আদিম যুগের উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার ছিল আগুন। আগুনের আবিষ্কার ও ব্যবহার গোটা মানব সভ্যতার ইতিহাসকেই প্রভাবিত করেছে। আগুনের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের মাধ্যমে অনেক কিছু করা যায়। কিন্তু এই আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে পরিণত হয় এক ভয়াবহ দানবে।
যে কোনো অগ্নিকা-েই কিছু ক্ষয়ক্ষতি হলেও যথোপযুক্ত প্রস্তুতি ও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে একে নিয়ন্ত্রণে আনা এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব। কিন্তু দাবানল এমন এক ঘটনা, যেটি একবার ছড়িয়ে পড়লে একে নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার এবং এর ব্যপ্তি ও স্থায়িত্বকাল অনেক বেশি। ফলে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রাও হয় অনেক বেশি। দাবানলের শুরুটা সাধারণত শুষ্ক বনভূমি বা ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ এলাকা থেকেই হয়। কোনোভাবে এরকম একটি জায়গায় আগুন লাগলে আর কিছু বিষয় মিলে গেলে তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়া শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার।
প্রাকৃতিকভাবে সাধারণত দুটি উপায়ে দাবানল শুরু হতে পারে। যদি কোনো শুষ্ক বনভূমির উপর বজ্রপাত হয় এবং কোনো আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত লাভা অথবা বিভিন্ন পদার্থের জ্বলন্ত টুকরা থেকে। এরপর সেটি পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুসারে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে সাম্প্রতিক কালে মানবসৃষ্ট কারণেই দাবানল বেশি ঘটে থাকে। ধারণা করা হয়, বর্তমানে ৮৪% ক্ষেত্রেই বিভিন্ন মানবসৃষ্ট কারণে দাবানল সংঘটিত হয়ে থাকে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং আবহাওয়ার পরিবর্তনও ঘন ঘন দাবানল সংঘটনের পেছনে ভূমিকা রাখছে। তাপমাত্রার সামান্যতম বৃদ্ধিও বিভিন্ন অঞ্চলের আর্দ্রতা ও বনভূমির শুষ্কতার পেছনে ভূমিকা রাখতে পারে। সেইসাথে তাপমাত্রা নিজেই একটা প্রভাবক। এছাড়া, সমতলের তুলনায় পাহাড়ি অঞ্চলে দাবানল দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে। এমন আরো অসংখ্য প্রভাবক নিয়ে অনুসন্ধান চলছে।
দাবানলকে বন্যা বা ঘূর্ণিঝড়ের চেয়েও ভয়াবহ দুর্যোগ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। কেননা এগুলোর পূর্বাভাস দেওয়া যায় এবং সচেতন থাকলে এসব দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা যায়। কিন্তু এগুলো দাবানলের ক্ষেত্রে ঘটে না।
অনেকেই ভাবতে পারেন, দাবানল হয়তোবা কোনো নদী বা জলাশয়ের পাড়ে এসে থেমে যেতে পারে। এ ধারণা পুরোপুরি সঠিক নয়, আগুনের এক অদ্ভূত ক্ষমতা আছে নদীর মতো বিশাল বাধা পাড়ি দেওয়ার!
যখন নদীর একপাশে তীব্রভাবে আগুন জ্বলতে থাকে, তখন সেখানকার বাতাস হালকা হয়ে তীব্র বেগে উপরের দিকে উঠে যায়। উঠে যাওয়ার সময় ছাইসহ সেখানকার বিভিন্ন দাহ্য পদার্থ, যেমন- পাতা, ডালের টুকরা, কাগজ বা অন্য কোনোকিছুর অসংখ্য জ্বলন্ত টুকরা সাথে নিয়ে যায়। সেগুলো যখন নদীর অপর পাড়ে গিয়ে পড়ে, তখন সেখানে শুরু হতে পারে নতুন দাবানল।
সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়াতে ভয়াবহ দাবানলের ঘটনা ঘটেছে। অস্ট্রেলিয়ায় গ্রীষ্মে ভয়ঙ্কর গরম পড়ে। মাত্রাতিরিক্ত গরম মানেই সেখানকার বনাঞ্চলে শুরু হয়ে যায় দাবানল। কিন্তু এবারে অনেক আগেই দাবানল গ্রাস করতে শুরু করেছে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার বনভূমিকে।
গত সেপ্টেম্বর থেকে অস্ট্রেলিয়ায় শুরু হওয়া দাবানলে এই পর্যন্ত ২৪ জন মারা গেছেন। এছাড়াও এই দাবানলে পুড়ে গেছে এক কোটি ত্রিশ লাখ একর জমি। তিন হাজার ঘরবাড়ি পুড়ে গেছে। আক্রান্ত হয়েছে ৫০ কোটি বন্যপ্রাণী। ৩ কোটি বন্যপ্রাণী পুড়ে মারা গেছে। উদ্ধারকারীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এখনও পর্যন্ত দেড়শোর বেশি বাড়ি ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছে। ঘরছাড়া হয়েছে লাখ লাখ মানুষ।
গ্রীষ্মের পারদ এখনও চরমে ওঠেনি। তার আগেই দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করেছে নিউ সাউথ ওয়েলসের বনভূমি। আগুনের পুড়ে গিয়েছে অনেক বাড়ি। কেউবা নিজের গাড়ির মধ্যে বসেই ঝলসে গিয়েছেন। এই দাবানলখরা ও প্রচণ্ডদাবদাহের কারণে উৎপত্তি হয়েছে এবং প্রশাসনের তথ্য বলছে, দেড় হাজার দমকলকর্মী এবং উদ্ধারকারীকে এলাকায় নামানো হয়েছে। কিন্তু হাওয়ার বেগ না কমলে তাঁদের পক্ষে খুব বেশি কিছু করা সম্ভবনায়। ৬০টি স্থানে আগুন জ্বলছে, যার মধ্যে ৪০টি জায়গায় পরিস্থিতি কার্যত হাতের বাইরে চলে গিয়েছে।
শহরগুলোর হাজার হাজার আতঙ্কিত বাসিন্দা এবং সেসব শহরে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বাড়িঘর ছেড়ে পূর্বাঞ্চলীয় সমুদ্র সৈকতেরদিকে ছুটে গিয়েছিলেন।
সম্প্রতি অ্যামাজনের জঙ্গলেও ভয়ঙ্কর আগুন দেখেছে বিশ্ব। পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে বিশ্বের সব থেকে বড় রেন ফরেস্টের বিশাল অংশ। জানা গিয়েছিল ওই আগুন মানব সৃষ্ট আগুন ছিল।
প্রতিবাদের ঝড় ওঠে বিশ্বজুড়ে। তবে অস্ট্রেলিয়ার বনাঞ্চলে আগুন স্বাভাবিক নিয়মেই লেগেছে বলে এখনও পর্যন্ত জানা যাচ্ছে। তবে এতটা আগেই কেন লাগল দাবানল তার কারণ স্পষ্ট নয়।
দাবানলের প্রভাব কমানোর জন্য কিছু প্রচেষ্টা চালানো হয়ে থাকে। যেমন- আগুন যেদিকে অগ্রসর হচ্ছে, সে অঞ্চলের কিছু গাছপালা ও ঝোপঝাড় ইচ্ছাকৃত ও নিয়ন্ত্রিতভাবে পুড়িয়ে ফেলা হয় যেন দাবানল ততটুকু পর্যন্ত গিয়ে আর এগোতে না পারে। আবার, দাবানল শহরাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার আশংকা থাকলে তার গতিপথে অগ্নিনির্বাপক বা অগ্নি প্রতিরোধক রাসায়নিক পদার্থ নিক্ষেপ করে আগুনের তীব্রতা কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়। এ রাসায়নিক পদার্থগুলো গাছপালা বা অন্যান্য জ্বালানীর সাথে মিশে বিক্রিয়া করে সেগুলোর দাহ্যতা কমিয়ে দেয়।
তবে দাবানলের বিশাল আকৃতি ও শক্তির কাছে এ প্রচেষ্টাগুলো বড়ই ক্ষীণ ও অক্ষম। এ প্রচেষ্টা বড়োজোর দাবানল ছড়িয়ে পড়ার গতিকে কমিয়ে দিতে পারে, থামাতে পারে না। মানুষকে অসহায়ের মতো অপেক্ষা করতে হয় কখন প্রাকৃতিকভাবেই এ দুর্যোগটি থেমে যাবে।

Share.

মন্তব্য করুন