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে, সত্যি সত্যি পালিয়ে যাবি তোরা?
ঠিক তখনই মামুন বলে, চল্ আমাদের গ্রামের বাড়ি যাই। আমাদের বাড়িটা জঙ্গলবাড়ি আর কি! অনেক বন্যফল পাবি। খুব মজা হবে।
সবাই রাজি হয়।
রাজি হয় মামুনের আম্মাও। তিনিই অভিভাবক হয়ে ওদের নিয়ে বেড়াতে যাবেন।
প্লান মতোই ওরা চারজন আসে মামুনদের গ্রামের বাড়ি, এখানে বড় ঘর। বাড়িটা গাছগাছালিতে ভরা।
বুনো ফল-ফুল আর পাখ-পাখালির কলরবে বেশ মনোরোম বাড়িটা। মামুনরা বছরে দু-একবার আসে।
তাই বুনোলতায় পুরো আঙিনা ছেয়ে আছে। মনে হবে বনের মাঝখানে ঘরটা। সত্যি যেন জঙ্গলবাড়ি!
ওরা এখন সবাই থাকে বড়ো বৈঠকখানা ঘরে। রাতের আড্ডার সময় একটা ছায়ামূর্তির মত কী যেন উঁকি মারল জানালায়। মামুন দেখল। সাথে সাথেই উঠে জানালা দিয়ে মামুন উঁকি দেয়। মামুন দেখতে চেষ্টা করে ওটাকেই। জানালা থেকে সরে এসে পা টিপে টিপে দরজা দিয়ে বের হয়। খুঁজে বের করতে হবে ওটাকে।
ওটা কী ছিল? একটা ছায়ামূর্তি। জানালা দিয়ে উঁকি মেরেই ওদিকে গেল। একটা চোখ মনে হলো আগুনের মতো।
ফিরে আসে মামুন।
– কিরে কিছু পেলি দেখতে?
উৎসুক্য নিয়ে জিজ্ঞেস করে তিনজনেই।
– না।
জনি জিজ্ঞেস করে, আসলে তুই সত্যি কিছু দেখেছিস?
– মানে! দেখলামই তো।
তন্ময় বলে, চল আমরা সবাই যাই। খুঁজি ওটাকে।
– আমিও যাবো?
ভয় ভয় কণ্ঠে রাইয়ান বলে।
– না তুই এখানে ঘুমা।
মামুনের কথার সাথে সাথে রাইয়ান আরো ভয় নিয়ে বলে, একা একা ঘুমাবো?
– না, তোমার সাথে একজন রাজযোদ্ধা থাকবে।
আবার বের হয় মামুন আর জনি টর্চ নিয়ে। তন্ময় যায়নি। সাথে সাথে রাইয়ান বলে, ধ্যাৎ! আমিও যাই।
কথাটা বলে রাইয়ান উঠে দাঁড়ায়। তারপর পা টিপে টিপে দরজার কাছে গিয়ে গলা বাড়িয়ে সামনের দিকে তাকায়। অমনি তন্ময় পেছন থেকে শার্টের কলার ধরে টেনে বলে, থাক যেতে হবে না। তোর জন্যেই আমি রয়ে গেলাম।
– কেন যাব না?
– ভয়ে যদি মূর্ছা যাস? তুই তো ব্যাঙ দেখলেই মাথা ঘুরে পড়বি। তখন তোকে টানবে কে?
– মামুন জনি ওরা দু’জন আছে না?
– তো?
– ওদের ভয় না লাগলে মনে হয় আমিও ভয় পাবো না। আর কিছু হলে কোলে নিলে তিনজনেই নিবি।
আমি আরামে তোদের কোলে ঘুমাব।
– ও তাই! সখ কতো! বসে থাক্ খাটে।
ঘণ্টা আধেক পরে ফিরে আসে ওরা দু’জন। হাঁপাতে হাঁপাতে জনি বলে, পুরো জঙ্গলটা ঘুরে আরেক বাড়ি চলে গিয়েছিলাম।
রাইয়ান আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে, তারপর? ভূতের তাড়া খেয়ে পালিয়ে এসেসিছ, এইতো! দেখলি ওরা ভয় পায় বলেই আমি যাইনি।
আবারও অট্টহাসি দিয়ে ওঠে সবাই।
এমন সময় মামুনের আম্মা আসেন ওদের খাবারের জন্য ডাকতে। তাঁকে জানানো হয় পুরো ব্যাপারটা।
তিনি হেসে বলেন, তোমরা যা ভাবছো, তার কিছুই না।
– কেন, আম্মা আমি তো দেখলাম ছায়ার মতো কিছু একটা উঁকি মারল। একটা চোখ মনে হলো আলোর গোলা।
মামুন বলে।
– ধূর, টর্স হাতে এলাকার কেউ হবে হয়তো। চলো সবাই রাতের খাবার খেতে।
রাইয়ান বলে, আন্টি দেখলেন ওরা এলাকার মানুষকেই ভয় পায়। ওদের দ্বারা কিচ্ছু হবে না।
– ঝগড়া করতে হবে না, খেতে আসো।
আর কোনো কথা নয়, সুবোধ বালকের মতো খেতে যায়। খেতে খেতেই মামুন বলে, আইডিয়া পেয়েছি। খেয়ে গিয়ে বলব।
খাওয়া শেষে ওরা সবাই আসে থাকার ঘরে। রাইয়ান বলে, আমারও মাথায় আইডিয়া এসেছে, বলি?
– বল?
জনি বলে। মামুন তন্ময় মুচকি হাসে। জনি আবার বলে, বল তাড়াতাড়ি।
মানুষের ভয় মাপার জন্য একটা সফটওয়্যার বানাব।
কেউ কিচ্ছু বলে না। রাইয়ান আবার বলে, শুধু মানুষের ভয় নয়, আপগ্রেড করে দেশের ভয়ও জানার ব্যবস্থা করতে হবে।
এবার সবাই একসাথে অট্টহাসি দিয়ে ওঠে। তারপর একটু থেমে তন্ময় বলে, মানলাম তোর জন্য মানুষের ভয় মাপার চিপস বানাব। কিন্তু দেশের জন্য কেন?
– দেশ বুঝি ভয় পায় না? ছোটদেশ বড়দেশকে বুঝি ভয় পায় না?
মামুন সাথে সাথে বলে, শুনলাম তোরটা। এবার আমারটা শোন, এই যে রাতে কিছু একটা আমি দেখলাম, কী হতে পারে এটা?
– আন্টি তো বললই গ্রামের মানুষ।
তন্ময় বলে। রাইয়ান একটু সন্দেহ নিয়ে বলে, না রে আন্টি তো সিওরিটি দেয় নাই। ভূতও তো হতে পারে।
– এখানটাতেই আমার আইডিয়া।
সবাই সমস্বরে বলে, কী কী! কী আইডিয়া।
– ভূত, কেউ বলে অদৃশ্য, কেউ বলে মানুষের রূপ ধরে। আবার চোর-ডাকাতও হতে পারে। কিন্তু সবগুলোই রাতের অন্ধকারে চলে। একটা সফটওয়্যার চিপস বানাব যা থাকবে ঘরের চারপাশে। সূর্য ডোবার পর থেকেই একটিভ হবে। ওটার নির্দিষ্ট রেঞ্জের মধ্যে কোনো মানুষ, শুধুমাত্র মানুষ এলে তার কার্যবিধি রিড করবে। সংকেতও দিবে। তাতে মানুষ চোর ডাকাত জঙ্গি থেকে নিরাপদে থাকতে পারবে।
সাথে সাথে রাইয়ান বলে, যদি ভূত আসে?
– ভূত আছে। আসলে এটা জিনের আরেক নাম।
এসব অদৃশ্য হলে তো শূন্যই। আর যদি সত্যি সত্যি মানুষের রূপ ধরে আসে, তবে রিডিং দিবে। বিজ্ঞান সত্যিটাই বলবে।
আচমকা লাফিয়ে উঠে রাইয়ান বলে, এবার অলিম্পিয়াডে আমাদের আইডিয়া ফার্স্ট হবে।
হুররে…।

Share.

মন্তব্য করুন