‘ওহ! আল্লাহ, এই বৃষ্টি তো মনে হচ্ছে আজ আর শেষ হবে না।’ হতাশার ভঙ্গিতে বললো সিয়াম।
‘হ্যাঁ, সারা রাত বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে?’ গাল চুলকাতে চুলকাতে বললো শাহীন। শাহীনের খালামণির বাড়িতে আসার জন্য, গত দুইদিন থেকে ওদের সে কি প্ল্যান, কত জল্পনা কল্পনা। কিন্তু রাস্তায় বের হয়ে এখন মনে হচ্ছে, বাড়িতে থাকলেই ভালো করতো। বাস থেকে নেমে একটা লোকাল রাস্তায় ঢুকে পড়ে ওরা। একটু হাঁটার পরই শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। তখনই রাস্তার পাশের একটা ছাউনিতে আশ্রয় নেয় ওরা। ছাউনিটা একটা উপত্যকার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এর দক্ষিণে পিচঢালা সিঙ্গেল লেনের পাকা সড়ক।

তারপরেই শুরু হয়েছে পাহাড়ি ঢাল। উত্তর দিকে কয়েকটা উচু টিলা দেখা যাচ্ছে। তারপরই শুরু হয়েছে বিস্তীর্ণ বনভূমি। শাহীনের খালামণির বনপাড়া গ্রামটা এখান থেকে সামান্য দূরেই। কিন্তু, বৃষ্টি এই ব্যবধান অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। খালামণিকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য, ওদের আসার কথা আগে জানায়নি শাহীন। এখন বুঝতে পারছে, মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে। অবশ্য এখন আর আফসোস করে লাভও নেই, ওদের কারো ফোনই জীবিত নেই ফোন করার জন্য। চার্জ শেষ!
একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। থেকে থেকে বিজলি চমকাচ্ছে। সেকেন্ডের জন্য আলোকিত হয়ে উঠছে আশপাশের পরিবেশ। বাতাসের ঝাপটায় ছাউনির ভেতরেও বৃষ্টির পানি চলে আসছে, একটু আধটু। বৃষ্টির পানির শব্দ, আর মেঘের গর্জন ছাড়া অন্য কোনো শব্দই কানে আসছে না ওদের। গলা ছেড়ে গান গাইতে ইচ্ছে করলো সিয়ামের, এমনিতে তার গলা ভালো না। তাই গলা ছেড়ে গান গাওয়ার সাহস হয় না তার। এখন গান গাইলে কেউ শুনতে পাবে না। কিন্তু, বৃষ্টির পানি নিরাশ করলো তাকে। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে এলো বৃষ্টি। গান গাওয়া আর হলো না তার, তবুও খুশি সে।
‘ভালোই অভিজ্ঞতা হবে কী বলো?’ কিছুটা অভিযোগের সুরে সিয়াম বললো। ‘পাহাড়ি রাস্তায়, এই রাতের বেলা শেয়াল, কুকুরের সাথে মারামারিও করা লাগতে পারে।’ হাসতে হাসতে শাহীন কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু তার গলার কণ্ঠস্বর ঢাকা পড়ে গেলো, সবকিছু ছাপিয়ে শোনা গেলো কারো তীব্র আর্তচিৎকার। মুহূর্তে থেমে গেলো ওরা। জমে গেলো দুইজন। দুই জোড়া চোখ ঘুরে গেলো সেদিকে। টিলার ওপারের জঙ্গল থেকে ভেসে এসেছে কারো চিৎকার। এরপর, আবার শোনা গেল সেই চিৎকার। কণ্ঠস্বর বলছে ওদেরই বয়সের কোনো কিশোর। কিন্তু এই সময়ে, এই জঙ্গলে কী করছিলো ছেলেটা? বেশ অবাক হলেও বেশি ভাবার সময় পেলো না ওরা।
শব্দটা ক্রমেই নিকটে আসছে। আকাশে মেঘ থাকলেও অল্প আলো আছে। রাতটা একদম কালো নয়। তাছাড়া দীর্ঘ সময় এখানে থাকার ফলে চোখ সয়ে গেছে। এখন, বেশ ভালোভাবেই আশাপাশের সবকিছু দেখতে পাচ্ছে ওরা। দৌড়ে এদিকেই আসছে ছেলেটা। তাকে থামানোর চেষ্টা করলো সিয়াম, কিন্তু টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলো ছেলেটা। ওকে ধরে তুললো ওরা। ওদেরই বয়সী একটা ছেলে। পরনে জিন্স প্যান্ট, গায়ে লাল রঙের টি শার্ট। পায়ে কোনো স্যান্ডেল নেই, খালি। দৌড়ানোর সময় হারিয়ে গেছে মনে হয়।
‘আমাকে ছেড়ে দাও,’ হাঁপাতে হাঁপাতে বললো ছেলেটা, ‘আমি তোমাদের কোনো ক্ষতি করিনি।’ ছেলেটার এমন কথায় আরো একবার অবাক হলো ওরা। মুখ চাওয়া চাউয়ি করলো দু’জন বৃষ্টির পানিতে গোসল হয়ে গেছে সে। চেহারা স্পষ্টভাবে জানান দিচ্ছে, ভয় পেয়েছে।
‘কী হয়েছে তোমার?’ শাহীন বললো। ‘ভয় নেই। আমাদের বন্ধু ভাবতে পারো।’
এতক্ষণে ওদের দিকে ভালোভাবে তাকালো ছেলেটা। মনে হয় নিশ্চিত হতে চাচ্ছে, ওরা বন্ধু, না শত্রু। ওকে ধরে দাঁড় করালো ওরা।
‘নাম কী তোমার?’ সিয়াম জিজ্ঞেস করলো, ‘জঙ্গলে কেন গিয়েছিলে?’
‘আ..মা..র নাম আ.. ন,’ ভাঙা ভাঙা শব্দে বললো ছেলেটা।
‘কিন্তু, তোমরা কারা? আগে তো এদিকে দেখিনি!’
‘আমি শাহীন,’ সিয়ামকে দেখিয়ে বললো শাহীন, ‘আর ও সিয়াম। আমরা দুই বন্ধু। খালামণিদের বাসায় বেড়াতে এসেছি। বনপাড়া গ্রামের শেষ মাথায় তাদের বাসা।’
‘তাই, আমার বাড়িটাও ওখানে।’
‘ভালোই হলো, তাহলে চলো, তোমাকে তোমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যাই,’ শাহীন বললো। ‘মনে হচ্ছে তুমি খুব ক্লান্ত এবং ভয়ও পেয়েছো। তোমার পায়ের বেশ কিছু জায়গার চামড়া ছড়ে গেছে। একা যেতে সমস্যা হবে।’
‘ধন্যবাদ তোমাদের।’
‘অয়ন, তুমি কিন্তু এখনো একটা প্রশ্নের উত্তর দাওনি,’ সিয়াম বললো। ‘জঙ্গলে কেন গিয়েছিলে, এই রাতের বেলা?’
‘সে অনেক কথা, এখন বলা সম্ভব না,’ অয়ন বললো।
‘তোমরাও অনেক দূর থেকে এসেছো, তাই কালকে এ বিষয়ে কথা বলবো। এখন আপাতত, আমাকে বাড়িতে দিয়ে এসো।’
রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে শাহীন, এখনই সব শুনতে ইচ্ছে করছে ওর, কিন্তু অয়নের অবস্থা বিবেচনা করে আর চাপাচাপি করলো না সে। সে বললো, ‘সেই ভালো হবে।’ হাঁটতে শুরু করলো তিন কিশোর।
‘অয়নকে’ তার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে, খালামণিদের বাড়িতে পৌঁছাতে রাত ৮টা বেজে গেলো শাহীনদের। রাতে আবার বৃষ্টি শুরু হলো। শাহীনের জন্য রাতটা কাটানো কঠিন হয়ে গেলো।
কিছুতেই ঘুম আসতে চাইলো না, বারবার মনে হতে লাগলো অয়নের সেই কথা, ‘আমাকে ছেড়ে দাও, আমি তোমাদের কোন ক্ষতি করিনি।’ জংগলে কী এমন কাজ করতে গিয়েছিলো সে?
আর কেনই বা ওভাবে দৌড়াচ্ছিলো? আর যাইহোক, কেউ তাকে তাড়া করছিলো এটা নিশ্চিত শাহীন। এটা কোনভাবেই সাধারণ কোনো ঘটনা হতে পারে না। জানতে হবে কেন এবং কে তাকে ধাওয়া করেছিলো। যাই হোক, কালকেই এই সবকিছু অয়নের কাছ থেকে জানা যাবে।

দুই.
অয়নের বাড়ির দিকে হাঁটছে ওরা দুজন। গ্রামটা সমতল ভূমিতে। পশ্চিম ও উত্তর দিকে পাহাড়। বনজঙ্গল অনেক বেশি এদিকটায়। খুব অল্পসংখ্যক মানুষ বসবাস করে এই গ্রামে।
গ্রামের বাড়িগুলো এজন্য বেশ দূরে দূরে। আজকে আবহাওয়া বেশ ভাল। গতকালের মতো মেঘের সেই দাপট আজ আর নেই। গতকালের ঘটনাটা সম্পর্কে আজ অয়নকে জিজ্ঞেস করবে ওরা। গাছপালার দেয়াল গলিয়ে, একটা ছোট আধাপাকা বাড়ি চোখে পড়ছে ওদের। গতকাল রাতে এখানেই এসেছিলো ওরা।
কিন্তু তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য, ওদের বয়সি এক ছেলেকে জিজ্ঞেস করলো, অয়নের বাড়ি কোনটা। ছেলেটা সামনের বাড়িটা দেখিয়ে দিলো। ওরা কয়েক কদম এগুতেই, দৌড়ে এসে ছেলেটা ওদের পথ রোধ করে সামনে দাঁড়ালো।
‘থামো, তোমরা কারা? অয়নের বাড়িতে কেন যাবে?’ ওদের পরিচয় দিয়ে শাহীন বললো, ‘আমরা অয়নের বন্ধু, তার সাথে দেখা করতে চাই। কিন্তু, তুমি কে?’
‘আমি ইমন, অয়নের ক্লাসমেট। তোমরা তার কেমন বন্ধু? জানো না সে গতকাল দুপুর থেকে নিখোঁজ?’
‘কি?’ চোখ কপালে তুলে বললো সিয়াম। ‘আমরা তো গতকাল সন্ধ্যার পরেও তাকে দেখেছি।’
‘কি আবোলতাবোল বকছো?’ কিছুটা অবিশ্বাসের সুরে বললো ইমন। ‘তাকে দুপুর পর আর কেউ দেখেনি। আর সে এখন বাড়ি নেই।’
শাহীন ও সিয়াম আকাশ থেকে পড়লো যেন। তাহলে ওরা গতকাল সন্ধ্যার পর কার সাথে কথা বললো? ওরা কি স্বপেড়ব দেখেছে অয়নকে? নাহ! একই স্বপ্ন দুইজন দেখতে পারে না।
এটাও সত্যি যে, অপরিচিত কোন মানুষকে কেউ স্বপ্নে দেখে না। এখনো গতকালের ঘটনা স্পষ্ট মনে আছে শাহীনের।
‘কি হলো? কি ভাবছো?’ ইমনের ডাকে বাস্তবে ফিরে এলো শাহীন।
‘না, তেমন কিছু না।’ মাথা নেড়ে বললো শাহীন- ‘আন্টি আঙ্কেলের সাথে কথা বলে আসি।’
‘যাও, কিন্তু এসব কথা তাদের বলো না। নির্ঘাত পাগল ভাববে।’
কিছু বললো না ওরা। হেঁটে চললো বাড়ির দিকে। কিন্তু আবারও পেছন থেকে ডাকলো ইমন, ‘দাঁড়াও দাঁড়াও, চলো, আমি যাচ্ছি তোমাদের সাথে।’ মাথা নেড়ে সায় জানালো ওরা। ওদের নিয়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো ইমন। বারান্দায় চিন্তিত অবস্থায় বসে ছিলো মধ্য বয়স্ক এক লোক। ইমন তাকে বললো, ‘আঙ্কেল, এরা অয়নের বন্ধু। এরা নাকি, গতকাল সন্ধ্যা বেলাতেও অয়নকে দেখেছে।’
‘তাই বাবা?’ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন ভদ্রলোক।
‘জ্বি আঙ্কেল।’ বললো শাহীন। তারপর গতকালের ঘটনাটি খুলে বললো।
‘তুমি বলছো, তোমরা গতকাল তাকে বাড়িতে দিয়ে গেছো, ’ পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে, অয়নের আম্মু বললেন। ‘কিন্তু আমারা তাকে দেখিনি।’
‘এসবের উত্তর পাওয়া যাবে অয়নের রুমে গেলে, ’ চারিদিকে চোখ বুলিয়ে বললো শাহীন, ‘অয়নের রুম কোনটা? দয়া করে চলুন সেখানে।’
সবকিছু গোছানো ও বেশ পরিপাটি একটা রুম- দুইটা জানালা, একটা দরজা। একটা খাট, পড়ার জন্য চেয়ার টেবিল। বোঝা যাচ্ছে, সবকিছু গুছিয়ে রাখতেই বেশি পছন্দ করতো অয়ন। অন্যান্য জামা কাপড়ের মধ্যে পাওয়া গেল অয়নের ভেজা টি শার্ট ও প্যান্ট।
‘এই যে দেখুন, ’ অয়নের কাপড়চোপড় এর দিকে নির্দেশ করে বললো শাহীন। ‘অয়ন গতকাল রুমে এসেছিলো তার প্রমাণ এটা।’
‘এটা আপনারা খেয়াল করেন নি, ’ শাহীনের কথার সাথে যোগ করলো সিয়াম- ‘এটাই স্বাভাবিক, কারণ আপনাদের চোখ অয়নকে খুঁজছিলো তখন।’ মাথা নেড়ে সায় জানালো অয়নের আব্বু আম্মু। দক্ষিণ দিকের জানালার পর্দাটা সরিয়ে দিল শাহীন। এক চিলতে আলো এসে ঘরে প্রবেশ করলো। কিন্তু , এটা কেউ দেখলোনা- সবার চোখ জানালার গ্রিলের দিকে। গ্রিলের একাংশ বাকানো। বিস্ফোরিত চোখে তাকালো সেদিকে, অয়নের আব্বু আম্মু।
‘নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, গ্রিল বাকিয়ে রাতে কেউ রুমে প্রবেশ করেছিলো। এবং অবশ্যই তা এ বাড়ির কেউ নয়, ’ আবার বলতে শুরু করলো শাহীন। ‘তারপর অয়নকে নিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেছে। এইজন্য দরজাটা শুধু ভেজানো ছিল। এর ব্যাখ্যা এটাই।’
‘আপনারা তার চিৎকার চেচামেচি শুনতে পাননি, ঘরে প্রবেশ করতে আগন্তুকের কোনো ঝামেলাই হয়নি’ সিয়াম বললো। ‘কারণ তখন হয়তো বৃষ্টি হচ্ছিলো, অথবা তাকে আগেই সেন্সলেস করে নেয়া হয়েছিল। এটার জন্য অবশ্যই জানালার বাহির থেকে, রুমের ভেতরে ক্লোরোফরমের স্প্রে করা হয়েছিল।’
বিষ্ময়ে চোখ বড় বড় করে ওদের দিকে তাকালো অয়নের আব্বু আম্মু। অয়নের আব্বু বললো, ‘হয়তো ঠিক বলেছ তোমরা। কিন্তু এটা ঠিক বুঝতে পারছি, খুব বুদ্ধিমান ছেলে তোমরা। এই বয়সে এমনভাবে আর দশটা ছেলে ভাবে না।’
‘এমন যুক্তিসংগত একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করালে তোমরা, আর যেভাবে বর্ণনা করলে তাতে তোমাদের কথাই ঠিক মনে হচ্ছে।, ’ বললো অয়নের আম্মু। ও কথা শাহীন শুনলো কিনা বোঝা গেল না। সে আবার বলতে শুরু করলো, ‘জঙ্গলে আর যাই ঘটুক, নিশ্চয় খারাপ কিছু ঘটেছিলো । হতে পারে কোন গোপনীয় জিনিস দেখে ফেলেছিলো অয়ন । সেটা ফাঁস হলে অনেক বড় সমস্যা হত কারো। আমি নিশ্চিত, বাড়ি থেকে এজন্য তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু, অয়ন কিভাবে জানলো ওখানে কি হচ্ছে? আর কেনই বা ঐ সময়ে সেখানে গেল সে? এই উত্তরগুলো আপাতত নেই আমার কাছে।’
এসব আমার কারণে হয়েছে, ’ আক্ষেপ করে বললো অয়নের আব্বু। ‘আমি তাকে বকাঝকা না করলে, হয়তো ও রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেত না, আর সেখানেও যেত না।’ ‘এসব কথা এখন রাখুন, আঙ্কেল। দয়া করে পুলিশকে ফোন করে সব জানান, ’ বললো শাহীন।
‘হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ । বোঝাই যাচ্ছে ওকে কেউ কিডন্যাপ করেছে । আমি যাচ্ছি, পুলিশকে ফোন করতে, ’ অয়নের আম্মু বললো।
‘সে যদি জানতোই যে, জঙ্গলে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে, তবে কেন রাগ করেই ওখানে গেলো?’ সিয়াম বললো, ‘বিষয়টা অদ্ভুত মনে হচ্ছে আমার কাছে।’
মাথা নেড়ে সায় জানালো শাহীন, তারপর বললো, ‘আঙ্কেল, অয়ন, ঐ জঙ্গলে কেন গিয়েছিল তা আপনি জানেন? এ ব্যাপারে কোনদিন বাড়িতে কথা বলেছে?’
‘না, বলেনি। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, তোমরা এর কারণ জানতে পারবে একটু চিন্তা করলেই, তোমাদের উপস্থিত বুদ্ধি আমাকে মুগ্ধ করেছে।
এমন সুক্ষ্মভাবে সবকিছু ভাবো তোমরা, যেন কোন কিছু তোমাদের ভাবনার বাহিরে নয়।’
সলজ্জ একট হাসি দিল শাহীন ও সিয়াম। নিজেদের প্রশংসায় খুব অস্বস্তি বোধ করে ওরা।
‘অয়ন আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড, কিন্তু আমাকেও বলেনি জঙ্গলের কোন কথা, কিন্তু, আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না, ’ এতক্ষণ চুপ থাকার পর বললো ইমন- ‘তোমরা গোয়েন্দাদের মতো করে কথা বলছো কেন?’
‘কারণ আমরা গোয়েন্দা,’ মুখে হাসি টেনে বললো সিয়াম। শাহীন ওদের একটা কার্ড বের করে ইমনের হাতে ধরিয়ে দিল। ইমন সেটা হাতে নিয়ে জোরে জোরে পড়লো। ‘দুই কিশোর গোয়েন্দা। গোয়েন্দা প্রধান শাহীন সোহেল। গোয়েন্দা সহকারী আহমদ সিয়াম।’
পড়া শেষে চোখ বড়ো বড়ো করে ওদের দিকেত তাকালো ইমন। যেন বিশ্বাস করতে পারছে না।
অয়নের আব্বু আমিন হাওলাদার ইমনের হাত থেকে কার্ডটা নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখলেন।
তারপর বললেন, ‘আমি প্রথমেই ভেবেছিলাম মাই বয়েজ, তোমরা অন্যদের থেকে আলাদা।’
‘আঙ্কেল, আমরা এই কেসের তদন্ত করতে চাই,’ শাহীন বললো ‘এজন্য আপনার অনুমতি দরকার।’
‘ধন্যবাদ তোমাদের, কিন্তু এটা তোমাদের কাজ নয়। বড় কোন ক্রিমিনাল এতে জড়িত থাকলে তোমাদের বিপদ হবে। তাই যা করার পুলিশ করবে,’ বললেন আমিন হাওলাদার।
‘পুলিশ তো দেখবেই বিষয়টা। আমরা চেষ্টা করলে ক্ষতি কি?,’
শাহীন বললো। ‘কক্সবাজার পুলিশ চিফকে ফোন করতে পারেন, তিনিই বলে দিবেন আমরা কেমন। আমরা এর আগেও বেশ কিছু জটিল রহস্যের সমাধান করেছি।’
‘বন্ধু এমন একটা বিপদে, অথচ তখন আমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি বলুন আঙ্কেল?, ’ মন খারাপ করে বললো সিয়াম।
‘আঙ্কেল, একটা সুযোগ দিন না এদের। আমার মনে হচ্ছে এরা পারবে, ’ উৎসাহী কন্ঠে বললো, ইমন ।
‘আমি আগেই বুঝেছি ছেলেগুলো বুদ্ধিমান, ’ অয়নের আম্মু বললেন, ইতিমধ্যে তিনি পুলিশকে ফোন করে এসেছেন। ‘তবে এই কাজে অনেক ঝুঁকি আছে, তাই তাদের এই ঝুঁকিতে ঠেলে দেয়া যায়না। আমি মা, তাই ছেলেদের বিপদে কেমন হয় তা বুঝি। এরাও তো আমার ছেলের মতোই।’
‘ঠিক আছে, আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। আমরা কোনো ঝুঁকি নেবোনা। ওরকম ঝুঁকি পূর্ণ মনে হলে পুলিশকে জানাবো।’
শাহীন বললো। কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন আমিন হাওলাদার, তারপর বললেন, ‘ঠিক আছে, অনুমতি দিলাম। চেষ্টা করতে পারো তোমরা। আমি পুলিশকে বলে রাখবো, তারা তোমাদের যেকোনো সময় সাহায্য করবে।’
‘ধন্যবাদ আঙ্কেল।’ বললো শাহীন।
খুশিতে লাফাতে ইচ্ছে করছে দুই গোয়েন্দার, কিন্তু তা আপাতত ভেতরেই চেপে রাখতে হলো।
‘আমার একটা কথা ছিলো, আঙ্কেল,’ আমিন হাওলাদারের দিকে তাকিয়ে ইমন বললো। ‘আমিও দুই গোয়েন্দার সাথে কাজ করতে চাই, কারণ আমি অয়নের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।’
‘ঠিক আছে, ’ দুই গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে আমিন হাওলাদার বললেন। ‘তোমাদের কোন আপত্তি আছে?’
‘আমাদের কোন আপত্তি নেই, একজনকে পেলে বরং আমাদের সুবিধাই হবে, ’ বললো শাহীন সোহেল।
‘ধন্যবাদ আঙ্কেল। তোমাদেরও ধন্যবাদ।’ দুই গোয়েন্দার দিকে তাকিয়ে উচ্ছাসিত কন্ঠে বললো ইমন।
ইতিমধ্যে অয়নের আম্মু, ওদের জন্য কফি দিয়ে গেছে। এখন কফি খাওয়ার ইচ্ছে নেই ওদের কিন্তু একান্তই, সৌজন্যতার জন্য খেতে হলো।
‘আঙ্কেল, এই কেসের সমাধানের জন্য আপনার সাহায্য দরকার। আমরা কিছু তথ্য জানতে চাই,’ কফির কাপটা টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে বললো শাহীন।
‘কি তথ্য জানতে চাও বলো,’ আমিন হাওলাদার বললেন ।
‘আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন? ’ শাহীন জিজ্ঞেস করলো, ‘কারো সাথে কোনো ঝামেলা হয়েছে কখনো?’
‘না। ওরকমভাবে কাউকে সন্দেহ হয়না। তবে ফরহাদ হাবিবের সাথে ঝামেলা হয়েছিলো, বেশ কয়েকবার। একসাথে ব্যবসা করতাম আমরা। এখন বাদ দিয়েছি। ব্যবসাতে লোকসানের জন্য সে আমাকে দায়ী করে, ’ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর, আমিন হাওলাদার বললেন। ‘কিন্তু, এর সাথে অয়নের নিখোঁজ এর সম্পর্ক নেই, সে একটা ভিতু টাইপের মানুষ। তার দ্বারা এসব সম্ভব না।’
‘দেখা যাক, ’ শাহীন জিজ্ঞেস করলো। ‘জঙ্গলে যাতায়াত আছে এমন কাউকে চেনেন? বা জানেন?’
‘জঙ্গলে যাতায়াত আছে, শুধু কপিলের,’ আমিন হাওলাদার বললেন ‘সে কাঠ ও মধু সংগ্রহের জন্য সেখানে যায়। তাও বেশি ভেতরে প্রবেশ করে না।’
‘অনেক ধন্যবাদ আঙ্কেল, ’ বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে বললো শাহীন। ‘আমরা এখন যাচ্ছি। আর কোন তথ্য জানার থাকলে আবার আসবো।’ আমিন আঙ্কেলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো ওরা তিনজন। বাড়ির বাইরের দিক থেকে, অয়নের রুমের জানালার কাছে খুঁজে দেখলো ওরা, কিন্তু কোন ক্লু খুঁজে পেলো না। এমনকি, কোনো পায়ের ছাপও নেই। বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে গেছে।

তিন.
উপত্যকা পেছনে ফেলে টিলার কাছে চলে এসেছে, দুই গোয়েন্দা ও অস্থায়ী গোয়েন্দা ইমন। টিলার ওপার থেকে শুরু হয়েছে জঙ্গল। জঙ্গলের শুরুতে ঘনত্ব কম। একটু ভেতরে গেলেই, এটা কতটা দুর্গম তা বোঝা যায়। কোনো প্রয়োজনে কেউ এদিকে এলেও, বেশি ভেতরে প্রবেশ করে না। এর ভেতরে কোথাও কোথাও, উঁচু টিলা রয়েছে। ওরা আরো ভেতরে চলে এসেছে।
এখানে দুই এক জায়গায় ঝোপঝাড় সামান্য দুমড়ে মুচড়ে আছে। এ ছাড়া আর কিছু পায়নি ওরা। এখন পথ চলতে খুবই অসুবিধা হচ্ছে ওদের। লতাপাতা কেটে পথ করে নিতে হচ্ছে, মশার উপদ্রবও কম নয় এখানে। এসব মশার কামড়ে রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুও হতে পারে। এ ছাড়া আক্রমণাত্মক কিছু হিংস্র শেয়াল ও বিষাক্ত সাপ আছে, এসবের পরেও এদিকে মানুষ আসার আর কী কারণ থাকতে পারে? কিন্তু ওরা এসেছে। রহস্য ওদের হাতছানি দিয়ে ডেকে এনেছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক ঘোরাঘুরি করেও, প্রয়োজনীয় কিছু আবিষ্কার করতে পারলো না ওরা।
ক্লান্তিতে একটা গাছের গোড়ায় বসে পড়লো তিন কিশোর গোয়েন্দা। ‘আমরা মনে হয়, খড়ের গাদায় সুচ খুঁজছি,’ কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললো ইমন। ওকে সমর্থন করে বললো সিয়াম, ‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছে, ইমন।’
‘আমিও তাই ভাবছি,’ শাহীন বললো। ‘আমাদের অন্যভাবে চেষ্টা করতে হবে। আর সামনে এগোনো যাবে না। পথ হারিয়ে ফেলার আশঙ্কা থাকবে এতে। চলো, ফিরে যাওয়া যাক।’
একটু বিশ্রাম নিয়ে, ফেরার পথ ধরলো ওরা। পাখির কিচির মিচির, আর খুটখাট শব্দে চঞ্চল একটা পরিবেশ জঙ্গলে। মাথার মধ্যে গত রাতের চিন্তাগুলো ঘুরপাক খাাচ্ছে শাহীনের। অয়ন কেন এসেছিলো এখানে? ওরা এর কোনো যুক্তি বা কারণ খুঁজে পায়নি এখানে এসে। কোনো ক্লু ছাড়াই, খালি হাতে ফেরত যেতে হচ্ছে ওদের।
পুলিশও এসেছিলো এখানে। তারাও কিছু খুঁজে পায়নি। শাহীন ভেবেছিলো, কোনো কিছু পুলিশের চোখ এড়িয়ে গেলেও হয়তো ওদের চোখে পড়তেও পারে। কিন্তু না। ওর ধারণা ভুল, তেমন কিছুই দেখেনি ওরা। ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত লেগেছে ওর কাছে। জঙ্গলটা যেন সব প্রমাণ গায়েব করে দিয়েছে। জঙ্গলটাকে এখন আরো রহস্যময় লাগতে শুরু করেছে শাহীনের। রহস্যময় জঙ্গলে যেন সবকিছুই হারিয়ে যায়।
মাথায় চিন্তার ঝড় চলছে ওর, কিন্তু তখনো কানটা সজাগ আছে। ঝোপের ডাল মাড়ানোর
সামান্য শব্দও তাই ওর কান এড়ালো না। দাঁড়িয়ে গেলো সে। ওর দেখাদেখি অন্যরাও
দাঁড়িয়ে পড়েছে। ‘কী হলো?’ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শাহীনের দিকে তাকিয়ে বললো সিয়াম।
‘দাঁড়ালে কেন, এখানে?’ দুই ঠোঁটে আঙুল রেখে, ওকে চুপ থাকতে বললো শাহীন।
ফিসফিস করে বললো, ‘বামের ঐ ঝোপের ওপার কিছু একটা আছে।’ এক সাথে তিন জোড়া চোখের দৃষ্টি, সেদিকে নিবদ্ধ হলো। ওদের পেছনে রেখে আস্তে সেদিকে দুই কদম এগোলো শাহীন। একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে, সাবধানে উঁকি দিলো সে। ঠিক তখনই নড়ে উঠলো ঝোপটা। ওখানে থেকে দ্রুত একটা পদশব্দ পেছনে সরে গেলো। শাহীন পদশব্দের পিছু নিলো, কিন্তু সুবিধা করতে পারলো না। ও যখন সেই ঝোপের কাছে পৌঁছালো, ততক্ষণে কারো ছায়াও নেই সেখানে। এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজি করেও কাউকে দেখা গেলো না। জঙ্গল ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ছে না। দাঁড়িয়ে পড়লো সে।
‘কী হয়েছে?’ হাঁফাতে হাঁফাতে ওর পাশে এসে দাঁড়ালো সিয়াম ও ইমন। তারপর ইমন বললো।
‘কার পিছু নিলে হঠাৎ? আমাদের রেখেই এভাবে?’
‘কেউ আমাদের পিছু নিয়েছিলো,’ একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললো শাহীন। ‘কিন্তু কে তা জানা হলো না। আর আগেই পালালো। ধুর, আমি খুব বোকা, নয়তো কেন আগে বুঝতে পারলাম না।’
‘অতো দুঃখ পাওয়ার মতো কিছু ঘটেনি’’ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো সিয়াম। ‘বোকা শুধু তুমি একা হওনি, আমরা সবাই হয়েছি।’
‘যা হবার হয়েছে,’ শাহীনের দিকে তাকিয়ে বললো ইমন। ‘এখন কি করবে?’
‘চলো, এখান থেকে অয়নের বাড়ি যাবো। তার ডায়েরিটা একটু ঘাঁটাঘাঁটি করবো। এরপরই পরবর্তী করণীয় ঠিক করা যাবে,’ শাহীন বললো।
জঙ্গল থেকে বের হলে, দুপুরের কড়া রোদ ওদের গায়ে এসে লাগলো, সেই সাথে কপিল দেওয়ানের দেখা পেয়ে গেলো ওরা। ইমন ওদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো কপিল দেওয়ানকে। লম্বায় পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির মতো হবে লোকটা। গায়ে ধূসর রঙের ময়লা পাঞ্জাবি।
পরনে কালো রঙের প্যান্ট। পায়ে অনেক পুরনো বুট জুতা। মুখে মাঝারি সাইজের দাড়ি। উসকো খুসকো চুল। যেন অনেক দিন আঁচড়ানো হয়নি।
চুল দাড়ি প্রায় অর্ধেক পেকে গেছে। বয়স আনুমানিক চল্লিশের মতো হবে। তবুও পেশিবহুল শরীর। কাঁধে কুড়াল। কেউ দেখলে প্রথম বাক্যেই পাগল বলবে তাকে। ‘দাদা, এরা আমার বন্ধু,’ দুই গোয়েন্দাকে দেখিয়ে বললো, ইমন। ‘আপনার থেকে কিছু জানতে চায়।’
‘কী জানতে চাও তোমরা?’ কাঁধ থেকে কুড়াল মাটিতে নামিয়ে বললেন, কপিল দেওয়ান।
‘সময় তার স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে, বলে ফেলো জলদি।’
‘এই জঙ্গল সম্পর্কে জানতে চাই,’ মুখে হাসি টেনে বললো শাহীন। ‘আশা করি, সবার থেকে আপনি ভালো বলতে পারবেন।’
‘জঙ্গলকে জানবে? সে তো নিজেই নিজেকে জানে না,’ অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বললো, কপিল দেওয়ান। ‘কখনো কখনো এটা অসীম, এর কোনো সীমা নেই, যেদিকে তাকাবে সেদিকে জঙ্গল। না, এর শেষ কেউ খুঁজে পাবে না। এই জঙ্গল সবকিছু খেয়ে ফেলবে একদিন।’ কথা শুনে অবাক হয়ে পরস্পরের দিকে তাকালো দুই গোয়েন্দা। তারপর শাহীন আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘এই জঙ্গলে অস্বাভাবিক কিছু দেখেন?’
‘এই জঙ্গল খুব ভয়ঙ্কর জায়গায়,’ কণ্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বললো কপিল দেওয়ান। ‘জোড়া কোকিল আর জোড়া পেঁচা, এখানে মৃত্যুর ডাক বয়ে আনে। খবরদার! এদিকে এসো না। খুব খারাপ জায়গা এটা, অভিশপ্ত জীবেরা ঘোরাফেরা করে এখানে।’
‘তাহলে আপনি কেন এখানে আসেন?’ ভয়ার্ত চোখে কপিলের দিকে তাকিয়ে বললো, সিয়াম।
‘আপনাকে ওরা কিছু বলে না?’
‘আগুন অনেক কিছু পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়,’ কপিল দেব একটা দিয়াশলাই এর কাঠি ধরিয়ে বললো। ‘কিন্তু পানিকে সে ভয় পায়। ঠা-ায় পানি বরফে পরিণত হয়, কিন্তু তাপে তা বাষ্প হয়ে উড়ে যায়, তেমনিভাবে আমাকেও ওরা থামাতে পারে না।’ এবারও অবাক হলো দুই গোয়েন্দা, তার কথা শুনে। পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো আবার। ইমন এতে অবাক হলো না। সে তাকে আগে থেকেই চিনতো।
‘গতকাল, অয়ন নিখোঁজ হয়েছে জানেন?’ শাহীন জঙ্গলের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললো। ‘তার আগে এই জঙ্গলে এসেছিলো সে। তারপরই, এখান থেকে অজানা কারণে পালিয়েছে সে। অদ্ভুত ব্যাপার কি জানেন? বাড়ি থেকে নিখোঁজ সে।’
‘এই জঙ্গল, এই পথ অভিশপ্ত। কাউকে অপছন্দ করলে তার আর রক্ষা পাওয়ার পথ থাকে না। ছেলেটাকে পছন্দ করেনি জঙ্গলটা,’ কথা বলতে বলতে হঠাৎ ধমকে উঠলো কপিল দেব। ‘চলে যাও তোমরা, এই অভিশপ্ত জায়গায় আর এসো না। খুব খারাপ ভাবে ফেঁসে যাবে।’ কথাগুলো বলে আর এক মুহূর্ত থামলো না সে। ওদের আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে, কুড়ালটা কাঁধে করে জঙ্গলে হারিয়ে গেলো। সে চলে যাওয়ার পরও, তার পথের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো ছেলেরা। ‘কি অদ্ভুত লোক রে বাবা,’
জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে সিয়াম বললো। ‘শেষের কথাগুলো কেমন ভাবে বললো দেখলে? কেমন ভারি কথাগুলো। তার চেহারাটাও কেমন হয়ে গেলো। আমি তো ভয় পেয়ে গেছি।’
‘সে ভয় দেখাতেই চেয়েছিলো হয়তো,’ সিয়ামের পিঠে থাবা দিয়ে বললো শাহীন। ‘ভয়টা ঝেড়ে ফেলো মাথা থেকে। চলো যাওয়া যাক।’
‘সে এমনি, কেমন যেন রহস্যময় কথা বলে। কথা বলার শেষে এমন খারাপ আচরণ করে চলে যায়,’ শাহীনের দিকে তাকিয়ে বললো ইমন। ‘এ জন্য তাকে কেউ পছন্দ করে না। লোকজন তাঁর সাথে মেশেও না, প্রায় সবাই একই কথা বলে, সে একটা পাগল।’
‘আমরা চোখে যা দেখি অনেক সময় তা সত্য হয় না, আড়ালে অবডালে অনেক কিছুই লুকিয়ে থাকে,’ বললো শাহীন।
‘এই সোহেল ভাইয়া,’ শাহীনের কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো ইমন, ‘তুমি আবার কপিলের মতো করে কথা বলছো কেন? কী বলতে চাচ্ছো, সহজ করে বলো।’
‘না, কিছু না, কপিল দাদাকে নজরে রাখতে হবে,’ শাহীন বললো।
‘এখন দ্রুত চলো অয়নের ওখানে।’
একের পর এক ডায়েরির পাতা উল্টিয়ে চলেছে শাহীন, কেসের সাথে সম্পৃক্ত কোনো লেখাই পায়নি এখনো। বন্ধুদের সাথে শিক্ষা সফরে যাওয়া, স্কুলের টুর্নামেন্টে বিজয়ী হওয়া, বাবা মায়ের ওপর অভিমান থেকে শুরু করে খুঁটিনাটি অনেক কিছুই লেখা আছে এতে, অথচ এমন কিছু লেখা নেই যা দ্বারা তার নিখোঁজের কারণ জানা যাবে। হয়তো লিখা ছিলো, সেগুলো এখন নেই। ডায়েরির শেষের দুইটা পৃষ্ঠা খুব সুন্দরভাবে ছিঁড়ে নেয়া হয়েছে। ফরেনসিক ল্যাবে এতে অয়নের আঙুলের ছাপই পাওয়া গেছে শুধু। হতে পারে অয়নই এটা ছিঁড়েছে কোনো কারণে, আর অন্য কেউ হলে, খালি হাতে এটা ছেড়েনি। আমিন আঙ্কেলর অনুরোধে পুলিশের কাছ থেকে ডায়েরিটা দেখার সুযোগ পেয়েছে ওরা। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। এখন ডায়েরি থেকে হারিয়ে যাওয়া পাতাটি উদ্ধার করতে হবে। আশা করা যায়, ওতে কোনো সূত্র লুকিয়ে আছে।

চার.
পরদিন দুপুরে, হেড কোয়ার্টারে আলোচনায় বসেছে দুই গোয়েন্দা ও গোয়েন্দা সহকারী ইমন। মোটামুটি গোছানো একটা লাইব্রেরি রুম। বুক সেলফের বিপরীত প্রান্তে টেবিল। তার পাশে জানালা।
টেবিলটা ঘিরে, তিনটা চেয়ার নিয়ে বসেছে তিন কিশোর গোয়েন্দা। শাহীনের খালামণিদের এই রুমটাকে, গোয়েন্দাদের অস্থায়ী হেডকোয়ার্টার বানিয়েছে ওরা। বাড়ির মূল অংশ থেক বিচ্ছিন্ন রুমটা, কেউ বিরক্ত করতে আসে না এখানে, ওদের জন্য পারফেক্ট এই জায়গাটা।
‘আমরা এখনো সেই প্রমেই রয়ে গেছি,’ টেবিলে রাখা বইটা, নাড়াচাড়া করতে করতে বললো শাহীন। ‘এখনো কোনো সূত্র খুঁজে পাইনি।’
‘চোখে অন্ধকার দেখছি,’ বললো সিয়াম। ইমন বললো, ‘এখন আমরা কি করবো?’
‘অয়ন কাদের সাথে বেশি চলাফেরা করতো?’ শাহীন ইমনকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তার পছন্দ, অপছন্দ, অভ্যাস, ব্যবহার সম্পর্কে বলো।’
‘আমি আর অয়নই সবসময় একসাথে থাকতাম,’ ইমন বললো।
‘আমরা অন্য কোনো ছেলেদের সাথে তেমন মিশতাম না। অয়ন, নতুন নতুন জায়গায় বেড়াতে পছন্দ করতো, আর সে অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করতো।’
‘সে তোমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু,’ সিয়াম বললো, ‘অথচ জঙ্গলে যাওয়ার ব্যাপারে কিছুই বলেনি?’
‘না, সে একটু চাপা স্বভাবের ছিলো,’ ইমন বললো, ‘কোনো কিছু শেষ না করে কাউকে জানাতো না। এটাও তো হতে পারে, জঙ্গল সম্পর্কে বিশেষ কিছু, আগে থেকে সে জানতো না। তার আব্বুর উপর রাগ করে সেখানে যায় এবং বাজে কিছু দেখে ফেলে।’
‘না, এটা হয়নি। সে জঙ্গলের কোনো বিশেষ কিছু আগে থেকেই জানতো,’ শাহীন বললো, ‘এটা তোমাকে না বললেও তার ডায়েরিতে লিখেছিলো। আর সে জন্যই তার নিখোঁজের সাথে ডায়েরির কয়েকটা পাতাও নিখোঁজ।’
‘এতটা নিশ্চিন্ত হচ্ছো কী করে?’ সিয়াম জিজ্ঞেস করলো।
‘এটা আমার ধারণা,’ শাহীন বললো, ‘দেখা যাক সত্যি হয় কিনা।’
‘কিন্তু অয়ন কি জেনেছিলো, এটাই এখনো আমরা জানতে পারলাম না,’ ইমন বললো। ‘আমার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছে না, সোহেল ভাইয়া।’
‘অয়নকে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য কিডন্যাপ করা হয়নি এটা আমরা নিশ্চিত। তাই এই অপশনটা বাদ, ঘটনাগুলো আবারত প্রথম থেকে ভাবা যাক,’আবার বলতে শুরু করলো শাহীন, ‘প্রথমে অয়নকে জঙ্গল থেকে পালাতে দেখা গেলো, তারপর নিজের বাড়ি থেকে নিখোঁজ হলো। সাথে তার ডায়েরির কিছু পাতা। আমরা তার বাবার থেকে জানলাম, ব্যবসায়িক কারণে ফরহাদ হাবিবের সাথে কয়েকবার তার ঝামেলা হয়েছে। জঙ্গলে অভিযান চালিয়ে কিছু পেলাম না। উল্টো আমাদের ওপর নজর রাখছিলো, অজানা কোনো ব্যক্তি। জঙ্গল থেকে বের হয়ে কপিল দেওয়ানের উদ্ভট সব কথাবার্তা শুনলাম। এখন আমাদের সন্দেহের তালিকায় তিনজন ব্যক্তির নাম আসছে- ১. ফরহাদ হাবিব ২. অজানা সেই ব্যক্তি ৩. কপিল দেব।’
‘ঐ পাগলকে সন্দেহ করার কী আছে?’ হাসতে হাসতে বললো ইমন।
‘গোয়েন্দাদের কাছে কেউই নিরপরাধ নয়, যতক্ষণ না আসল অপরাধীকে খুঁজে পাওয়া যাবে। ভুলে যাবে না কপিলই একমাত্র ব্যক্তি, যে জঙ্গলকে ভালোভাবে চেনে।’ ইমনকে কথাটা মনে করিয়ে দিলো সিয়াম।
‘আচ্ছা, বুঝতে পেরেছি, দুঃখিত।’
‘যাই হোক, এখন আমাদের কয়েকটি কাজ করতে হবে- ১. ফরহাদ হাবিবের সম্পর্কে খোঁজ নেয়া, ২. জঙ্গল সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানা, ৩. কপিল দেওয়ানের উপর নজর রাখা, ৪. ডায়েরির হারানো পাতাগুলো খুঁজে বের করা এবং ৫. সবসময় চোখ কান খোলা রাখা,’ শাহীন বললো। ‘আমার ধারণা সত্যি হলে, অজানা সেই ব্যক্তি আবারও আমাদের অনুসরণ করবে । তখন তাকে ধরার চেষ্টা করতে হবে।’
‘তোমার একটা কাজ কমিয়ে দিয়েছি,’ ইমন বললো, ‘জঙ্গল সম্পর্কে জেনেছি আরো। এর আয়তন ১৫০.৫৫ বর্গমাইল, বদনাম আছে যে, পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে যাওয়া অপরাধীদের বাসস্থল নাকি ওটা, কিন্তু জঙ্গলে ওদের কখনো খুঁজে পায়নি পুলিশ। গুগল ম্যাপ থেকে অবশ্য তেমন কিছু জানা যায়নি, শুধু কিছু টিলা আর গাছপালা দেখানো হয়েছে ম্যাপে।’
‘চমৎকার,’ ইমনের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললো শাহীন। ‘অনেক কিছু জেনেছো। আজ বিকেলে, আমি আর সিয়াম ফরহাদ হাবিবের সাথে দেখা করবো, তুমি সন্ধ্যা পর্যন্ত কপিলের উপর নজর রাখবে।’
‘ঠিক আছে।’
ফরহাদ হাবিব গত দুইদিন কোথায় ছিলো, তা তাকে জিজ্ঞেস করার ভালো একটা উপায় বের করতে হবে। ভাবলো শাহীন।
(চলবে)

Share.

মন্তব্য করুন