প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে আমাদের স্কুলে, অফিসে, বাজারে বা দরকারি কাজে স্বল্প দূরত্বে বা দীর্ঘ দূরত্বে ভ্রমণ করতে হয়। এর জন্য আমাদের কাছে জনপ্রিয় মাধ্যম হলো গাড়ি। এই গাড়ির আবার আছে রকমফের, কোনটা দু-চাকা, তিন-চাকা, চার-চাকা আবার ছয়-চাকাও হয়! কিন্তু কখনও কি ভেবে দেখেছেন সব গাড়ির টায়ার কেন কালো হয়? বেনিআসহকলাও তো হতে পারতো। আঠারো শতকের পর জন্মগ্রহণ করা সব মানুষের কাছেই ‘গাছে সবুজ পাতা’ ফোটার মতো স্বাভাবিক ব্যাপার! তাই এ নিয়ে কারো মনে প্রশ্ন তৈরি হয় না। কিন্তু কেউ কেউ আছেন রহস্য উদঘাটন করতে পছন্দ করেন। তারাই হলেন আমাদের সমাজের বিজ্ঞানপ্রিয় মানুষ। যদিও কম বেশি সবারই কৌতূহল থাকে! তাই আর কথা না বাড়িয়ে কালো টায়ারের আপাদমস্তক রহস্য উদঘাটন করি।
ইতিহাস বলছে ১৮৮৫ বা ১৮৮৬ সালে জার্মান উদ্ভাবক কার্ল বেনজ প্রথম সম্পূর্ণ গাড়ি তৈরি করেন। কিন্তু একদম গোড়ায় ১৮৮০ সালের দিকে স্কটল্যান্ডের উদ্ভাবক জন বয়েড ডানলোপ, হাওয়ার টিউবসহ একটি টায়ার খেলনা সাইকেলের জন্য তৈরি করেন। এরপর থেকেই টায়ার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষের কাছে। আর এভাবেই গাড়ি শিল্প উন্নত হতে হতে বর্তমানে আধুনিক হয়েছে এবং আরো উন্নত করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।
একটি গাড়ির অন্যতম প্রধান অংশ হলো চাকা এবং চাকার বাইরে রাবারের তৈরি এক ধরনের খোলকের মধ্যে হাওয়া ভর্তি টিউব থাকে। যাকে এক কথায় আমরা টায়ার হিসেবে চিনি। আঠারো শতকের দিকে টায়ার তৈরির প্রধান উপাদানগুলো ছিলো যেমন- রাবার যেটা Hevea Barsiliensis গাছের কস থেকে পাওয়া যায়, জিংক অক্সাইড (ZnO) ব্যবহার হতো দৃঢ়তা প্রদান এবং দীর্ঘস্থায়িতার জন্য। তা ছাড়া আরো কিছু রাসায়নিক যৌগ ব্যবহার করা হতো। রাবার দেখতে কিছুটা ধূসর রঙের। আবার ZnOএর গুড়ার রঙ ও সাদা। তাই সেই সময়ের টায়ার সব সাদা রঙের হতো। আপনি নিশ্চয়ই মজা করছেন?
জি না! আঠারো শতকে সাদা রঙের টায়ারকে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হতো। নিশ্চয়ই এখন আপনাদের মনে প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে, তাহলে গাড়ির চাকা কালো হয়ে গেলো কিভাবে? একটু ধৈর্য ধরুন! সেই কথাই এখন বলবো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ZnO এর চাহিদা অনেক বেড়ে গেলো। গুলি তৈরি করার জন্য। তাই টায়ার শিল্পে ZnO এর টান পরতে শুরু করলো। তাই বিকল্প উপাদান হিসেবে কার্বন ব্ল্যাক ব্যবহার করা হলো। ইতিহাসে এ নিয়ে মতভেদ আছে যে কখন কোথায় কার্বন ব্ল্যাক যৌগটি ব্যবহার করা হয়েছিলো। কার্বন ব্ল্যাক যৌগটি মূলত প্রাকৃতিক গ্যাস বা পেটুলিয়াম কে অক্সিজেন (O2) এর উপস্থিতে অসম্পূর্ণ দহনের মাধ্যমে পাওয়া যায়। একে এক ধরনের সিনথেটিক পলিমার বলা যায়। কাঠ পুড়িয়ে রান্না করলে পাতিলের নিচে যে কালো রঙের উপাদানটি পাওয়া যায়, কার্বন ব্ল্যাক যৌগটা ঠিক সেরকম। কার্বন ব্ল্যাক যৌগটা অনেকটা জিনতত্ত্বের পিগমেন্টের মতো কাজ করে। তাই টায়ারে কার্বন ব্ল্যাক ব্যবহার করলেই টায়ারের রঙ কালো হয়। তাহলে এখন ZnO দিয়ে টায়ার তৈরি করলে সমস্যা কোথায়? এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
ZnO দিয়ে তৈরি টায়ার UV রশ্মি বা অতি বেগুনি রশ্মির প্রভাবে, এবং টায়ারের পৃষ্ঠে ঘর্ষণের ফলে সৃষ্ট তাপমাত্রায় খুব অল্পদিনে নষ্ট হয়ে যায়। অন্য দিকে কার্বন ব্ল্যাক টায়ারে ব্যবহার করলে টায়ারে তাপধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এবং টায়ার কালো রঙের হওয়ায় সহজে অতি বেগুনি রশ্মি শোষণ করতে পারে। এর ফলে টায়ারের অভ্যন্তরীণ কাঠামো সহজে নষ্ট হয় না। টেকেও দীর্ঘদিন। এখন হয়তো এটাও বুঝতে পারছেন সানগ্লাস কেন কালো হয়? এখানে আমাদের জেনে রাখা প্রয়োজন, কার্বন ব্ল্যাক যৌগ গলতে ৩৭২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ZnO যৌগ গলতে ১৯২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্র প্রয়োজন। তা ছাড়া টায়ারের পৃষ্ঠে ১০০-১২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা উৎপন্ন হয়। তাই দীর্ঘদিন টিকে থাকার দৌড়ে কালো টায়ার সকলের কাছে জনপ্রিয়। বাজারে কার্বন ব্ল্যাক এবং ZnO এর দাম একই। কিন্তু ZnO এর টায়ার ৫ হাজার মাইল এবং কার্বন ব্ল্যাকের টায়ার ৫০ হাজার মাইল চলে। তাই সমান দামে ভালোটা কে না চায়! আর এখানেই শেষ হলো কালো টায়ারের রহস্য। কিন্তু টায়ার কেন রাবার দিয়েই তৈরি হয়? তুমি যদি জ্যামে থাকো এটাই শুভলগ্ন! উত্তরটি খোঁজো তাহলে!

Share.

মন্তব্য করুন