(গত সংখ্যার পর)

ক্ষুধাটা এতো তীব্র কোনো কিছু খেয়াল করার মতো চেতনাও নেই ওর। গোগ্রাসে গিলছে ও। যেনো পেটের ভেতর হাঁ হয়ে আছে ক্ষুধার হাঙর। দুটি লোক কোনো কথাই বললো না ওর সাথে। প্রায় রোবটের মতো চেয়ে আছে ওর দিকে। খাবার শেষ হতেই নেমে এলো নেতা গোছের লোকটি।
বললো- পেট পুরেছে তো? দানবের মতো খেলে মনে হলো। মনে মনে হেসে ফেললো সম্রাট। সত্যিতো দানবের মতোই খেয়েছে গপাগপ। খেয়ে ভালো লাগছে বেশ। লোকটি আবার বললো- এখানে থাকো খাও আনন্দের সাথে। তুমি আমাদের অতিথি। এভাবে কেটে গেলো তিনদিন। তিনদিন পর এলো লোকটি ফের। বললো- চলো তোমাকে আমার সাম্রাজ্য দেখিয়ে আনি। একটি কথা শুধু মনে রেখো- কোনো চালাকি করার চেষ্টা করবে না। আমি এক হুকুম দুবার করি না। সুবোধ ছেলের মতো যাবে। দেখবে। তারপর ফিরবে কক্ষে। এসো বলেই লোকটি মই বেয়ে ওপরে উঠতে শুর করলো। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পেছনে ছুটলো সম্রাট। ওর পেছনে বাকি দু’জন। মই বেয়ে উপরে উঠেই চোখ ছানাবড়া সম্রাটের। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না ও। বিশাল সাম্রাজ্য। আলো ঝলমল চারিদিক। আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেডিয়ামের মতো। চারিদিকে মানুষ বন্দির নানা আয়োজন। কোথাও মানুষকে ঝুলিয়ে রেখে শাস্তি দিচ্ছে। কোথাও চোখ হাত বাঁধা উপুড় করে রাখা মানুষ। আবার কোথাও কাচের দেয়াল ঘেরা মানুষ। এভাবে নানা রকম মানুষের পরিণতি দেখে ভেতরে ঘৃণা ফুঁসে উঠছে সম্রাটের।
ভয়ংকর হাসি ছড়িয়ে লোকটি বললো- তোমার সাম্রাজ্য নেই অথচ নামে তুমি সম্রাট। কিন্তু আমার নামে সম্রাট নেই বটে কিন্তু দেখো আমার কি বিশাল সাম্রাজ্য। বলে পিচাসের মতো হাসলো আরেকবার। সম্রাটের ইচ্ছে করছে ঘুষি মেরে লোকটির সব কয়টি দাঁত ভেঙে দিতে। কিন্তু সামলালো নিজেকে। এখনি প্রতিক্রিয়া নয়। দেখি কি আছে ললাটে। আহা চতুর্দিকে বেদলাক্লিষ্ট মানুষের আহাজারি- চিৎকার। এমন করে নির্যাতন করে মানুষকে মানুষ। বেদনায় ভারি হয় সম্রাটের বুক। ঘুরে দেখতে দেখতে ওর চোখ আর সইতে পারছে না। ও বিস্ময়ের সাথে দেখলো- যে সব লোক গুম হয়েছে অথবা যাদের অনেক দিন ধরে পাওয়া যাচ্ছে না তাদের প্রায় সকলেই এখানে এই অবাক পাতাল জেলে বন্দি। কারো সন্তান। কারো পিতা। কারো ভাই। কারো আত্মীয় স্বজন। আহারে হাহাকার। মানুষের এমন দুর্দশা! মানুষের প্রতি মানুষের এমন অবিচার অত্যাচার সহ্য করা যায় না। সম্রাটের ভেতরটা ভেঙে যাচ্ছে। হু হু করে কেঁদে উঠছে মন। এত বীভৎসতা সহ্য করা কঠিন। দাঁতে দাঁত চেপে দেখছে সম্রাট। মনে মনে খুঁজে এসব মানুষের মুক্তির পথ। সিদ্ধান্ত দৃঢ় হয়ে ওঠে- এসব মানুষ মুক্ত করবেই। নেতা লোকটি যেনো জ্যোতিষী। সম্রাটের দিকে ফিরে উপহাসের হাসি হাসলো। বললো- এদের মুক্তির উপায় খুঁজছো? হা হা হা..। আমার সাম্রাজ্যে একবার যে ঢুকে পড়ে তার আর মুক্তি নেই। কেবল মৃত্যুই তাকে মুক্তি দিতে পারে। সম্রাট খানিকটা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো- মৃত্যুর বাইরে কেউ নয়। মৃত্যু সবাইকে ছুটি দিয়ে দেয়। ইঙ্গিতটা প্রথম বুঝতে পারেনি লোকটি। বুঝতে পেরে বিকৃত হাসি। বললো- আমাকে ভয় দেখালে? মৃত্যুর? হাহ্ মৃত্যু আমার পকেটে ঘুমায়। মৃত্যুর ভয় দেখাস আমাকে? তোর সাহসতো সত্যিই প্রশংসা করার মতো! এই অপরাধের শাস্তি তো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যুর স্বাদ দেখিয়ে দেয়া। কিন্তু তোকে আমার দরকার। আমার আরেকটি সাম্রাজ্য আছে। এর
পাশেই। ওই যে পথ ও পথেই। যেখানে মুক্তির জন্য হাহাকার করছে তোর ওমর জামিল। ওমর জামিল নামটি শুনেই একটি শীতল স্রোত বয়ে গেলো সম্রাটের সারা দেহে। তাহলে এখানে নেই জামিল। এবং এই বদমাইশ লোকটিই তার কিডন্যাপার? লোকটির ভয়ঙ্কর রূপ মুহূর্তের জন্য ভুলে গেলো সম্রাট। বললো- ওমর জামিলকে কেন এনেছো? কি অপরাধ তার?
হা হা হা…। লোকটি উপহাস করে হাসতে পারে এতোটা! তার প্রতিটি হাসির ভেতর ভয়ঙ্কর জিঘাংসা হো হো করে ওঠে। হাসিটি স্রেফ পিশাচের হাসির মতো শোনায়।
বিকৃত কণ্ঠে বললো- ওমর জামিলের জন্য খুব মন কাঁদে না? হা হা হা। তোমার মনটি এমন বানিয়ে দেবো আমি- আর কারো জন্য কাঁদবে না মন। জানতে চাইলে কেনো এনেছি ওমর জামিলকে? কেনো আনবো না বলো? ও যে মনের গোপন কথা ধরে ফেলার যন্ত্র আবিষ্কার করে ফেলেছে। মনের সমস্ত গোপন কথাই যদি যন্ত্র বলে দেয় আমাদের কি হবে? আদালতে আমরা দাঁড়াতেই পারব না। আমাদের বিচারপতিদেরও অসুবিধা। তারা প্রভাবশালীদের কোনো অনুকম্পা গ্রহণ করতে পারবে না। কোনো অপরাধী পার পাবে না তখন। সাক্ষী প্রমাণের দরকার হবে না। এমনকি কোনো উকিল ব্যারিস্টারেরও প্রয়োজন শেষ হয়ে যাবে। এ তো হতে পারে না মি. সম্রাট। এখন ক্ষমতা আর সম্পদ মিথ্যা ছাড়া অর্জন করা যায় না। আমার গোটা সাম্রাজ্য দাঁড়িয়ে আছে মিথ্যার ওপর। আমাকে প্রায়ই আদালতে যেতে হয়। হাজির হতে হয় বিচারপতিদের সামনে। রায় আমার পক্ষেই হয়। যদি কোনো বিচারপতি সত্যের বুলি আওড়ায় তাকে কেবল একবার ঘুরিয়ে নেই আমার এই সাম্রাজ্য থেকে। এবং দেখিয়ে দেই তার বাসস্থান। ব্যাস আর কিছু বলার প্রয়োজন পড়ে না। রায় আমাদের পক্ষেই ঘোষণা হয়। মিথ্যার সাম্রাজ্য একদিন আপনাতেই ভেঙে পড়ে বললো সম্রাট।
হা হা হা। আরে তুমিতো দেখছি দার্শনিকও বটে! কিন্তু দারুণ বোকা। আরে আমার সাম্রাজ্য ভাঙার আগে সবারটা ভেঙে দেবো আমি। তছনছ করে দিবো তথাকথিত সত্যের প্রাসাদ। রাজনৈতিক নেতা খুন পুলিশ পালিশ যা-ই বলো এরা আমার বুক পকেটের কীট। জগতে টাকা আর ক্ষমতাই সত্য হে বোকা সম্রাট। অকারণ সত্য সত্য বলে জীবন খোয়াচ্ছো তুমি। আমার অনুগত হয়ে যাও। সত্যিই তোমাকে রাজ্যের সম্রাট বানিয়ে দেবো।
রাগে ক্ষোভে মন জ্বালা করছে সম্রাটের। ইচ্ছে করছে থুু ছিটিয়ে ভরে দিতে লোকটির মুখ। কিন্তু অধৈর্য হওয়া চলবে না। তবুও মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো কথাটি- তোমার এ সাম্রাজ্য তুচ্ছ আমার কাছে। সঙ্গে সঙ্গে লোকটি প্রচণ্ড এক থাপ্পড় দিলো সম্রাটের গালে। থাপ্পড়ের প্রচণ্ডতায় বিকৃত হয়ে উঠলো মুখ। ব্যথার তীব্রতা ছড়িয়ে পড়লো সারা দেহে। এতো প্রচণ্ড শক্তি লোকটির হাতে। বিস্মিত সম্রাট। হাত নয় যেনো ইস্পাতের কোনো ব্যাট। আর একটু হলে চোয়াল খুলে যেতো মুখ থেকে। ফুঁসছে লোকটি। বললো- আমার মুখের ওপর কথা বলে জগতের কোনো মুখ পৃথিবীর আলোয় ছিল না। কিন্তু তোকে আমার দরকার। তাই এই মৃধু শাস্তি।
এই ভয়ঙ্কর থাপ্পড় সম্রাট খায়নি জীবনে। সম্রাট বুঝে নিলো- কথা বলা যাবে না এ বদমাশটির সাথে। একে এর অনুগত হয়েই করতে হবে জব্দ। সম্রাটের দু’পাশে সে রোবট মানুষ। এ যাবৎ মুখ খোলেনি এদের কেউ। কোনো কথাই না। কী আশ্চর্য প্রশিক্ষণ। ইঙ্গিত ইশারাই যথেষ্ট। কত লোককে এমন রোবট বানিয়ে তুলেছে কে জানে। হঠাৎ লোকটি বললো- আজ আর না। ওকে নিয়ে যাও ওর বাসস্থানে। একাকীই থাকতে দাও। টের পাক জীবনের মজা। নইলে সোজা হবে না এই বোকা সাহসীটা। লোকটি আর ফেরলো না সম্রাটের সাথে। দুই রোবট মানুষ বাতাসের মতো টেনে হিঁচড়ে মুহূর্তে নিয়ে এলো সেই ঘরটিতে যেখানে ওকে রাখা হয়েছিলো। ওকে ঘরে রেখেই দুজনই উধাও। ওরা মই বেয়ে ওঠার সাথে সাথে ছলাৎ বন্ধ হয়ে গেলো ছাদটি। নিচু হয়ে গেলো ছাদ। হঠাৎ যেনো দম আটকে যাচ্ছে সম্রাটের। কক্ষটিতে যেনো ওর নিঃশ্বাসের জায়গা হচ্ছে না। দম যেনো আটকে যাচ্ছে চার দেয়ালের বেড়ায়। একরাশ হতাশ দলা পাকিয়ে উঠলো বুকের ভেতর। যেনো স্বপ্ন মরে যাচ্ছে এই কক্ষের চার দেয়ালে। লেপটে বসে পড়লো মেঝে ঝিমঝিম করছে গোটা মাথা। ভীষণ ভারী বুক। শরীরে কোনো শক্তিই যেনো অবশিষ্ট রইলো না। থাপ্পড়টি এখনো যেনো চেপে আছে গালের ওপর। মাথার পিছনে যন্ত্রণাও জাগিয়ে উঠলো হঠাৎ। মুখে ব্যথা মাথা ব্যথা আর মনের ব্যথা একদম একাকার। শুয়ে পড়লো মেঝের ওপর। ঠিক তখনি চলে গেলো কক্ষের আলো। অন্ধকার নামতেই যেনো খানিকটা ভালো লাগলো ওর। এই মুহূর্তে অন্ধকারই যেনো ছিলো কাম্য। অন্ধকারে ছোট রুম বড় হয়ে উঠলো। তা ছাড়া মানুষের ভেতর জগতের সাথে একীভূত হওয়া যায়। মানুষের ভেতর তো অন্ধকারই বসত করে।
হঠাৎ ওর মনে হলো- ও কি পরাজিত হয়ে যাচ্ছে জীবনের কাছে? কেন? পরাজয় বরণ করার জন্যতো জন্ম হয়নি ওর! ওর বাবা ওর নাম রেখেছে সম্রাট। ওমর পৃথিবীর ইতিহাসে এক সাহসী নাম। একজন বিরাট বীর। এবং একজন নীতিবান শাসক। তার নামের সাথে মিলিয়েই ওমর সম্রাট রাখা। অদম্য সাহস বুকে পুরে দিয়েছে তার বাবাই। তবে কেন সাহসহীন হচ্ছে? কেন ভাবছে পরাজয়ের কথা। শোয়া থেকে হঠাৎ বসে পড়লো ও। আকস্মিক যেনো ভেতর থেকে ভয় উধাও। যেনো সাহসের রশ্মি সূর্যের মতো জ্বলজ্বল বুকের ভেতর। মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো হাত। বুকে জন্ম নিলো জয়ের পিপাসা। এ সমস্ত নরপিশাচ নৃশংসদের হাত থেকে জগৎকে বাঁচাতে হবে। বাঁচাতে হবে নিরীহ অসহায় মানুষকে। বাঁচাতে হবে ওমর জামিলকে।
দিন না রাত এখন এ কথা বোঝার উপায় নেই তার। তবে মনে হচ্ছে এখন দিনই হবে। কিন্তু বেশ ঘুম পাচ্ছে ওর। আবার শুয়ে পড়লো মেঝে। শুয়ে আরাম লাগছে কিছুটা। চোখ বন্ধ করলো ও। কিছুক্ষণ। তারপর চোখ জুড়ে নেমে এলো রাজ্যের ঘুম। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে জানে না। যখন ঘুম ভাঙলো, দেখে আলো ঝলমল কক্ষ। কয়েক প্রকার খাবার সাজানো মেঝেতে। ঝাল মিষ্টি এবং ফল মিলিয়ে সাজিয়ে রাখা। কিন্তু কেউ নেই। ঘুমিয়ে ফ্রেশ লাগছে বেশ। ক্ষুধাও লাগছে খুব।
খাবারের প্লেট টেনে খেতে শুরু করলো। দারুণ মজা লাগছে। গোগ্রাসে গিলছে ও। খেতে খেতে ভাবছে যা-ই হোক ওর সাথে লোকটি ভালো ব্যবহার করেছে। বশ মানানোর এটা এক কৌশল। কিন্তু ও কি বশ মানবে কখনো! জবাবে বিদ্রোহী হযে ওঠে মন- না কক্ষনো নয়। জীবনতো একটাই। অন্যায় অবিচারে যদি ডুবে যায় মন, তবে কি অর্থ জীবনের? এমন অবিচারী অত্যাচারী লোকের কাছে নতি স্বীকার করার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু কৌশল নিতে হবে। ভান করার দরকার আছে। দেখাতে হবে আমি তার আনুগামী। নইলে এ পাতালপুরী থেকে বের হবার কোনো পথ মিলবে না। কিন্তু কে এই লোকটি। মুখোশ পরে কেনো। প্রশ্ন জাগে সম্রাটের। অনেক কিছু খেয়ে ফেললো ও। খেতে সুস্বাদু মনে হওয়ায় খেলো অনেক। ঘুমিয়ে খেয়ে শরীরটা বেশ চাঙ্গা মনে হচ্ছে।

পাঁচ.
লোকটির সামনে বসা সম্রাট। কক্ষটি তার বাসা না অফিস ঠাওর করতে পারলো না ও। হঠাৎ দেখে মনে হবে বাসা। কিন্তু আসবাব সাজানো দেখে মনে হয় অফিস। অথবা হতে পারে অফিস কাম বাসা। ভেতরের অংশ বাসা। সামনে অফিস। একটি চেয়ারে বসা সম্রাট। লোকটির উল্টো দিকে। মাঝখানে একটি টেবিল। টেবিলে একটি লাটিম আর একটি গোলাকার বিশ্ব মানচিত্র। লোকটির চেয়ারটিও অসাধারণ। মোগল রাজাদের মতো চেয়ারের উচ্চতা। স্বর্ণ খচিত কারূকাজ। আয়েশি ভঙ্গিতে হেলান দিয়ে বসা। দুপাশে দুজন প্রহরী। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত তারা। দেখে মনে হয় দু’জনই দুশজনকে ঠেকিয়ে দিতে যথেষ্ট। দু’জনের চেহারা ভয়ংকর। দু’জনই টগবগে যুবক। কিন্তু দুজনের চোখ ভীষণ ঠাণ্ডা। এবং বাজপাখির মতো ধারালো। দেখে মনে হয় মনের গভীরে ঢুকে পড়ে দৃষ্টি। লাটিমটি হাতে তুলে খেলছে লোকটি। খেলতে খেলতে বললো- আচ্ছা সম্রাট বলতো কেউ যদি সুখের জীবন পায় সে কি কষ্টের জীবন বেছে নেয়?
সম্রাটের দিকে না তাকিয়েই প্রশ্নটি করলো। লাটিমের দিকেই চোখ রেখে খেলছে লোকটি। কোনো জবাব দিলো না সম্রাট। আসলে জবাব চেয়েছে বলে মনে হলো না ওর। তুমি লাটিম দিয়ে খেলেছো কখনো? বললো লোকটি। লোকটির দিকে ফ্যাল ফ্যাল চেয়ে আছে সম্রাট। ভাবছে মুখোশ পরে থাকে কেনো লোকটি!
লাটিম ঘোরাতে ঘোরাতে বললো- আমার মুখোশ নিয়ে অনেক ভাবনা তোমার? চমকে উঠলো সম্রাট। লোকটি মনের কথা কিভাবে ধরে ফেলে! দেখো তবে আমাকে! বলেই বামহাতে টেনে নিলো মুখোশটি। চেহারাটি দেখে বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেলো সম্রাট। এযে বিখ্যাত রাজনীতিক সমাজসেবক দানশীল আলহাজ্জ ডাবলু খান। তারই এলাকার বিরাট নেতা। সবার ডাবলু ভাই মাস্তানদের নেতা! মানুষ ধরে এনে আটকে রাখার কারখানা ইনিই বানালেন তবে! এই কারখানার ভয়ংকর শাস্তির আবিষ্কারকও এই ডাবলু খান। নিজের চোখকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না সম্রাট। রাজ্যের প্রশ্ন ওর মনে। সমাজে ভদ্রবেশী লোক অথচ ভেতরে একটা জঘন্য পিশাচ। আহা ভাবা যায় না।
খুব ঠাণ্ডা গলায় বললো- কী চমকে গেলে খুব! আরে চমকানোর কি আছে। তুমিতো আমারই এলাকার ছেলে। ছোটকাল থেকেই তো দেখেছি তোমাকে। তোমার বাপের সাথে যদিও আমার সম্পর্ক ছিলো না। না থাকার কারণ কিন্তু উনিই। আমার কার্যক্রমে কখনো সমর্থন দেননি তোমার। কোনো কাজেই যদি সমর্থন না দেন তবে সম্পর্ক কি করে ভালো থাকে! কোনো কথা নেই সম্রাটের মুখে। মনের ভেতর তার বাবার শান্ত শিষ্ট চেহারাটি ভেসে উঠলো। বাবার চেহারা
এতো মায়াবী এতো সুন্দর। লোকেরা তাকিয়ে দেখে বারবার।
সে বাবা আমার। একদিন হঠাৎ গায়েব হয়ে গেলো। আজ ছয় মাস। কোনো খবর কেউ দিতে পারলো না। দুচোখে দুফোঁটা অশ্রু চিকচিক করে উঠলো সম্রাটের।
এই নিয়ে কোনো কথা বললো না ডাবলু খান। দূরে দাঁড়ানো দু’জন পাহারাদারকে কি যেনো ইশারা দিলো। ইশারা পেয়ে চলে গেলো ভেতরের দিকে। অল্পক্ষণ। তারপর দুদিক থেকে দু’হাত ধরে একজন লোককে নিয়ে প্রবেশ করলো ওরা।
লোকটিকে দেখে ছানাবড়া চোখ সম্রাটের। বাবা বলে তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেলো সম্রাট। দৌড়ে গিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো। বললো- বাবা তোমাকেও এই লোকটি নিয়ে এলো এখানে! আজ ছয়মাস এখানেই তুমি বাবা! ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে রইলো সম্রাটের বাবা। মুখে কোনো কথা নেই। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। মনে হলো অনুভূতিহীন একজন মানুষ। সম্রাটের বুকটা ভেঙে যাচ্ছে বেদনায়। দুঃখ শোকে পাথর হয়ে গেছে তার বাবা।
হো হো করে হাসলো ডাবলু খান। বললো বাবাকে ছাড়ো। বিপরীত দিকটা দেখিয়ে বললো- ওদিকে দেখো। দেখলো সম্রাট- ভূত দেখার মতো ভিরমি খেয়ে উঠলো। তার স্নেহের ছোট ভাইটি। পেছন দিকে হাত বাঁধা। মুখটি ভীষণ রকম শুকনো। বেদনায় নীল হয়ে আছে মুখটি। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সম্রাট। কেঁদে কেঁদে বললো- আমাদের পরিবারটি তছনছ করছেন কেন? কি অপরাধ আমার বাবার। আমার নিষ্পাপ ভাইটিকে কেন ধরে এনেছেন? আরে থামো থামো। এত অস্থির হচ্ছো কেন হে সম্রাট। তোমার বাবাতো ছয়মাস ধরে এখানে। তোমার ভাইটিকে মাত্র গতকাল আনা হলো। তোমার নিশ্চয়তা পেলে দুজনকেই ছেড়ে দেবো আমি। হ্যাঁ এতে কোনো ভুল নেই। দু’জনকেই ছেড়ে দেবো। সসম্মানে পৌঁছে দেয়া হবে বাড়িতে। শুধু তুমি যদি আমাদের হয়ে ওঠো। জীবনে আর কিছুই করা লাগবে না তোমাদের। আয়েশি জীবন যাপন করবে তোমার পরিবার।
চিৎকার করে বললো সম্রাট- এতো কিছু বুঝি না। আমি রইলাম এখানে। আমার বাবা ভাইকে পৌঁছে দিন বাড়িতে। আমার মায়ের অবস্থা হয়তো সঙ্গিন। তার স্বামী পুত্র কেউ নেই কাছে। কোথায় আছে জানে না সে কথাও।
হা হা হা এই তো সুবোধ ছেলে। বুদ্ধিমান। এক্ষনি পাঠিয়ে দিচ্ছি তোমার বাবা ভাইকে। বড় তাজিমের সাথেই পাঠাবো। কোনো চিন্তা করতে হবে না তোমার। বলেই ফিরলো এক পোশাকধারীর দিকে। বললো- এদের যত্নের সাথে পৌঁছে দাও বাড়ি। কোনো কষ্ট যেনো না হয়। সম্রাটের বাবা ভাইকে বললো- আপনাদের সব অসুবিধা দূর করে দেবো আমি।
কোনো অভাব অনটন থাকবে না। শুধু একটি শর্ত মান্য করতে হবে- আমার এ সাম্রাজ্যের খবর কাউকে জানান দেয়া যাবে না। কাউকে না। যদি একথার বিপরীত কিছ হয় তবে কাউকে আস্থ রাখবো না আমি। পৃথিবীর বাতাসে শ্বাস নেয়ার কোনো সুযোগ আমি দেবো না। হ্যাঁ মনে রাখতে হবে আমি এক কথা দুবার বলি না। পোশাকধারীকে বললো- যাও নিয়ে যাও ওদের। পৌঁছে দাও বাড়িতে।
সম্রাটের দু’পাশের পাহারাদার দুজনকে বললো- নিয়ে যাও একেও। এর জন্য নির্ধারিত কক্ষে। আশা করি ও আমাদের অমতে যাবে না। দু’জন সম্রাটকে চলার ইশার দিলো। চলতে শুরু করলো সম্রাট। ভাবলো- এদের ভেতর বাহির জানতে হবে আমাকে। চলতে চলতে জিজ্ঞাসা করলো সম্রাট- আচ্ছা তোমাদের কথা বলা নিষেধ? কোনো কথাই বলো না মুখে! দু’জনের কেউ কোনো জবাব দিলো না। কোনো রকম প্রতিক্রিয়াও নেই। মনে হয় ওরা শুনতে পায়নি সম্রাটের কথা। বুঝলো ও। যা ভেবেছে তাই। কথা না বলাই এদের প্রশিক্ষণ।

ছয়.
সম্রাটের কক্ষটি বেশ আরামদায়ক। বেশ কদিন কেটে গেলো আয়েশে। কেবল নানা রঙের খাওয়া দাওয়া আর ডাবলু খানের সাথে পাতাল সাম্রাজ্য ঘুরে বেড়ানো। ডাবলু খানের সৈনিক যারা সবাই বুঝে গেছে ডাবলু খান প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করছে সম্রাটকে। সম্রাটের হাব ভাবও তেমনি। ডাবলু খান ছাড়া কাউকে পরোয়া করছে না ও। নিজের মতো চলা। নিজের মতো বলা। এবং নিজের মতোই সবকিছু করছে সে। তাকে ঘাঁটানোর অথবা উপদেশ দেয়ার ডাবলু খান ছাড়া কেউ রইলো না। সম্রাট এ কথা খুব করে বুঝে গেছে ডাবলু খানের আস্থা অর্জন না করা গেলে এ পাতাল রাজ্য থেকে বের হবার কোনো সুযোগ নেই।
এতদিনে বেশ বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছে সম্রাট। কিন্তু একা চলার সুযোগ থাকছে না মোটেই। কিংবা দিচ্ছে না। তবে ডাবলু খানের সাম্রাজ্যের কোথায় কি তার নাড়ি নক্ষত্র এখন নখদর্পণে সম্রাটের। একটি জিনিস বারবার লক্ষ্য করছে সম্রাট- যে সৈনিকগুলো মানুষকে শাস্তি দেয়ার কাজে নিয়োজিত এদের প্রায় সকলেরই মন খারাপ থাকে। নিরপরাধ মানুষের ওপর কঠিন শাস্তি নিয়োগ করা হয়তো বেশ কষ্টকর। যখন ওদের কাছে গেছে সম্রাট দেখেছে ওদের চোখে মুখে অন্যরকম ভাষা। বাকি সমস্ত পাহারাদারদের সাথে এদের কোনো মিল নেই। কি যেনো বলতে চাই এরা সম্রাটকে। কিন্তু একা হওয়ার কোনো সুযোগ সম্রাটের নেই। কিন্তু সম্রাট এদের মনোভাব ঠিকই বুঝে। ডাবলু খানের সাম্রাজ্য জয়ে এরাই হতে পারে তার সঙ্গী। যেভাবেই হোক ওকে পৌঁছাতে হবে এদের কাছে।

সাত.
পরিকল্পনা পাকা। আজ রাত ১ টায় অপারেশন। গত রাতে ছায়ামানব বলে গেলো বেশ সংখ্যক প্রহরী সম্রাটের সঙ্গে একাকার। সম্রাটসহ দশজনের একটি অপারেশন গ্রুপ প্রস্তুত। সারাদিন সম্রাট রুম থেকে বের হয়নি কোথাও। শুধু সন্ধ্যায় ডাবলু খানের সাক্ষাৎ চাইলো ও। ডাবলু খান সানন্দে ওকে আমন্ত্রণ জানালো তার ভবনে। অনেকবার এই ভবনে এসেছে সম্রাট। আজ বিশেষ কারণে আসা। খুব সূক্ষ্মভাবে দেখার লক্ষ তার। তিন স্তরের নিরাপত্তা এখানে। মূল গেটের আগে আছে একটি গেট। এ গেটে জনা দশেক নিরাপত্তাকর্মী। এরপর মূল গেট। এখানে দশ থেকে বারোজনের একটি টিম। সবশেষে বাসভবনের দরোজা। এখানে পাঁচজন প্রহরী। এ পাঁচজন হলো সেরা সৈনিক ডাবলু খানের।
অবশিষ্ট যে কয়জন তারাও অন্যদের তুলনায় বাছাইকৃত। এদের প্রত্যেকের চোখ বাজপাখির মতো। হায়েনার মতো ক্ষীপ্র। শুধু সন্দেহ হলেই আক্রমণ করতে মুহূর্তও সময় নেবে না। চোখের পলকেই ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকারের ওপর। এদের পোশাক আশাক অস্ত্রশস্ত্র ট্রেনিং সবই আলাদা। এদের সবকিছু নিখুঁত দেখে নিলো সম্রাট। দেখতে দেখতে পৌঁছালো ডাবলুখানের কাছে। ডাবলু খানের দু’পাশেও দু’জন প্রহরী সারাক্ষণ মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে। কোনো ঘটনা রটনা অথবা কাউকে দেখে এদের কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না। সম্রাট একরকম স্যালুট দেয়ার কায়দায় সালাম দিলো ডাবলো খানকে। উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে ডাবলু খান বললো- আরে সম্রাট! এসো এসো। তোমার বিষয়ে সমস্ত রিপোর্ট ভালো। তোমার দু’জন প্রহরী তোমাকে ভীষণ পছন্দ করে। ওরাই জানালো সব। তোমার মনোবল ওদের প্রশংসা কুড়ায়। আমার নিরাপত্তাকর্মীদের একই মত- প্রধান সেনাপতি হিসেবে তুমিই যোগ্য। আপনি আমার প্রতি আস্থা রেখেছেন এটি আমার আনন্দ- খোশ মেজাজে জবাব দিলেন সম্রাট।
বললো- আমি আমার কর্তব্য পালন করার চেষ্টা করবো। এবং সেটি জীবন দিয়ে হলেও।
কথাটি শুনে বেশ খুশিই হলো ডাবলু খান।
বললো- বাহ এইতো চেয়েছি আমি। যে জীবনের পরোয়া করে না তার কাছে মৃত্যু তুচ্ছ। যারা মৃত্যুকে তুচ্ছ ভাবে আমি তাদের খুব পছন্দ করি। লোকটি কী ভয়ংকর একথাই প্রমাণ দেয়- ভাবে সম্রাট। এমন ভয়ংকর বলেই পাতালপুরীতে গড়ে তুলেছে বিস্ময় সম্রাজ্য। সে যাই হোক মনে মনে বললো সম্রাট- আজ রাতই তোমার শেষ রাত। সম্রাট বললো- জি জনাব, আজ তবে আসি। দেখা হবে নিশ্চয়। ওকে ইয়াংম্যান যাও তবে পিঠ চাপড়ে বললো ডাবলু খান। বাই বলে সম্রাট ঘুরে পা বাড়ালো দরজার দিকে। সম্রাটের পথের দিকে চেয়ে আছে ডাবলু খান। তার মনের ভেতর টুপ করে একটি কথা যেনো পড়লো- আচ্ছা সম্রাট কেনো এলো আজ তাতো কিছু বললো না! নিজে থেকে এলো ও। অথচ কিছুই বললো না- এ কেমন কথা হলো! একবার ভাবলো ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করার।
সাথে সাথে তার ভেতরের অহঙ্কার চিৎকার দিলো- এ হয় না ডাবলু খান। এ তোমার অহংবোধের বিপরীত। ওর কিছু বলার থাকলে বলবে আবার। যাক ও। যেতে দাও। কিন্তু ভেতরে খটখটানি থেকেই গেলো। খচখচ করছে মনের ভেতর। কেন এলো সম্রাট এ জিজ্ঞাসা বড় হয়ে উঠলো মনের কাছে। কিছুটা আনমনা হয়ে যায় ডাবলু খান। কিছু উলট পালট যেনো তার ভেতর জগতে। রাজকীয় সিংহাসনে গা এলিয়ে দিলো সে। চোখ বন্ধ করে কি যেনো ভাবছে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লো সে। তার নিরাপত্তাকর্মী বেশ অবাক।
গত দশ বছরে কোনোদিন ডাবলু খানকে এ অবস্থায় দেখেনি ওরা। না এতো আনমনা। না এভাবে সিংহাসনে ঘুমিয়ে পড়া। কিন্তু কিছু বলার সাহস যেমন এদের নেই। তেমনি অনুমতিও নেই। দু’জনই অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো শুধু। দু’জনের চারটি চোখ শুধু দেখলো ঘুমন্ত ডাবলু খানের মুখের ওপর ছড়িয়ে আছে কিসের যেনো ছায়া। দুজন প্রহরী দুজনকে দেখলো। দুজনের চোখে বিস্ময়ের ভাষা। কথা নেই কারো মুখে। নতুন এ দৃশ্য যেনো হজম করতে পারছে না- দুজনের কেউ। রাত বেড়েই চললো। টিকটিক এগোচ্ছে ঘড়ির কাঁটা।
ক্রমাগত নিঃশব্দ হয়ে উঠেছে পৃথিবী। রাতের চোখেও নেমে আসছে ঘুম। সে ঘুমেই আচ্ছন্ন যেনো ডাবলু খান। গুহায় সাম্রাজ্যের অধিপতি এভাবে অসহায়ের মতো ঘুমিয়ে আছে চেয়ারে- এটি ভাবা যায় না! তাকে দেখে মনে হচ্ছে ক্লান্তি এবং অবসন্নতা চেপে আছে তার ওপর। দু’জন প্রহরী একই কথা ভাবে- থাক ঘুমিয়ে। দুজনই একবার ডাবলু খানের দিকে আরেকবার ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত ১টা বেজে গেছে। ডাবলু খানের যেনো চেতনাই নেই। এমন বেঘোর দশা থেকে ভয়ংকর এক দুঃস্বপ্ন দেখে বিগবিগিয়ে জেগে উঠলো ডাবলু খান। হাঁফাচ্ছে খুব। চোখে মুখে আতঙ্ক। দ্রুত ওঠানামা করছে বুক। ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো পানি। একজন প্রহরী দ্রুত পানির গ্লাস ধরলো তার সামনে। হাত বাড়ালো সে। হাতও কাঁপছে তার। কী হলো- এমন কথাই তোলপাড় করছে দু’জন প্রহরীর। পানি খেতে খেতে কিছু পানি গড়িয়ে পড়লো মুখ বেয়ে। পানিগুলো মোছার চেষ্টাও করছে না। এসব দৃশ্য একবারেই বেমানান- ভাবে প্রহরী দু’জন।
একি দুঃস্বপ্ন দেখলাম আমি! আমার প্রাসাদের ছাদ ভেঙে পড়ছে আমার ওপর। কথাগুলো যেনো নিজেকেই নিজে বললো। বললো- আমার দম যেনো বুক থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলো। এক অপ স্বপ্ন দেখা দিলো আমার চোখে! কোনো দুঃসময় শুরু হবে কি আমার! চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালো। শরীরের কাঁপন থামেনি তখনো। তখনো তার বুক হাপরের মতো ওঠানামা করছে। শ্বাস-প্রশ্বাস তখনো ভীষণ দ্রুততার সাথে টানছে আর ছাড়ছে। ছাদের দিকে বারবার তার দৃষ্টি ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছুটা ভীত হয়ে পড়লো রাজপ্রহরী দুজন। তারা কি করবে বুঝে উঠতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো দু’জনের দিকে। কিন্তু এদের দিকে কোনো নজর নাই। ডাবলু খানের। উদভ্রান্তির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে তার দৃষ্টি। কখনো ছাদে কখনো দেয়ালে। ঘুরে এসে বসে পড়লো চেয়ারে। যেনো ক্লান্তি ঘিরে ধরেছে তাকে। কোনো কিছু ভাবার শক্তিও যেনো নেই তার। আবার বললো- পানি! গ্লাসটি তুলে মুখের কাছে নিলো। ঠিক তখনি রাজকীয় বিশাল অফিস কক্ষের বাইরে ধুপধাপ শব্দের ভুতুড়ে আওয়াজ। ডাবলু খানের হাত থেকে পড়ে গেলো পানির গ্লাসটি। কার্পেটে পড়ে চুরমার হলো গ্লাসটি। কার্পেটের ছোট অংশ ভিজে গেলো গ্লাসের পানিতে। আরো ভয়ার্ত হয়ে উঠলো ডাবলু খানের চোখ। বাইরের ধুপধাপ শব্দ যেনো এগিয়ে আসছে নিকটে।
হঠাৎ গা ঝাড়া দিলো ডাবলু খান। যেনো ভয় তাড়ানোর চেষ্টায় ঝাঁকিয়ে নিলো নিজেকে। আকস্মিক প্রহরীদের দিকে ঘুরে বললো- এ কিশের শব্দ ভেসে আসছে বলো তো! প্রধান দরজার দিকে ফিরলো ডাবলু খান। দেখলো- দরজার প্রহরী দুজন চঞ্চল হয়ে উঠেছে। কান খাড়া করে আছে বাইরের দিকে। বাইরের শব্দ আরো এগিয়ে এলো কাছে। একজন প্রহরী দরজায় কান লাগিয়ে খুঁজছে শব্দের উৎস। ডাবলু খান চিৎকার দিয়ে বললো- খোলো দরজা! কি হচ্ছে দেখো। দরজা খুলতে হাত বাড়ালো একজন প্রহরী। ঠিক তখনি প্রচণ্ড শব্দে খুলে গেলো দরজা। ভীষণ ভাবে ধাক্কায় ছিটকে পড়লো সে। দরজা খুলেই অত্যন্ত ক্ষীপ্রগতিতে ভেতরে ঢুকে গেলো ৫টি ছায়া মানব। যমকালো পোশাকে ঢাকা সারা শরীর, মুখও। প্রত্যেকের হাতে উদ্যত রিভলবার। দুজন থেকে গেলো দরজায়। বাকি তিনজন ঝড়ের গতিতে এগুলো ডাবলু খানের দিকে। কক্ষের দুই দেয়াল ঘেঁষে দু’জন। মধ্যপথে একজন।
ঘাড়ে ভীষণভাবে বাড়ি দিলো রিভলবারের। অন্ধকার হয়ে উঠলো ওর চোখ। কাটা গাছের মতো পড়ে গেলো প্রহরীটি। পড়ে যাওয়া প্রহরী রিভলবারটি ছিটকে পড়লো খানিকটা দূরে। শোয়া থেকে চিতা বাঘের মতো লাফিয়ে উঠলো প্রহরীটি। ছিটকে যাওয়া রিভলবার কুড়িয়ে নিতে হাত বাড়ালো ও। এ সময় কানের পাশে প্রচণ্ড এক ঘুষি উড়ে আসলো যেনো। এক ছায়ামূর্তি এক ঘুষিতেই তাকে প্রায় শীতল করে দিলো। মধ্যপথ দিয়ে এগুতে থাকলো এ দুজনও। গণ্ডারের মতো চিৎকার দিলো ডাবলু খান। খবরদার সামনে এগুবে না আর। পাশে রাখা স্বয়ংক্রিয় স্টেনগানটি তুলে নিলো হাতে। বললো- আর এগুনোর চেষ্টা করলে ঝাঁঝরা করে দেবো। প্রহরী দুজনের প্রতি রিভলবারও উদ্যত ছায়া মানবের দিকে। বিকৃত হয়ে উঠলো ডাবলু খানের মুখ। মনে হয় এখনি স্টেনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেবে এদের। আর এক কদমও এগুবে না- এমন কমান্ডে হঠাৎ থেমে গেলো ছায়া মানব সবাই। তারা বুঝলো- এগুলে গুলি ছুঁড়তে মুহূর্তও দেরি করবে না ডাবলু খান। ওরা দাঁড়াতেই পরবর্তী নির্দেশ- অস্ত্র ফেলে দাও। ইতস্তত করছে ওরা।
চেঁচিয়ে বললো ডাবলু খান- এক নির্দেশ দুবার দেই না আমি। রিভলবার ফেলে দিলো সবাই। আবারো কড়া নির্দেশ- প্রত্যেকে দুহাত উপরে উঠাও। সুবোধ বালকের মতো ৫টি ছায়ামূর্তি হাত তুললো উপরে। আরেকটি নির্দেশ ডাবলু খানের- হাত উপরে রেখেই আগাও সামনে। খবরদার চালাকি করার চেষ্টা করো না কেউ। ঝালাফালা করে দেবো বুক। কোন মায়ের সন্তান তোমরা দেখবো আজ। ডাবলু খানের সাম্রাজ্যে হানা! জানিস না বাঘ মাড়ায় না এ পথ! ঠিকঠাক মতো এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে যা। কি চাষ তোরা? ডাবলু খান? না ডাবলু খানের সিংহাসন? কোনোটিই সহজ নয়রে গাধার দল। মৃত্যু ছাড়া ডাবলু খানকে কেউ রুখতে পারবে না।
যদি তোর মৃত্যু এসে যায়! ভীষণ ভারী গলায় বেজে উঠলো একটি কণ্ঠ। দুহাত উপরে রেখে এগুতে এগুতে বললো মাঝের ছায়া মানব। মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো ডাবলু খান। এ মুহূর্তে এমন কথা আশা করেনিও। সামান্য সময়ের জন্য চমকালো। তারপরই বললো- মৃত্যুকে আমার সাথে কথা বলেই আসতে হবে!
হো হো হো করে হেসে ফেললো ছায়ামানব। বললো- হ্যাঁ কথা বলেই আসবে তোর কাছে। অনেক কথা এবং শেষ কথা। কে তুই? তোরা কারা? কি চাস এখানে? আমার এ সুরক্ষিত দুর্গে কি করে ঢুকলি? ঢুকেই পড়েছিস যেহেতু আমার মেহমান তোরা। যেমন মেহমান তেমনি তার মেহমানদারি! আমাদের পরিচয় একটু পরে পেয়ে যাবে ঠিকঠাক। যখন মৃত্যুর সাথে কথা হবে তোর।
স্টেনগান নাচিয়ে বললো ডাবলু খান- একটু পরে মৃত্যুর সাথে কথা হবে তোদের। ওখানেই দাঁড়া আর এক পাও এগুবে না। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যা। হাত উপরের দিকে তুলেই দাঁড়িয়ে গেলো পাঁচজন। প্রহরী দুজনকে নির্দেশ দিলো ডাবলু খান- এদের প্রত্যেকের হাত পেছনের দিকে বেঁধে দাও। কেউ চালাকি করলে তাকে পাঠিয়ে দেবো ওপারে। রিভলবার রেখে দুজন প্রহরী শুরু করলো হাতবাঁধা। দু পাশ থেকে বাঁধছে হাত।
দুজনের বাঁধা হলো। বাঁধছে তার পরের দুজনের। মাঝখানের জনই বাকি। ঠিক তখনি চোখের পলকে ফুটবলের শর্ট মারার মতো স্টেনগান ধরা ডাবলু খানের হাতের ওপর কিক মারলো মাঝের ছায়া মানব। ছিটকে স্টেনগান পড়ে গেলো ডাবলু খানের হাত থেকে। বাতাসের গতিতে স্টেনগান কুড়িয়ে নিলো ছায়ামানব। রিভলবার সক্রিয় করার চেষ্টা করছিলো ডাবলু খানের প্রহরী দুজন। দুটি ছায়ামানব কব্জা করে নিলো দুজন প্রহরীকে।
হো হো হেসে উঠলো স্টেনগান ধারী ছায়া মানব। স্টেনগান তাক করে বললো- কি হে ডাবলু খান এখন তোমার সম্রাজ্যের কি হবে?
কে মান্য করবে তোমার হুকুম!
কে তুমি? কি চাও আমার কাছে? গর্জে উঠলো ডাবলু খান। রাগে ক্ষোভে ষাঁড়ের মতো গোঙ্গাচ্ছে সে।
তোমার নৃশংস জুলুমের অবসান চাই। তোমার অবিচারের সমাপ্তি চাই। এবং এই গুহা সাম্রাজ্যের পতন চাই।
দুটি চোখ বাঘের মতো জ্বলছে ডাবলু খানের। চিৎকার করে বললো- তুমি যেই হও তোমার রক্ষা নেই। আমার সেনাপতি বাঁচতে দেবে না তোমাকে। হা হা হা। তাই নাকি! তোমার সেনাপতি! উদ্ধার করবে তোমাকে! এখনো অনেক আশা তোমার মনে! দেখো তবে একজন ছায়া মানব। মুখোশটি টেনে খুলে নিলো ছায়ামানব। ভূত দেখার মতো ভিরমি খেলো ডাবলু খান। তারই সেনা নায়ক ইশতিয়াক বাবর। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হবার মতো ধাক্কা খেলো ডাবলু খান। রাগে ক্ষোভে কাঁপছে সারা শরীর। মনে হয় এই বুঝি চিবিয়ে খাবে সব। বললো- বিশ্বাসঘাতক। কাপুরুষ! চুপ ডাবলু খান- চিৎকার করে উঠলো বাবর।
বললো- তোর তো বিশ্বাসই নাই। কিসের বিশ্বাসঘাতকতা আবার। কাপুরুষ? তোর মতো কাপুরুষ কজন আছে জগতে! তোর দিন শেষ। জীবনে বহু অন্যায় করেছি তোর কথায়। আর নয়। তোর মাংস টুকরো টুকরো করে শেয়াল শুকুনকে খাওয়াবো।
শুয়রের মতো গোঁ গোঁ করে উঠলো ডাবলু খান। মনের অজান্তে দুহাত মুষ্টিবদ্ধ হলো। ষাঁড়ের মতো চেঁচিয়ে স্টেনগান ধারীকে বললো- কে তুই মুখোশ পরা কাপুরুষ? আহারে বীর পুরুষ ডাবলু খান- দেখতে চাষ আমাকে? দেখ বলে একটানে খুলো নিলো মুখোশ।
বিস্ময়ে চোখ যেনো বেরিয়ে যাবে চোখ থেকে। ঘরঘর শব্দে বললো- সম্রাট তুমি? হ্যাঁ আমি হে ডাবলু খান। তোমার সাম্রাজ্য পতনের জন্য দায়ী আমি। আর দায়ী ঐ ছেলেটি বলে দরজার দিকে ইশারা দিলো। ডাবলু খান দেখলো- সমস্ত বন্দিরা ঢুকছে তার রাজকীয় কক্ষে। সবার সামনে ঢুকছে ওমর জামিল।

Share.

মন্তব্য করুন