হিমশীতল তুন্দ্রা অঞ্চলের কোথাও কোথাও যাযাবর গোষ্ঠীকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। তারা কোথাও ঘর বেঁধে থাকতে পারে না। স্থায়ী ঘর বাঁধার বিষয়টি তাদের স্বভাবে যেন একেবারেই নেই। তারা বুঝি সবসময় এমনটি ভাবে যে, ‘হেথা নয়, হেথা নয়, আর কোনখানে।’ যাযাবর গোষ্ঠীর লোকেরা বলগা হরিণের চামড়ার তাঁবু খাটিয়ে নিয়ে তাতে থাকে। কারিবু হরিণের চামড়া দিয়েও তাঁবু বানায়।
এমনি এক যাযাবর দলে ছিল এক বৃদ্ধ। তার অনেক বয়স হয়েছে। মাথার চুল পেকে ধবধবে সাদা হয়ে গেছে। বৃদ্ধের ছিলো তিনটি কন্যে। তারা সবাই ছিলো অসম্ভব রকমের রূপসী। যারাই তাদের দেখত তারাই তাদের সৌন্দর্যে দারুণভাবে মুগ্ধ হয়ে যেত। তারা যেন এই মর্ত্যরে কেউ না। তারা আকাশ থেকে নেমে আসা পরী। বৃদ্ধের তিনটি কন্যের প্রকৃতি ছিল আবার তিন ধরনের। স্বভাবও ছিলো তিন ধরনের। এর মধ্যে ছোটজনটি ছিল সবচাইতে বেশি গুণবতী আর বুদ্ধিমতী। সে দয়াবতীও ছিল।
যাযাবর বৃদ্ধটি ছিলো অতি গরিব। বলা চলে দুস্থ। তাদের বলগা হরিণের চামড়ার তাঁবুটি ছিল একেবারেই পুরনো। শতচ্ছিন্ন সেই তাঁবুটি ব্যবহারের জন্য মোটেই উপযোগী ছিল না। তাঁবুর ছিদ্রগুলো দিয়ে শীতের কনকনে বাতাস খুবই সহজেই প্রবেশ করত। বৃদ্ধ আর তার পরিবারটি সেই বাতাসে ঠকঠকিয়ে কাঁপতো। শীত নিবারণের জন্য তাদের পরিধানের কাপড় চোপড় ছিল কম। তাতে প্রয়োজন মিটত না। তাদের খুবই অসুবিধে হতো।
যখন প্রচণ্ড রকমের তুষারপাত হতো তখন তাদের হতো ভয়ানক সমস্যা। শীত বাতাসের ছোবল থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিন বোন তখন একে অপরকে জড়িয়ে গুটিসুটি দিয়ে থাকত। এতে যদি একটু উষ্ণতা পাওয়া যায়। কিন্তু সেটা ছিল একটা ব্যর্থ চেষ্টা। তাঁবুর ভেতরটাকে গরম রাখার জন্য তারা নানাভাবে চেষ্টা করত। আগুন জ্বালিয়ে রাখত।
সেবার শীতের মাঝামাঝি সময়ে প্রচণ্ড তুষার ঝড় নেমে এলো। সেটা ছিল তুন্দ্রা অঞ্চলের শক্তিশালী তুষার ঝড়। শোঁ শোঁ শব্দ করে বাতাস বইতে থাকে। বরফকুচি উড়তে থাকে।
একদিন যায়, দুইদিন যায়, তিনদিন যায়। তীব্র তুষার ঝড় বয়েই চলেছে। তার থেমে যাওয়ার কোনো রকম লক্ষণ নেই। প্রবল ঝড়ের তাণ্ডবে সেখানকার যাযাবর জাতির লোকজন দিশেহারা হয়ে পড়ে। অনেকের তাঁবু উড়ে যায়। আর যারা কোনোমতে তাঁবুর ভেতরে জড়োসড়ো হয়ে আছে তারাও আর তাঁবু থেকে মুখ বের করতে সাহস পায় না। তাঁবুর ভেতরেই আটকে থাকে।
বৃদ্ধ তার তিন কন্যেকে নিয়ে তাঁবুর ভেতরেই কোনোভাবে মুখ গুঁজে থাকে। এ ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। তাঁবুর কোনায় গুটিসুটি মেরে থেকে শোনে বাইরের তুষার ঝড়ের শোঁ শোঁ গর্জন। মেয়েরা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চায়, ‘এবার কী হবে আমাদের?’
বৃদ্ধ ভয়মাখা গলায় জানায়, ‘এই তুষার ঝড় থেকে মনে হচ্ছে আর রক্ষা পাবো না। কারণ, এই ঝড়টি আসছে বাতাসের দেবতা কুটরার নিকট থেকে। স্বয়ং দেবতাই ঝড়কে পাঠাচ্ছেন। তিনি ভয়ানক ক্রোধে এই ঝড়কে সৃষ্টি করেছেন।
মেয়েরা জানতে চায়, কেন এমন তীব্র ঝড় তিনি তৈরি করেছেন?
বৃদ্ধ বলে, এর কারণ হচ্ছে যে তিনিই একজন দয়াবতী, গুণবতী বউ চাইছেন। আর তার কামনা আমরাই যেন এরকম এক ভালো কনেকে তার নিকট পাঠাই। বৃদ্ধ এই ভয়ানক বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে চাইছেন। তিনি তার বড় মেয়েটির দিকে তাকিয়ে তার সিদ্ধান্তের কথাটি জানালেন।
‘আমি ভাবছি তোমার কথা। তুমিই যাবে কুটরার কাছে। তুমি গেলে এই সমস্যা থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি। তুমি না গেলে সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করবে। আমাদের গোষ্ঠীর সকলেই অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করতে হবে। তুমি এখনই বাতাসের দেবতা কুটরার কাছে যাও। তার কাছে গিয়ে ঝড় থামানোর জন্য প্রার্থনা করো।
বড় মেয়েটি তখন তার বাবার কাছে জানতে চাইল, ‘কিন্তু আমি কিভাবে যাবো বায়ুদেবতা কুটরার কাছে! আমি তো তার নিকটে পৌঁছানোর জন্য পথ চিনি না।’
বৃদ্ধ জানাল, ‘সেখানে যাওয়ার জন্যে আমি তোমাকে একটি ছোট শ্লেজ গাড়ি দেবো। তুমি সেই গাড়িটিকে বাতাসের মুখোমুখি রাখবে। বাতাসের ধাক্কা খেয়ে আপনা আপনি চলা শুরু করবে শ্লেজ গাড়িটি। তুমি শুধু সেই গাড়িকে অনুসরণ করে চলতে থাকবে। ঝড়ো বাতাস তোমার গায়ের পোশাকের দড়ি খুলে ফেলবে। সাবধান, তুমি কিন্তু কখনও দড়ি বাঁধার চেষ্টা করবে না। তোমার জুতোর ভেতরে ঢুকে যাবে তুষারকচি। তুমি কিন্তু ভুলেও সেই কুচিগুলো ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করবে না। আর এভাবেই পথ চলতে থাকবে তুমি।  যতক্ষণ পর্যন্ত না তুমি একটি উঁচু পাহাড় দেখবে, ততক্ষণ পর্যন্ত চলবে। পথ চলা থামাবে না। যখন তুমি উঁচু পাহাড়টিকে দেখবে তখন তাতে চড়তে শুরু করবে। এভাবে তুমি পাহাড় চূড়োতে গিয়ে উঠবে। তুমি যখন পাহাড়ের শীর্ষ চূড়োটিতে পা রাখবে তখন তুমি তোমার পোশাকের দড়ি বাঁধবে আর জুতোর ভেতরে জমে থাকা তুষারকুচি ঝেড়ে ফেলবে। পাহাড় চূড়োতে উঠবার পর তোমার কাঁধে একটি পাখি উড়ে এসে বসবে। তুমি কিন্তু সেই পাখিটিকে তাড়ানোর চেষ্টা করবে না। সেই পাখিটিকে আদর-যত্ন করবে। পাখিটির প্রতি দয়ামায়া দেখাবে। মমতা দেখাবে। তারপর শ্লেজে চেপে তরতরিয়ে নেমে আসবে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। মনে রাখবে যে ঐ শ্লেজ গাড়িটাই কিন্তু তোমাকে পৌঁছে দেবে কুটরার আবাসে। একটি ব্যাপারে তোমাকে অতি সাবধানী হতে হবে। আর সেটা হলো যে কুটরার ঘরের কোনো কিছুকেই ছোঁবে না। নীরবে থাকবে। কুটরা যা যা করতে বলবে শুধু তা-ই করবে। কুটরার নির্দেশের কোনো অন্যথা যাতে না হয়।
বৃদ্ধ পিতার কথা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনল তার বড় কন্যে। সে তখন বায়ুদেবতা কুটরার আবাসে যেতে চায়। সে শ্লেজ গাড়িতে করে রওনা দিল।
কিছু পথ যাওয়ার পরই প্রচণ্ড বাতাসের ঝাপটায় তার পরিধানের পোশাকের দড়ি আলগা হয়ে যায়। জুতোর ভেতরে বরফকুচি ঢোকে। এতে তার পায়ে যন্ত্রণা শুরু হয়। হিমশীতল বাতাসে সে থরথরিয়ে কাঁপতে থাকে। তার শরীর অবশ হয়ে পড়ে। এ রকম কষ্ট, যন্ত্রণা পাওয়াতে সে তার পিতার উপদেশ ভুলে যায়। সে তার জুতো ঝেড়ে তুষারকুচিগুলো সরিয়ে দেয়। পোশাকের আলগা হয়ে যাওয়া দড়িটাতে শক্ত গিঁট দেয়।
এভাবে কিছুক্ষণ যাওয়ার পর সে বড় একটি পাহাড় দেখতে পায়। মেয়েটি সেই পাহাড়ে চড়ল। সে যখন পাহাড় চূড়োতে পা রেখেছে তখন সেখানে একটি ছোট পাখি উড়ে আসে। পাখিটি এসে টুপ করে বসে মেয়েটির কাঁধে। বড় মেয়েটি কিন্তু পাখিটিকে আদর করল না। বিরক্তিভরা মুখে তাড়িয়ে দেয়। পাখিটি তাড়া খেয়ে উড়ে যায়। এরপর মেয়েটি শ্লেজগাড়িতে চাপে। শ্লেজটিকে গড়িয়ে দেয় পাহাড়ের ঢালে। সেটা নেমে যেতে থাকে। তরতরিয়ে নেমে একটা তাঁবুর সামনে এসে থামে শ্লেজটি। মেয়েটি শ্লেজ থেকে নেমে তাঁবুর ভেতরে প্রবেশ করে। সে দেখল সামনে রাখা আছে কয়েক টুকরো হরিণের মাংস। এমন মাংস দেখে ভারী খুশি হয়। মাংস খেতে তার লোভ জাগে। সে তখন আগুন জ্বেলে নিজেকে উষ্ণ করে। হরিণের মাংস ঝলসায়। ঝলসানো মাংস চিবিয়ে খায়। হঠাৎ তার কানে এলো একটা শব্দ। কেউ যেন আসছে।
দুলে উঠল তাঁবুর চামড়ার পর্দা। এক সুদর্শন যুবক ঢুকল। সে আর কেউ নয়। সে হচ্ছে গিয়ে বায়ুদেবতা কুটরা।
কুটরা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কেন এখানে এসেছ?’
মেয়েটি উত্তর দিল, ‘আমার পিতা পাঠিয়েছে আপনার নিকটে।’
কুটরা কৌতূহলী হয়ে জানতে চায়, ‘কিন্তু কেন?’
মেয়েটি লাজুক ভঙ্গিতে বলল, ‘আপনি আমাকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করবেন সে জন্য।’
এমন উত্তর শুনে কুটরা অবশ্য কিছু বলল না। জানাল, ‘শোনো মেয়ে, আমি শিকার করে কিছু মাংস এনেছি।
তুমি সেই মাংস রান্না করে দাও তো। বড় মেয়ে কুটরার নির্দেশে তখন মাংস রান্না করে। কুটরা সেই রান্না করা মাংস সমান দুই ভাগে ভাগ করে দিতে বলল। মেয়েটি তাই করল।
কুটরা বলল, ‘এই মাংস তুমি আর আমি অর্ধেক খাবো। বাকিটা ঐ কাঠের পাত্রে করে পৌঁছে দেবে পাশের তাঁবুতে। কিন্তু সেই তাঁবুর ভেতরে ঢুকবে না।
মাংসের পাত্রটি নিয়ে তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে তাঁবুর প্রবেশমুখে। খানিকপর এক বৃদ্ধা বেরিয়ে আসবে সেই তাঁবুর ভেতর থেকে। তুমি পাত্রটি তার হাতে তুলে দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে। ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে যতক্ষণ পর্যন্ত না বৃদ্ধা শূন্য পাত্রটিকে তোমার হাতে ফেরত দেয়।’
মাংসের পাত্র নিয়ে বড় মেয়েটি বেরিয়ে যায়। বাইর তখন প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাস বইছে। চারপাশে ঘনিয়ে এসেছে অন্ধকার। বড় মেয়েটি কিছুক্ষণ ঝড়ের মধ্যে হাঁটল।
তারপর কিছু একটা চিন্তা করে পাত্রের মাংসের পুরোটাই তুষারের মাঝে ফেলে দেয়। এরপর খালি পাত্র হাতে ফিরে এলো কুটরার তাঁবুতে।
কুটরা জানতে চায়, ‘আমাদের পাশের তাঁবুতে মাংস দিয়ে এসেছ তো?’
মেয়েটি উত্তর দেয়, ‘দিয়ে এসেছি।’
‘এবার তাহলে আমাকে পাত্রটাকে দেখাও। দেখি মাংসের বদলে তোমাকে কিছু দিয়েছে কিনা।’
বড় মেয়েটি শূন্য পাত্র দেখাল কুটরাকে। সেই খালি পাত্রটি দেখে কুটরা অবশ্য কিছু বলল না। শুধু নিজের ভাগের মাংসটুকু খেয়ে ঘুমুতে গেল।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে কুটরা হরিণের চামড়া এনে দিয়ে মেয়েটিকে বলল, ‘তুমি এই চামড়া দিয়ে আমার জন্য একটা পোশাক, এক জোড়া জুতো আর এক জোড়া দস্তানা বানাবে।’
এ কথা বলে কুটরা শিকার করার জন্য রওনা দিল তুন্দ্রা অঞ্চলের দিকে।
বড় মেয়েটি তখন হরিণের চামড়া নিয়ে বসে। তাকে এখন চামড়া কেটে জামা-জুতা দস্তানা তৈরি করতে হবে। কুটরা বলে গেছে।
সে সময় তাঁবুর ভেতরে এক বৃদ্ধা প্রবেশ করে। সে বড় মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলে, ‘দেখোতো বাছা, আমার চোখের ভেতরে কিছু ঢুকেছে। তুমি সেটা বের করে দিতে পারো কিনা!’
বড় মেয়েটি বৃদ্ধার কথায় বিরক্ত হয়। এ আবার কোন আপদ এসেছে। মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, দেখতে পাচ্ছ না যে আমি ব্যস্ত রয়েছি। তোমার কোনো কাজ করে দিতে পারবো না।
বড় মেয়ের এমন রুক্ষ উত্তর শুনে বৃদ্ধা কিছু বলল না।
তাঁবু থেকে বেরিয়ে গেল।
মেয়েটি ছুরি দিয়ে হরিণের চামড়া কাটতে থাকে। কিন্তু সে ঠিকমতো কাটতে পারে না। জিনিসগুলো সব বেঢপ ধরনের হয়ে যায়। সে কোনোমতে জোড়াতালি দিয়ে ওগুলো বানায়।
কুটরা তুন্দ্রা অঞ্চলে শিকার করে ফিরে এসে বড় মেয়েকে জিজ্ঞেস করে, ‘কী পোশাক তৈরি হয়েছে তো?’
মেয়েটি বলল, ‘তৈরি হয়েছে।’
কুটরা তখন চামড়ার কোটটিকে তোলে। কিন্তু সেটার ভেতরে সহজে হাত ঢোকাতে পারে না। কারণ সেটা এত ছোট ছিল যে তার ভেতরে আর হাত ঢোকানো সম্ভব হচ্ছিল না। কোটটির চামড়া নিখুঁতভাবে কাটা হয়নি। শেলাই ছিল খুবই খারাপ। পোশাকটি ছিল বিচ্ছিরি রকমের আর ছোট।
এরকম বাজেভাবে তৈরি করা পোশাকটিকে দেখে কুটরা গেল বেজায় চটে। তার বেদম রাগ হলো।
এতটাই রেগে গেল যে বড় মেয়েটিকে তাঁবু থেকে ছুড়ে বাইরে নিক্ষেপ করল। মেয়েটি মুখ থুবড়ে পড়ল তুষারের স্তূপে। প্রবল ঝড় বইছিল। হিমশীতল পরিবেশে মারা যায় মেয়েটি। বাতাস ক্রমশ তীব্রতর হয়ে ওঠে। বাতাসের গর্জন বেড়ে যেতে থাকে। দিনের পর দিন এ ধরনের তুষার ঝড় বইতে থাকে। যাযাবর বৃদ্ধ বুঝতে পারল তার বড় মেয়েটি বায়ুদেবতা কুটরার নির্দেশ পালন করতে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
কুটরা তার প্রার্থনা শোনেনি। তুষার ঝড়ের তাণ্ডব কমে যায়নি। বরং তার মাত্রা আরো বেড়েছে।
বৃদ্ধ বায়ুদেবতাকে শান্ত করার জন্য তখন তার মেজো মেয়েটিকে সমস্ত নির্দেশ দিয়ে পাঠাল। কিন্তু মেজো মেয়েটিও কোনো উপকারে এলো না। সেও ঠিক তা বড় বোনের মতোই কাজ করল। আর কুটরাও প্রচণ্ড রেগে গিয়ে তাকে তাঁবু থেকে বাইরে ছুড়ে ফেলে দিল। বড় বোনটির মতোই একই পরিণতি হলো। তুষার স্তূপে অসহায়ের মত মরে পড়ে রইল মেয়েটি। কুটরা তখন বাতাসকে নির্দেশ দিলো আরো প্রচণ্ড বেগে বয়ে যেতে। অশান্ত হয়ে উঠেছে কুটরা।
এ দিকে তাঁবুর ভেতরে যাযাবর বৃদ্ধ তার কনিষ্ঠা মেয়েটিকে নিয়ে তুষার ঝড় থামার প্রতীক্ষা করছে। কিন্তু তা থামার কোনো লক্ষণ নেই। বাতাসের বেগ বেড়েই চলেছে। তাঁবুগুলোকে বুঝি উড়িয়ে নিয়ে যাবে। বৃদ্ধ আক্ষেপ করে চলেছে। চরম হতাশ হয়ে বলছে, ‘আমার মেয়েরা যে আমার কথামতো কাজ করেনি। ওরা নিশ্চয়ই বায়ুদেবতা কুটরার ওখানে এমন মন্দ কাজ করেছে যাতে তিনি আরো বেশি করে ক্রোধান্বিত হয়েছেন। ঝড়কে থামাচ্ছেন না। বৃদ্ধ তখন সস্নেহে তার ছোট মেয়েটিকে বললেন,
‘এখন তো তুমিই হলে একমাত্র ভরসা। তুমি ছাড়া আর কোনো গতি নেই। তোমাকেই আমি এখন বায়ুদেবতা কুটরার নিকটে পাঠাতে চাচ্ছি। আমার বিশ্বাস, তিনি তোমাকে তার স্ত্রী রূপে গ্রহণ করে নেবেন।’
বৃদ্ধের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে এভাবে তার ছোট মেয়েটিকে পাঠাতে। তবু নিতান্ত বাধ্য হয়েই তাকে এ কাজটি করতে হবে। তা না হলে যাযাবর গোষ্ঠীর সবাই ঝড়ে মৃত্যুবরণ করবে। বৃদ্ধ ছোট মেয়েটিকে তার করণীয় কাজগুলোকে ভালো করে বুঝিয়ে দেন।
ছোট মেয়েটি তাঁবুর বাইরে আসে। সেখানে শ্লেজ গাড়িটি রাখা। মেয়েটি শ্লেজটিকে বাতাসের মুখোমুখি রেখে জোরে ধাক্কা দেয়। তরতরিয়ে চলতে থাকে শ্লেজ গাড়িটি। আর ছোট মেয়েটি চলল গাড়ির পিছু পিছু। তখন বাতাসের ঝাপটা ছিল প্রবল। ছোট মেয়েটির পা কখনও কখনও হড়কে যায়। তুষারকুচি ক্রমাগত ভাবে তার চোখে মুখে ছিটকে এসে পড়ছিল। এতে সে সামনের দৃশ্যগুলো ঝাপসা দেখছিল। তুষার ঝড়ের মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলেছে ছোট মেয়েটি।
সে তার পিতার দেয়া প্রতিটি উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। বাতাসের ঝাপটায় তার পরনের পোশাকের দড়ি খুলে যায়। সে দড়ি বাঁধল না। বরফকুচি ঢুকে যায় তার জুতোর ভেতরে। সে বরফকুচি ঝেড়ে ফেলে দেয় না। মেয়েটি ছিল প্রত্যয়ী। পথে একবারের জন্যেও থামল না। একেবারে পাহাড়ের শীর্ষে গিয়ে থামল। আর পাহাড় চূড়োয় ওঠার পর সে তার পোশাকের দড়ি বাঁধল। জুতোর ভেতর থেকে জমে থাকা বরফকুচি ঝেড়ে ফেলল।
সে সময় পতপত করে ডানা মেলে সেখানে উড়ে এলো একটি ছোট পাখি। পাখিটি ডানা মুড়ে তার কাঁধের উপরে এসে বসে।
ছোট মেয়েটি কিন্তু তার অন্য দুই বোনের মতো ঐ পাখিটিকে তাড়িয়ে দিলো না। আলতো করে পাখিটির পালকে হাত বুলিয়ে দিয়ে আদর করল।
এক সময় পাখিটি উড়ে যায়। মেয়েটি তখন শ্লেজ গাড়িতে ওঠে। গাড়িটি পাহাড়ি ঢাল বেয়ে তরতরিয়ে নামতে থাকে। শ্লেজ গাড়িটি এসে থামে বায়ুদেবতা কুটরার আবাসের সামনে। মেয়েটি কুটরার তাঁবুর ভেতরে প্রবেশ করে। তাঁবুর পর্দা সরিয়ে এক সুদর্শন যুবক প্রবেশ করে। যুবক হলেন স্বয়ং বায়ুদেবতা কুটরা।
কুটরা মেয়েটির কাছে সেখানে আসার কারণ জানতে চায়।
ছোট মেয়েটি উত্তর দেয়, ‘আমার বাবা পাঠিয়েছে।’
কুটরা জিজ্ঞেস করে, ‘কী কারণে পাঠিয়েছে?’
মেয়েটি নতমুখে বলে, ‘তিনি আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন একটি প্রার্থনা করতে।’
: সেই প্রার্থনাটি কী?
: সেই প্রার্থনা হলো আপনি যেন অবশ্যই এই প্রচণ্ড তুষার ঝড়কে থামিয়ে দেন। এই ঝড় এখন আমাদের নিকট মহা আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঝড় যদি বন্ধ না হয় তাহলে আমাদের জাতির সবাই মারা পড়বে। কেউ আর বেঁচে থাকতে পারবে না।
কুটরা বলল, ‘আমি ভীষণ ক্ষুধার্ত। শিকার করে কিছু মাংস এনেছি। তুমি সেই মাংস রান্না করে আমাকে খেতে দাও। আমার কাছে মনে হচ্ছে যে তুমিও অনেকক্ষণ ধরে না খেয়ে আছ।’
মেয়েটি তখন উনুন জ্বালিয়ে কুটরার আনা মাংস রান্না করে। ঝলসানো মাংস একটি পাত্রে রেখে কুটরার সামনে আনে। কুটরা সেখান থেকে কিছু মাংস তুলে খায়। তারপর বাকি মাংস প্রতিবেশীর তাঁবুতে দিয়ে আসার জন্য বলে। ছোট মেয়েটি কুটরার নির্দেশমতো প্রতিবেশীর তাঁবুতে মাংস পৌঁছে দিতে যায়। বাইরে তখন প্রবল তুষার ঝড়ের দাপট চলছে। ঘূর্ণিঝড় পাক খাচ্ছে। চোখের সামনে মেয়েটি সবকিছু ঝাপসা দেখছে। মেয়েটি ঠিক বুঝতে পারছে না যে সে কিভাবে এগোবে।
হঠাৎ তখন সেই পাহাড় চূড়োর ছোট পাখিটি সেখানে উড়ে আসে। পাখিটি মেয়েটির সামনে দিয়ে উড়ে চলেছে। আর মেয়েটি পাখির দেখানো পথ ধরে চলতে শুরু করে। কিছুদূর যাওয়ার পর মেয়েটি সামনে কিছু দেখতে পেল। মেয়েটি ভাবল ওটা বোধ হয় সেই প্রতিবেশীর তাঁবু।
মেয়েটি সেটার কাছে গিয়ে বুঝতে পারল যে ওটা আসলে তাঁবু না। ওটা একটা বড় ঢিবি। সেই ঢিবি থেকে গলগলিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। মেয়েটি পায়ের আঙুল দিয়ে ঢিবিতে খোঁচা দেয়। এতে খানিকটা ফাঁক হয়ে একটা দরোজা খুলে যায়। দরোজার ওপাশে এক বৃদ্ধাকে দেখা গেল।
বৃদ্ধা জিজ্ঞেস করে, ‘কে তুমি? এখানে এসেছো কেন?’
ছোট মেয়েটি নম্র কণ্ঠে জানাল, ‘আমি যে আপনার জন্য মাংস রান্না করে নিয়ে এসেছি। কুটরা পাঠিয়েছেন।’
বৃদ্ধা খুশি হলেন, ‘তুমি বলছ কুটরা পাঠিয়েছেন। উত্তম কথা। তুমি মাংসের পাত্রটাকে এখানে রেখে বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করো।’
ছোট মেয়েটি তা-ই করল। ঝলসানো মাংসের পাত্রটি সেখানে রেখে বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ছোট মেয়েটি অপেক্ষা করতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে বৃদ্ধা বাইরে এসে মেয়েটিকে তার পাত্রটি ফেরত দেয়। তবে পাত্রটি ছিল ঢাকা।
পাত্রের মাঝে কী আছে তা মেয়েটি জানল না। সে পাত্রটি নিয়ে ফিরে আসে কুটরার তাঁবুতে।
কুটরা জানতে চায়, ‘তুমি কি সেই তাঁবুটিকে খুঁজে পেয়েছিলে?’
: পেয়েছিলাম।
: তাদের কি মাংস দিয়েছিলে?
: দিয়েছিলাম।
: আমাকে খালি পাত্রটা দাও তো। দেখি, তাতে কিছু আছে কিনা।
কুটরা তখন পাত্রটিকে নিয়ে দেখে যে তার ভেতরে রয়েছে সেলাই করার জন্য সুই, চামড়া, ঘষার যন্ত্র আর একটি পাটি।
কুটরা হেসে বলে, ‘বাহ তুমিতো দেখছি মেলা কিছু পেয়েছ। এসব তোমার প্রয়োজনে লাগবে।’
কুটরা ঘুমুতে চলে যায়।
ভোরবেলা কুটরা ঘুম থেকে উঠে হরিণের কয়েকটি চামড়া এনে ছোট মেয়েটিকে দিয়ে বলে, তুমি সাঁঝবেলার আগেই এসব চামড়া দিয়ে একটা পোশাক, এক জোড়া জুতো আর এক জোড়া দস্তানা তৈরি করে রাখবে। তুমি যদি আমার পছন্দ মতো এসব তৈরি করে রাখতে পারো তাহলে আমি তোমাকে বিয়ে করব।
কুটরা এরপর তুদ্রা অঞ্চলে শিকার করার জন বেরিয়ে যায়। ছোট মেয়েটি তখন হরিণের চামড়ার জিনিসগুলো তৈরি করতে থাকে। বৃদ্ধার দেয়া জিনিসগুলো খুব কাজে লাগে। সে মন ঢেলে নিখুঁতভাবে তার কাজ করতে থাকে। সে খুব বুদ্ধিমতী। সুন্দর করে কাজ করার পদ্ধতি জানে। সে পাটির ওপর চামড়া পেতে যন্ত্র দিয়ে ঘষতে থাকে। তারপর ছুরি দিয়ে কেটে শেলাই করতে থাকে।
এমন সময় তাঁবুর পর্দা সরিয়ে বৃদ্ধা ঢোকে। ছোট মেয়েটিকে বলে, ‘এই মেয়ে, তুমি কি আমাকে একটু সাহায্য করতে পারো? আমার চোখে কি যেন ঢুকেছে। আমি সেটা বের করতে পারছি না। আমার চোখ ব্যথা করছে। তুমি কি বের করে দেবে?’
ছোট মেয়েটি তখন হাতের কাজ বন্ধ করে বৃদ্ধার চোখের ভেতরটা ভালো করে পরিষ্কার করে দেয়। আর সেই কাজটা সে করে অতি যত্নের সাথে।
চোখের ভেতর থেকে জিনিসটা বের হয়ে যাওয়াতে বৃদ্ধা স্বস্তি ফিরে পায়।
বৃদ্ধা তখন বলে, ‘এবার আমার ডান কানের ভেতরে দেখোতো।’
ছোট মেয়েটি বৃদ্ধার কথামতো তার কানের ভেতরে তাকিয়ে চমকে ওঠে। অবাক হয়ে যায়।
বৃদ্ধা জানতে চায়, তুমি কী দেখতে পাচ্ছ ওখানে?
ছোট মেয়েটি অবাক কণ্ঠে উত্তর দিলো, ‘আমি তো দেখতে পাচ্ছি যে আপনার কানের ভেতরে একটি মেয়ে বসে আছে।
বৃদ্ধা বলে, ‘তুমি এখন ওকে ডেকে নাও। ও তোমাকে কুটরার পোশাক তৈরির কাজে সাহায্য করতে পারবে। ছোট মেয়েটি তখন বৃদ্ধার কানের ভেতরে বসে থাকা মেয়েটিকে ডাকে। আশ্চর্যজনক কাণ্ড ঘটল! সেই ডাক শোনার সাথে সাথে চারটি মেয়ে কানের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। আর তারা বেরিয়ে এসেই ঝটপট কাজ শুরু করে দেয়। কেউ পাটির ওপরে, চামড়া পাতে। কেউ কেটে সমান করে। কেউ আবার শেলাই করে। এর ফলে অল্প সময়ের ভেতরেই সমস্ত সাজপোশাক তৈরি হয়ে যায়।
কাজ শেষ হয়ে যাবার পর বৃদ্ধা মেয়ে চারটিকে আবার কানের ভেতরে লুকিয়ে নিয়ে বেরিয়ে যায় তাঁবু থেকে।
শেষ বিকেলে কুটরা তুন্দ্রা অঞ্চল থেকে শিকার করে ফিরে আসে। ছোট মেয়েটিকে বলে, ‘কী ঠিকমতো সাজপোশাক তৈরি করেছো তো?’
ছোট মেয়েটি জানাল যে সে সবই করেছে।
কুটরা বলে, ‘এবারে আমাকে সেসব দেখাওতো। একবার পরে দেখি কেমন হয়েছে সেগুলো। ’
ছোট মেয়েটি তখন সারা দিন ধরে তৈরি করা সাজ পোশাকগুলো কুটরাকে এনে দেয়। কুটরা পোশাকে হাত বুলিয়ে দেয়।
‘বাহ, বেশ মোলায়েম হয়েছে দেখছি। পোশাকটি তার শরীরে মানানসই হয়েছে। সে খুব খুশি হয়। কুটরা ছোট মেয়েটিকে বলে, ‘তোমাকে আমার অনেক পছন্দ হয়েছে।’
আমার মা আর চার বোনও তোমাকে পছন্দ করেছে।
তোমার কাজ অনেক সুন্দর আর নিখুঁত। আমি তোমার সাহসিকতা দেখেও মুগ্ধ। তুমি অনেক কষ্ট স্বীকার করে তোমার গোষ্ঠীর লোকদের মঙ্গলের জন্য এসেছো। আমি তোমার প্রার্থনা শুনলাম। তুষার ঝড়ের দাপট বন্ধ করে দিলাম। সে আর তোমাদের কোনো প্রকার ক্ষতি করতে পারবে না। আর এখন থেকে তুমি এখানে আমার সাথে থাকবে।’
বায়ুদেবতা কুটরার সদিচ্ছার কারণে তখন থেমে যায় প্রলয়ঙ্করী তুষার ঝড়। পুরো তুন্দ্রা অঞ্চল শান্ত হয়ে যায়। আলো হাসি গানে তুন্দ্রা অঞ্চল মুখরিত হয়ে ওঠে।

*(তুন্দ্রা অঞ্চলের আদিবাসী লোকগল্প।)

Share.

মন্তব্য করুন