সে এক সময়ের কথা। গ্রাম থেকে বেশ দূরে ছিলো গভীর এক বন। বনটা ছিলো নানান জাতের বড়বড় বৃক্ষ আর লতাপাতায় ছাওয়া। গাছগাছালির পরিমাণ ছিলো অধিক। যেন ঠাসাঠাসি করে বেড়ে উঠেছে গাছেরা। দূর থেকে অন্ধকারের মতো লাগতো বনটাকে।
সেই বনে বাস করতো কিছু কাক আর কিছু কোকিল। কাক আর কোকিল আলাদা জাতের হলেও তারা ছিলো একই বর্ণের। তাই মিলেমিশে তারা একসাথে থাকতো। অবশ্য ফিঙেপাখির বর্ণও একই। তবে ফিঙেরা পাখিদের রাজা হওয়ায় তারা কাক-কোকিলদের সাথে থাকতো না। তারা থাকতো আরো দূরে, আরেক বনে।
কাক-কোকিলদের বনে একটা অদ্ভুত নিয়ম ছিলো। আর তা হচ্ছে, সেখানে অন্যকোনো পাখি বাস করতে পারতো না। বনটা আগে শকুনদের দখলে ছিলো। শকুনেরা ছিলো খুবই বাজে স্বভাবের। তারা শুধু শুধু ঝগড়াঝাটি করতো সে বনে। বনের আশেপাশে অন্যকোনো পাখি ঘুরতে আসলে তারা তাদের ওপর হামলা করতো।
একদিন একটি কাকের ছানা আরেকটি কোকিলের ছানা উড়তে বেরিয়েছিলো। নতুন উড়তে শিখেছিলো তারা। তাই মনের আনন্দে উড়তে উড়তে সে বনের পাশে চলে গিয়েছিলো। তখন দুষ্ট শকুনেরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঠুকরে ঠুকরে তাদেরকে রক্তাক্ত করে। সে খবর কাক-কোকিলদের কানে পৌঁছালে তারা একজোট হয়ে উড়ে যায় বনের পাশে।
চারিদিক থেকে ঘেরাও করে বন। তারপর শকুনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। শুরু হয় যুদ্ধ। তুমুল যুদ্ধে শকুনদের তাড়িয়ে তারা বন দখল করে নেয়।
যুদ্ধে যাওয়ার সময় কাক-কোকিলরা অন্যান্য পাখিদেরও তাদের সঙ্গী হওয়ার আহবান করে। কিন্তু কোনো পাখিই শকুনদের ভয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়নি। আর এ জন্যই তারা তাদের বনে অন্য পাখিদের বাস করতে দিতো না। তবে সবার বেড়িয়ে যাওয়ার অধিকার ছিলো। অন্যান্য পাখিরা তাই দু’একদিনের অতিথি হয়ে এখানে বেড়াতে আসতো।
কাক আর কোকিলদের বাসা ছিল বনের প্রতিটা গাছের শাখায় শাখায়। সুন্দর সুন্দর বাসা বুনতো তারা। দেখে চোখ জুড়িয়ে যেতো পথিকের। কাকের তুলনায় কোকিলের বাসা ছিলো বেশি। কেননা কোকিলেরা সংখ্যায় বেশি ছিলো। কিন্তু হলে কী হবে, বনের পরিচালনায় ছিলো কাকেরাই। কেননা, শক্তিসামর্থ্যে, শরীর-স্বাস্থ্যে কাকেরা ছিলো কোকিলদের চেয়ে অনেক উপরে। শিক্ষাদীক্ষায়ও তারা এগিয়ে ছিলো। তাছাড়া কাকদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণ ছিলো প্রখর। অন্যদিকে কোকিলেরা ছিলো আরামপ্রিয় এবং বন্ধুবৎসল। ঝগড়াঝাটি তাদের মোটেও পছন্দ ছিলো না। তাই তারা কাকদের কর্তৃত্ব মেনে চলতো।
বনে ছিলো দু’টি অংশ। একটি পূর্বে, অন্যটি পশ্চিমে। পূর্বাংশ ছিলো কোকিলদের রাজ্য, আর পশ্চিমবনে বাস করতো কাকেরা। পূর্ববনে নানাজাতের ফুল ফুটতো। ফুলের সুরভিতে সদা ম-ম করতো বাগান। দূরদূরান্ত থেকে দলেদলে ভ্রমর আর রংবেরঙের প্রজাপতি উড়ে আসতো। উড়েউড়ে মনের আনন্দে ফুলেফুলে ঘুরে বেড়াতো তারা। ফুলের সাথে দোস্তি গড়তো, সখাসখির ভাব জমাতো। ফুলেরাও প্রজাপতি আর ভ্রমরাদের ভালোবেসে বুকে টেনে নিতো, সৌরভে মোহিত করে রাখতো সবসময়।
মৌমাছিরাও অনেক দূর থেকে পালা করে ঝাঁকবেঁধে আসতো এই ফুলের বনে। পরম আদরে ফুলেরা তাদেরকেও স্বাগত জানাতো। তারপর নিজেদের সবটুকু মধু উতলে দিতো তাদের মুখে। ফুলেফুলে উড়ে মধু নিয়ে মৌমাছিরা ফিরে যেতো মৌচাকে। শুধু কি তাই? দখিনহাওয়া আছড়ে পড়তো ফুলের বনে। তারপর সে হাওয়া ফুলের সৌরভি নিয়ে বয়ে যেতো পাশের গাঁয়ে। ঘ্রাণে ভরিয়ে দিতো গাঁয়ের পরিবেশ। ফুলের গন্ধে বিভোর হতো গাঁয়ের মানুষ। পথিকেরা বনের পাশে এসে থমকে দাঁড়াতো। মনোহরি ফুলের বিচিত্র সুবাসে প্রাণ জুড়াতো। ঠিক তখনই কোকিলেরা তাদের সুমিষ্ট কণ্ঠে সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে ভরিয়ে তুলতো চারিপাশ। দূরান্তে ছড়িয়ে পড়তো মোহনীয় সে সুর। কোকিলের সে কুহুগানে হৃদয় ভরাতো পথিকজন।
বিচিত্র ফুলের মিষ্টি সৌরভ, বহুরূপি প্রজাপতির ওড়াউড়ি, ঝাঁকবাঁধা মৌমাছি আর ভ্রমরার গুঞ্জরন, অমৃতস্বর কোকিলের কুহুকুহু কলতান- সবমিলিয়ে পূর্ববন ছিলো ঠিক যেন এক স্বর্গরাজ্য। অন্যদিকে পশ্চিমবন ছিলো সে তুলনায় অনেকটাই সৌন্দর্যহীন, মলিন। সেখানে তেমন কোনো ফুল ফুটতো না।  উড়েউড়ে প্রজাপতিরাও নৃত্য করতো না। আর অলিদের আনাগোনাও ছিলো হাতেগোনা। এজন্য কাকদের মনে বেজায় দুঃখ ছিলো। তবে তারা ছিলো বড্ড ধূর্ত। মনেমনে তারা কোকিলদের সহ্য করতে পারতো না। কোকিলদের তারা ঈর্ষা করতো। ভেতরে ভেতরে হিংসার আগুনে জ্বলেপুড়ে মরতো। কিন্তু বাইরে তারা এগুলো প্রকাশ করতো না।
কিছুদিন পরে কাকেরা একটা বুদ্ধি বের করলো। আর সে বুদ্ধি মাফিক প্রতিদিন তারা পূর্ববন থেকে ফুল আর মধু নিয়ে আসতো। এতে কোকিলরা কোনো আপত্তি করতো না। কেননা, কাকদের এমন কাজে পূর্ববনের ফুল-মধু একটুও কমতো না। বরং আরো বেশি হারে ফুলেরা ফুটে উঠতো। আরো বেশি করে মধু তৈরি করতো। এর সব কৃতিত্ব ছিলো কোকিলদের সুমধুর কণ্ঠের কুহুতান। কাকেরা যখন পূর্ববনের ফুল-মধু লুটে নিতো, তখন কোকিলেরা মিষ্টি সুরে গান গাইতো। সে গানের সুরে বিমোহিত হয়ে ঘুমন্ত কুঁড়িরা চোখ মেলে তাকাতো। ফুল হয়ে ফুটে উঠতো। তারপর পাগল করা সুবাসে ভরিয়ে তুলতো বনের পরিবেশ। আর সে সুবাসে ব্যাকুল হয়ে ছুটে আসতো প্রজাপতি, মৌমাছি আর ভ্রমর। আছড়ে পড়তো দখিনহাওয়া। থমকে দাঁড়াতো পথের পথিক।
একসময় এ রহস্য উদ্ধার করতে সক্ষম হয় কাকেরা। মনেমনে তারা বড্ড খুশি। তাদের রাজ্যও ফুলে ফুলে এবার শোভিত হবে। ভ্রমরা আসবে। অলিরা গাইবে। প্রজাপতি নাচবে।
স্বপ্নে বিভোর কাকদের চোখে ঘুম নামে না খুশিতে।
খুশিখুশি মনে একদিন তারা সভা ডাকে। সমস্ত কাক সভাস্থলে এসে পৌঁছালে জানিয়ে দেয়া হয়- তারাও এখন থেকে কোকিলদের মতো কুহুকুহু ডেকে বেড়াবে। তাদের মতো গান গাইবে। গান গেয়ে ফুল ফোটাবে। প্রজাপতি-মৌমাছি আনবে। সমৃদ্ধ করবে তাদের পশ্চিমবন।
যেই সিদ্ধান্ত সেই কাজ। কোকিলের মতো কাকেরাও গান গাওয়া শুরু করে। গান গাইতে গাইতে সারাবন ঘুরতে থাকে। কিন্তু হয় তার হিতে বিপরীত। তাদের কর্কশ ‘কা-কা’ ধ্বনিতে পশ্চিমবনে যে ফুলগুলো ছিলো, তার সবই ঝরে যায়। যে ক’টা প্রজাপতি উড়ে বেড়াতো, ভয় পেয়ে তারাও পালিয়ে যায়। যে মৌমাছিগুলো তাদের বাগানজুড়ে গুনগুন করে গান গাইতো, ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে তারাও উধাও হয়ে যায়। আর এদিকে পথিকেরাও তাদের কর্কশ স্বরে মহাবিরক্ত হয়ে তাদেরকে ইটপাটকেল ছুঁড়ে মারে। বোকা-কাকদের এমন বোকামি দেখে কোকিলেরা মুখটিপে হাসে।
ফুল, প্রজাপতি আর মৌমাছিদের হারিয়ে, সেইসাথে পথিকের ছোঁড়া পাটকেলে আহত হয়ে কাকেরা ভীষণ অসহায় বোধ করতে থাকে। তার উপর আবার কোকিলদের এমন উপহাসের হাসি। কাটাঘায়ে এ যেন নুনের ছিঁটা। তাদের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে কোকিলদের উপর। ভীষণ ক্ষেপে যায় তারা। মনে মনে ভাবে, তারা এর উত্তম প্রতিশোধ নিয়ে ছাড়বে। এমনটা ভেবে মনটাতে সান্ত্বনার পরশ বুলিয়ে স্ব-স্ব বাসায় চলে যায় তারা।
এভাবে কেটে যায় দিন কয়েক। আহত কাকেরা আস্তে আস্তে সুস্থ হয়। কিন্তু তাদের মনের অসুখ সারে না। অপমানবোধের ক্ষত রয়ে যায় মনে। কোকিলদের উপর প্রতিশোধের নেশায় তখনও টগবগ করে জ্বলতে থাকে তারা। এর ক’দিন পর কাকেরা জরুরী সভা ডাকে তাদের রাজ্যে। কী উপায়ে প্রতিশোধ নেয়া যায়, তা নিয়ে আলোচনা হবে। সভায় উপস্থিত সকল কাক একএক করে তাদের মতামত ব্যক্ত করে। কিন্তু কারোটা মনঃপুত হয় না। সবশেষে শক্ত-সামর্থ্য এক যুবক কাক উঠে দাঁড়ায়। সে বলে, তারা পূর্ববনের সকল ফুল ঝরিয়ে দেবে। প্রজাপতি আর মৌপোকাদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দেবে। সবুজ লতাপাতা সব বিনষ্ট করে দিয়ে পূর্ববনের সৌন্দর্য ধুলোর সাথে মিশিয়ে দেবে।
যুবক কাকটির এমন পরামর্শে সবাই বাহবা দিয়ে ওঠে। ডানা ঝাপটে তাকে সাধুবাদ জানায়। সকলের সমর্থন পেয়ে যুবক কাকটি খুশিতে কয়েকবার ‘কা-কা’ করে ডেকে ওঠে। কিন্তু সবাইকে থামিয়ে দিয়ে ওপাশ থেকে একটা বৃদ্ধকাক টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়ে খুক-খুক করে বারকয়েক কেশে শ্লেষ্মজড়ানো কণ্ঠে বলে, ‘কিন্তু কোকিলের কণ্ঠ রোধ করবে কে? তারা তো গান গেয়ে আবারো ফুল ফোটাবে। ভ্রমর আনবে। প্রজাপতি আনবে। পুনরায় ভরে উঠবে তাদের রাজ্য।’
বৃদ্ধকাকের এমন যুক্তিতে সভা জুড়ে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। কারো মুখে কোনো কথা থাকে না। সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ বৃদ্ধকাকের দিকে। এভাবে অনেকক্ষণ কেটে যায়। কেউ কথা বলে না। সবাই চিন্তিত। শেষে সভাপ্রধান দাঁড়কাক সেদিনের মতো সভা মুলতবি ঘোষণা করে। আর এ বিষয়ে সবাইকে বেশিবেশি ভাবনা-চিন্তা করে একটা সমাধান বের করার চেষ্টা করতে বলে। দু’দিন কেটে যায়। পরদিন আবারো সভা বসে কাকদের। একএক করে সবাই হাজির হয় সভাস্থলে।
সকলের উপস্থিতি নিশ্চিত করে সভাপ্রধান দাঁড়কাক কে কী উপায় খুঁজে পেয়েছে তা পেশ করতে আহবান করে। দাঁড়কাকের আহবানে ধূসররঙের মাঝবয়সী একটি কাক উঠে দাঁড়ায়। তারপর পায়ের আঙুল দিয়ে একবার মাথা চুলকে বলে ওঠে, ‘মহামান্য! আমার কাছে একটি উত্তম প্রস্তাব আছে। যদি অভয় দেন, তাহলে আমি তা সবার সামনে পেশ করতে আগ্রহী।’ দাঁড়কাক অভয় দিলে সে বলতে শুরু করে, ‘মহামান্য!
যেহেতু আমরাই এ বনের অধিপতি, আমরাই পরিচালনা করি এ বনকে, সেহেতু আমরা যা ইচ্ছা তা করতে পারি। আমরা চাইলেই যখনতখন যেকোনো নিয়মনীতির পরিবর্তন ঘটাতে পারি। আমরা চাইলে নতুন নিয়মও সৃষ্টি করতে পারি।’ এ পর্যন্ত বলে একটু থামে ধূসরকাক। অন্যান্য কাকেরা একজন আরেকজনের দিকে তাকায়। তারা ঠাহর করতে পারে না ধূসরকাক কী বলতে চাচ্ছে। শেষমেশ আগ্রহ নিয়ে ধূসর কাকের প্রতি দৃষ্টিপাত করে তারা।
ধূসরকাক পুনরায় বলতে শুরু করে, ‘মহামান্য! এই মুহূর্তে আমার মাথায় যে বুদ্ধিটা লাফালাফি করছে, তা হচ্ছে- একটি নতুন নিয়ম জারি করা। আর সেই নিয়মটি হচ্ছে, এ বনের ভাষা হবে একটিই। আর তা হলো- আমাদের ভাষা ‘কা-কা’। কোকিলেরা এখন থেকে আর তাদের ভাষায় কথা বলতে পারবে না।
তাদের কথা বলতে হবে আমাদের ভাষায় কা-কা করে। তাহলে অল্পদিনেই তাদের পতন হবে। তাদের রাজ্যের সৌন্দর্য বিলীন হবে।’ মন্ত্রমুগ্ধের মতো ধূসরকাকের শেষোক্ত কথাগুলো শোনে উপস্থিত কাকেরা। বিস্ময়ে তারা অভিভূত হয়ে যায় মাঝবয়সী কাকটির এমন যুগান্তকারী অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত বক্তব্য শুনে। সে থেমে যেতেই বিস্ময় সামলে সকলে সমানতালে ডানা ঝাপটে তাকে অভিনন্দিত করে।
সভাপ্রধান দাঁড়কাক আনন্দে আত্মহারা হয়ে কয়েকবার শূন্যে লাফিয়ে ঘোষণা করে, ভবিষ্যতে ধূসরকাককেই এ বনের প্রধান করা হবে। দাঁড়কাকের এ ঘোষণায় খুশিতে ডালের ওপর বারকয়েক ডিগবাজি খায় ধূসরকাক। অবশেষে সকল কাকের প্রাণে প্রশান্তি আসে। তারা কোকিলদের ছোটো করার একটি উপায় পেয়েছে।
পরদিন বন জুড়ে ঘোষণা করা হয়, এ বনের ভাষা হবে একটিই, এবং তা হচ্ছে কা-কা। বনে বসবাসকারী সকলকে কা-কা ভাষায় কথা বলতে হবে। এর বাইরে অন্যকোনো ভাষা এ বনে চলবে না, চলতে দেয়া হবে না। দাঁড়কাক পূর্ববনে উপস্থিত হয়ে কোকিলদের মাঝে ঘোষণা করে, ‘কা-কা, একমাত্র কা-কা’ই হবে এ বনের রাজ্যভাষা।’ দাঁড়কাকের এমন নীতিহীন সিদ্ধান্তে কোকিলেরা তৎক্ষনাৎ ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তারা এমন অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানায়। তাদের মাতৃভাষা কেড়ে নেয়ার অধিকার কাকদের নেই। ক্ষোভ আর প্রতিবাদের দাবানল ছড়িয়ে পড়ে পুরো কোকিলসমাজে। তারা এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না।
তারা এর প্রতিবাদে পথে নামার সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিন বনজুড়ে জরুরী অবস্থা জারি করা হয়। বনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে কাকসৈন্যদের মোতায়েন করা হয়, যাতে কোকিলেরা কোনোধরনের প্রতিবাদ-সমাবেশ করতে না পারে। কিন্তু রাগে-ক্ষোভে ফুঁসতে থাকা কোকিলেরা তাদের মুখের ভাষা ফিরে পাওয়ার দাবিতে জরুরী অবস্থা ভেঙে প্রতিবাদমিছিল করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা রঙবেরঙের ফুলের রেণু দিয়ে বুকে, পিঠে, কেউবা ডানায় লিখে নেয় বিভিন্ন শ্লোগান। ‘রাজ্যভাষা কুহু চাই’, ‘মায়ের ভাষা ফেরত চাই’, ‘কোকিলের ভাষা কুহুকুহু’, ‘কাকের ভাষা মানি না’ এমন নানান শ্লোগানে তারা তাদের বুক-পিঠ সাজিয়ে মিছিল নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু কপাল তাদের বড়ই খারাপ। তাদের মিছিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুর্র্ধষ কাকেরা।
হামলা চালায়। তাদের হামলায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে পাঁচ-পাঁচটি তাজা কোকিল। রক্তে ভেসে যায় বনের নরম মাটি। নিহত হয় বেড়াতে আসা আরো একটি নিরীহ বাচ্চাপাখি। আহত হয় আরো অনেকে।
নিষ্ঠুর কাকেরা তবুও ক্ষান্ত হয় না। তারা ছত্রভঙ্গ মিছিল থেকে ধরে নিয়ে যায় কয়েকটি কোকিলকে। মুহূর্তের মধ্যে এখবর ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। পূর্ববনের সমস্ত কোকিল বেরিয়ে আসে একযোগে। তাদের চোখে বন্যহিংস্রতা, দৃষ্টিতে যেন গোলাবারুদ। শান্তিপ্রিয় কোকিলেরা হয়ে ওঠে হিংস্র শ্বাপদ।
সমস্ত কোকিলের একজোট এবং এমন হিংস্রতা মনোভাব দেখে কাকেরা ভয়ে পূর্ববন ছেড়ে পালিয়ে যায় তাদের পশ্চিমবনে। কিন্তু থেমে থাকে না পূর্ববনের কোকিলেরা। তারা তাদের নিরপরাধ ভাইদের অন্যায়ভাবে হত্যার বিচার আর গ্রেফতারকৃত কোকিলদের মুক্তি এবং মাতৃভাষা ফিরে পাওয়ার দাবিতে মুহুর্মুহু মিছিল করে। একটানা কুহুকুহু স্বরে কাঁপিয়ে তোলে পুরো বন। ঘেরাও করে কাকরাজ্য।
তাদের সাথে যোগ দেয় বনের সমস্ত প্রজাপতি, ভ্রমর আর মৌমাছি। অন্যজাতের পাখিরাও আসে দলে দলে। এই অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যায় কাকেরা। তাদের মনোবল ভেঙে যায়। ভীষণভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে তারা। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার আশঙ্কাও জাগে মনে। শেষে কোকিলদের দাবি মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা।
পরদিন কাকেরা বন্দি কোকিলদের মুক্তি দেয়। নিহত কোকিলদের হত্যার সুষ্ঠুবিচারের আশ্বাস দেয়। আর সেইসাথে ‘কুহু’কে পূর্ববনের মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। আরো ঘোষণা করে যে, আজীবন কোকিলেরা তাদের কুহুকুহু ভাষায় গান করুক, কথা বলুক, তাতে কাকেরা আর কখনোই হস্তক্ষেপ করবে না।
কাকদের এমন ঘোষণায় নিমেষেই বিজয়ের পুলক বয়ে যায় কোকিলদের মনে। বিজয়ের আনন্দে মধুর কলতানে মুখর করে তোলে চারিপাশ। মাতৃভাষায় ডাকতে পারার স্বাধীনতা পেয়ে একটানা কুহুকুহু কলতানে আকাশবাতাস মুখরিত করে তোলে। তারপর ডানা ঝাপটে তারা ফিরে চলে তাদের কোকিলরাজ্যে, তাদের আপন ঠিকানায়।

Share.

মন্তব্য করুন