ইছামতি নদীর তীর ঘেঁষা গ্রামটির নাম ইছাপুর। সে গ্রামের ফুটফুটে কিশোর ছেলেটির নাম মানিক। বয়স ১৩ বা ১৪। পরিবারে একমাত্র মানিককে নিয়েই মায়ের সংসার। সংসারের আয়ের একমাত্র অবলম্বন কয়েকটি গবাদি পশু।
সেগুলো লালন-পালন করাই মানিকের কাজ। একদিন মানিক ভরদুপুরে নদীর ধারে গাছের ছায়ায় বসে বাঁশি বাজাচ্ছিল। হঠাৎ সে শুনতে পেল গাছের ডালে বসে কে যেন মিষ্টি করুণ সুরে মিনতি করছে। বাঁশি থামিয়ে কান খাড়া করে শুনল সে। সত্যিই তো মৃদু মৃদু গলায় কে যেন কথা বলছে। এই নির্জন দুপুরে আশপাশে তো কোনো মানুষজন নেই। লোকশূন্য জনপদ। তাহলে কথা বলছে কে? কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে তরতর করে উঠে গেল গাছের ডালে। গাছে উঠতেই একটি পাখির বাসা নজরে আসে তার। বসায় বসে কাঁদছে ছোট্ট একটা টুনটুনির ছানা। মানিককে দেখে সে বলে উঠলো, তুমি আমায় বাঁচাও ভাই। আমার মাকে শিকারিরা মেরে ফেলেছে। আমার ডানাও তেমন গজায়নি যে আমি উড়ে উড়ে খাবার জোগাড় করব। ক্ষুধায় আমার পেটটা চুঁ চুঁ করছে। যেন ক্ষুধায় আমি মরে যাচ্ছি।
মানিকের বড্ড মায়া হলো পাখির ছানার কথাগুলো শুনে। ছানাটিকে অপেক্ষা করতে বলে সে নিচে নেমে এলো। তারপর মাঠ থেকে কিছু শস্যদানা সংগ্রহ করে খানিকটা সময় পর সে পাখির ছানাটির কাছে ফিরে এলো। শস্যদানা পেয়েতো পাখির ছানাটি অনেক খুশি। মানিকের খুব মায়া লেগে গেল। প্রতিদিন সে ছানাটির জন্য কিছু কিছু শস্যদানা আনতে লাগলো। কিছুদিনের মধ্যেই ছানাটির ডানায় পালক গজালো।
একদিন মানিকের কাছ থেকে সে বিদায় নিয়ে মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় আকাশে ডানা মেলল। এখন আর সে ছানাটি ছানা হিসেবে নেই। হয়ে উঠলো একটা পরিপূর্ণ টুনটুনি পাখি। দিন যায়, মাস যায়। পাখিটি এডাল থেকে ওডালে, এ বন থেকে ও বনে ঘুরে বেড়ায়। মানিক প্রতিদিন সকালে গরুর পাল নিয়ে বের হয়।
সারাদিন মাঠে থেকে বিকেল শেষে বাড়ি ফিরে। আজ বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে, সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত। মানিক প্রতিদিনের মত আজ আর বাড়ি ফেরেনি। এদিকে বাড়িতে মা ছাড়া আর কেউ নেই। বড়ই গরিব মানুষ ওরা। ছেলে বাড়িতে না ফেরায় মায়ের মুখে খাবার নেই, ঘুম নেই। গাঁয়ের লোকেরা যে যার মতো ঘরের দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। পাড়া প্রতিবেশীদের দরজায় দরজায় গিয়ে ছেলেকে খুঁজে আনার জন্য ধরনা দিল। কিন্তু কেউ মানিকের মায়ের কথায় সায় দিল না। এত আকুতি-মিনতি করার পরও কেউ দরজাটা পর্যন্ত খুললো না। দুঃখী মা তার বাড়িতে ফিরে গেল। ঘরের দরজায় বসে অনবরত কাঁদতে লাগলো। সেই কান্নার আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ল আকাশে-বাতাসে। শুধু গাঁয়ের স্বার্থপর মানুষগুলো শুনলো না। তারা শুনেও না শুনার ভান করে রইল। বনের ধারে বসে থাকা টুনটুনির কানে পৌঁছল সে আওয়াজ। রাতের ঘুম হারাম করে টুনটুনি পাখা মেললো আকাশে। পাখিটা মানিকের বাড়িতে এসে তাঁর মায়ের কাছ থেকে পুরো ঘটনাটা শুনলো। আবার সে উড়াল দিল অজানা গন্তব্যে। রাতের আঁধারে সে উড়তে উড়তে হাজির হলো গহিন বনের গভীরে এক কালো পাহাড়ের পাদদেশে। সেখানে গিয়ে দেখতে পেল একচোখা এক দৈত্যের আস্তানায়। দৈত্যটা তখন কড়মড় করে হাড়-মাংস চিবাচ্ছে। তার চারদিকে হাড়ের স্তূপ। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে রক্ত মাংস।
খানিকটা পরেই মানিককে তার গরুগুলো নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। হয়তো কালই সাবাড় করবে ওদেরকে। টুনটুনি দেখলো মানিক ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। মানিকের কাঁপুনি দেখে দৈত্যটা মুলোর মতো দাঁত বের করে হো হো করে হাসছে আর বলছে, খাবো বলে তোদেরকে মাঠ থেকে তাড়িয়ে এনেছি। আজই তোর জীবনের শেষ দিন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই টুনটুনি এক ফন্দি আঁটলো। দৈত্যটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই পেছন থেকে উড়ে এসে ঘাড় বাঁকিয়ে দৈত্যের কপালে বসে চোখটার উপরে ধারালো ঠোঁট দিয়ে মারল এক খোঁচা। সাথে সাথে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেল দৈত্যটা। এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করলো। খুব বেশি দূর এগোতে পারল না, সামনে যেতেই পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ল সে। দৈত্যটা জ্ঞান হারিয়ে ফেলায় রক্ষা পেল মানিক ও তার গরুগুলো। না হয় ততক্ষণে সাবাড় করে দিত। এতক্ষণে আকাশও পরিষ্কার হয়ে গেছে। বেঁচে যাওয়া গরুগুলো নিয়ে সে রওনা দিল গাঁয়ের পথ ধরে। টুনটুনিটাও রওনা দিল মানিকের সাথে। মানিক বাড়িতে ফিরে যাওয়ার পর মা কি যে খুশি হলো, সেটা আর বুঝানো যাবে না। এরপর থেকে মানিক আর টুনটুনি সারা জীবনের জন্য বন্ধু হয়ে গেল।

Share.

মন্তব্য করুন