[বিশ্ববিখ্যাত রুশ সাহিত্যিক লেভ টলস্টয় (জ. ৯ সেপ্টেম্বর, ১৮২৮ – মৃ. ২০ নভেম্বর, ১৯১০) ছিলেন লেখকদের লেখক। তাঁর সাহিত্য প্রতিভা ও অবিস্মরণীয় অবদানের সূর্যালোকে বিশ্ব সাহিত্য আলোকিত হয়ে আছে। তিনি ছিলেন মানবতাবাদী লেখক। তাঁর প্রধান পরিচয় তিনি ঔপন্যাসিক। ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ ও ‘ আনা কারেনিনা’ উপন্যাস দু’টি টলস্টয়ের অনন্য সাহিত্য প্রতিভার পরিচয় বহন করছে। এ দু’টি উপন্যাসই বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম সেরা সৃষ্টি হিসেবে স্বীকৃত। তিনি ছিলেন উনিশ শতকের রাশিয়ার অভিজাত সমাজের সদস্য তথা উঁচুতলার মানুষ। কিন্তু তাঁর সাহিত্য সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। বলা হয়ে থাকে যে তাঁর সাহিত্যে অবাস্তব বলে কিছু নেই। যা দেখেছেন, জেনেছেন তাই সাহিত্যে এনেছেন, অভিজ্ঞতার বাইরে কোনো কিছুকে তিনি সাহিত্যে আনেননি। আমৃত্যু তিনি সৃষ্টি করেছেন বিপুল বিচিত্র সাহিত্য সম্ভার। তাঁর সাহিত্য রচনার উদ্দেশ্য ছিল মানব কল্যাণ ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ সাধন। উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি বেশ কিছু ছোটগল্পও লিখেছেন। এ সব গল্প সাহিত্য স্রষ্টা টলস্টয়কে বিপুল সম্মান ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। রাশিয়া ও রাশিয়ার বাইরের জনজীবনের ছবি অতুলনীয় নৈপুণ্য ও দক্ষতার সাথে আঁকা হয়েছে গল্পগুলোতে । তিনি ছোটদের জন্যও গল্প লিখেছেন যাতে তুলে ধরা হয়েছে নীতি ও সত্যের জয়। শিশুদের ভবিষ্যত জীবন গঠন ও তাদের অনুপ্রেরণা দানে এ গল্পগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর বিখ্যাত গল্পগুলোর মধ্যে ‘ককেশাসের বন্দী’ অন্যতম। এটিকে ছোট উপন্যাসও বলা হয়ে থাকে। এতে একজন বন্দীর মুক্তির অদম্য পিপাসা চিত্রিত হয়েছে।]

(গত সংখ্যার পর)

পাহাড়গুলোর মঝে একটি বন, সেখান থেকে বেশ দূরে দেখা যায় পর্বতমালা- ক্রমশ উঁচু হয়ে উঠে গেছে তা। পর্বতমালার সর্বোচ্চ চূড়াটি বরফ ঢাকা- যেন চিনির মত সাদা। পূর্ব ও পশ্চিমেও একই ধরনের পাহাড়ের বিস্তৃতি। ওদিকে পাহাড়ের গিরিখাতের আউলগুলো থেকে ধোঁয়া উঠছিল। আরে! গোটা এলাকাতেই তো দেখছি তাতারদের বাস- ভাবে ঝিলিন। রাশিয়ার দিকটায় তাকায় সে। পায়ের নিচের দিকে একটি নদী বয়ে চলেছে, তার পাড়েই ছোট ছোট বাগান ঘেরা আউল যেখানে সে থাকে। সে নদীর তীরে বসে কাপড় কাচায় রত মহিলাদের দেখতে পায়, তাদের দেখতে পুতুলের মত মনে হচ্ছিল। আউলের পিছনে একটি পাহাড়, দক্ষিণের পাহাড়ের চেয়ে সেটা নিচু, তার পিছনে ঘন বনে ঢাকা আরো দু’টি পাহাড় আর এগুলোর মাঝে একটি নীলাভ সমভূমি এবং দূরে, আরো দূরে ধোঁয়ার মেঘের মত কিছু দেখা যায়। সে মনে করার চেষ্টা করে যে দুর্গে থাকার সময় সূর্য কোনদিকে উঠত আর কোন দিকে অস্ত যেত। সে দেখতে পেল, তার কোনো ভুল হয়নি। এ সমভূমিতেই অবশ্যই কোথাও রুশ দুর্গটি আছে। সে যদি পালায় তাহলে এ দুই পাহাড়ের ভিতর দিয়ে তাকে পথ খুঁজে নিতে হবে।
সূর্য ডুবে যাচ্ছিল। সাদা বরফ ঢাকা পাহাড়গুলো বিদায়ী সূর্যের আলোয় লাল হয়ে ওঠে। দূরের পাহাড়গুলো ঢাকা পড়তে থাকে অন্ধকারে, গিরিখাত থেকে উঠে আসতে থাকে কুয়াশা। আর যে উপত্যকায় রুশ দুর্গটি আছে বলে সে ধারণা করছিল সেটি শেষ সূর্যের আলোয় যেন আগুনের মত জ্বলছিল। ঝিলিন তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় অস্পষ্ট ভাবে একটি চিমনি থেকে ধোঁয়ার মত কিছু চোখে পড়ে তার। সে নিশ্চিত হয় যে রুশ দুর্গটি ওখানেই আছে।
অনেক সময় বয়ে যায়। মসজিদ থেকে মোল্লার আযান ভেসে আসে। তাতারদের সন্ধ্যার নামায পড়ার সময় হয়ে গেছে। পশুর পাল নিয়ে রাখালরা আউলে ফিরছে। গরুগুলোর ডাক শোনা যায়। মনিবের ছেলেটি তাকে ডাকে-বাড়ি এসো। কিন্তু ঝিলিন সাড়া দেয় না।
অবশেষে পাহাড় থেকে নেমে আসে ঝিলিন। মনে মনে বলে-ঠিক আছে। পথ জেনে গেছি। এখন পালানোর সময় এসেছে। সে রাতেই পালাবে বলে ঠিক করে সে। কৃষ্ণপক্ষ বলে রাতে অন্ধকার থাকবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার। তাতাররা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসে। অন্যান্য বার তারা আসার সময় পশুর পাল সাথে আনে, আর খুব হৈ চৈ করে। কিন্তু এবার তাদের সাথে কোনো পশুর পাল ছিল না। ছিল একটি লাশ। নিহত লোকটি ছিল লাল দাড়ির ভাই। সবাই ছিল বিষন্ন। তাক কবর দেয়ার জন্য সবাই একসাথে জড়ো হয়। এ সময় ঝিলিন বাইরে এসে ব্যাপারটা দেখতে থাকে। তারা লাশটি লিনেন কাপড়ে জড়িয়ে একটি খাটিয়ায় করে আউলের বাইরে নিয়ে যায়। কয়েকটি গাছের নিচে ঘাসের উপর শুইয়ে রাখা হয় লাশটি। এ সময় মোল্লা ও সেই বুড়ো এসে হাজির হয়। সবাই সার বেঁধে দাঁড়ায় জানাযা পড়ার জন্য। একটু দূরে কবর প্রস্তুত করা ছিল। জানাযা শেষে সবাই ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে লাশ কবরে নামিয়ে মাটি দিয়ে ঢেকে দেয়। এরপর কবরের মাটি সমান করে মাথার দিকে একটি পাথর বসিয়ে দেয়া হয়।
লাল দাড়ি তাতার কিছু টাকা দেয় বুড়ো লোকটিকে। তারপর সে একটি চাবুক নিয়ে নিজের কপালে তিনবার আঘাত করে এবং বাড়ি ফিরে যায়।
পরদিন সকালে ঝিলিন দেখে, লাল দাড়ি একটি মাদি ঘোড়া নিয়ে গ্রামের বাইরে যাচ্ছে। তার সাথে আরো তিন জন। গ্রামের বাইরে গিয়ে সে গায়ের জামা খুলে ফেলে। একটি ছোরা বের করে শানপাথরে ধার করে। তারপর মাদি ঘোড়াটিকে জবাই করা হয়। রাতে সেই মাংস দিয়ে ভোজ দেয়া হয় গ্রামের সবাইকে।
তিনদিন ধরে ভোজ খাওয়ার পাশাপাশি মৃত ব্যক্তির জন্য প্রার্থনা চলে। এ কয়দিন তাতারদের কেউই গ্রামের বাইরে গেল না। চারদিনের দিন সকালে ঝিলিন দেখতে পেল তারা কোথাও যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। ঘোড়া আনা হয়। লাল দাড়িসহ দশজন রওনা হয়ে যায়। তবে তার মনিব গ্রামে রয়ে গেল। সন্ধ্যায় নতুন চাঁদ উঠেছিল। নতুন চাঁদ আকাশে বেশিক্ষণ থাকে না। তাই এখন আঁধার নেমেছে।
আহ্! আজকের রাতই পালানোর সময়- ঝিলিন ভাবে। কস্তিলিনকে তা জানাতেই ভীত হয়ে সে বলে-
: কি ভাবে পালাব? আমরা তো পথ চিনি না।
ঝিলিন বলে-
: আমি চিনি।
: কিন্তু পালাতে পারলেও এক রাতের মধ্যে আমরা রুশ দুর্গে পৌঁছতে পারব না। বলে কস্তিলিন।
: তা না পারলে বনের মধ্যে আশ্রয় নেব। সারাদিন ঘুমিয়ে রাতে আবার রওনা হব। দেখ, আমি এখানে কিছু পনির জমিয়ে রেখেছি। আমরা এখানে বসে বসে আঙুল চুষলে কোনো লাভ হবে? যদি তোমার বাড়ি থেকে মুক্তিপণ পাঠায় তো ভালো। কিন্তু যদি তারা তা যোগাড় করতে না পারে,তখন? তাতাররা এখন খেপে আছে। কারণ রুশরা তাদের এক লোককে হত্যা করেছে। তারা এখন আমাদের হত্যা করার কথা ভাবছে।
কস্তিলিন কিছুক্ষণ চিন্তা করে। তারপর বলে-ঠিক আছে। চল রওনা হই আমরা।
কস্তিলিন সে গর্তে ঢুকে পড়ে। সে যাতে বেরোতে পারে সে জন্য গর্তটাকে আরো বড় করার চেষ্টা করে ঝিলিন। তারপর আউলের সবার ঘুমিয়ে পড়ার জন্য বসে অপেক্ষা করতে থাকে।
চারদিক সুনসান হয়ে আসার পর ঝিলিন গর্ত দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে ফিসফিস করে কস্তিলিনকে বলে- এসো। সে হামাগুড়ি দিয়ে বের হয়ে আসে। এ সময় তার পায়ে একটি পাথর লেগে শব্দ হয়। মনিবের একটি কুকুর ছিল। ভীষণ সতর্ক। কোনো শব্দই তার কান এড়ায় না। কুকুরটির নাম ছিল উলিয়াশিন। শব্দটি কানে যেতেই সে ডাকতে শুরু করে। তার সাথে গলা মেলায় অন্য কুকুররাও। উলিয়াশিনের সাথে ভাব রাখার জন্য মাঝে-মধ্যে তাকে এটা ওটা খেতে দিত ঝিলিন। তাই কুকুরটা তাকে চিনত। ঝিলিন মৃদু শিস দিয়ে তার দিকে একটু পনির ছুঁড়ে দেয়। তাকে চিনতে পেরে চুপ হয়ে যায় উলিয়াশিন।
তবে তার মনিব জেগে উঠেছিল। কুকুরটাকে থামাতে
সে কথা বলে- হেট! হেট! উলিয়াশিন।
ঝিলিন কুকুরটার কানের পিছনে চুলকে দেয়। সে তখন শান্ত হয়ে যায় এবং ঝিলিনের পায়ের সাথে তার গা ঘষতে থাকে আর লেজ নাড়তে থাকে।
আড়াল একটি জায়গায় কিছু সময় চুপচাপ বসে অপেক্ষা করে দু’জন। আবার গভীর নিরবতা নেমে আসে। শুধু একটি গোয়ালের মধ্যে একটি ভেড়া কেশে ওঠে। পাথরের ওপর দিয়ে নদীর পানি বয়ে চলার শব্দ অস্পষ্ট শোনা যায়। আঁধারের মধ্যে আকাশের তারারা অনেক ওপর থেকে আলো ছড়িয়ে চলে। উপত্যকায় দুধের মত সাদা কুয়াশা ছড়িয়ে পড়ছিল।
ঝিলিন উঠে দাঁড়ায়। কস্তিলিনের উদ্দেশ্যে বলে- চল বন্ধু, এগোনো যাক।
কয়েক পা মাত্র এগিয়েছে তারা। এ সময় মসজিদ থেকে রাতের নামাযের (এশা) আযান শোনা যায়। সর্বনাশ!
ভাবে ঝিলিন। এখন লোকজন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নামাজ পড়তে মসজিদে যাবে। একটি দেয়ালের পিছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে তারা। লোকজন না যাওয়া পর্যন্ত বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করে। অবশেষে আবার নিরবতা নেমে আসে চারপাশে।
চলতে শুরু করে তারা। একটি বাড়ির আঙ্গিনা পেরোয়। হাঁটতে থাকে পাহাড়ের দিকে। নদী অতিক্রম করে উপত্যকায় পৌঁছে। মাটির ওপর বরাবর কুয়াশা বেশ ঘন থাকলেও মাথার ওপর আকাশের তারার আলো উজ্জ্বল মনে হচ্ছিল। তারা দেখে চলার পথ নির্ধারণ করে ঝিলিন। ঠান্ডা সত্ত্বেও বেশ ভালো ভাবেই চলতে পারছিল তারা। তবে পায়ের বুটগুলো বেশ অসুবিধার সৃষ্টি করছিল। ঝিলিন তার বুট জোড়া খুলে ফেলে।
তারপর সেগুলো ছুড়ে ফেলে দিয়ে খালি পায়ে পাথরের ওপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটতে থাকে। কস্তিলিন তাকে অনুসরণ করে। বুট পায়ে তার চলতে সমস্যা হচ্ছিল।
: একটু আস্তে চল। আমার বুটগুলো খুব সমস্যা করছে। ভালো করে হাঁটতে পারছি না। কস্তিলিন বলে।
ঝিলিন বলে-
: ওগুলো খুলে ফেল। তাহলে ভালো ভাবে হাঁটতে পারবে।
কিন্তু বুট খুলেও কস্তিলিনের সুবিধা হয় না। পাথরে তার পা কেটে যায়। পিছিয়ে পড়ে সে। ঝিলিন বলে-
: পিছিয়ে পড়লে বিপদে পড়ব আমরা। পা কেটে গেলে সেরে যাবে, কিন্তু তাতারদের হাতে ধরা পড়লে প্রাণে মারবে।
কস্তিলিন জবাব দেয় না, তবে ঝিলিনের পিছন পিছন চলতে থাকে। তার মুখ থেকে যন্ত্রণা-কাতর আওয়াজ শোনা যায়।
দীর্ঘ সময় ধরে তারা উপত্যকার ভিতর দিয়ে চলতে থাকে। ডান দিকে কুকুরের ডাক শোনা যায়। থেমে যায় ঝিলিন। চারদিক তাকিয়ে দেখে। তারপর পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠতে শুরু করে।
: আমরা পথ ভুল করেছি- কস্তিলিনের উদ্দেশ্যে বলে ঝিলিন- বেশি ডান দিকে চলে এসেছি। আমাদের পিছনে ফিরতে হবে, যেতে হবে বাম দিকের ওই পাহাড়ের কাছে। ওখানে অবশ্যই বন আছে।
কিন্তু কস্তিলিন বলে-
: একটু থাম। আমাকে দম নিতে দাও। আমার পা সবখানে কেটে গেছে, রক্ত ঝরছে।
: কিছু মনে কর না। পা সেরে যাবে। তোমাকে এখন দ্রুত চলতে হবে। ঠিক এ রকম।
ঝিলিন পিছন ফিরে বামের পাহাড়ের বনের দিকে দৌড়াতে থাকে। কস্তিলিন এগোয় ধীরে। তার সাথে ঝিলিনের দূরত্ব বেড়ে চলে।
অবশেষে ঝিলিনের কথা মত বনের দেখা মেলে। বনের মধ্যে ঢুকে পড়ে তারা। ঝোপ-ঝাড় ঠেলে এগোতে গিয়ে তাদের জামা-কাপড় ছিঁড়ে যায়। অবশেষে তারা একটি পথ দেখতে পেয়ে সে পথ ধরে চলতে থাকে।
হঠাৎ পথের ওপর খুরের শব্দ শুনে থেমে যায় দুজন। অপেক্ষা করতে থাকে আবার আওয়াজ শোনার জন্য। মনে হল, ঘোড়ার পায়ের শব্দ। কিন্তু আর তা শোনা যায় না। এগোয় তারা। আবার সে শব্দ শোনা যায়। তারা থেমে যেতে খুরের শব্দও থেমে যায়। ঝিলিন হামাগুড়ি দিয়ে শব্দের উৎসের দিকে এগোয়। আবছা অন্ধকারে পথের ওপর কিছু একটা দাঁড়িয়ে আছে বলে তার মনে হয়। তা ঘোড়ার মতও নয়, আবার মানুষের মতও নয়। এ সময় একটি ফোঁসফোঁস ধরনের আওয়াজ শোনা যায়। এটা কি- ভাবে ঝিলিন। সে নিচু স্বরে শিস দিতেই প্রাণীটি রাস্তা থেকে নেমে বনের মধ্যে ঢোকে। পরমুহূর্তে বনের মধ্যে তুমুল আলোড়ন ওঠে যেন ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়েছে আর গাছপালা সব ভেঙ্গে পড়ছে।
কস্তিলিন প্রচন্ড ভয় পেয়ে উপুড় হয়ে মাটির সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করে। ঝিলিন ততক্ষণে ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছে। সে হেসে ফেলে। তারপর কস্তিলিনের উদ্দেশ্যে বলে-একটা মর্দা হরিণ। তুমি কি তার ছড়ানো শিং-এ বেধে ডালপালা ভাঙ্গার শব্দ শোননি? আমরা তাকে দেখে ভয় পেয়েছি, আর সে আমাদের দেখে ভয় পেয়েছে।
তারা আবার চলা শুরু করে। সপ্তর্ষি মন্ডল তখন অস্ত গিয়েছিল। চারদিকে ভোরের আভাস। তারা সঠিক পথে যাচ্ছে কিনা তা বুঝতে পারছিল না। ঝিলিন ভাবল, তাতাররা এ পথেই তাকে নিয়ে এসেছিল।
তাই যদি হয় তাহলে তারা রুশ দুর্গ থেকে এখনো সাত মাইলের মত দূরে আছে। তবে সে নিশ্চিত হতে পারছিল না। কারণ, রাতের বেলা যে কেউই পথ ভুল করতে পারে।
কিছুক্ষণ পর তারা একটি ফাঁকা জায়গায় পৌঁছে। কস্তিলিন মাটিতে বসে পড়ে । বলে-
: ভাই! তোমার যা খুশি কর। আমি আর যাব না। আমার পা দুটো আমাকে আর বহন করতে পারছে না। ঝিলিন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, যে করেই হোক এগোতেই হবে।
: না, আমি কোথাও যাব না। পারব না।
ঝিলিন রেগে যায়। বলে-
: ঠিক আছে, পড়ে থাক তুমি। আমি একাই চললাম। বিদায়।
এক লাফে উঠে দাঁড়ায় কস্তিলিন। অনুসরণ করে ঝিলিনকে। মাইল তিনেকের মত পথ হাঁটে তারা। বনের মধ্যে ঘন কুয়াশার চাদর আরো গাঢ় হয়েছে। এক গজ সামনেও দেখতে পাচ্ছিল না তারা। আকাশের তারার আলোও খুব ক্ষীণ হয়ে এসেছিল।
হঠাৎ তারা সামনে একটি ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পায়। ঝিলিন মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে কান পাতে শব্দ শোনার জন্য। কস্তিলিনের উদ্দেশ্যে বলে-
: একজন অশ্বারোহী আমাদের দিকে আসছে। পথ থেকে সরে আসে তারা। ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে অপেক্ষা করতে থাকে। একটু পর ঝিলিন হামাগুড়ি দিয়ে রাস্তার দিকে এগোয়। দেখে, এক অশ্বারোহী তাতার একটি গরু নিয়ে চলেছে । নিজের মনে গুনগুন করে গান গাইছে সে। তাতার চলে যেতে কস্তিলিনের কাছে ফিরে আসে ঝিলিন। বলে-
: স্রষ্টার দয়ায় বেঁচে গেছি। চল, রওনা হই।
কস্তিলিন উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে পড়ে যায়। কাতর কন্ঠে বলে-
: আমি পারব না। আমার শরীরে কোনো শক্তি নেই।
কস্তিলিন ছিল মোটাতাজা ভারি দেহের লোক। প্রচন্ড ঘেমে গিয়েছিল। তার উপর কুয়াশার ঠান্ডা লেগে ও পা থেকে রক্ত ঝরার ফলে একেবারে নেতিয়ে পড়ে সে। ঝিলিন তাকে টেনে তোলার চেষ্টা করতেই ভীষণ চিৎকার করে ওঠে। ঝিলিন আতংকে জমে যায়। একটু পর বলে-
: তুমি এ ভাবে চিৎকার করলে কেন? তাতারটা তো বেশি দূরে যায়নি। শুনতে পাবে সে।
ঝিলিন ভাবতে থাকে। কস্তিলিন চলতে অক্ষম হয়ে পড়েছে। এখন কি করবে সে? সঙ্গীকে সে ফেলে যাবে কি ভাবে? বলে-
: ঠিক আছে, আমার পিঠে চড়। তুমি হাঁটতে না পারলে তোমাকে বয়ে নিয়ে যাব আমি।
কস্তিলিনকে উঠতে সাহায্য করে সে। এক হাত তার ঘাড়ের নিচে এবং অন্য হাত দু’ উরুর নিচে দিয়ে তাকে রাস্তার ওপর নিয়ে আসে। এরপর তাকে পিঠে বসায়। বলে-
: ঈশ্বরের দোহাই, পিঠের ওপর কোনো রকমে ঝুলে থাক, আমাকে শ্বাস রোধ করে মেরো না।
কস্তিলিনকে খুব ভারি মনে হয় ঝিলিনের। তার নিজেরও পা কেটে গিয়ে অনেক রক্ত ঝরেছিল। তারপর ভীষণ ক্লান্ত। মাঝে-মধ্যে ঝুঁকে পড়ে কস্তিলিনের দেহের ভারসাম্য ঠিক করে নিতে হচ্ছিল, সে নিচে নেমে গেলে ঝাঁকুনি দিয়ে উপর দিকে তুলছিল। তারপর আবার চলছিল।
তাতারটি ঠিকই কস্তিলিনের চিৎকার শুনতে পেয়েছিল। ঝিলিন হঠাৎ টের পায় তার পিছনে কে যেন আসছে আর চিৎকার করে তাতার ভাষায় কি যেন বলছে। সে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যায়। তাতারটি তার বন্দুক তুলে ঝিলিনকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। তবে তাদের কারো গায়েই আঘাত লাগে না। তাতারটি রাস্তা দিয়ে দৌড়ে চলে যায়।
ঝিলিন বলে-
: আমরা শেষ। তাতার শয়তানাটা এখন অন্য তাতারদের জড়ো করবে এবং আমাদের খুঁজে বের করবে। আমরা যদি এখান থেকে আরো দু’ মাইল যেতে না পারি তাহলে বাঁচতে পারব না।
ঝিলিনের মনে হয়, এ অচল বোঝাটা আমি কেন বয়ে নিচ্ছি? সে সাথে না থাকলে আমি এতক্ষণ অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারতাম।
কস্তিলিন বলে-
: তুমি চলে যাও। আমার জন্য কেন ধরা পড়বে?
ঝিলিন জবাব দেয়-
: না, সঙ্গীকে ফেলে আমি যেতে পারি না। কস্তিলিনকে কাঁধে তুলে নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করে ঝিলিন। আধ মাইল বা তার কিছুটা বেশি পথ হাঁটে।
তখনো বনের মধ্যেই ছিল তারা। এর শেষ দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু কুয়াশা কেটে যাচ্ছিল, মেঘ জমছিল, তারাগুলো আর চোখে পড়ছিল না। ঝিলিন ক্লান্ত হয়ে একটি ঝরনার কাছে এসে থামে। সেটার পথের দিকটা দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সে কস্তিলিনকে মাটিতে নামায়। বলে-
: আমাকে একটু বিশ্রাম নিতে হবে। তারপর একটু পনির খেয়ে রওনা হব। দুর্গ বোধ হয় বেশি দূরে নয়। ঝরনা থেকে পানি খাওয়ার জন্য সবে একটু ঝুঁকেছে কস্তিলিন, তখুনি আবার ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনতে পায়। দ্রুত সঙ্গীকে টেনে নিয়ে ডানদিকে ঝোপের মধ্যে ঢোকে ঝিলিন। তারপর ঢালু জায়গায় শুয়ে পড়ে।
তাতারদের গলা শুনতে পায় তারা। তারা যেখানে পথ থেকে নেমে এসেছিল, তাতাররা সেখানে এসে থামে। নিজেদের মধ্যে একটু সময় কথা বলে। তারপর একটি কুকুরকে ছেড়ে দেয় তারা। গন্ধ শুঁকে শুঁকে এগোতে থাকে কুকুরটি। ছোট ডালপালা ভাঙার শব্দ শোনা যায়।
একটু পরই ঝোপের পিছন থেকে অচেনা কুকুরটি বেরিয়ে আসে। ডাকতে থাকে তাদের কাছে এসে । কয়েকজন তাতার নেমে এসে তাদের বেঁধে ফেলে। তারপর তােেদর ঘোড়ায় তুলে নিয়ে রওনা হয় তারা। মাইল দুই পথ আসার পর মনিব আবদুল মুরাদকে দেখতে পায় তারা। তার সাথে আরো দু’জন লোক। আটককারী তাতারদের সাথে কথা বলার পর তাদের দু’জনকে নিয়ে আউলে ফিরে আসে মনিব।
এবার আবদুল একবারও হাসেনি, এমনকি একটি কথাও বলেনি তাদের সাথে।
তখন সকাল হয়ে গিয়েছিল। রাস্তার ওপর বসিয়ে রাখা হয় দু’জনকে। ছোট ছেলেমেয়েদের কেউ কেউ তাদের গায়ে পাথর ছুঁড়তে আর চাবুক মারতে লাগল। অন্যরা মেতে উঠল হৈ-হল্লায় ।
তাতাররা গোল হয়ে বসে পরামর্শ করতে থাকে। তাদের মধ্যে সেই যোদ্ধা বুড়োও ছিল। তাদের আলোচনা থেকে ঝিলিন বুঝতে পারে তাদের নিয়ে কি করা হবে সে পরামর্শই চলছে। কেউ কেউ তাদের পাহাড়ের আরো গভীরে পাঠিয়ে দিতে বলে। তবে বৃদ্ধ বলল, তাদের অবশ্যই হত্যা করা উচিত।
আবদুল তাদের সাথে তর্ক করতে থাকে। সে বলে, আমি তাদের জন্য টাকা ঢেলেছি। অতএব আমাকে মুক্তিপণ আদায় করতেই হবে। কিন্তু বৃদ্ধ বলে, তারা তোমাকে কিছুই দেবে না। রুশদের খাওয়ানো পাপ। তাদের হত্যা কর,এখুনি।
তাতাররা উঠে পড়ে। তারা চলে যাওয়ার পর মনিব ঝিলিনের কাছে আসে। বলে-
: পনেরো দিনের মধ্যে যদি তোমার মুক্তিপণের টাকা না আসে তাহলে তোমাকে রোজ চাবুক পেটা করা হবে। আর ফের যদি পালানোর চেষ্টা কর তাহলে কুকুরের মত গুলি করে মারব। মুক্তিপণের টাকা চেয়ে আবার চিঠি লেখ। ঠিকমত লিখ, কোনো চালাকি কর না।
কাগজ-কলম এনে দেয়া হয়। তারা যার যার চিঠি লেখে। তারপর তাদের পায়ে শিকল পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় মসজিদের পিছনে। সেখানে প্রায় ১২ বর্গফুট আকারের একটি গর্তে দু’জনকে নামিয়ে দেয়া হয়।

৬.
ভীষণ কষ্টে দিন কাটছে দু’ বন্দীর। তাদের শিকল আর খোলা হয়নি। গর্ত থেকেও বের হতে পারেনি তারা। রুটি নয়, ময়দার ডেলা কুকুরের মত ছুঁড়ে দেয়া হয় তাদের দিকে, কলসিতে করে নামিয়ে দেয়া হয় খাবার পানি।
গর্তের ভেতরটা ভেজা ও অপরিসর। ভীষণ দুর্গন্ধ। কস্তিলিন অসুস্থ হয়ে পড়ে, শরীর ফুলে যায় তার। সে সাথে খুব ব্যথা। সারাক্ষণ হয় সে যন্ত্রণায় কাৎরায়, নয় ঘুমায়। ঝিলিনও মনমরা হয়ে পড়ে। দুর্ভাগ্যের কারণে পালাতে পারেনি তারা। নতুন করে পালানোর কোনো পথ সে খুঁজে পায় না।
সে একটি সুড়ঙ্গ খোঁড়ার চেষ্টা করে। কিন্ত খুঁড়ে ফেলা মাটি রাখার জায়গা পায় না। তার মনিব এটা দেখে ফেলে। মেজাজ খারাপ হয়ে যায় তার। ফের এ চেষ্টা করলে তাকে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দেয়।
একদিন গর্তের মেঝেতে বসে মুক্তির কথা ভাবছিল ঝিলিন। অত্যন্ত হতাশা বোধ করে সে। এ সময় তার কোলের ওপর এক টুকরো কেক এসে পড়ে। তারপর আর এক টুকরো। তারপর একগুচ্ছ চেরি ফল। উপরের দিকে তাকাতেই দীনাকে চোখে পড়ে। তাকে দেখে হাসে মেয়েটি, তারপর দৌড়ে পালিয়ে যায়। হঠাই ঝিলিনের মনে ভাবনাটা উঁকি দেয়- আচ্ছা! দীনা কি আমাকে পালাতে সাহায্য করতে পারে না?
সে গর্তের মেঝেতে খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে। কিছু মাটি ভেঙ্গে নেয়। তারপর ভালো করে ছেনে নিয়ে পুতুল তৈরি করতে থাকে। মানুষ, ঘোড়া, কুকুর বানায় সে। ভাবে- দীনা এলেই এগুলো ওপরে ছুড়ে দেবে।
পরদিন দীনা আসে না। ঝিলিন তাতারদের ঘোড়ার খুরের আওয়াজ পেল, কিছু লোক কোথাও গেল বলে বুঝতে পারল সে। বাকি তাতাররা মসজিদের কাছে আলোচনায় বসে। তারা চিৎকার করে কথা বলে ,বাদানুবাদও শোনা যায়। বেশ ক’বার তারা ‘রাশিয়ান’ শব্দটি উচ্চারণ করে। বৃদ্ধ লোকটির কথা শুনতে পায় সে। তারা কি বলছে তা ঝিলিন বুঝতে না পারলেও অনুমান করে যে রুশরা নিকটেই আছে। তারা আউলেও আসতে পারে বলে তাতাররা আশংকা করছে। এখন বন্দীদের নিয়ে কি করবে তা তারা ঠিক করতে পারছে না।
কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে তারা চলে যায়। হঠাৎ একটা শব্দ কানে আসায় ওপরের দিকে তাকায় ঝিলিন। দেখে দীনা একেবারে গর্তের কিনারায় চলে এসেছে। তার হাঁটুগুলো তার মাথার ওপরে, চুলের বেণীর সাথে বাঁধা রুশ রৌপ্য মুদ্রাগুলো গর্তের মেঝের উপর ঝুলছে। চোখগুলো তারার মত জ্বলছিল তার। সে তার হাতার ভেতর থেকে দু’ টুকরো পনির বের করে আনে, তারপর ছুঁড়ে দেয় ঝিলিনের দিকে। ঝিলিন সেগুলো হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করে-
: তুমি কাল আসনি কেন? আমি তোমার জন্য কিছু পুতুল বানিয়ে রেখেছি। এই নাও। বলে এক এক করে সেগুলো তার দিকে ছুঁড়ে দেয়।
দীনা মাথা নাড়ে। পুতুলগুলোর দিকে চেয়েও দেখে না। বলে-
: কোনো পুতুল লাগবে না আমার।
চুপচাপ একটু সময় বসে থাকে সে। তারপর বলে-
: ইভান, তারা তোমাকে হত্যা করতে চায়। হাত দিয়ে নিজের গলা দেখায় সে।
ঝিলিন জিজ্ঞেস করে-
: কে মারতে চায় আমাকে?
দীনা বলে- : বাবা। বুড়ো লোকটি বলেছে তোমাকে হত্যা করতেই হবে। আমি তোমার জন্য দু:খিত।
ঝিলিন বলে- বেশ তো! আমার জন্য দু:খিত হয়ে থাকলে আমাকে একটি বাঁশের লম্বা খুঁটি এনে দাও।
সে প্রবল বেগে মাথা নেড়ে বলে-
: আমি পারব না।
ঝিলিন হাত জোড় করে মিনতি জানায়-
: দীনা! লক্ষী মেয়ে, আমার জন্য এটুকু কর। দয়া কর আমাকে।
: আমি পারব না। বাঁশ আনতে গেলে তারা আমাকে দেখে ফেলবে। সবাই বাড়িতে রয়েছে।
চলে যায় দীনা।
সন্ধ্যা নেমে আসে। ঝিলিন ব্যাকুল চোখে বারবার উপরের দিকে তাকাতে থাকে, কিন্তু দীনা আসে না। তার মনের অস্থিরতা বাড়তে থাকে। রাতের আকাশে তারা জ্বলছিল, তবে চাঁদ তখনো ওঠেনি। মসজিদ থেকে মোল্লার আযান ভেসে আসে। তারপর সব কিছু নিরব হয়ে যায়। ঝিলিন চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে-দীনা কি তাকে সাহায্য করতে ভয় পেয়েছে!
হঠাৎ করে মাথায় কিছুটা মাটি এসে পড়ে। চোখ খুলে তাকায় সে। দেখে, তার সামনের দেয়ালে একটি লম্বা বাঁশ উপর থেকে ঝুলছে। একটু পরই সেটা নিচে নেমে আসে। খুশিতে লাফিয়ে ওঠে ঝিলিন। বাঁশটি হাতে নেয়। ভীষণ মজবুত। সে বুঝতে পারে এ বাঁশটিকেই সে সেদিন তার মনিবের ঘরের ছাদের ওপর দেখেছিল।
উপরে তাকায় ঝিলিন। আকাশে উজ্জ্বল তারার ঝাঁক চোখে পড়ে। তার মাথার খানিক ওপরে গর্তের কিনারায় ঝুঁকে ছিল দীনা। অন্ধকারে তার দিকে তাকিয়ে আছে সে। ফিসফিস করে ডাকে-ইভান! ইভান!
ঝিলিন সাড়া দেয়-
: কি ব্যাপার?
: দু’জন ছাড়া সবাই চলে গেছে।
ঝিলিন কস্তিলিনকে ডাকে-
: শিগগির উঠে পড়। চল আরেকবার চেষ্টা করে দেখি পালানো যায় কিনা। আমি তোমাকে সাহায্য করছি। কিন্তু তার কথায় কস্তিলিন রাজি হয় না। বলে-
: না, আমি যেতে পারব না। নড়তেই পারি না, হাঁটব কিভাবে?
: ঠিক আছে, থাক তাহলে তুমি। বিদায়।
ঝিলিন বাঁশটি ধরে। দীনাকে বলে শক্ত করে চেপে ধরতে। উঠতে শুরু করে সে। পরপর দু’বার সে পিছলে নেমে আসে। পায়ের শিকল বাধা সৃষ্টি করছিল। কস্তিলিন এগিয়ে এসে সাহায্য করে তাকে। অবশেষে ওপরে উঠে আসে ঝিলিন। দীনা তার ছোট দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে জামা ধরে ঝিলিনকে টেনে তোলে।
ঝিলিন বাঁশটি তুলে নিয়ে দীনাকে দেয়। বলে-
: এটা যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দিও। নইলে তারা টের পাবে আর তোমাকে মারবে।
দীনা বাঁশটি হাতে নিয়ে চলে যায়। পাহাড়ের দিকে রওনা হয় ঝিলিন। শিকলের জন্য হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল। কিছুদূর গিয়ে সে একটি ধারালো পাথর হাতে তুলে নেয়। শিকলের তালা ভাঙার চেষ্টা করে। কিন্তু তালাটি ছিল মজবুত। ফলে ভাঙতে ব্যর্থ হয় সে। এ সময় হালকা পায়ে কারো ছুটে আসার শব্দ কানে আসে তার। নিশ্চয়ই দীনা- ভাবে সে । ঠিক তাই।
দীনা এসে একটি পাথর তুলে নেয় । বলে-
: দেখি, আমাকে চেষ্টা করতে দাও।
সে হাঁটু গেড়ে বসে একটি পাথর দিয়ে তালাটি ভাঙার চেষ্টা করে।
কিন্তু তার ক্ষুদ্র দেহের শক্তিতে পেরে ওঠে না। পাথরটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কাঁদতে থাকে সে। তখন ঝিলিন আবার চেষ্টা শুরু করে। আর দীনা পাশে বসে দেখতে থাকে।
ঝিলিন চারদিকে তাকায়। বাম দিকে পাহাড়ের পিছনে আলোর আভাস দেখতে পায়। চাঁদ উঠছে। সর্বনাশ!
চাঁদ ওঠার আগেই তাকে উপত্যকা পেরিয়ে বনের মধ্যে ঢুকে পড়তে হবে। হাতের পাথরটি ছুঁড়ে ফেলে দেয় ঝিলিন। এখন শিকলের বাধা নিয়েই তাকে চলতে হবে। দীনার দিকে ফিরে বলে-
: লক্ষ্মী মেয়ে, বিদায়। তোমাকে কোনোদিন ভুলব না। দীনা তাকে জড়িয়ে ধরে। খানিকটা পনির তার হাতে তুলে দেয়। কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠে ঝিলিনের হৃদয়। বলে-
: ছোট্ট মেয়ে! ধন্যবাদ। আচ্ছা, আমি না থাকলে তোমাকে পুতুল বানিয়ে দেবে কে?
তারপর দীনার মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দেয় সে। দীনা দু’ হাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। পাহাড়ি ছাগলের মত সে দ্রুত পায়ে পাহাড়ের দিকে দৌড়ায়। তার চুলের সাথে বাঁধা মুদ্রাগুলো পিঠের ওপর দুলতে থাকে।
শিকলের তালাটি যাতে শব্দ না করে সে জন্য সেটা হাতে নিয়ে চলতে থাকে ঝিলিন। পা টেনে টেনে হাঁটতে হাঁটতে সে চোখ রাখে পাহাড়ের দিকে। তখনো চাঁদ পাহাড়ের ওপর ওঠেনি। এখন অবশ্য সে পথ চেনে।
সে যদি সোজা হাঁটে তাহলে তাকে প্রায় ছয় মাইল যেতে হবে। ইস! চাঁদ পুরো উঠে আসার আগেই যদি সে বনে পৌছতে পারত! নদী পার হয় সে। পাহাড়ের পিছনে চাঁদ ক্রমেই আলোময় হয়ে উঠছিল। সেদিকে চোখ রেখে সে উপত্যকা পেরোতে থাকে। উপত্যকার
এক দিক ক্রমেই আলোয় হেসে ওঠে। পাহাড়ের নিচে ছায়া ঘন হয়ে এগিয়ে আসছিল ঝিলিনের কাছে। ছায়ার মাঝ দিয়ে সে এগোতে থাকে। সে যত তড়িঘড়ি করছিল চাঁদের আলোও তত উজ্জ্বল হচ্ছিল। ডানদিকের পাহাড় এতক্ষণে পুরো আলোকিত হয়ে ওঠে। যখন সে বনের কাছে পৌঁছে সে সময় বামের পাহাড়ের ওপর উঠে আসে চাঁদ। চারদিক প্রায় দিনের মত আলো হয়ে যায়। সে আলো এত উজ্জ্বল যে গাছের প্রতিটি পাতাও দেখা যায়। আলোয় ভেসে যাওয়া পাহাড়ে গভীর নিরবতা।
প্রাণের কোনো সাড়া নেই। জীবন্ত কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না। শুধু নিচ থেকে নদীর কলধ্বনি ভেসে আসে। কারো চোখে না পড়েই বনের মধ্যে পৌঁছে যায় ঝিলিন। অন্ধকার জায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়ে। বিশ্রাম নিতে হবে। কিছুক্ষণ পর দীনার দেয়া একটুকরো পনির খেয়ে নেয়। তারপর পাশে একটি পাথর দেখে তা দিয়ে আবার শিকলের তালা ভাঙ্গার চেষ্টা করে। কিন্তু তার হাত ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেলেও তালাটি অক্ষতই থেকে যায়। এ অবস্থায়ই পথ ধরে হাঁটতে থাকে সে। এক মাইলের মত হেঁটে ক্লান্ত হয়ে পড়ে ভীষণ, পায়ে ব্যথা শুরু হয়। প্রতি দশ পা হাঁটে আর থামে। কিছু করার নেই- সে ভাবে-যতক্ষণ শক্তি আছে ততক্ষণ শরীরকে টেনে নিয়ে যেতে হবে। একবার বসে পড়লে আর উঠতে পারব না। দুর্গেও আর পৌঁছনো হবে না। সকাল হয়ে গেলে বনের মধ্যে কোথাও লুকিয়ে থেকে দিন পার করে রাতে আবার হাঁটতে হবে।
সারারাত ধরে হাঁটে ঝিলিন। এর মাঝে দু’জন অশ্বারোহী তাতার তাকে অতিক্রম করে। সে দূর থেকেই তাদের আসা টের পেয়েছিল, তাই তারা কাছে আসার আগেই আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।

৭.
চাঁদ পান্ডুর হয়ে আসে, ঝরতে থাকে শিশির। ভোর হয়ে আসছে। ঝিলিন তখনো বন পেরোতে পারে নি। সে ভাবে-আর তিরিশ পা হাঁটব। তারপর ঘন ঘাছপালার মধ্যে বসে বিশ্রাম নেব।
আরো তিরিশ পা হাঁটার পর সে পৌঁছে বনের শেষে।
তখন বেশ আলো হয়ে এসেছে চারদিক। সেখানে দাঁড়িয়ে সে দেখে , তার সামনে সমভূমি, তার ওপারে রুশ দুর্গ। বামদিকে পাহাড়ের ঢালের পাদদেশে প্রায় নিভে আসা আগুন চোখে পড়ে। তা থেকে তখনো ধোঁয়া উঠে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। আগুনের চারপাশ ঘিরে ছিল কিছু মানুষ।
সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। তাদের সাথের চকচকে অস্ত্রগুলো চোখে পড়ে। কসাক সৈন্য তারা।
খুশিতে লাফিয়ে ওঠে ঝিলিন। সে শরীরের সকল শক্তি একত্র করে পাহাড়ের নিচের দিকে নামতে থাকে। মনে মনে প্রার্থনা করে- হে স্রষ্টা! কোনো তাতার যেন এখন আমাকে না দেখে ফেলে। তাহলে এত কাছে এসেও আমি তাদের কাছে পৌঁছতে পারব না।
এ কথা ভাবা শেষ হতে না হতেই বামদিকে পাহাড়ের ওপর তিন তাতার অশ্বারোহীকে দেখতে পায় সে। তাতাররাও দেখে ফেলেছে তাকে। তারা তার দিকে ছুটে আসতে থাকে। সর্বনাশ! ভয়ে ঝিলিনের প্রাণ উড়ে যাবার মত অবস্থা হয়। কসাক সৈন্যদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়তে নাড়তে গলার সব শক্তি জড়ো করে চিৎকার করে সে ডাকে-ভাইয়েরা! ভাইয়েরা! আমাকে সাহায্য কর তোমরা।
কসাকরা তার ডাক শুনতে পায়। তাদের মাঝ থেকে কয়েকজন অশ্বারোহী তাতারদের পথ আটকাতে ছুটে আসে। তবে কসাকরা ছিল দূরে, আর তাতাররা ছিল কাছে। ঝিলিন একটা শেষ চেষ্টা করে। কি করছে না বুঝেই সে তার শিকল উঁচু করে ধরে কসাকদের দিকে দৌড় দেয় প্রাণপণে। আর চিৎকার করে ডাকতে থাকে- ভাইয়েরা! ভাইয়েরা!
কসাকরা সংখ্যায় ছিল পনেরো জন। তাদের দেখে ভয় পেয়ে আর এগোয় না তাতাররা। ঝিলিন কসাকদের কাছে পৌঁছে। তারা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে তাকে। নানা প্রশ্ন করে চলে- কে তুমি? কি কর? কোথা থেকে আসছ?
কিন্তু ঝিলিন কথা বলবে কি, সে শুধু কাঁদে আর বলে – ভাইয়েরা! ভাইয়েরা!
সৈন্যদের একজন তাকে একটি রুটি খেতে দেয়, একজন খেতে দেয় বাজরা, একজন দেয় বলকারক পানীয়, অন্য একজন তার গায়ে জড়িয়ে দেয় একটি কম্বল। আরেকজন তার শিকলের তালা খোলার কাজে লেগে পড়ে।
অফিসাররা তাকে চিনতে পারে। এ তো অফিসার ঝিলিন! তারা দুর্গে নিয়ে যায় তাকে। সৈন্যরা খুশি হয় ঝিলিনকে দেখে, তার চারপাশে ভিড় জমায় সহকর্মী অফিসাররা ।
খানিকটা ঠিকঠাক হয়ে ঝিলিন ধীরে ধীরে তাদের সব কাছে সব ঘটনা বর্ণনা করে। তারপর বলে-
: এই হল আমার বাড়ি যাওয়া আর বিয়ে করা, বুঝলে ভাইয়েরা! সোজা কথা, আমার ভাগ্যে ওসব নেই।
ককেশাসের সেনাদলে আবার কাজ শুরু করে সে।
ওদিকে এক মাস পর মুক্তিপণ পরিশোধ করে ছাড়া পায় কস্তিলিন। তাকে যখন নিয়ে আসা হয় তখন খুবই শোচনীয় অবস্থা তার।

Share.

মন্তব্য করুন