বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ষড়ঋতু অর্থ নিশ্চই তোমরা জানো। ষড়ঋতু অর্থ হচ্ছে ৬ ঋতু। ৬টি ঋতুর পঞ্চমটিই হলো শীত। সাধারণত ইংরেজি নভেম্বর মাস থেকে ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত শীত অনুভূত হলেও মধ্য ডিসেম্বর থেকে মধ্য ফেব্রুয়ারি এই দুই মাস শীতকাল। বাংলায় পৌষ এবং মাঘ মাস। শীত আমাদের প্রকৃতির বৈচিত্রময় রূপের একটি। কিন্তু কেন শীতকালে শীত আসে?
নিশ্চয়ই এটা আমাদের ভাবনায় প্রায়ই নানারকম প্রশ্নের সৃষ্টি করে। এই শীত আসে কোত্থেকে? আকাশ থেকে নামে? যেমনি আকাশ থেকে বৃষ্টি নামে? নাকি কোনও অঞ্চল থেকে ঘূর্ণিঝড়ের মতো ধেয়ে আসে? নাকি শীতের অতিথি পাখির মতো সাইবেরিয়া থেকে আসে শীত?
না, এমনটি নয়। বরং শীত আসে হিমালয় পর্বত থেকে। বাংলাদেশ থেকে অনতিদূরে ভারতের মানচিত্রে বাস করে এই হিমালয়। এই হিমালয়ে জমে থাকে বরফ। সেই বরফ থেকে বাতাসে ভর করে ঠাণ্ডা শীতল হিমবায়ু ভেসে আসে আমাদের দেশে। আমাদের দেশের মানুষ তখন হি-হি করে কাঁপে আর আগুনের পরশ খুঁজে বেড়ায়।
অনেকেতো শীতের এই কাঁপুনি সহ্য করতে না পেরে মারাও যায়। আহারে! গরম কাপড়ের অভাবে কতো মানুষ এই শীতে কষ্ট পায়! যদি প্রতিটি মানুষের কাছে গরম কাপড় পৌঁছে দেওয়া যেত তাহলে সবাই মিলে এই শীতকালটাকে আমরা আনন্দের সাথে উপভোগ করতে পারতাম। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের মানুষ শীতে খুব কষ্ট করে। কারণ বাংলাদেশের উত্তর দিকেই সেই হিমালয়। যার শরীর বেয়ে আসে হিম-হিম বাতাস, আসে ঠকঠকানি শীত।
এইটুকু কষ্টের কথা ভুলে গেলে শীত কিন্তু সবারই খুব প্রিয় ঋতু হতে পারে। বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের কাছে শীততো এক মহা আনন্দের ঋতু। এই ঋতুটি বিশেষভাবেই যেন শিশুদের জন্য। কারণ এই শীতকালে অনেকটা সময় শিশুদের স্কুল ছুটি থাকে। তারা গ্রামে বেড়াতে যেতে পারে।
দাদী-নানী-খালা-ফুপুর হাতের বানানো পিঠা খেতে পারে। পারে লেপের নিচে শুয়ে দুয়োরানী-সুয়োরানীর গল্প শুনতে। দুয়োরানীরা কিন্তু শুধু গল্পেই নেই, আছে আমাদের আশপাশের বাসাবাড়িতেও। কোনও এক ভোরে তোমরা ঘর থেকে বেরিয়ে দেখতে পাবে, কতো দুয়োরানী গরম কাপড়ের অভাবে রাস্তার পাশে ঠক-ঠক করে কাঁপছে। কতো দুয়োরানী এই শীতের সকালেও পানিভেজা পান্তাভাতের প্লেটে হাত বাড়িয়ে দেয় সামান্য কাচামরিচের সাথে। আবার সুয়োরানীরাও কিন্তু আছে। তারা সকালে উঠে গরম গরম খিচুড়ি রানড়বা করে খায় ঘি মাখিয়ে। তারা বাচ্চাদের হাতে বড় বড় মোয়া তুলে দিয়ে বলে ‘খেয়ে নে বাবা।’ বিকেলে তারা পিঠা বানায় আর রাজ্যের গল্প জুড়ে দেয়। হাসি-ঠাট্টায় কতোইনা ভালো সময় কাটে তাদের।
সুয়োরানীরা-দুয়োরানীদের একটু খবর নিলে কিন্তু দুয়োরানীদের আর দুঃখ থাকতো না। তাদের দুখী-দুখী মুখটা দেখে তোমাদেরও মুখভার করতে হতো না। যাক দুয়োরানী-সুয়োরানীর গল্প ছেড়ে চলো অন্য গল্প করি। শীতকালে সবচেয়ে কদর বেশি কার জানো? লেপের।
তোমরা যারা বেশি দুষ্ট, তারা তো লেপ টানাটানি করে ছিঁড়েই ফেলো। এ বলে আমার পাশে লেপ নাই, ও বলে আমার পাশে লেপ কই। শুরু হয় টানাটানি। শেষে বাবা মা বড়রা এসে যদি থামাতে পারে! তবেই রক্ষে।
এই যে গরমের ডিপো, আরামের উপর আরাম দেয় লেপ, এই লেপ কীভাবে তৈরি হয়? লেপ তৈরি হয় তুলা দিয়ে।
তুলা আসে তুলা গাছ থেকে। শহরের মানুষেরা তুলাও খুঁজতে যায় না, কাপড়ও খুঁজতে যায় না। তারা ‘লেপ-তোষক’ হাঁক দেয়া লোকটাকে বলে বানিয়ে দাও…।
আর গ্রামের মানুষ প্রম তুলা সংগ্রহ করে, তারপর কাপড় কেনে, তারপর গঞ্জের বাজারে গিয়ে বলে ‘কেরামত ভাই একটা লেপ বানিয়ে দেন তো! শীততো চলে এলো…।’
আবার শীতের অন্যতম আকর্ষণ পিঠা নিয়েও শহরের মানুষদের কিন্তু কোনও আটঘাট বাঁধার বিষয় নেই। তারা ভোরে অথবা সন্ধ্যায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রেডিমেট বানানো দুটো ভাপা পিঠা অথবা দুটো চিতল পিঠা খেয়ে মনের সাধ মেটায়।
আর গ্রামে! বাব্বাহ কত্তো আয়োজন পিঠাকে কেন্দ্র করে। নানীরা মেয়েকে ডেকে ডেকে হয়রান হয়, ‘কীরে কবে আসবি, শীতের পিঠা খেতে? স্কুলতো বন্ধ, জলদি আয় না মা।’ তারপর নাতি নাতনি মেয়েকে পেয়ে নানীদের সে কি আনন্দ! চাল ভিজিয়ে, ঢেঁকিতে গুড়ি করে শুরু করে পিঠা পায়েসের ধুম। এ যেন খাওয়ার চেয়ে তৈরিতেই বেশি আনন্দ।
দাদা-নানারাও কিন্তু বসে থাকে না। ভোরবেলা নাতি নাতনির হাত ধরে নিয়ে চলে ক্ষেতের আইল ধরে খেজুর গাছের তলায়। তারপর হাঁক ছাড়ে, ‘ও রহমত ভাই, খেজুরের হাঁড়িটা নামাও, আমার নাতিরা রস খাবে।’ তারপর ঠাণ্ডা মিষ্টি রসের স্বাদে নাতি নাতনিরা যখন ‘ওয়াও’ বলে নানা দাদাকে জড়িয়ে ধরে তখন এক পরম তৃপ্তিতে চোখের কোণায় জমে অশ্রু। দাদা নানাদের কাছে এটাই পরম সুখ। আপনজনেরা খুশি হবে, জড়িয়ে ধরবে। এর চেয়ে বেশি চাওয়ার কিইবা আছে তাদের?
মামা চাচারা কী করে?
‘এ্যাই চল, যাবি?’ বলে ধরে নিয়ে যায় আগুন পোহাতে। ওদিকে মা পেছন থেকে সাবধান করে, ‘দেখিস, আগুন যেন কাপড়ে না লাগে।’ সত্যিই কিন্তু! শীতের এতসব আনন্দ মাটি হয়ে যেতে পারে, আগুন পোহাতে গিয়ে গায়ে আগুন ধরে গেলে। এর জন্য একটু সাবধান হলেই চলে।
সকালে শীতের কাঁপুনীতে কাঁপলেও একটু বেলা হলে অনেকেরই ইচ্ছে হয়, পুকুরে সাঁতার কেটে বীরত্ব দেখাতে। হুপুস করে পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে বিজয়ের চিৎকার দিতেই শীত উধাও। তারপর শরীর থেকে রীতিমত ধোঁয়া বের হয়। শীতের ভোরে কিন্তু আরেকটা দৃশ্য সবারই নজর কাড়ে। সেটি হলো ধোঁয়ার কুণ্ডলির মতো কুয়াশা।
এতো কুয়াশা নামে, যে পাঁচহাত দূরের মানুষটাকেও দেখা যায় না। এসময় রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে খুব সাবধান হতে হয়। নয়তো দুর্ঘটনা ঘটে। শীতের ভোরে চাদর মুড়ি দিয়ে আপন মনে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে গাড়ি সামনে এসে যায়, কেউ কাউকে দেখতে পায় না।
তবে গ্রামে কিন্তু এই কুয়াশার মাঝেও অনেক মজার মজার খেলা হয়। পলানটুক খেলতে পারো কুয়াশার আড়ালে। ‘বলতো আমি কোথায়?’ শব্দ শোনা যায় কিন্তু মানুষ দেখা যায় না। আবার টুক দে…টুক…তারপর শব্দ অনুসরণ করে খুঁজে বের করার পালা। কুয়াশার চাদরে ঢাকা এমন প্রকৃতি দেখে মনে হতে পারে পৃথিবীটা ছোট হয়ে গেছে। অথবা পুড়ে ধোঁয়া হয়ে গেছে। আসলে এটাই প্রকৃতির রহস্য। কখনও রোদে ঝলমল, কখনও কুয়াশার আধারে ঢাকা সব।
শীতকাল অনেকেরই প্রিয় ঋতু। কারণ শীতে প্রচুর নতুন সবজি পাওয়া যায়। ফুলকপি, বাধাকপি, সিম, লালশাক, পালংশাক, লাউ, টমেটো, মূলা কতো রকমের সবজি যে তখন বাজারে ওঠে। কতো সুন্দর সাজে সেজে ওঠে গ্রামের ক্ষেতগুলো। বড়দের সাথে এসব ক্ষেতখামারের যতেড়ব ছোটরাও ভীষণ আনন্দ নিয়ে অংশ নেয়। নিজেরা পেড়ে আনে ধুন্দল, লাউ, ঢেঁড়স, সিম, বরবটি। কেউ কেউ সাজিয়ে তোলে খেলনাবাড়ি।
তবে শীতের সকালে মিটিমিটি রোদের হাসি কিন্তু সবার প্রাণেই আশা জাগায়। সবাই মিলে রোদ পোহাবার দৃশ্যটা কিন্তু দারুণ লাগে। রোদ যে কতো বড় নেয়ামত তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায় শীতকালে। সূর্যটাকে তখন আর সূর্য মনে হয় না, মনে হয় ‘সুয্যিমামা।’ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতাটা নিশ্চয় মনে আছে। এসো পড়ি-
‘আমি হব সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুমবাগে
উঠব আমি ডাকি!
সুয্যি মামা জাগার আগে
উঠব আমি জেগে,
হয় নি সকাল, ঘুমো এখন,
মা বলবেন রেগে।
বলব আমি- আলসে মেয়ে
ঘুমিয়ে তুমি থাক,
হয়নি সকাল, তাই বলে কি
সকাল হবে না ক?
আমরা যদি না জাগি মা
কেমনে সকাল হবে?
তোমার ছেলে উঠবে গো মা
রাত পোহাবে তবে।
কী মনে হয়? এই ছড়া কিন্তু কবি শীতকালেই লিখেছেন। কারণ শীতকাল ছাড়া অন্যসময় সূর্যটাকে ‘সুয্যিমামা’ মনে হয় না। কারণ তখন রোদপোহাবার মজাও পাওয়া যায় না।
শীতের খেজুর রসের কথা তো আগে বলেছি, কিন্তু খেজুর রসের কতো যে নানান ব্যবহার আছে সে কথা কি ভুলে গেছো?
খেজুরের রস দিয়ে কতো কী তৈরি হয়, সে কথা কিন্তু ভুলবার নয়। রস দিয়ে তৈরি হয় রসের ফিরনি, রস আর নারকেল দিয়ে তৈরি হয় চইপিঠা, চিতল পিঠা ভেজেও কিন্তু ডোবানো হয় রসের মধ্যে। এই রস দিয়ে তৈরি হয় ঝোলা গুড়, খেজুরের পাটালি গুড়। সেই গুড় দিয়ে হয় আরও কতো পিঠা। পাটালি গুড়ের কথা বলতে গিয়ে মনে পড়ে গেলো যশোরের বিখ্যাত পাটালী গুড়ের কথা। যে একবার খাবে সে কখনও ভুলতে পারবে না এর স্বাদের কথা। শীতের এই খেজুরের রস কিন্তু জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। রস দিয়ে গুড় তৈরি হয়, সেই গুড় বাজারে বিক্রি সংসার চালায় অনেক পরিবার।
শীতের সবজি চাষ করে, বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়, পরিবারের ভরণপোষণ করে কৃষকেরা। গরম কাপড় তৈরি করে, গরম কাপড় বুনেও কিন্তু অনেক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। তাই শীত কিন্তু শুধু আনন্দেরই ঋতু নয় বরং অর্থনৈতিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ ঋতু। এবারের শীত সবার জন্য আনন্দের হয়ে উঠকু, শীত হয়ে উঠুক উপার্জনের মাস। এই কামনা রইলো।

Share.

মন্তব্য করুন