পাক্কা সাত দিনের মামলা। গোলাপ ফুফুর বাড়িতে বেড়াতে যাবে টুপুর। কী যে এক নাম না জানা আনন্দ টগবগে দুধের মতো বুকের মধ্যে বলকাচ্ছে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত রক্তের মধ্যে নাচন শুর হয়েছে যেন। টুপুর বরাবরই একটু কবি ভাবাপন্ন। একটু অন্য রকম। পড়াশোনায়ও ভালো। তারপর সবচেয়ে ভালো যেটা সেটা হচ্ছে একজন নাক চোখ কান খোলা সচেতন মানুষের মতো বেড়ে ওঠার চেষ্টা।
বাবা যে সবসময় বলেন, শুধু পড়শোনার পুঁথিগত বিদ্যে দিয়ে সবকিছু জয় করা যায় না, হতে হবে পারফেক্ট ম্যান পরিপূর্ণ মানুষ। যার জন্যে হতে হবে বেশ সচেতন। যাই হোক টুপুর ভালোবাসে এই বাংলার ছয়টি ঋতুকে। আর ঋতু পরিবর্তনের বাঁকটুকু তার খুব ভালো লাগে। কিন্তু বর্ষা ঋতুকে যেন সবচেয়ে ভালোবাসে টুপুর। বসন্ত ঋতু খুব সুন্দর, শরৎ-হেমন্তও সুন্দর কিন্তু ওসব ঋতুগুলো যেন একঝলক দেখা দিয়েই মুখ লুকিয়ে ফেলে। আর এই ঢাকা শহরে কেইবা শুনতে পায় বসন্তের কুহু কুহু, দেখতে পায় প্রাণভরে ফোটা ফুলের সৌন্দর্য।
শরৎ-হেমন্তও সুন্দর কিন্তু ওসব ঋতুগুলো যেন একঝলক দেখা দিয়েই মুখ লুকিয়ে ফেলে। শরৎ তার কাশফুলের গুচ্ছ যে কোথায় লুকিয়ে রাখে আজকাল। শুধু বইতে পড়া আর সিনেমায় দেখা। চোখে দেখার উপায় নেই। অবশ্য শীত ঋতুতে নার্সারিগুলোর গোলাপ, গাঁদা, ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকার সমারোহ খুব ভালো লাগে। আর মা যেদিন পাটিসাপটা তৈরি করেন, ভাপা পিঠা করেন সেদিনটা কাটে মহা আনন্দে। কিন্তু বৃষ্টিভেজা বর্ষাঋতুই টুপুরের ঋতুরাজ। আর এই আনন্দ ঋতুতে গোলাপ ফুফুর বাড়িতে ফুলবাড়ি গ্রামে যাবার মজাই আলাদা। টুপুরের প্রাণ-মন যেন কচিঘাসের মতো, নবীন কিশলয়ের মতো তরতর করে জেগে উঠেছে। মন কেমন করা ঘোরের মধ্যে আছে ও।
টুপুরের গ্রিনরোডের এই সাততলা ফ্ল্যাট বাড়িটায় জোছনা দেখা যায় না। ফুলের গন্ধ পাওয়া যায় না। অবশ্য পাশের ফ্ল্যাটের সামনে একটা দোতলা পুরনো আমলের বাড়ি আছে। সেই বাড়িতে কনকচাঁপা ফোটে, কামিনীফুল ফোটে, মধুমঞ্জরী। কী যে সুবাস ফোটা ফুলের। টুপুর কয় দণ্ড বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, শ্বাস টেনে ফুলের সৌরভ নেয়। খুব ভালো লাগে। অলীক আনন্দে প্রাণমন ভরে ওঠে। ঐ হলুদ বাড়িটার সামনে সবুজ বাগান। এখনও ডেভেলপারের খপ্পড়ে পড়ে নাই। বাড়ির মালিক বিধবা মহিলা খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আর সাহসী। তিনি জীবিত থাকতে এ বাড়ির একটা ইটেও কেউ হাত দিতে পারবে না। ‘ছায়ানীড়’ নামের বাড়িটা টুপুরকে হাতছানি দিয়ে ডাকে- ‘আয়রে পাগল এই ছায়াচ্ছনড়ব বাড়িটায় একটু প্রাণ জুড়িয়ে যা।’ ….কিন্তু তাই বলে তো আর হুট করে কারো বাড়িতে ঢুকে পড়া যায় না।
যাহোক, গোলাপ ফুফুর বাড়িতে আসার সময় সবার জন্যে মনপ্রাণ উজাড় করে উপহারের আয়োজনে মেতেছে টুপুর। ফুফুর জন্যে তাঁতের বুটিদার শাড়ি আর ফুপার জন্য সুন্দর পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছেন মা আরিফা খান। ছোট্ট ট্র্যাভেল ব্যাগে সবকিছু পাট পাট করে গুছিয়ে নেয় টুপুর। দুটো প্রিয় বইও নিয়েছে সঙ্গে ‘চাঁদের পাহাড়’ আর ‘বুড়ো আংলা’। আরো অনেক প্রিয় বই আছে টুপুরের কিন্তু বর্ষা ঋতুকে উপভোগ করতে যাচ্ছে যেখানে সেখানে বইয়ে মুখ গুঁজে থাকলে কি চলে?
ফুফুর বাড়িটা খোলামেলা। যেন সুনীল আকাশটা উপুড় হয়ে নেমে পড়েছে উঠোনে। উঠোনে নিমগাছের ঝিরি ঝিরি পাতার নকশি। গন্ধরাজের ঝোপালো গাছ আর আছে করমচার কয়েকটা গাছ। বারান্দার টবে ফুটে আছে গোলাপ। ফুপাজান শৌখিন পুষ্পপ্রেমিক। তিনি এক সময় ছিলেন কৃষিবিদ-কৃষি অফিসের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। এখন চাকরির অবসর মুহূর্তগুলো কাটে গাছ-গাছালির সঙ্গে বন্ধুত্ব করে যতড়ব করে গভীর মমতায়। শিক্ষিত মানুষের মমতার পরশে এই গোলাপ ভিলার প্রকৃতি যেন প্রাণখুলে হাসছে। ফুপার নিজ হাতে তৈরি বাগিচা দেখে তো টুপুর অবাক। কী নেই সে বাগানে ম্যাগনোলিয়া যার বাংলা নাম উদয়পদ্ম সেও দাঁড়িয়ে আছে নিরিবিলি বাগানের দক্ষিণ কোণে। আর আছে ঝোপালো রঙ্গন লাল, সাদা, গোলাপি রঙের। আছে টগর, বেলি। রাজরানীর শোবার ঘরের চালে বেয়ে উঠেছে জুঁইলতা, ফুল ফুটলে গোলাপভিলা আশ্চর্য সুগন্ধে ভরে যায়। মোতিয়া বেলির গাছগুলো ফুলে ফুলে সাদা হয়ে থাকে। কী চমৎকার পরিবেশ। টুপুরের রূপকথার রাজ্য। তার উপর ফুপা-ফুফুর আদরের নির্যাস।
টুপুর সারাটা দিন বাড়ির আনাচে-কানাচে ঘুরে ফিরে গাছ-লতাগুলো পরখ করল। বাড়ির পিছনে খানিকটা ঝোপঝাড়। ভাঁটফুলের জঙ্গল। আকন্দ, মাদার, শেয়ালকাঁটায় ভরা। লান্টানা লজ্জাবতী আরও কত কী লতাগুল্ম। সবার নাম জানে না টুপুর। গোলাপ ফুফু দেখতেও গোলাপের মতোন। স্নেহময় সুরে ডাকতে থাকেন, ‘কইরে টুপুর কই গেলি বাপজান। সেই সাত-সকালে কয়টা শুকনো পিঠে খেয়ে এখন পর্যন্ত ঘুরে বেড়াচ্ছিস?’
টুপুর দৌড়ে আসে। আদুরে গলায় বলে, ‘সকালে পাটিসাপটা খেলাম। পুলি পিঠা খেলাম। আর তো এখনও ক্ষিধা পায়নি ফুফুমা।’
ফুফুর এক হাতে পেতলের একটা জামবাটি ভরা ফুরফুরে মুড়ি আর এক হাতে নারকেল কোরা। মধুমিয়ার হাতে আলিশান এক গ্লাসে ডাবের পানি। টুপুর চোখ দুটো রসগোল্লা বানিয়ে বলে, ‘ওমা ফুফুমা একটু পরে ত ভাতই খাব। এখন এতকিছু খেলে ক্ষিধে থাকবে না।’
ফুফু কপট রাগে তন্বি করে বলেন, ‘ক্ষিধে থাকবে না বললেই হলো! এই উঠানটা তিন চক্কর দিলেই প্যাটে খিদা একেবারে চোঁ-চোঁ করতে থাকবেনে। আয় লক্ষ্মী সোনা, খেয়ে নে বাগানের নারকেল কচি ডাবের পানি।’
অগত্যা খানিকটা খেতেই হলো। ফুফুর হুকুমের অমান্য হতে পারে না। গোলাপ ফুফুর তিন ছেলে। তারা সবাই রিয়াদে থাকেন। এক মেয়ে বিয়ে হয়েছে শাহজাদপুরে। রবিঠাকুরের কাচারি বাড়ির কাছাকাছি। থাকেন ঢাকায়। ঘরসংসার নিয়ে ব্যস্ত।
বাড়ির আঙিনার পূবপাড়ে ছোট একটা টলটলে পুকুর। এক কোণে কিছু কচুরিপানায় ফুল ফুটে পুকুরপাড় আলো করে রেখেছে। পুকুরে ফুপা মাছের পোনা ছাড়েন খাবার দেন। এখানে নাইলোটিকা, তেলাপিয়া, শোল, কাতলা মাছের রাজত্ব। সারাটা দিন কোনাকানচি, গোয়ালঘর পেছনবাড়ি বাহির বাড়ি বাগবাগিচা ঘুরে ফিরে টুপুর দাঁড়াল ফুফুর আটচালা টিনের ঘরটার সামনে। দূরে কোথায় বাঁশঝাড়ের ভেতর থেকে ঘুঘুর ডাক শোনা যাচ্ছে। ঘু-ঘু-ঘু-উ। ভারী আনন্দ হয় টুপুরের। ডাকটা কেমন মন উদাস করা। নতুন করে টুপুর দেখছে ফুফুর শোবার ঘর!
রূপকথার রাজারাণীর শয়নকক্ষটি। অপূর্ব এক টিনের ঘর দেওয়াল ভিত পাকা উচু বারান্দা। পুরো বারান্দা জুড়ে টিনের অসাধারণ নকশি কাটা ঝরকা। সবুজ রং করা। বৈঠক ঘরখানাও বড়সড়। পুরনো আমলের গদি আঁটা চেয়ার পাতা। পুরনো মখমলের কাপড়ে ঢাকা একটা চওড়া আসনে মোটা মোটা দুটো কোলবালিশ। সদর দরজার দু’পাশে দুটো শাপলা ফুল। তার মধ্যে আবার দুটো সিমেন্টের টবে লতানো গুল্মের এলিয়ে পড়া শোভা।
বিকেলে আকাশটার রঙ ক্রমশ ধূসর হয়ে এলো। মেঘ ডাকতে থাকল গুরু গুরু। হয়তো একটু পরে ঝেঁপে বৃষ্টি নামবে। ঢাকা শহরের ফ্ল্যাটবন্দী থেকে বৃষ্টি দেখতে ভালো লাগে না। মন ভরে না। মা বলেছেন, গ্রামের বৃষ্টির আনন্দ অন্যরকম। টুপুর একা মনে আওড়ায়, ‘ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে-।’ ঝম ঝম করে বৃষ্টি নেমে পড়েছে।
ফুফু চেঁচিয়ে ডাকেন, ‘ঘরে উঠে আয় টুপু। ঠাটা পড়বার পারে।’
টুপুর একটু শিউরে ওঠে। ঠাটা মানে বাজ-বজ্রপাত। ওরে বাপরে, বড় বড় ফোঁটার ঝাপটা এসে চোখে মুখে লাগে টুপুরের। সারাটা বিকেল সন্ধ্যা কাটল একটানা বর্ষণে। মন ভরে উপভোগ করল টুপুর।
রাতের খানা দেওয়া হয়েছে টেবিলে। ফুপা চেয়ার টেবিলেই খানা খান। বহু আগে মেঝেতে দস্তরখানা বিছিয়ে খানা খাওয়া হতো। কালুমিয়া আর ফুফুমা খাবার সাজাচ্ছেন টেবিলে। ফেনা ফেনা লাসা লাসা গরম ভাত। এইমাত্র চুলা থেকে নামানো হয়েছে। তারপর পকুরের কাতলা মাছের তেঁতুল দেয়া টক ঝোল। রুই মাছ ভাজা। চাক বেগুন ভাজা। অমৃত স্বাদের নিরামিষ। ঘন সোনামুগের ডাল। খাবার পর ঘরে পাতা দই। পাকা আম। সুগন্ধে টেবিলটা ম’ ম’ করছে যেন। এই আষাঢ় মাসেও ফুফুর বাড়িতে মধুমাসের জের প্রায় সবটুকুই রয়ে গেছে। সারারাত ঘুমের ঘোরে স্বপেড়বর দেশে গভীর আনন্দে ডুবে রইল টুপুর। মাঝে মাঝে টুপটাপ বৃষ্টি ঝরছে টিনের চালে। ফুপা শোবার আগে কবিতা শোনালেন,
“জল ঝরে জল ঝরে সারাদিন সারারাত
অফুরান নামতায় বাদলের ধারাপাত।
আকাশের মুখ ঢাকা ধোঁয়ামাখা চারিধার,
পৃথিবীর ছাত পিঠে ঝমাঝম বারিধার।
স্নান করে গাছপালা প্রাণখোলা বরষায়,
নদীনালা ঘোলাজল ভরে ওঠে ভরসায়।”
ফুপা গম্ভীর গলায় কৌতুক মেখে বললেন, বলত কার লেখা কবিতা?
টুপুর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, ‘ফুপা এটা সুকুমার রায়ের কবিতা।’
টুপুর ক্লাস এইটে পড়লে কি হয়, এরই মধ্যে সে অনেক ভালো ভালো সাহিত্য পাঠ করেছে। ফুপা ভীষণ খুশি হয়ে টুপুরের পিঠ চাপড়ে দিলেন। যাবার সময় বললেন, ‘ঘুমা বাবা বৃষ্টির রাতে ঘুম ভালো হয়। আর বাইরে শুনছিস না, ‘ব্যাঙেদের মহাসভা আহ্লাদে গদগদ। গান করে সারারাত অতিশয় বদখদ।’ টুপুর জানে এটিও সুকুমার রায়ের বর্ষার কবিতা। কিন্তু আশ্চর্য টুপুরের কানে বর্ষার গান মোটেই ‘বদখদ’ লাগছে না। বরং রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছে। গতরাতে রাতভর ঝিঁঝি ডেকেছে। ঝিঁঝিদের লাগাতার সেতার শুনতে খুব আনন্দ লেগেছে ওর। আজ রাতভর বৃষ্টির মাদল। কী মজা এমন করে কী সে কখনও বৃষ্টির গান শুনেছে। অ্যাপার্টমেন্টের ঘরে শুয়ে থাই অ্যালুমিনিয়ামের ব্যূহ ভেদ করে এমন বৃষ্টির গান শোনা যায় না। এখানে এই গোলাপ ভিলায় টুপুর একান্ত হয়ে গেছে প্রকৃতির সাথে। কখনও লঘু ছন্দে, কখনো মৃদু কখনও ঝড়ো। মহাসমারোহে বৃষ্টি ঝরছে। অপরূপ সিম্ফনি! খেজুরের ডাল জামরুলের ডাল বৃষ্টির তোড়ে আছড়ে আছড়ে পড়ছে টিনের চালে।
সকালে মোলায়েম ঘুম ভেঙে গেল মোরগের ডাক শুনে। কু- কু-রউ-কু-উ…। কতদিন যে টুপুর মোরগের ডাক শোনেনি। প্রাণ জুড়িয়ে গেল। দূরে মসজিদ থেকে ভেসে আসছে আজানের সুরেলা ধ্বনি। আসসালাতু খাইরুম মিনানড়বাওম…। মসজিদে নামাজ পড়ে ফুপাজি বসেছেন কোরআন তেলাওয়াত করতে। কী মোলায়েম সহি উচ্চারণে সুরেলা কণ্ঠে পাঠ করছেন সূরা আর রাহমান। ‘ফাবি আইয়্যি আলা ইয়ে রাব্বি কুমা তুকাজজিবান।’ …বারবার এই আয়াতের উচ্চারণ। বাবাও প্রায় দিন সকালে পড়েন। বড় মধুর লাগে টুপুরের, বড় শান্তি।
আজ দুপুরে পুকুরে মাছ ধরা হয়েছে জাল ফেলে। এখন মন্তাজ বসেছে ছিপ নিয়ে। টুপুরের খুব ইচ্ছে করছে ওর সঙ্গে ছিপ নিয়ে মাছ ধরতে। কিন্তু ফুফু বারবার নিষেধ করলেন পুকুর ঘাট পিছল বলে। টুপুর আবদারের গলায় বলে, ‘তুমি ভেবো না ফুফুমা। আমি এই কিনারে বসে বসে মাছ ধরব। ফুফু তার রাঙা ঠোঁট নাড়িয়ে বিড়বিড় করে দোয়া পড়ে ফুঁ দিলেন টুপুরের মাথায়। মন্তাজের ছিপে মাছ পড়েছে। উল্লাসে ও ফেটে পড়ছে। যেন বড়সড় একটা সাদা সরপুঁটি মাছ। কী সুন্দর রূপোর ঝলকে শরীর চকচক করছে। ছিপশুদ্ধ লাফ দিচ্ছে বারবার। কী অসাধারণ দৃশ্য। টুপুর বিভোর হয়ে দেখে। ওদিকে মধুমিয়ার ছিপে উঠেছে নলা, পুঁটি, আইড়। সে পাকা মৎস্যশিকারি। খুব যতড়ব করে মাছের ‘চার’ বানিয়েছে। মাছ খাবারের লোভে মৃত্যুফাঁদে ধেয়ে আসছে। চারিদিকে খালুই ছিপ কলাপাতায় মাছের চাষ ধরার উৎসব। জলজ সোঁদা গন্ধে চারপাশে মাতোয়ারা।
এমন সময় ঘটল কা-টা! মন্তাজের খালুই হাতড়ে হাতড়ে টুপুর দেখছিল সরপুঁটির শোভা। ওদিকে হঠাৎ টুপুরের ছিপে টান পড়ে। ও উত্তেজিত হয়ে ছিপ টানতে যেয়ে পা পিছলে এক্কেবারে পপাত ধরণীতল। একেবারে ডিগবাজি খেয়ে মাঝ পুকুরে। ঘটনা ঘটতে সময় লাগে কতক্ষণ! হায় হায় রব উঠে গেল চারদিকে। যার জন্য এই মাছ ধরার উৎসব সেই কিনা মাঝ পুকুরে! সাঁতার জানে না টুপুর। ফুফুকে মধুমিয়া দৌড়ে যেয়ে খবর দিলো বাঁশফাটা গলায়, ‘ও ফুফু সব্বোনাশ হয়্যা গেছে। টুপুর ভাইজান পুকুরে পইড়্যা গেছে।’
ফুফুমা হাউমাউ করে ওঠেন। তাঁর সর্ব শরীর কাঁপছে। ‘কী কথা শুনালি তুই মধু। আমি এখন কী করি।’
‘গোলাপ ফুফু নীল রঙের চওড়া পাড়ের শাড়ির আঁচল পেঁচান কোমরে। দৌড়ান পুকুর পাড়ে। এক্ষুনি যেন তিনি লাফ দেবেন পুকুরে।’ ‘আমার বাপজান রে…।’
গলা ছেড়ে কাঁদেন ফুফু। ফুপাকে বাজার থেকে ডেকে আনে ধনু।
ততক্ষণে ইদ্রিস, কলিমমুন্সী মন্তাজ পানি খেয়ে ঢোল পেটের টুপুরকে পাড়ে তুলেছে। ওরা টুপুরকে উঠানে নিয়ে আসে। নানা কায়দায় পেটের পানি বের করে। আর একটু হলে কী হতো আল্লাহ জানেন। টুপুর পিট পিট করে তাকায়। উভ্রান্তের মতো ফুফুমাকে দেখে কঁকিয়ে ওঠে, ‘আর কোনদিন তোমার কথা অমান্য করব না ফুফুমা।’
ঘরে নিয়ে শুকনো কাপড় পরিয়ে টুপুরকে শুইয়ে দেয় খাটে। শরবতী গরম দুধ নিয়ে আসে। যতড়ব করে খাওয়ান ফুফু।
ফুপা আসেন হন্তদন্ত ভঙ্গিতে। তারপর সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে বলেন, ‘এই ব্যারামের একটা ভালো টোটকা আমার জানা আছে।’ টুপুর বোকা চোখ মেলে বলে, ‘কী টোটকা ফুপাজি?’
ফুপাজি মুচকি হেসে বলেন, ‘তোমাকে সাঁতার শিখতে হবে। নদীময় এ দেশের ছেলে হয়ে সাঁতার শেখেনি যে। দেখো না মন্তাজ ধনু মধু ওরা চোখ বন্ধ করে একটানে ওই পুকুর পার হয়। ডুব সাঁতার দিয়েও পেরোতে পারে ওরা। নিজের জীবনের নিরাপত্তার জন্যেই তোমাকে সাঁতার শিখতে হবে, বুঝেছ, বাপজান?’
পরদিন কলসি, গাড়ির পুরনো টায়ার দিয়ে হুলস্থূল আয়োজনে টুপুর সাঁতার শিখতে নামল। অতি আশ্চর্যের বিষয় খুব দ্রুত সে রপ্ত করে নিলো সাঁতার পাঁচ দিনের মাথায়। টেলিফোনে আরও তিনদিনের ছুটি মঞ্জুর করিয়ে নিলেন ফুপা। জীবন-মরণেরও প্রশ্ন। এখন দিব্যি টুপুর সাঁতারে পুকুরটা পাড়ি দিতে পারে। অবশ্য মধু মিয়া, মন্তাজ দুই পাশে থাকে। ফুপা থাকেন পাড়ে। কথা হলো আগামী বছর বর্ষায়ও আল্লাহ বাঁচালে টুপুর আসবে, এই পুকুরে সাঁতার কাটতে।
পরদিন সকাল সকাল ফুপাজির আদি দাদার বাড়ি সনতলায় গেল ওরা। ফুপু ফুপা মন্তাজ। ফুলজোড় নদী কী সুন্দর বয়ে চলেছে। নৌকায় পাড় হয়ে সনতলা গ্রাম। ফুলজোড় নদীতে অবারিত কচুরিপানার সৌন্দর্য দেখে বিভোর হলো টুপুর। অপূর্ব এই কচুরিপানার রূপ। বেগুনি রঙের মধ্যে হলদে ফোটা। চোখ জুড়িয়ে যায় যেন। সনতলা গ্রামখানা সবুজ রঙের জলরঙ ছবি যেন। বাড়ি বাড়ি কী আপ্যায়ন। কেউ সহজে ছাড়ে না। কী মজা লাগছিল টুপুরের। এত আনন্দ ফুফুর বাড়িতে এসে ভাবাই যায় না। ঢাকার ফ্যান্টাসি কিংডম নন্দন পার্কে অনেকবার গেছে টুপুর কিন্তু এই আনন্দের সঙ্গে তুলনা হয় না।
ফুলবাড়ি ফিরে টুপুর ট্র্যাভেল ব্যাগ গোছাতে লাগল। ফুফুমার কুমড়া, বড়ি, নারকেল, আলোচাল, বরফি আরও কতকি পুঁটলি বেঁধে দিলেন। আবার পুনর্মষিকাভবের সেই ঢাকার ছককাটা একগুঁয়ে বন্দিজীবন। বাসস্ট্যান্ডের দিকে যেতে যেতে টুপুরের মন কাঁদতে লাগল গন্ধরাজের সুবাসের জন্য, উথালপাতাল বৃষ্টির সেই সোঁদা গন্ধ অসাধারণ ঘোরের জন্য। ফুফুর হাতের বাইনমাছের লাল রঙের সালুনের জন্যে। টুপুরের জন্যে গোলাপ ফুফুর বাড়িটা কি কাঁদছে?
দরজা খুলে মা অবাক? তার ছেলে ফিরেছে দুনিয়ার পুঁটলা নিয়ে ফুপার সঙ্গে। তিনি অবাক হলেন টুপুরের একটানা ডোরবেল বাজানোর শব্দে। আজ টুপুর এক অন্য খোকা অন্য মানুষ! ঢাকার গ্রিনরোডের ফ্ল্যাট বাড়িটার ননীর পুতুল বালকটি নয়।
টুপুরের বুকের মধ্যে তড়পাচ্ছে অন্য সুখ। সে কখন কিভাবে বলবে তার দিগ্বিজয়ের কাহিনী।

Share.

মন্তব্য করুন