জুবায়ের একা হয়ে গেছে। সমাপনী পরীক্ষার রেজাল্টের পর নতুন স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির কক্ষে আনমনা হয়ে বসে আছে সে। আশপাশে আগের চেনা মুখগুলো নেই।
হাইস্কুলের এই ক্লাসটাতে সবাই নতুন ভর্তি হয়। পুরাতন বন্ধুদের দু’য়েকজন ছাড়া বাকি সবাই নতুন। তাই এই ক্লাসে নতুন করে হয় বন্ধুত্ব। কিন্তু যাকে তাকে তো বেস্ট ফ্রেন্ড বানানো যায় না। তাই বন্ধুদের মধ্যে কাকে বেস্ট ফ্রেন্ড বানাবে তা নিয়ে খুব টেনশনে আছে। বাবা বলেছেন যাকে তাকে বন্ধু বানানো যাবে না। কেননা ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস আর অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’।
রেদওয়ান এই স্কুলে নতুন এসেছে। আর্থিকভাবে সচ্ছল না, ভালো জামা কাপড় নেই কিন্তু সবসময় হাসিখুশি থাকে। ক্লাসের সবাইকে সালাম দেয় মুসাফা করে।
টিফিন পিরিয়ডে সবাই যখন খেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকে তখন সে নামাজ ঘরে নামাজ পড়ে। নামাজ শেষ হলেই আবার ক্লাস শুরু হয় ফলে তাকে কখনো টিফিন খেতে দেখা যায় না। একদিন জুবায়ের তার স্কুল ব্যাগ সার্চ করে দেখেছে ও আসলে টিফিন আনে না। এর মানে টিফিন আনার মতো সামর্থ্যও তার নেই। তবে তার আচরণে সকল টিচার মুগ্ধ, সবাই তাকে ভালো চোখে দেখে। তবে কেউ তাকে বেস্ট ফ্রেন্ড করে না। কেননা সে সবার মতো দামি ড্রেস পরে আসে না। টিফিনের সময় বা খেলার সময় তাকে কেউ পায় না। সে নামাজ ঘরে থাকে, নামাজ পড়ে। মাঝে মাঝে কুরআন শরীফ হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে তেলাওয়াত করে। জুবায়ের বাবার কাছে নতুন এই সহপাঠীর বর্ণনা দিলো। বাবা সব শুনে বললেন, ‘সে-ই তোমার বেস্ট হওয়ার যোগ্য, কাল তাকে বাসায় দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এসো।’
পরদিন জুবায়ের রেদওয়ানকে অনেকটা জোর করেই বাসায় নিয়ে এলো। জুবায়েরদের বিশাল বাসা দেখে তো রেদওয়ানের চোখ ছানাবড়া। আনইজি ফিল করছিল সে কিন্তু জুবায়ের তাকে স্বাভাবিক হতে সাহায্য করল। বাবার আসতে এখনো একটু দেরি তাই আম্মু বললেন, ‘তোমরা খাবার টেবিলে এসো, আমি খাবার দিচ্ছি।’ রেদওয়ান খাবার টেবিলে বসে আনন্দে কেঁদে ফেলছে। এতো খাবার সে কখনো এক সাথে দেখেনি। দুই বন্ধু তৃপ্তি সহকারে খাবার শেষ করলো। এমন সময় জুবায়েরের আব্বু অফিস থেকে চলে এসেছেন।
রেদওয়ানের বুকটা দড়ফড় করছে। না জানি কী বলেন! কী ভাবেন! ড্রইং রুমে বাবা বসে অপেক্ষা করছেন, তাই জুবায়ের আর দেরি না করে রেদওয়ানকে নিয়ে বাবার কাছে এলো। রেদওয়ান অত্যন্ত বিনয়ের সাথে শুদ্ধ উচ্চারণে সালাম দিল এবং মুসাফা করল। সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়ে রেদওয়ান জুবায়েরের বাবার হাতে চুমু খেল। পরিচয় পর্ব শেষ করে জুবায়েরের বাবা বললেন, ‘রেদওয়ান! আমি তোমার অনেক প্রশংসা জুবায়েরের কাছে শুনেছি। তুমি সত্যিই একজন ভালো ছেলে, আমি তোমাদের জন্য দোয়া করি।’
‘বাবা ! আজ থেকে সে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।’ বললো জুবায়ের। বাবা একটা প্যাকেট বের করে জুবায়েরের হাতে দিয়ে বললেন, ‘তাহলে এই গিফ্ট তোমার বন্ধুর জন্য।’ জুবায়ের বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রিয় বন্ধুকে গিফটের প্যাকেট দিল। রেদওয়ান প্রথমে নিতে চায়নি কিন্তু বন্ধুত্বের খাতিরে নিতে বাধ্য হলো। প্যাকেট খুলে তো রেদওয়ান আরো আশ্চর্য কেননা প্যাকেটে স্কুলের জুতোসহ দুই সেট স্কুল ড্রেস। রেদওয়ান জুবায়েরকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেললো।
জুবায়েরের বাবা বললেন, “কাউকে ভালোবাসলে তা হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, শোনো! আমাদের প্রিয় নবী (সা.) একটি হাদিসে বলেছেন। হাদিসটি আবু উমামা (রা.) বর্ণনা করে বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, যে কাউকে ভালোবাসে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য, কারো সাথে শত্রুতা পোষণ করে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। কাউকে কিছু দান করে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এবং কাউকে দান করা থেকে বিরত থাকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। সে ঈমানের পূর্ণতা লাভ করবে।” (আবু দাউদ শরিফ)
বাবা আরো বললেন, ‘আজ থেকে তোমরা বন্ধু তবে তোমাদের সকল কাজে থাকতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি তবেই এ বন্ধুত্ব হবে সার্থক ও ফলপ্রসূ।’ জুবায়েরের আম্মু একটু এগিয়ে এসে বললেন, ‘বাবা রেদওয়ান! এখন থেকে আমি দু’জনের স্কুল টিফিন তৈরি করে দিব, তোমরা নামাজ ঘরে নামাজ শেষে এক সাথে টিফিন করবে।’ বাবা ড্রাইভারকে ডেকে বললেন, রেদওয়ানকে তার বাসায় পৌঁছে দিতে, সাথে জুবায়েরও বন্ধুর বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলো।

Share.

মন্তব্য করুন