বিপু আর সুরমাকে পাওয়া যাচ্ছে না। কোথায় গেলো ওরা। ওদের নাওয়া খাওয়া হয়েছে কিনা কে জানে। বাড়িতে বউ ভাতের গ্যাঞ্জাম। বিপু সুরমা যমজ ভাই বোন। চাচুর বউভাতে মা ব্যস্ত ছিলো। ওদের দেখভালের দায়িত্ব ছিলো ছোটফুফু সায়লার ওপর। সায়লার বান্ধবীরা এসেছে। সে কারণে ওদের দিকে মনোযোগ দিতে পারেনি। এই সুযোগে ওরা লাপাত্তা হয়েছে। সবখানে খুঁজেও সন্ধান মিলছে না। সায়লাকে ধরে বসলো বিপুর মা।
‘তোর কা- কী বলতো সায়লা?’
‘ওদের তো চোখে চোখে রেখেছি। খাইয়ে দাইয়ে ঘুমও পাড়ালাম।’
‘চোখে চোখে রাখলে এই দুর্ভোগ হয়।’
‘তুমি কি মনে করো ভাবী? ওদের দিকে নজর দেইনি?’
‘তাই তো মনে হচ্ছে। এত্তো করে বললাম। শেষে এ অবস্থা হলো। কোথায় আছে কে জানে।’
চোখের জলে ভেসে মা কাঁদতে লাগলো। কী করার আছে। রাত বারোটা বাজে। বিয়ে বাড়ির ধকল সামলে সবাই ক্লান্ত। নিকট জনরা বাড়ি বাড়ি চলে গেছে। যারা ছিল, যেদিকে খুশি চলে গেছে। কোন প্রতিবেশী হয়ত ওদেরকে নিজের বাড়িতে ঘুমিয়ে রেখেছে। এই সান্ত্বনায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে সবাই। কিন্তু নাজমা মনকে প্রবোধ দিতে পারছে না। শুধু বিপুটা হারালে ফার্নিচারের খোসে খুঁজলেই হতো। কিন্তু সুরমা সমেত হারিয়ে যাওয়াতে নানান আশঙ্কা দানা বাঁধছে মায়ের মনে।
একদিনের কথা মনে পড়লো নাজমার। সুরমাকে নিয়ে ওর ফুফু বাইরে বেড়াতে গেছে। বিপুকে ঘুম পাড়িয়ে নাজমা ওয়াশরুমে ঢুকেছে। এসে দেখে বিপু বিছানায় নেই। কোথায় গেল বিপু! উঠোন, বারান্দা, বাগা এমনকি ছাদে ওকে না পেয়ে মা হতবিহ্বল হয়ে পড়লো। বালিশ, বিছানার তল এমনকি আলনার পেছনে ওকে খুঁজতে লাগলো মা। তন্ন তন্ন করে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে পড়লো। কোনক্রমেই সন্ধান পেলো না বিপুর। নাজমা বাধ্য হয়ে স্বামীকে মোবাইল করলো।
‘ওগো শুনছো। জলদি বাড়ি চলে আসো।’
‘কী হয়েছে বলবে তো।’
‘আমি বলতে পারবো না। বাসায় এসে শুনবে।’
‘মাথা ঠাণ্ডা করে বলতো শুনি। কি হয়েছে?’
‘বিপু নেই।’
‘বিপু নেই মানে?’
‘ওকে রেখে ওয়াশরুমে ঢুকেছি। এসে দেখি নেই।’
‘দাঁড়াও আসছি। কী অবাক কথা বলো।’ অফিসের কাজ ফেলে বাসায় আসে বিপুর বাবা।
সবখানে বিপুকে তনড়বতনড়ব করে খোঁজে সে। কোথাও না পেয়ে দারুণ ভেঙে পড়ে। বাবা চিন্তা করতে থাকে পিচ্চি ছেলে যাবে কোথায়। পথঘাট চেনে না। কোনদিন একা বাইরে বের হয়নি। তার পক্ষে কোথায় যাওয়া সম্ভব। অনেক ভেবে বাবা খাটের নিচে খুঁজতে শুরু করে। চালের ড্রামটা কে যেন ফেলে রেখেছে খাটের তলে। সেই ড্রাম সরাতে গিয়ে বিপুকে পাওয়া গেলো।
ওই ড্রামের ভেতর ঢুকে আরামে ঘুমাচ্ছে। এদিকে বাড়ির সবাই পাগল হওয়ার উপক্রম। কখন ঢুকেছে ড্রামের ভেতর ছেলেটা? ওর মাথায় এরকম দুষ্টবুদ্ধি আসলো কেমন করে। সবাই অবাক হয়ে গেলো ওর কাণ্ড দেখে।
আজ কারো বুদ্ধি খাটছে না। এমন কোন জায়গা নেই খুঁজে দেখার। যার যেমন মনে হয়েছে সে সেভাবেই খুঁজেছে। তা ছাড়া পরিচিত সবাইকে কল করে জানানো হয়েছে এদের হারিয়ে যাওয়ার কথা। নতুন আত্মীয়ের বাড়িতেও কল দেয়া হয়েছে। যদি ওদের সাথে গিয়ে থাকে। কিন্তু কোথাও ওদের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না।
ওদের কথা ভেবে বাবা ঘামতে লাগলেন। যদি ওদের না পাওয়া যায় তাহলে কি হবে? কেউ কেউ পরামর্শ দিলো থানায় জানাতে। বিপুর এক মামাত ভাই এ কথা শুনে থানায় চলে গেলো। থানায় জানাতে তো দোষ নেই।
বিয়ে বাড়িতে আজেবাজে কতো লোক আসে। সুযোগ বুঝে কেউ ওদের নিয়ে যেতে পারে। বিষয়টা থানার গোচরে রাখলে সময়ে কাজে লাগবে।
বিয়ে নিয়ে সবাই যখন ব্যস্ত তখন বিপু আর সুরমা কিছুক্ষণ সায়লার পেছনে ছিল। সায়লা ওদের খাইয়ে বান্ধবীদের নিয়ে মগ্ন হয়ে পড়ে। বর যখন আসবে তখ ওরা কী করবে এই নিয়ে বান্ধবীদের সাথে পরিকল্পনায় মত্ত হয়। ফুফুকে ব্যস্ত হতে দেখে সুরমা বিপুকে বললো,
‘চল বিপু পিকনিক করি।’
‘কোথায় করবে পিকিনিক?’ খুশিতে বাগবাগ হয়ে বলে বিপু।
‘সুপারি বাগানে। ওখানে একটা পেয়ারা গাছ আছে। তার তলায়।’
‘রান্না করবে কে?’
‘রান্না করবো কেন? বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে মজা করে খাব।’
‘কেউ দেখে ফেলে যদি?’
‘বলবো পিকনিক খাচ্ছি। দরকার হলে তারাও খাবে।’
ঘর থেকে চাদর বালিশ নিয়ে পেয়ারার তলে সুন্দর করে বিছায় ওরা। মনোরম করে তোলে জায়গাটা। তারপর চুপটি করে গামলা ভরে পোলাও মাংস নিয়ে যায়।
বাড়িতে অনেক হাঙ্গামা। কেউ কারো দিকে খেয়াল করছে না। বরের জন্য গেট সাজানো হচ্ছে। সেখানে সবাই বরের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। লাউড স্পিকারে গান বাজছে। সে গানের শব্দে কেউ কারো কথা শুনতে পায় না। সাবধানে জগ ভর্তি করে পানি নিয়ে এলো বিপু। টেবিলে অতিথিরা হল্লা করে খাচ্ছে।
তারাও খাবে নিজের তৈরি ঘরে বসে। খাওয়া হলে পাতার পুতুল বানিয়ে বিয়ে দেয় ওরা। বিয়ে হলে বউভাত আর বিদায় নিয়ে ওরাও ব্যস্ত হয়। তারপর ওরা ঘুমিয়ে পড়ে। সাঁঝের পর সুনসান পরিবেশে ওদের ঘুম স্বপ্নমুখর হয়ে ওঠে।
চিন্তাক্লিষ্ট মনে নানা কথা ভাবছে সবাই। নাজমা বিছানায় শুয়ে চোখের জলে ভাসছে। কোথায় কিভাবে রাত কাটাচ্ছে বিপু আর সুরমা। সুরমাটা যে কেমন হয়ে গেছে। এই অবোধ ছেলেটাকে নিয়ে কোথায় হারিয়ে গেল। ভাবতে ভাবতে চোখ ধরে গেছে নাজমার। ঘুমের জড়তায় সে পেছনের বাগান বাড়িতে চলে গেল। তখন মধ্যাহ্ন দুপুর। একটা পাখি গাছের শাখায় বসে মনের দুঃখে সকরুণ গান বলে চলছে। সে গান নাজমার মনটা শোকে ভরিয়ে দিল। শুকনো পাতার বুকে শব্দ তুলে সে বাগানের উত্তর দিকে গোলাবজামের গাছের দিকে চলে গেল। সেখানে দেখল লাল চাদরের ঘেরে বিপু আর সুরমা ঘুমিয়ে আছে।
বাগানের বড় বড় মশা ওদের শরীরের রক্ত চুষে খাচ্ছে। একটা কাল সাপ ঘেরটার চারপাশে ফণা তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সুযোগ পেলে সাপটা ওদের কামড় দেবে। জোরে চিৎকার দিয়ে বিছানায় উঠে বসে নাজমা। কাউকে কিছু না বলে এলামেলো বসনে বাগানের দিকে ছুটতে লাগলো। বাড়ির সবাই হতবিহ্বল হয়ে আলো নিয়ে নাজমাকে অনুসরণ করল।
বাগানের প্রান্তে এসে সবাই অবাক হয়ে গেল। নির্জন বাগানে বিছানা পেতে কী সুন্দর ঘুমাচ্ছে ওরা। সুন্দর করে খড় ছড়িয়ে তার ওপর চাদর বিছিয়ে দিয়েছে নিপুণভাবে। বিপু সুরমাকে বুকে নিয়ে কাঁদতে লাগলো নাজমা। কতদিন থেকে ওরা পিকনিক করার আবদার করছিলো। নাজমা তা একদম পাত্তা দেয়নি। আজ ওরা মাথা খাটিয়ে নিরিবিলি বাগান বাড়িতে মনের মতো পিকনিক করেছে।

Share.

মন্তব্য করুন