যুক্তরাষ্ট্রের ফেয়ারফ্যাক্স শহরের পেছনে আছে একটি জংগল। তাতে গাছপালা খুব ঘন নয়। তবে বড়বড় গাছ- যেমন ম্যাপোল, পপলার ও বিচ্ গাছ আছে অনেক। আর আছে হিংস্র নয় সেরকম বেশ কিছু প্রাণী। আজ আমরা আলফ্রেদো’কে নিয়ে এ জংগলে ‘নেচার ওয়াক’ করতে এসেছি। নেচার ওয়াক হচ্ছে কোন বনের ভেতর ঘুরে বেড়ানো। ঘুরতে ঘুরতে খেয়াল করে গাছপালা ও লতাগুল্ম দেখা। আর সুযোগ হলে বনের প্রাণীদেরও মনযোগ দিয়ে নজর করা। আলফ্রেদোর বয়স বারো। সে গলায় জুমলেন্স লাগানো ভারী একটি ক্যামেরা নিয়ে হাঁটছে। উপড়ে পড়া পপলার গাছের গুড়ির কাছে সে দাঁড়ায়। তাতে জন্মেছে কমলা রঙের বেশ কিছু ছত্রাক। তার ছায়ায় বাস করছে সবুজ রঙের শুঁয়োপোকা। শুঁয়োপোকার ছবি তুলবে কি? আলফ্রেদো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। পোকাগুলো আকারে খুব ছোট। ক্যামেরায় বিশেষ রকমের লেন্স না থাকলে এগুলোর ছবি ভালো আসবে না। তাকে চিন্তিত দেখায়।
জংগলের ভেতর পায়ে চলার পথে ছড়ানো আছে ঝরা পাতা ও কিছু পাথর। আলফ্রেদোর হাঁটতে কোন অসুবিধা হচ্ছে না দেখে আমরা খুশি হই। আজকে আলফ্রেদোর জন্য নেচার ওয়াকের আয়োজন করেছেন আমার স্ত্রী, তার নাম হলেণ। আলফ্রেদো বেশ কয়েক মাস পর স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলা করতে পারছে। এটা আমাদের জন্য খুব আনন্দের। সাত মাস আগে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে তার পা ভেঙ্গে যায়। শরীরের অন্যান্য জায়গায়ও জখম হয়। চিকিৎসায় ভালো হয়ে উঠেছে সে। তবে তাকে হাঁটতে হয় ক্র্যাচ ভর দিয়ে। ডাক্তার তাকে ফিজিওথেরাপি নিতে বলেন। ফিজিওথেরাপিতে প্রতিদিন ব্যায়াম করতে হয়। ব্যায়াম করার পদ্ধতি বেশ জটিল। আলফ্রেদোর মা দুটো চাকরি করেন। তার সময় নেই ছেলেকে ব্যায়ামের নিয়ম-কানুন দেখিয়ে দেয়ার। তাই হলেণ তাকে প্রতিদিন ফিজিওথেরাপির ব্যায়াম করতে সাহায্য করেছে। ব্যায়াম করে আলফ্রেদো ভালো হয়। কিন্তু কিছুদিন সে  ছাড়া হাঁটতে সাহস পেতো না। তার মনে হত, হাঁটলেই সে পড়ে যাবে। আস্তে আস্তে সে হাঁটার সাহস ফিরে পেয়েছে। এখন প্রতিদিন ক্র্যাচ ছাড়া সে নিয়ম করে হাঁটছে।
বেলা পড়ে আসছে। বড়বড় গাছপালার ভেতর দিয়ে বনে এসে পড়েছে বিকালের সোনালি আলো। তার ভেতর দিয়ে আমরা চলে আসি ছোট্ট এক ছড়া-নদীর পাড়ে। ঝিরি ঝিরি করে পানি বয়ে যাচ্ছে। আর তাতে ভাসছে কয়েকটি বুনোহাঁস। এ হাঁসগুলোর নাম ম্যালার্ড। এদের গলার পালকে ঝিলিমিলি করে সবুজ রঙের পালক। কাছেই একসাথে ডেকে ওঠে অনেকগুলো পাখি। মনে হয়, তারা ভয় পেয়েছে, বা কোন কারণে উত্তেজিত হয়েছে।
বিষয় কী? চারদিকে তাকিয়ে হলেণ আবিষ্কার করে পপলার গাছের ডালে বসে মস্তবড় একটি চিল। চিলটি নিরিবিলি বসতে পারে না। কয়েকটি রেড উইং ব্ল্যাকবার্ড উড়ে এসে তাকে আক্রমণ করে। এ পাখিগুলোর পালকের রঙ কুচকুচে কালো। তবে ডানায় লাল রঙের গোলাকার বৃত্ত আছে। এরা নদী, ছোট্ট ছড়া বা পাহাড়ি ঝোরার পাশে বাস করে। আকারে তেমন বড় না, তবে সংখ্যায় সাত আটটি। এরা তারস্বরে চিৎকার করে তেড়ে যাচ্ছে চিলের দিকে। চিল বিরক্ত হয়ে তার ধূসর ডানা ঝেড়ে আকাশে ওড়ে। নিশ্চয়ই সে রেড উইং ব্ল্যাকবার্ডের বাসা ভেঙ্গে ডিম বা ছানা খেয়েছে। ছোট্ট পাখিগুলো তাকে সহজে ছেড়ে দেয় না। তারা তার দিকে তেড়েফুড়ে যায়। চিলটি উড়তে উড়তে উল্টে গিয়ে তার ধারালো নখ দেখায়।
পাখিগুলো দূর আকাশে মিলিয়ে গেলে আমরা সাঁকোর ওপর দিয়ে ছড়া-নদটি পাড়ি দেই। ওপারে আসতেই আলফ্রেদো কিছু একটা স্পট্ করে। সে সাবধানে ফিসফিসিয়ে আমাদের বাঁ’দিকে তাকাতে বলে। দেখি, ছড়ার পাড়ে ঘন ঝোপের কাছে দাঁড়িয়ে একটি কায়োটি। কায়োটি হচ্ছে শিয়ালের মতো চালাক চতুর প্রাণী। তাদের শরীর ঢাকা বাদামি ও ধূসর রঙে মেশানো ঘন লোমে। এরা ‘কারনিভরাস’ অর্থাৎ মাংসাশী। ছোট ছোট পাখি, মেঠোইঁদুর, বা খরগোশ শিকার করে কয়োটি তার মাংস খায়। এ কায়োটিকে বেশ নাদুস নুদুস দেখায়। মনে হয়, সে তক্কে তক্কে আছে বুনোহাঁসের ছানা পেলে ঘাড় মটকাবে।
হাঁটতে হাঁটতে আমরা ছোটখাট টিলার উপর এসে উঠি। চলার পথে ছড়িয়ে আছে লালচে হলুদ রঙের ঝরাপাতা। খানিক উঁচু জায়গায় উঠতে আলফ্রেদোর কোন কষ্ট হচ্ছে না দেখে আমাদের খুশি লাগে। সে সত্যিই ভালো হয়ে উঠছে। এভাবে নিয়ম করে হাঁটাহাঁটির ব্যায়াম করলে- কিছু দিনের মধ্যে সে দৌড়াতে পারবে। টিলায় মৃদু বাতাসে পাতা দোলাচ্ছে লম্বা লম্বা গাছ। এ গাছগুলোর নাম ইয়েলো বার্চ। একেকটি বার্চ গাছ লম্বায় তিরিশ থেকে চল্লিশ ফুট উঁচু। পাতার রঙ হলুদাভ। রোদের আলো পড়ে পাতার গুচ্ছকে সোনালি দেখায়। গাছের বাকলের রঙ সাদায় ধূসর মেশা। বাকল কেমন যেন আলগা। তাকালে মনে হয় খুলে আসছে। হলেণ বলে-ইয়েলো বার্চ গাছের বাকল হরিণের প্রিয় খাদ্য।
খানিক খোঁজাখুঁজি করে নরোম মাটিতে আমরা হরিণের পায়ের ছাপ দেখি। কিন্তু কোথাও হরিণ দেখতে পাওয়া যায় না। চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে আমি চারদিকে তাকাই। বেশ দূরে আলফ্রেদো ইশারায় কিছু দেখায়।
সে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। আমরা তার সাথে টিলার প্রান্তে চলে আসি। দেখি-অনেক দূরে ঘাসের প্রান্তরে চরছে ছয়-সাতটি হরিণ। দূর থেকে দেখছি তো, তাই এদের দেখায় চিনামাটি দিয়ে তৈরী খেলনা হরিণের মতো। খুব কাছ থেকে হরিণ দেখার জন্য আমরা নেচার ওয়াকে বেরিয়েছি। কিন্তু পায়ে চলা পথের পাশে হরিণ না পেলে কি আর করবো? একটু মন খারাপ করে হাঁটতে থাকি। আমরা চলেছি গ্রানি উইলভারের কটেজের দিকে। মিসেস উইলভার বেশ বৃদ্ধ। তাঁর বয়স আটাত্তর বছর।
তিনি জংগলের পাশে একটি কটেজে বাস করেন। তাঁর ছেলে জাপানে কাজ করেন। তাঁর মেয়েও বাস করেন হাওয়াই দ্বীপে। তাঁর নাতি নাতনির সংখ্যা চার। সে কারণে তাঁকে সবাই গ্রানি বলে। গ্রানি হচ্ছে গ্র্যান্ডমাদার শব্দের সংক্ষিপ্ত কথ্যরূপ।
বনের কাঠবিড়ালি মিসেস উইলভারের খুব পছন্দ। তাঁর কটেজের পাশেই গাছে বাস করে কয়েকটি উড়ুক্কু কাঠবিড়ালি। তাদের তিনি ছোলা, বাদাম ও মাশরুম বা ছত্রাক খেতে দেন। এ বনানীতে সাধারণ কাঠবিড়ালি আছে অনেক। সব সময় তাদের গাছের ডালে ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। তবে উড়ুক্কু কাঠবিড়ালির সংখ্যা খুবই কম। একেবারে হাতে গোনা। সচরাচর তাদের দেখা যায় না। তাই আমরা আজ যাচ্ছি গ্রানি’র কটেজের দিকে। জংগলের এ দিকে গাছপালা হালকা হয়ে এসেছে। এখানে বনের ভেতর আছে কয়েকটি সুন্দর ঘরবাড়ি।
একটি বাড়ির চিমনি থেকে ধোঁয়া বেরোয়। পাশেই আরেকটি চারতলা বাড়ি। তার বেলকনি থেকে দুটি ছেলেমেয়ে বাইনোকুলার চোখে গাছপালার দিকে তাকাচ্ছে। মনে হয়, তারা ডালে পাখির বাসা খুঁজছে। সূর্যের আলো বাইনোকুলারের কাচে পড়ে ঝিলিক দেয়।
ছেলেটি বাইনোকুলার হাতে ঘুরে যায়। মেয়েটি বেলকনির রেলিংয়ে বেঁকে হাতের ইশারায় তাকে কি যেন দেখায়। আমরাও ওদিকে ফিরে তাকাই। কোন কোন বাড়ির সামনে কাঠের বেড়ার ভেতর ফুল ও শাকসব্জির বাগান। পরপর দুটি হরিণ বেড়া টপকে বাইরে আসে। তারা তাজা ফুলের ডাঁটি চিবোতে চিবোতে দৌড়ে ঢুকে পড়ে ঝোপে। একটু সামনে যেতেই দেখি, আরেকটি বাড়ির কাঠের বেড়া দেয়া বাগানে বাচ্চা একটি চিত্রল হরিণ লাজুক ভাবে ফুলের পাপড়িতে মুখ দিচ্ছে।
আমরা বাড়িঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাই গ্রানি উইলভারের কটেজের দিকে। আর চারদিকে চোখ রাখি, যদি দেখতে পাওয়া যায় হরিণ। আমাদের বেশীক্ষণ তাকাতে হয় না। দেখি-পথের পাশে পিটে পিট দিয়ে দাঁড়িয়ে দুটি হরিণ। এ শিংগাল দুটিকে খুব সতর্ক দেখায়। মনে হয়, তাদের বন্ধুবান্ধব আত্মীয় স্বজনরা পাশের কোন বাগানে মজাসে শাকসব্জি খাচ্ছে। আর এরা কান খাড়া করে পাহারা দিচ্ছে। বিপদ বুঝতে পারলে কোন সংকেত দিয়ে সতর্ক করে দেবে।
গ্রানি উইলভারের কটেজটি কাঠের। তার ঝুলবারান্দায় তাঁকে পাওয়া যায় না। আমরা ঘুরে কটেজের পেছন দিকে আসি। দেখি- আঙ্গিনায় বেতের চেয়ারে বসে আছেন তিনি। চশমা চোখে কুরুশ কাঁটা দিয়ে গ্রানি সোয়েটার বুনছেন। আমাদের দেখে খুশি হয়ে আলফ্রেদোকে বলেন, ‘তুমি ভালো হয়ে হাঁটতে পারছো দেখে খুব খুশি লাগছে। তোমাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে ভাই। সন্ধ্যা লাগুক, একটু অন্ধকার হলে উড়ুক্কু কাঠবিড়ালিরা বেরোবে। তোমরা বস।’ আমরা গ্রানির পাশে বসতে গিয়ে দেখি, তাঁর পায়ের কাছে রাখা একটি বড়সড় পটেটো চিপসের প্যাকেট। একটি সাধারণ কাঠবিড়ালি তা থেকে এক টুকরা চিপস্ খুপ করে তুলে নেয়। তারপর আড়চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে লাফ দিয়ে সরে যায়। আঙ্গিনার ছাল ওঠা একটি গাছে কাঠে তৈরি চারকোণা বাক্স। তা থেকে মুখ বের করে আমাদের দিকে তাকায় আরেকটি কাঠবিড়ালি। গ্রানি বাঁধানো দাঁতে হেসে বলেন, ‘এটা হচ্ছে উড়ুক্কু প্রজাতির কাঠবিড়ালি। এর নাম উইলিয়াম উইলভার। উইলিয়ামের কোমরে প্যাঁচা নোখ বিঁধিয়েছিলো। তাকে আমি পশু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। চিকিৎসায় সে ভালো হয়। উড়ুক্কু কাঠবিড়ালি বাসা বাঁধে গাছে কাঠঠোকরার খোদা খোড়লে। কিন্তু আমার কটেজের কাছে কোন গাছে কাঠঠোকরার খোড়ল নেই। তাই আমি তাকে কাঠ দিয়ে এ বাসা বানিয়ে দিয়েছি। উইলিয়াম একটু দুষ্টু আছে।
মিচকে শয়তান এখন মুখ বের করে দেখছে- আমি কি করছি। এটা মাশরুম খেতে খুব ভালোবাসে। তার খাবারের টান পড়লে আমার জানালায় উড়ে এসে লেজ দিয়ে বাড়ি মারে। আরো দুটি কাঠবিড়ালি সরসরিয়ে চলে আসে কাছে।
তারা গ্রানির পায়ের কাছে রাখা পটেটো চিপসের ব্যাগ থেকে তুলে নেয় দু টুকরো চিপস্। এরা উড়ুক্কু প্রজাতির কাঠবিড়ালি নয়। সাধারণ কাঠবিড়ালি। এ জংগলে এদের সংখ্যা প্রচুর। আমার সাধারণ কাঠবিড়ালিদের ব্যাপারে কোন আগ্রহ নেই। আজ দেখতে এসেছি উড়ুক্কু কাঠবিড়ালি। সন্ধ্যা না হলে তাদের দেখা পাওয়া যাবে না। একটু অস্থির লাগে। আর পটেটো চিপসের ব্যাগের দিকে আমার চোখ বারবার ফিরে যায়। অনেকটা হেঁটে এসেছি। একটু খিদাও লেগেছে। চিপস্গুলো স্বাদে চমৎকার। ব্যাগে আছেও প্রচুর। কিন্তু গ্রানির কাছে তো চাওয়া যায় না।
গ্রানি কথা বলতে খুব ভালোবাসেন। তিনি নিজের জীবনের কথা বলেন। ছোটবেলা তাঁর মা-বাবা খুব গরিব ছিলেন। স্কুলে পড়ার সময় তিনি ফেরিওয়ালা হয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বিক্রি করতেন লিপস্টিক, কোল্ড ক্রিম ও ফেসপাউডার। পড়াশুনা শেষ করে তিনি ডাকঘরে পোস্টমাস্টারের কাজও করেন অনেক বছর। বন-জংগল গাছপালা হাঁস-হরিণ এসব ভালোবাসেন। প্রকৃতি তাঁর খুব প্রিয়। তাই এক সময় চাকুরি বদলে এক বনভূমিতে ফরেস্ট রেঞ্জারের কাজ নেন। তখন কাঠবিড়ালিদের সাথে তাঁর বিশেষভাবে বন্ধুত্ব হয়। আজ সাত বছর হয় তিনি অবসর জীবনযাপন করছেন।
সন্ধ্যা হতে কেন জানি দেরি হচ্ছে। গ্রানির জীবনের গল্পও শেষ হচ্ছে না। আলফ্রেদো ও আমি দুজনেই অস্থির হয়ে উঠি। গ্রানি বিষয়টি বুঝতে পেরে আমাকে বলেন, ‘শোনো, আমি বুড়ো মানুষ, উঠতে পারবো না।
তুমি কাইন্ডলি কিচেনে যাও। দেখবে কাউন্টারে ডিশে রাখা আছে বেশ কিছু কুকি-বিস্কিট। আর রেফ্রিজারেটারে দুধ পাবে। তুমি সবার জন্য কুকি ও মিল্ক নিয়ে আসোতো, প্লিজ।’ শোনা মাত্র আমি উঠে কিচেন থেকে ট্রেতে করে নিয়ে আসি দুধ ও কুকি। সবাইকে তা পরিবেশন করলে গ্রানি আবার বলেন, ‘ক্রিসমাসের সময় আমার নাতি-নাতনিদের হাওয়াই
দ্বীপ থেকে এখানে আসার কথা ছিল। তাদের জন্য চকোলেট চিপস্ দিয়ে কুকি তৈরী করেছিলাম। কিন্তু তারা আসতে পারেনি। কুকিগুলোর ওপর চিনির শিরা দিয়ে ক্রিসমাস ট্রি’র নকশা আঁকা। দুধে ভিজিয়ে খেতে খুব ভালো লাগে। আলফ্রেদো খুব মজাসে তা খায়।
তার ঠোঁটের ওপর দুধের স্বর লেগে তৈরী হয় সাদা গোঁফের রেখা।
গ্রানি কুকি খেতে খেতে উড়ুক্কু কাঠবিড়ালি নিয়ে কথা বলেন। এ বিড়ালগুলোকে ইংরেজীতে বলা হয় ‘ফ্লাইয়িং স্কোয়ারেল’, আর এদের বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে ‘গ্লোকোমিয়াস সাবরিনাস।’ লম্বায় ১১ থেকে ১২ ইঞ্চির মত। শরীরের ওজন চার থেকে সাড়ে ছয় আউন্সের বেশী হয় না। এরা পতঙ্গ, পাখির ডিম, ফুলের পাপড়ি ও মাশরুম খায়। আর পাইন কৌণ বলে পাইনগাছের ফল খেতে খুব ভালোবাসে। গ্রানি’র কথা শুনতে শুনতে কখন যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে,ত ঠিক বুঝতে পারিনি। আলফ্রেদোই প্রথম নজর করে।
মাথার ওপর দিয়ে গ্রানি’র দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে উড়ে যাচ্ছে একটি উড়ুক্কু কাঠবিড়ালি। আমরা তার পেটের সাদা লোম পরিষ্কার দেখতে পাই। তাকে দেখে গ্রানি হেসে বলেন, ‘সন্ধ্যা লাগতেই বেরিয়ে পড়েছে দেখছি। এ কাঠবিড়ালি উড়তে খুব ভালোবাসে। একটানে উড়ে যেতে পারে ষাট সত্তর ফিট। আমি এর নাম দিয়েছি ফ্লাইয়িং সসার। খুব লাজুক, মানুষ দেখলে কাছে আসতে চায় না।’
গ্রানি তাঁর জীবনের আরো কিছু গল্প করেন। আলফ্রেদো উসখুশ করে জানতে চায়, ‘আর কোন উড়ুক্কু কাঠবিড়ালির দেখা পাওয়া যাবে না আজ?’ গ্রানি চেয়ারের তলা থেকে একটি ঝুড়ি বের করেন। তাতে রাখা দুটি পাইন কৌণ ও পিনাট বাটারের একটি কৌটা। তিনি আলফ্রেদো’কে বলেন-পাইন কৌণের খাঁজে সামান্য একটু পিনাট বাটার লাগিয়ে তা গাছের কাছে রেখে আসতে। আলফ্রেদো কাঠি দিয়ে খাঁজ খুঁজে খুঁজে তাতে পিনাট বাটার মাখিয়ে তা রেখে আসে গাছের গোড়ায়।
আমরা অপেক্ষা করি। গ্রানি আলফ্রেদো’কে বলেন, ‘তোমার গায়ের মাপ দাও। আমি সুয়েটার বুনে রাখবো। তুমি যখন দৌড়াতে পারবে তখন এসে সুয়েটার নিয়ে যেও। ততদিনে হয়তো শীত এসে যাবে।’ গ্রানি আলফ্রেদোর গায়ের মাপ ফিতা দিয়ে নিতে শুরু করেন। আর আমরা ডানায় বাতাস কাটার মৃদু আওয়াজ শুনি। ভালো করে কিছু বোঝার আগেই একটি উড়ুক্কু কাঠবিড়ালি এসে গাছের গোড়ায় ল্যান্ড করে। পিনাট বাটার মাখানো পাইন কৌণ মুখে উড়ে যাওয়ার সময় তার পরিষ্কার ভিউ পাওয়া যায়। গ্রানি বলেন, ‘এ কাঠবিড়ালির আমি নাম দিয়েছি নাইট রাইডার। পিনাট বাটার এর খুব প্রিয় খাবার। বেশ রাত করে উড়ে উড়ে নাইট রাইডার পোকা-মাকড় ধরে ধরে খায়।’
গ্রানিকে ধন্যবাদ দিয়ে আমরা উঠতে যাচ্ছি, একটু ইতস্তত করে তিনি বলেন, ‘মাস খানেক পর আবার আলফ্রেদোকে নিয়ে এসো। সুয়েটার ততদিনে তৈরী হয়ে যাবে। একটু সময় হাতে করে যদি আসো, আর আমাকে যদি একটু সাহায্য করো, তাহলে খুব ভালো হয়।’ হলেণ জানতে চায়, ‘ঠিক কি রকমের সাহায্যের দরকার আপনার গ্রানি।’ তিনি জবাব দেন, ‘একা মানুষ, এখন তো সব কাজ নিজে করতে পারি না। কটেজের চারদিকে ম্যাপোলের ঝরাপাতা জমে জমে স্তূপ হয়ে যাচ্ছে। তোমরা যদি পাতা পরিষ্কার করতে একটু সাহায্য করো; আর জংগল থেকে কুড়িয়ে বেশ কিছু পাইন কৌণ জোগাড় করা দরকার। হাতের কাছে পাইন কৌণ থাকলে শীতে যখন তুষার পড়বে, তখন নাইট রাইডার বা ফ্লাইং সসারকে খাবার দিতে কোন অসুবিধা হবে না।’ আমরা অবশ্যই মাস খানেক পর এসে তাঁকে সাহায্য করবো জানালে তিনি খুশি হয়ে বলেন, ‘একদিন আগে টেলিফোন করে জানিয়ে আসবে। আমি দারুচিনি দিয়ে অভেনে আপেল পাই বেক করে রাখবো।’
দারুচনি দেয়া মিষ্টি আপেল পাই স্বাদে কী যে ভালো, তা বলে বুঝানো যায় না। তাই, আমি গ্রানিকে গুডনাইট বলতে বলতে ভাবি-এক মাস কেটে যাবে দেখতে দেখতে। তারপর আমরা এসে অবশ্যই তার আঙ্গিনার ঝরাপাতা পরিষ্কার করে দেবো। আর কিছু পাইন কৌণ কুড়িয়ে দেয়া তো কঠিন কিছু না। গ্রানি আপেল পাই বেক করার কথা না ভুললেই হলো। তবে অসুবিধা নেই, টেলিফোন করে তাঁকে বিষয়টা আসার আগেই মনে করিয়ে দেয়া যায়।

Share.

মন্তব্য করুন