গোলাঘরে পুষি বিড়ালটা তিনটি ছানা দিয়েছে। কী ফুটফুটে। তুলতুলে। মিষ্টি মিষ্টি চেহারা। যেন এক মুঠো রঙিন শিমুল তুলো। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। সেই তিনটের একটা ছানা বেশ দুর্বল। লিকলিকে। অন্য দুটোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মা-বিড়ালের দুধ খেতে পারে না। প্রায় সময়ই সে ঠিকমতো খেতে পায় না। সবল দুটো ছানার কাছে সে যেন কিছুই না। খেতে না পেয়ে কেমন করুণ সুরে ডেকে ওঠে ছানাটি।
এই ডাক টুসি সইতে পারে না। সে একদিন লুকিয়ে লুকিয়ে ব্যাপারটা দেখল। তার পর থেকে প্রতিদিন ওই বিড়াল ছানাটাকে দু’বেলা গরম দুধ খাইয়ে যায়। এখন তো, ছানাটি বলা যায় প্রতিদিন ওর দিকেই চেয়ে থাকে। কখন আসবে টুসি। কখন সে তার জন্য ফিডার ভরে দুধ নিয়ে আসবে। আর পেটপুরে খেয়ে মনের খুশিতে ডিগবাজি দেবে।
আর যখন টুসি ওই বিড়াল ছানাটাকে দুধ খাইয়ে দেয়, তখন সে কেমন খুশি হয়, তা তোমরা না দেখলে বুঝতেই পারবে না। ছানাটা যখন টুসির দিকে ডাগরডোগর বিড়ালচোখে তাকায়, তখন রাজ্যির আনন্দ পায় সে।
বিড়াল ছানাটাকে গাল টিপে আদর দিয়ে বলে, তুমি এখন থাকো। পরে আবার এসে দুধ খাইয়ে
যাব। আমার আবার ফুলবাগানে যেতে হবে। ওখানেও কত কাজ! আমি এখন যাই, কেমন?
বিড়াল ছানাটা ওকে মিউ-মিউ শব্দ করে বিদায় জানায়। তারপর টুসি গিয়ে ঢোকে বাড়ির কাছেই তাদের ফুলবাগানে।
ঢুকেই টুসি কেমন একটা আর্তনাদ করে ওঠে। ভাবছ, টুসি ব্যথা পেল বুঝি? না। সে ব্যথা পায়নি।
সে বলতে লাগল, দেখেছ, একদিন আসতে পারিনি তাতেই কী কাণ্ড! আহারে! এই একদিনে খুব কষ্ট পেয়েছ তুমি। রীতিমতো বিশাল বোঝা চেপে বসেছে তোমার মাথায়!
একটা হলুদ হয়ে যাওয়া পাতাসমেত পেঁপের ডাল দোপাটি ফুলের মাথায় এসে পড়েছে।
তাতেই তার জান যায় যায়। ঘাড়-মাথা একেবারে অবশ হয়ে গিয়েছে। শ্বাস নিতে পারছিল না। তড়িঘড়ি পেঁপে ডালটা সরাতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল যেন দোপাটি।
কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠল দোপাটির। কত সময় পর সে ঠিকমতো এই আলো-হাওয়ায় শ্বাস নিতে পারছে! এতটা সময় বুঝি সে মরেই গিয়েছিল!
ফুলের চোখ পিটপিট করে তাকানো দেখে টুসি বলল, মুখ গোমড়া করে না থেকে এবার তো একটু হাসো। দোপাটি টুসির কথায় আলো ছড়িয়ে হেসে দিল। ফিনকি দিয়ে সেই আলো পুরো বাগানে ছড়িয়ে পড়ল। মাথা দুলিয়ে-দুলিয়ে হাসল। তাতে তার চারপাশ ঝলমল করে উঠল।
এর মধ্যে গুটিকয় কালো পোকা টুসিকে দেখে পিলপিল করে বাগান ছেড়ে পালাতে শুরু করল।
ওই কালো কালো পোকাগুলো গাছেদের ক্ষতি করে।
বাড়বাড়ন্তে বাধা দেয়। কিন্তু বেচারা গাছেরা ওদের কিছুই করতে পারে না।
টুসির চোখে পড়তেই ওদের থামাল সে। বলল, এই তোমাদের না বলেছি, এই বাগানের ত্রিসীমানায় আসবে না? তারপরও কেন এসেছ? যাও এখান থেকে। শুধু শুধু গাছ নষ্ট করো। ফুল নষ্ট করো। গাছের কচিপাতা খেয়ে নাও। ওদের বুঝি কষ্ট হয় না? এর পর আর যদি কখনো দেখেছি তোমাদের, তাহলে পিট্টি দিয়ে ঠ্যাং খোঁড়া করে দেব, তখন বুঝবে মজা।
এ কথা বলে টুসি ওদের দিকে প্রায় মারবে এমন ভাবে তেড়ে গেল। এই দেখে ওরা পড়িমরি করে পালিয়ে বাঁচল।
টুসি মুখ টিপে হাসল। বলল, আজকে নিশ্চয় ওরা ভয় পেয়েছে।
দোপাটি মুখ খুলে বলল, ওরা খুব দুষ্ট। আমাদের কোনো কথাই ওরা শুনতে চায় না। ওদের হাতে-পায়ে ধরেও আমরা রেহাই পাই না। ওদের যা মন চায়, তা-ই করে। তুমি এলেই কেবল ওরা ভয় পায়।
টুসি বলল, এখন থেকে আমি রোজ আসব। যাতে ওরা তোমাদের কোনো ক্ষতি করতে না পারে।
এর পর টুসি সারা বাগান ঘুরে বেড়াল। সব ফুলের সঙ্গে কথা বলল। সব গাছের খোঁজখবর নিলো। আদর বুলিয়ে দিল। রঙিন ফুলের, সবুজ পাতার কাছ থেকে সেও আদর নিলো।
তারপর বাগান থেকে ধীরপায়ে বের হয়ে এল। পাশেই থাকে এক থুত্থুড়ে বুড়িমা। বুড়িমার কেউ নেই।
একা এক ঝুপড়ি ঘরে থাকে। তেমন করে চলাফেরাও করতে পারে না। একটা লাঠিতে কোনো রকমে ঠুকঠুক করে বড়জোর এ-বাড়ি ও-বাড়ি যায়।
দেখল সেই বুড়িমা রাস্তার পাশে বসে হাঁপাচ্ছে।
কোথাও গিয়েছিল মনে হয়। এই দুর্বল শরীরে আর হাঁটতে পারছে না।
টুসি দৌড়ে গেল বুড়িমার কাছে। বুড়িমার সামনে গিয়ে রাস্তায় ধুলোর ভেতর বসে পড়ল সে। বলল, কী হয়েছে বুড়িমা, তুমি অমন করে হাঁপাচ্ছ কেন?
বুড়িমা ওর দিকে ঘোলাচোখে তাকাল। বলল, কী বলব রে মা! সব আমার কপাল। আজ ঘরে কিছুই নেই।
সকাল থেকে পেটে দানাপানি কিছু পড়েনি। খিদেয় আর পারি না রে মা…।
বুড়িমা একটু থামল। খানিক সময় দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করল, ভাবছিলাম খাবারের খোঁজে একটু বড়বাড়ির দিকে যাব। কিন্তু দেখো না, এই এখানে এসে আর যেতে পারছি না। পা চলছে না আর।
টুসি বুড়িমার কথা শুনে মনে মনে খুব দুঃখ পেল।
বুড়িমার হাত ধরে বলল, বুড়িমা তুমি ওঠো..।
বুড়িমা টুসির দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল, কোথায় রে মা? আমারে কই নিয়ে যাবি?
টুসি বলল, আহা ওঠোই না, তোমাকে তোমার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।
বুড়িমা কিছুটা বিরক্ত হলো। বলল, আমার তো খিদে পেয়েছে। খেতে না পেলে তো আমি মরেই যাব রে মা। বলছি না, আমার ঘরে খাবার মতো কিছুই নেই!
টুসি বুড়িমার কথায় কান না দিয়ে তাকে জোর করেই উঠাল। ধরে নিয়ে বুড়ির বাড়ির দিকে যেতে যেতে বলল, তোমাকে বাড়ি অবধি পৌঁছে দেই আগে।
তারপর যেতে-আসতে যে সময়, তোমার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করছি। তোমার আর কষ্ট করে ওদিকে যেতে হবে না। তুমি বাড়ি বসেই খেও।
বুড়ির ঘোলাচোখ ফরসা হয়ে গেল। বলল, তুই কে রে মা? আমার পাশ দিয়ে এতক্ষণে কত লোক এল-গেল। কেউ ফিরেও তাকাল না আমার দিকে। আর তুই?
এইটুকু একটা মেয়ে… মনে হয় আল্লাহ তোকে আমার সাহায্যের জন্যই পাঠিয়ে দিয়েছেন। দোয়া করি আল্লাহ তোর অনেক বড় মনের মানুষ করুক মা। টুসি বাড়ি নেই। বাড়িতে তাই টুসির খোঁজ খোঁজ রব উঠেছে। অনেকক্ষণ থেকে তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। সে তো কেবলই বলে, তার অনেক কাজ। কিন্তু কী কাজ?
গোলাঘরে, ফুলের বাগানে তারপর বুড়িমাকে নিয়ে তার ব্যস্ততার শেষ নেই। এত কাজের ভিড়ে টুসি কিভাবে বাড়ি থাকবে? তোমরাই বলো।

Share.

মন্তব্য করুন