গুহার মুখেই দাঁড়িয়ে আছে সম্রাট। ওর অনুমান এই গুহায় লুকিয়ে রাখা হয়েছে খুদে বিজ্ঞানী ওমর জামিলকে। আশপাশে লুকিয়ে রাখার জায়গা তেমন নেই। যে দু’ চারটি আছে ইতোমধ্যে সবই খুঁজে দেখেছে সম্রাট। এসব জায়গার কোনোটিতেই ওমর জামিলের সন্ধান মেলেনি। সম্ভাব্য অন্যসব জায়গায়ও খোঁজ করা হয়েছে গোপনে প্রকাশ্যে। কোথাও পাওয়া যায়নি তার খবর। সবদিক ভেবে সম্রাটের মন বলছে এই গুহার ভেতরে পাওয়া যেতে পারে ওমর জামিলকে। গুহাটি এক ধরনের ভয়ঙ্কর। ভয়ঙ্কর এ কারণে এখানে দিনের বেলাও আসে না কেউ। গুহার চারদিকে পাহাড়। শুধু একদিকে দুই পাহাড়ের মাঝখানে একটি সরু পথ। যে পথ দিয়ে পৌঁছা যায় গুহার কাছে। পথটিও খুব স্বাভাবিক পথ নয়। কাঁটা গুল্ম আর বনগাছালিতে ভরা।
এসব গাছালিতে বড় বড় লাল পিঁপড়ের মিছিল। ছোট পিঁপড়ে আর মশার উৎপাত তো আছেই। বিষধর সাপের আনাগোনাও কম নেই। গোখরা সাপ হরদম ফুঁসে ওঠে এখানে। মাত্র ক’দিন আগে একজন পাখি শিকারি গোখরোর ছোবলে প্রাণ হারালো। এর আগে একজন গুপ্তধন সন্ধানীও মারা গেলো সাপের কামড়ে। কখনো কখনো অজগরের উপস্থিতিও টের পাওয়া যায়। আস্ত বুনো হরিণ গিলে ফেলে এসব অজগর।
নানা রকম ভয়ের দৃশ্য জাগছে সম্রাটের মনে। কিন্তু তাকে ভয় পেলে চলবে না। সাহস জাগিয়ে রাখতে হবে। উদ্ধার করতে হবে খুদে বিজ্ঞানী ওমর জামিলকে। জামিল একদিন উজ্জ্বল করবে দেশের মুখ। গুহা পরীক্ষা করছে সম্রাট। দু’চারদিনের মধ্যে এখানে কারো পদচিহ্ন পড়েছে কি না! সত্যি কি এখানে আছে জামিল? যদি ওকে এই গুহাতেই রাখা হয় তবে কোনো না কোনো পায়ের চিহ্ন পাওয়া যাবেই। গুহার এক পাশে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলো সম্রাট। ওর ধারণা জামিলকে গুহায় রাখলে ওর সঙ্গে কেউ না কেউ থাকবে। থাকবে ওকে পাহারা দেয়ার প্রয়োজনে। জামিলকে সহজে মারবে না এটুকু জানে সম্রাট। মারবে না কারণ মনের ভেতরে লুকানো সত্য আবিষ্কারের থিউরি তাদের পেতেই হবে। জামিল সহজে তার থিউরি প্রকাশ করবে বলে মনে হয় না। থিউরি না পেলে জামিলকেও মারবে না ওরা। হয়তো নানা রকম কষ্ট দেবে। শাস্তি দেবে। মৃত্যুর ভয় দেখাবে। মৃত্যুর আতঙ্ক ছড়াবে ওর সামনে। কিন্তু জানে মারবে না। সুতরাং গুহায় ওকে রাখা হলো কিনা অন্তত নিশ্চিত না হয়ে এমন ভয়ঙ্কর গুহায় প্রবেশ করা ঠিক হবে না।
সিদ্ধান্তটি নিতে পেরে হালকা লাগছে ওর। গুহার ডানপাশে একটি ডুমুর গাছ। গাছটি ঝোপঝাঁপে বেশ ছড়ানো। ডালগুলো নুয়ে এসে প্রায় মাটি ছুঁয়েছে। গাছটির একটি ডাল উল্টিয়ে খানিকটা ভেতরের দিকে বসে পড়লো সম্রাট।
এমন ভাবে বসলো যেনো গুহার মুখটি তার চোখে থাকে। আবার ওকে যেনো সহজে কেউ দেখে না ফেলে। ওর পিঠে বাঁধা ব্যাগের ভেতরে কম্বল রাখা আছে। ইচ্ছে করলে কম্বল বিছিয়েও বসতে পারে। কিন্তু ঝরা পাতার পিঠে বসে মজা নিতে চায় ও। ঝরা পাতার মর্মর ধ্বনি বেশ ভালো লাগে ওর। ছোটবেলা থেকেই ওর এ ভালো লাগা। সময় সুযোগ পেলেই ঝরা পাতায় বসা কিংবা গড়াগড়ি দেয়ার ঘটনাও কম নয়। হঠাৎ ঘোঁৎ করে একটি শব্দ হেলো। শব্দটা ঠিক সম্রাটের ডানদিকে মনে হলো। দ্রুত ফিরলো ডানে। পাতার ফাঁক খানিক বড় করে দেখার চেষ্টা করছে ও। না তেমন কিছুই নেই।
আকস্মিক বাম দিকেও শুনলো একই শব্দ। বায়ে তাকালো দ্রুত। কই তেমন কিছু পড়লো না চোখে। তবে মনের ভুল? হতেও পারে। মনে হয় কোনো শব্দ। আসলে শব্দ নয় তবু সাবধান থাকতে হবে। বেশ সতর্ক সম্রাট। কান খাড়া। অন্ধকার হলেও চোখ সয়ে গেছে খানিকটা। ফলে ঘুটঘুটে অন্ধকার কেটে গেছে। আকাশে চাঁদ নেই। কিন্তু তারার বিশাল সমাহার। তারার আলো অন্ধকার কিছুটা হালকা হয়ে উঠলো। শব্দটি আবার হলো। বাম দিকে। চকিত ফিরলো বামে। দেখে পাতার ফাঁক গলে দু’টি জ্বলন্ত শিখা জ্বলজ্বল করছে। প্রথম ধাক্কায় কেঁপে উঠলো ভেতরটা। কিন্তু ভয় পেলে চলবে না। নিজে নিজেই সাহস জোগায় সম্রাট। নড়া চড়া একদম না করে বোঝার চেষ্টা করছে আলো শিখার উৎস। কি এটা? ভালুক? শিয়াল নাকি হায়েনা? শেয়াল হলে ভয়ের কিছু নেই। ভালুক অথবা হায়েনা হয় যদি রিসকি বটে। সম্রাট লক্ষ করলো দুটি চোখের জ্বলন্ত শিখা তার দিকেই। শিয়াল হলে এভাবে চেয়ে থাকার কারণ নেই। ভালুক অথবা হায়েনা এ দুটির একটি নিশ্চয়। ভালুক এখানে খুব একটা আসে বলে জানা নেই সম্রাটের। কিন্তু হায়েনার বিচরণ অবাধ। দিনের বেলায়ও মাঝে মাঝে দেখা যায় এসব হিংস্র প্রাণীদের। সন্ধ্যা হলে তো কথাই নেই। সম্রাটের মন বলছে এটা হায়েনা। পৃথিবীর সবচেয়ে হিংস্র এবং দ্রুত আক্রমণকারী প্রাণী এটি। জ্বলন্ত চোখ যেনো বিঁধে আছে সম্রাটের দিকে। ভয়ের হিম স্পর্শ করলো সারা শরীর। পশম কাঁটা দিয়ে উঠলো। কিন্তু কোনো ভাবেই নড়াচড়া চলবে না। বৃক্ষের মতো স্থির ও। খানিকটা টেরসা চোখে চেয়ে আছে জ্বলন্ত শিখার দিকে। এসময় পায়ের উপর কি যেনো গড়িয়ে যাচ্ছে। শীতল এক অনুভূতি পায়ের উপরের অংশে। ভয় তীব্র আকার ধারণ করলো। ও নিশ্চিত বরফের রশির মতো গড়িয়ে যাওয়া প্রাণীটি কোনো সাপ।
ভেতরটা ভয়ে অস্থির। কিন্তু স্থির থাকতেই হবে। নিজেকে নিজেই সাহস জোগায় সে। বাঁচতে হলে বৃক্ষ হয়েই থাকো। সামান্য নড়লেও ছোবল দিবে সাপ। অন্যদিকে ভয়ঙ্করভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে হায়েনা। সাপটি বেশ দীর্ঘ। ধীরে গড়িয়ে যেতেই কিসকিস শব্দে বেজে উঠলো। সম্রাটের বুঝতে বাকি রইলো না সাপটি ইঁদুর ধরেছে। ওর হাতে ডিজিটাল লাইটার আছে। কিন্তু জ্বালানো চলবে না। কারণ আলো দূর থেকেও দেখা যাবে। শত্রুরা সাবধান হয়ে যাবে। এবং হামলার শিকার হবে ও। ভাবে জীবন একটাই। মৃত্যু জীবনে একবারই আসে। এবং সে নির্ধারিত সময়েই আসবে। সুতরাং এতো ভয়ের কিছ নেই। হঠাৎ সে দেখে জ্বলন্ত জোড়া চোখের পাশে আরো দুটো চোখ।
সম্রাট নিশ্চিত চোখগুলো ওকেই দেখছে। যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর ওপর। রিভলবার বের করে রাখা ছিলো আগেই। মানসিক প্রস্তুতি আগে থেকেই সম্রাটের। ও জানে এ উপত্যকায় হিংস্র প্রাণীদের আনাগোনা। এখানে বাঘ অথবা সিংহ এলেও অবাক হবে না সম্রাট। কিছুক্ষণ। তারপর জ্বলন্ত শিখা আর দেখলো না সম্রাট। ভাবতে ভাবতে আনমনা হয়ে ওঠে সে। মেধাবী বিজ্ঞানী জামিল। মিথ্যা ধরার যন্ত্র আবিষ্কার করে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে ও। না জানি কোথায় আছে কেমন আছে?
হঠাৎ মনে হলো গুহার মুখটি নড়ে উঠেছে। মুহূর্তে সাবধান হয়ে উঠলো ও। তীক্ষ্ণ ভাবে তাকিয়ে দেখে। সত্যি কেউ কি মাথা তুললো গুহা থেকে। খুব ভালো করে দেখলো- না। কিছুই নড়ছে না আর। তবে? ও কি ভুল দেখেছিল? ভুল হতেও পারে। কিন্তু দেখাটা ভুলের মতো মনে হচ্ছে না সম্রাটের। নিশ্চিত কোনো একটা নড়তে দেখেছে। ঠিক মানুষের মাথার মতোন। একটু উঠেই আবার ডুবে গেলো। আশপাশে কেউ আছে কি না দেখলো লোকটি। হতেও পারে। কিডন্যাপার যারা ওরা নিশ্চয় সাবধানী। অনেক সাবধান। কারণ ওরা জানে সম্রাট পিছু নেবে ওদের। কোনোভাবেই ছাড়বে না ও।
হ্যাঁ। যথার্থ। আবারো দেখছে সে। কারো মাথা। সামান্য উঠে আবার তলিয়ে গেলো। ভীষণ সতর্ক হয়ে উঠে সম্রাট। নিঃশ্বাস ছাড়া নাড়াচাড়া নেই ওর। এখানে ঝরা পাতার কার্পেট। একটু নড়াচড়া করলেই শব্দ হবে বেশ। শব্দ হলেই বিপদ। ওরা সাবধান হবে যেমন তেমনি হবে ভয়ঙ্কর। এর মধ্যে গা আবার শিরশির করে উঠলো। দেখছে ও আরেকটি সাপ পায়ের ওপর দিয়ে বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে গড়িয়ে যাচ্ছে। কী বিপদ! একি বিষধর সাপের অস্তানা! ওকেও কি বৃক্ষ অথবা গোদা ভেবেছে সাপ! কোনো বাছবিচার না করে পায়ের ওপর দিয়ে চলে গেলো।

গুহার সাম্রাজ্য । জাকির আবু জাফরদুই.
দুটি পা সামনে দিয়ে বসে ছিলো সম্রাট। এবার পা গুটিয়ে নিলো। পদ্মাসনের মতো করে বসলো। বসলো খুব সাবধানে। বসে গুহার দিকে চোখ তুলেই দেখে একটি ক্ষীণ আলো জ্বলে উঠলো গুহার মুখে। আলোটি হঠাৎ দেখলে মনে হবে দু’ তিনটি জোনাকির আলো এক সাথে জ্বললে যেমন তেমনি। আলোটা কোনো দিকে ঘুরছে না। ঠিক গুহার মুখ থেকে উপরের দিকে। বিষয়টা বুঝার চেষ্টা করছে সম্রাট। গুহার মুখে চোখ রেখে স্থির বসে আছে ও। একটুক্ষণ। তারপরেই বেশ কটি পায়ের ধুপধাপ শব্দ। ওর চোখে ভেসে ওঠে একটি দৃশ্য। জনা চারেক লোক। নিচের দিকে কিছু একটা ধরাধরি করে গুহার দিকে উঠছে। খেয়াল করে দেখলো সম্রাট। হ্যাঁ অচেতন কোনো মানুষ। অথবা কোনো মানুষের লাশ। তবে লাশ গুহায় আনার কোনো কারণ নেই। গুহার ভেতর লাশ রাখলে গন্ধে টেকা অসম্ভব। অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলো সম্রাট। খুব করে দেখলো। না। এটা জামিলের বডি নয়। জামিল এতোটা লম্বা হবে না। স্বাস্থ্যও জামিলের চেয়ে বেশি। তবে কি এখানে মানুষ জিম্মি করা হয়? কিডন্যাপ করে এখানেই কি নিয়ে আসে সবাইকে? ভাবতেই ভেতরটা কেমন কেঁপে ওঠে সম্রাটের। সে সাথে প্রতিবাদের একটা তীব্র স্রোত বয়ে যায় মনের ভেতর। দৃঢ় করে নিজেকে। এদের ভয়ঙ্কর খেলা বন্ধ করতেই হবে। শাস্তি দিতে হবে এদের সমস্ত অপরাধের।
ঠিক তাই। একটি অচেতন মানুষকেই চারজন ধরে ঢোকাচ্ছে গুহার ভেতর। গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেলো সম্রাটের। ওর ইচ্ছা করছে রিভলবারের গুলিতে এদের প্রত্যেকের মাতা গুঁড়িয়ে দিতে। কিন্তু আরো অপেক্ষা করতে হবে ওকে। আরো দেখতে হবে এদের কৌশল। এদের মোটিভ। কি চায় এরা। কত মানুষ বন্দি ওদের হাতে। কেনো বন্দি করে এরা। এদের পেছনে কারা আছে? ঠিক তখনি ঠাণ্ডা কি যেনো ওর ঘাড় স্পর্শ করলো। সেই সাথে ফিসফিসানি- চুপ একদম নড়বে না। কোনো চালাকি করার চেষ্টা করলে মাথার খুলি উড়ে যাবে। কানের সাথে ফিসফিস করে কথাগুলি বললো। সম্রাটের মনে হলো কথা নয় এ যেনো এক ধরনের বুলেট। যা কানের পাশে ঘেঁষে উড়ে গেলো। মুহূর্তে বুঝলো সম্রাট ভীষণ ঘাগু মাল এরা। ও ধরা পড়ে গেছে এদের হাতে। নির্দেশ মতো নড়লো না সম্রাট। যতদূর সম্ভব চোখ ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলো আর কেউ আছে কি না! মনে হলো কেউ নেই। একাই এই পিস্তলধারী।
কি চাই এখানে? আবার ফিসফিসিয়ে উঠলো লোকটি।
তোকে চাই। একইভাবেই জবাব দিলো সম্রাট। চাই তোদের অন্যায় ঘাঁটি ধ্বংস করে দিতে।
সম্রাট ভেবেছিলো জবাব শুনে কেঁপে উঠবে লোকটি। কিন্তু না। একদম না। বরং সাপের মতো শীতল কণ্ঠে বললো- সে সুযোগ তোর জীবনে আসবে না আর। তবে তার আগে বল- আমাদের পিছু নিয়েছিস কেন? জীবনের মায়া নেই তোর! মৃত্যুর ভয় নেই? আমাদের পিছু নেয় যে তার কোনো শ্বাস নেবার অধিকার নেই। বল এখানে কেনো তুই? ঘাড় না নেড়েই বললো- ওমর জামিলকে কোথায় রেখেছিস? কেনো কিডন্যাপ করেছিস ওকে?
চুপ শালা। একদম চুপ। ঘাড়ে পিস্তলের গুঁতো দিয়ে বললো- বেশি কথা বললে ঘাড় ফুটো করে দিবো। সাঁই করে বাতাসের গতিতে ঘুরে গেলো সম্রাট। পিস্তল ধরা হাতটি চোখের পলকে খাবলে ধরলো। ধরে ঘাড়ে রিভলবারের বাড়ি বসালো। পিস্তলটি মুহূর্তে খসে পড়লো মাটিতে। ঘাড়ে বাড়ি খেয়ে কলা গাছের মতো টলতে থাকলো শরীর। পড়তে পড়তে বৃক্ষটি ধরে দাঁড়িয়ে গেলো ফের। দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড গতিতে ঘুষি মারলো সম্রাটের মুখে। দ্রুত মুখটি সরিয়ে নিলো সম্রাট। টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলো লোকটি। পড়েই পিস্তল হাতড়াচ্ছে সে। অবাক হলো সম্রাট। বেটার কই মাছের প্রাণ। সহজে কাবু হয় না। বাজপাখির মতো মুহূর্তেই পিস্তল কুড়িয়ে হাতে নিলো। বুঝে গেলো সম্রাট, এখন মুহূর্ত দেরি করবে না লোকটি। গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেবে ওকে। সে সুযোগ পেলো না লোকটি। সম্রাটের রিভলবার গর্জে উঠলো তার আগেই। সাইলেন্সার লাগালো রিভলবার। ধুপ করে একটি শব্দ হলো। লোকটির মাথায় ঝড়ের গতিতে ঢুকে গেলো বুলেট। মগজ ছিটকে ছড়িয়ে গেলো চারদিকে। কয়েকবার কেঁপে ওঠে নিথর হয়ে গেলো দেহটি। মনটা খারাপ হয়ে গেলো সম্রাটের। ও কোনো ভাবেই মারতেই চায়নি লোকটিকে।
কিন্তু উপায় নেই। না মারলে এতক্ষণে লোকটির জায়গায় পড়ে থাকতো ওরই লাশ। ভাবে সে হায়রে মানুষ কেনো মৃত্যু নিয়ে খেলা করে এমন। কেনো মনুষ মানুষকে এমন করে নৃশংস করে।
বৃক্ষটি পিঠের সাথে ঠেসে দাঁড়ালো সম্রাট। বাজ পাখির মতো তীক্ষ্ণ চোখ খুলে দিলো গুহার দিকে। ওর ধারণা নিশ্চয় গুহা থেকে বেরিয়ে আসবে কেউ না কেউ। লোকটির সন্ধান করবে নিশ্চয়। ভাবতে না ভাবতেই দেখলো দু’জন লোক বেড়ালের মতো নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো গুহার দিকে। এক রকম হামাগুড়ি দিয়েই ওরা এগুচেছ সম্রাটের দিকে। হ্যাঁ যে গাছটির সাথে সম্রাট ঠিক সে গাছটির দিকেই। সম্রাট খানিকটা অবাক হলো- দু’জন সরাসরি ওর দিকে আসছে কেনো? দু’জনের হাতে উদ্যত রিভলবার। কোনো ফাঁকে পাহাড়ের ওপাশ থেকে উঠে এলো মধ্যরাতের চাঁদ। সামন্য কুয়াশা জড়িয়ে আছে চাঁদের আলো। এ আলোতে চকচকা রিভলবার যেনো এখনি ছুড়বে মরণ বুলেট।
সম্রাট ভাবনায় পড়লো। যদি ওরা জেনে যায় ওর অবস্থান তবেতো এভাবে আসার কথা নয়। এটি ওকে ফাঁদে ফেলার কৌশল নয়তো? রিভলবার নড়েচড়ে দেখে নিলো সম্রাট। এটি তার প্রিয় রিভলবার। তেল মাখিয়ে মুছে টুছে বেশ যত্ন করে রাখে। কতো শত্রুর প্রাণ নিলো এই প্রাণহীন যন্ত্রটি তার হিসেব নেই। স্থির দাঁড়িয়ে রইলো সম্রাট। চোখ দুটি হামাগুড়ি দিয়ে আসা লোক দুটির ওপর। বাড়াবাড়ি করলেই গুলি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েই দাঁড়িয়ে ও। তখনি চোখে পড়লো আরো দুটি মানব ছায়া।
চাঁদের অল্প আলোতে ছায়ার মতোই মনে হচ্ছে তাদের। ওরাও ঠিক আগের দু’জনের মতো হামাগুড়ি দিয়ে এগুচ্ছে। এদের হাতেও রিভলবার প্রস্তুত। সম্রাট স্থির তখনো। মুভ করার উপায় নেই মোটেই। সামান্য ভুলে মুহূর্তে ঝরে যাবে প্রাণ। ও একটি জিনিস ভালোভাবে অনুধাবন করছে- বেঘোরে প্রাণ দেয়া যাবে না। পরাজিত হওয়া যাবে না বোকামি করে। মরতে হলে লড়াই করেই মরবো- এমন দৃঢ়তা সম্রাটকে প্রতিটি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছে। আজো তাকে লড়তে হবে। লড়তে হবে একা। কিন্তু বুদ্ধি সঙ্গে রাখতেই হবে।
আগের দু’জন প্রায় বৃক্ষের কাছাকাছি। কিভাবে ওরা এতো নিঁখুতভাবে এগুচ্ছে বুঝতে পারছে না ও। হঠাৎ মনে হলো ইনফ্রারেড গগলস তো ওর ব্যাগে। মনে হতেই খুব সাবধানে ব্যাগের পেট থেকে গগলসটি বের করে আনলো। অন্ধকারে এই চশমাটির কথা একদম ভুলেই গেছে ও। চোখে পরে নিলো গগলসটি। চোখে দিতেই ছায়াময় দিনের মতো পরিষ্কার সব।
ওর অনুমান ঠিক। ওদের চোখেও ইনফ্রারেড গগলস। সুতারাং ওকে আগেই দেখেছে ওরা। যার জন্য সোজাসুজি ওর দিকেই এগুচ্ছে লোকগুলো। সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে সাবধান হলো সম্রাট। লোকগুলো আর গজ খানিক এলেই গুলি ছুঁড়তে হবে ওকে। নইলে বাঁচার কোনো উপায় থাকবে না। এরা এক ধরনের হায়েনা। মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়বে।
এসব ভাবতে ভাবতেই ঘটলো ঘটনাটি। পেছন থেকে সম্রাটের গলা পেঁচিয়ে ধরেছে একটি হাত। একই সাথে চেপে ধরেছে রিভলবার ধরা হাতটি। কঠিন হাতের চাপ। শ্বাস বন্ধ হওয়ার যোগাড়। কোনোভাবেই নড়াচড়া করার সুযোগ নেই। গলায় ফাঁস দেয়ার মতো হাত এতটা তীব্রভাবে চাপ দিচ্ছে সত্যি সত্যি দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর। তীব্র কণ্ঠে অথচ ফিসফিসিয়ে বললো- ফেলে দে রিভলবার। নইলে এভাবেই তোর জান কেড়ে নেবো। ফ্যাল। এতো কঠিন নির্দেশ যেনো কোনোদিন শুনেনি সম্রাট। ও বুঝে গেছে লোকটি এক কথা দুবার বলবে না। রিভলবারটি ফেলে দিলো সম্রাট। ঝুপ করে শব্দ হলো পাতার ওপর। হামাগুড়ি দিয়ে আসা দু’জনের একজন লাফিয়ে এসে তুলে নিলো রিভলবারটি।
ওকে ধরা লোকটি হাঁটু দিয়ে ওর কোমরের ওপর যাঁতা দিলো কঠিন ভাবে। বলল- আমাদের পিছু নিয়েছিস তো বুঝ জীবনের মজা? কি চাস বল! বাঘের মুখে এসে একাকীই দাঁড়িয়ে আছিস বাবু। টের পাবে ব্যাটা হাঁদারাম। এই বলে কঠিন যাঁতা মারলো আরেকবার। উফ্ পেছন অংশ যেনো অবশ হয়ে গেলো সম্রাটের। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো ও। ওই ব্যাটা কথা বল। মুখে তালা আছে নাকি। তালা খুলে দিচ্ছি বলে সাঁই করে একটি ভয়াবহ ঘুষি মারলো সম্রাটের মুখের ওপর। মারলো হামাগুড়ি দিয়ে আসা দ্বিতীয় লোকটি। ব্যথায় মুখ বেঁকে গেলো সম্রাটের।
মুখ খুললো সম্রাট। বেশ খানিকটা শব্দ করেই বললো- কোথায় রেখেছিস ওমর জামিলকে! ইচ্ছে করেই শব্দটা করলো সম্রাট। তার প্রতিক্রিয়াও হলো সাথে সাথে। আরো একটি ঘুষি উড়ে এলো ওর মুখে। সেই সাথে ফিসফিসানি- চুপ শালা। কপালে রিভলবার ঠেকিয়ে বললো- অন্যথা করবি তো খুলি উড়িয়ে দেবো। বজ্জাত কোথাকার। মহামনব সাজার শখ মিটিয়ে দেবো তোর। চিৎকার করে বললো- ওমর জামিলকে কিডন্যাপ করেছিস কেনো? কারা তোরা? কিসের মিশন তোদের?
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো ওরা। একজন রিভলবারের বাড়ি বসিয়ে দিলো ওর ঘাড়ে। চুপ শালা। গলার স্বর চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দেবো। বাড়ি খেয়ে টলছে সম্রাট। টলতে টলতে ধপাস করে পড়ে গেলো। দুচোখে জেগে উঠলো অন্ধকার। চোখে জ্বলছে জোনাকি। মাটিতে পড়েই দম বন্ধ করলো সম্রাট। স্যান্স হারানো চলবে না। জাগিয়ে রাখতে হবে নিজেকে। যতক্ষণ পারা যায় চেপে রাখলো দম। এতে কাজও হলো। সেন্স হারাতে গিয়ে হারায়নি। কিন্তু হারানোর অভিনয়টি করতেই হবে। ফলে মরার মতো পড়ে রইলো ও। পা দিয়ে এদিক ওদিক। ওদিক থেকে এদিক করে ওরা। একজন ঝুকে পড়ে ওর মুখের কাছে। বললো- মরে গেলো নাকি শালা! সাড়া শব্দ নেই। আরেকজন বললো- এতো সহজে মরণ ছোঁবে না ওকে। জ্ঞান হারিয়েছে মনে হয়। হাত পা বেঁধে রেখে দে এখানে। অমাদের হাতে সময় কম। বেশ মজবুত করে বাঁধা হলো সম্রাটের হাত-পা। যাহ শালা ঘুমা যতক্ষণ ইচ্ছা। আমরাই ভাঙাবো তোর ঘুম। তারপর হিসেব হবে তোর সাথে। ওমর জামিলের! সাথে কি সম্পর্ক তোর।

গুহার সাম্রাজ্য । জাকির আবু জাফরতিন.
ভাবে সম্রাট এরা কারা? এই গুহায় এদের কি কাজ? এরা যে ভয়ঙ্কর এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ ভয়ঙ্কর মানুষগুলোর কি মিশন? বন্য হিংস্র পশু আর সাপের রাজ্যে অস্ত্র নিয়ে কি করে এরা? এমন অনেক জিজ্ঞাসা উঁকি দিলো সম্রাটের মনে। ভাবে- ওমর জামিলের সন্ধান ওকে করতেই হবে। সেই সাথে এই ষণ্ডামার্কা ভয়ংকর লোকগুলোর কাজ সম্পর্কেও জানতে হবে। জানতেই হবে কেনো এরা জিম্মি করে মানুষ।
মরার মতো পড়ে রাইলো সম্রাট। শ্বাস প্রশ্বাস যতোটা সম্ভব ধীরে করার চেষ্টা করলো। যেনো ওরা ভাবে- ওর সেন্স সহসা ফিরবে না আর। একজনকে পাহারা রেখে চলে গেলো বাকিরা। যাকে রেখে গেলো তার চোখও চারদিকে ঘুরছে। সম্ভবত এদের বিদ্রোহী গ্রুপের আতঙ্কে এরা। চোখ খোলে মিটমিটিয়ে দেখলো সম্রাট। না। একদম গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে লোকটি। আবার চোখ বন্ধ করলো ও। অল্পক্ষণ। আবার খুললো সামান্য। দেখলো লোকটি পায়চারি করছে ওর চারপাশে। কিছুটা অস্থিরতা কাজ করছে লোকটির ভেতর। যে কোনো সময়ে হামলার ভয়ে কাতর মনে হয় লোকটিকে। লোকটির আনমনা পায়চারির সুযোগে হাতের বাঁধন ঢিলা করার চেষ্টা করছে সম্রাট। করতে গিয়ে দেখে কাজটি সহজ নয়। ভীষণ কঠিন করে বাঁধা দুটি হাত। পেছন মোড়া করে বেঁধেছে। খুব সহজে কাজটি করা যাবে না। ধীরে ধীরে চেষ্টা করছে। অনেকক্ষণ চেষ্টার পরও সামান্যতম ঢিলা করা যায়নি।
বেশ মজবুত করেই বেঁধেছে ওরা। পায়ের বাঁধনটিও নাড়াচাড়া করছে সম্রাট। মনে হলো পা কিছুটা ঢিলা হয়েছে। হাত মজবুত করে বেঁধে পায়ের বাঁধনখানিকটা দুর্বল করেছে হয়তো। খুব সাবধানে পায়ের বাঁধন ছোটানোর চেষ্টা করছে ও। যদি টের পায় লোকটি তবে রক্ষা নেই। হয়তো মাথায় বাড়ি দিয়ে সেন্স হারানোর চেষ্টা করবে। এর মধ্যে লোকটিও বেশ অস্থির হয়ে উঠেছে। তার দৃষ্টি অস্থির ভাবে চারদিক দেখছে। এই সুযোগটাই কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে সম্রাট। আরো খানিকটা ঢিলা হয়ে গেলো পায়ের বাঁধন। কিন্তু হাত ব্যথায় চিনচিন করছে। মনে হচ্ছে হাতে নাইলনের রশির দাগ বসে যাচ্ছে। চামড়াটা কেটে মাংসের ভেতর সেঁধে যাচ্ছে যেনো। এসব দেখার সময় এটা নয়- ভাবে সম্রাট। পায়ের বাঁধন ক্রমাগত ঢিলা হচ্ছে এটাই আনন্দের কথা। এর মধ্যে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ। সম্রাটদের উল্টো দিকেই ঘটনা। সম্রাটকে পাহারারত লোকটির অস্থিরতা আরো বেড়ে গেলো। গুলির শব্দের দিকে তির্যক চোখে চেয়ে আছে। সম্রাটের দিকে তার নজর নেই তেমন। এর মধ্যে পায়ের বাঁধন খুলে ফেললো সম্রাট। নিজেকে কিছুটা মুক্ত মনে হচ্ছে। এবার তাকে হাতের বাঁধন খুলতেই হবে। বেশ ধৈর্যের সাথে হাতের দিকে মন দিলো। ওদিকে গুলির আওয়াজ বেড়েই চলেছে। লোকটিও আরো বেখয়ালি হলো সম্রাটের প্রতি। রশির দাগ সাংঘাতিক ভাবে কেটে দিচ্ছে হাত। মনে হচ্ছে রক্ত ঝরছে কিছুটা। কিন্তু থামলে চলবে না। গোলাগুলি বন্ধ হতেই ওরা ছুটে আসবে সকলেই। সুতরাং যা করার অল্পক্ষণের মধ্যেই করতে হবে। কিছুটা মনে হয় ঢিলা হলো। আরো ঢিলা হলো রশি। খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠে মন। নাইলনের রশি এ এক সুবিধা। একটু ঢিলা হলে তারপর হতেই থাকে। এখনো হচ্ছে তাই। এইতো খুলে যাচ্ছে বাঁধন। হ্যাঁ খুলেই গেছে। খুলে গেলেও হাত ওভাবেই রাখলো ও। সুযোগের অপেক্ষা করছে এখন। লোকটির দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিলো। হ্যাঁ লোকটি সে দিকেই তাকিয়ে যেদিক থেকে অনবরত ভেসে আসছে গুলির শব্দ। লোকটাকে ধরাশায়ী করতে হবে প্রথমত। দ্বিতীয়ত লোকটির হাতে ধরা রিভলবারটি খুব প্রয়োজন। যেভাবেই হোক নিতেই হবে। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো সম্রাট। লোকটি আবার পায়চারি করা শুরু করলো। একবার সম্রাটের মাথার দিকে। একবার পায়ের দিকে। ভীষণ অস্থিরতা লোকটির ভেতর। সম্রাটকে ফেলে যেতে পারছে না এটাই তার বড় অস্থিরতা। মাথার দিক থেকে পায়ের দিকে লোকটি। ঠিক তখনি বিদ্যুৎ গতিতে জোড়া পায়ের লাথি ছুঁড়ে দিলো লোকটির বুকে। এক্রেলিকের মতো শোয়া থেকেই প্রচণ্ড লাথির আঘাত কোনো ভাবেই সামলাতে পারলো না লোকটি। কাটা গাছের মতো ধপাস পড়ে গেলো লোকটি। হাত থেকে ছিটকে পড়ে গেলো রিভলবারটি।
লোকটি ন্যাড়া কুকুরের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে ওঠার চেষ্টা করলো। পড়ার আঘাতে ঝিম ধরে গেলো মাথায়। সাধারণ কেউ হলে দুবার সেন্স হারাতো। কিন্তু এ লোক সেন্স হারায়নি। বরং উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে খুব। গালি দিচ্ছে সম্রাটকে। সম্রাট রিভলবার হাতে নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়লো লোকটির বুকের ওপর। একদম বুকে বসেই প্রচণ্ড এক ঘুষি দিলো লোকটির চোয়ালে। কাটা মুরগির মত তড়পাতে থাকলো কিছুক্ষণ। কিন্তু না এখনো সেন্স ধরে রেখেছে লোকটি। সম্রাট অজ্ঞান করতে চায় লোকটিকে। অকারণ খুন পছন্দ নয় ওর। ও ভাবে মানুষ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব। তাকে সামান্য কারণে খুন করা চলে না। চোয়ালে আরেকটি ঘুষি দিলো সম্রাট। হ্যাঁ কাজ হয়ে গেলো এবার। নিথর হয়ে গেলো শরীর। শুধু নিশ্বাসটা যাওয়া আসা করছে। দ্রুত হাত পাটা বেঁধে ফেললো ও। যে রশিতে বাঁধা ছিলো সম্রাট। সে রশি এখন লোকটির হাত পা জোড়া লাগিয়ে দিলো। হাত দু’টি পিঠের কাছে নিয়ে বাঁধলো। মজবুত করে বাঁধলো পা ও। উঠে দাঁড়ালো সম্রাট। ওপাশে গোলাগুলি থেমে গেছে ততক্ষণে। রাতের নিস্তব্ধতা এখন পাহাড়ে। চারিদিকে চোখ বোলাই সন্তর্পণে।
রাত প্রায় শেষের দিকে। চাঁদের ম্লান আলো পাহাড়ের গায়ে ছড়ানো। কী আশ্চর্য মৌনতা সারা পাহাড় জুড়ে। শূন্যতা যেনো বেজে উঠছে প্রকৃতির বুকে। নৈঃশব্দ্যের ভেতর এক ধরনের শব্দ শুনতে পাচ্ছে সম্রাট। একেই বোধহয় বলে প্রকৃতির গোপন শব্দ। কয়মিনিট অপেক্ষা করলো সম্রাট। না কেউ এদিকে এলো না।
কারো নড়াচড়ার শব্দও নেই এখন। তবে যারা গোলাগুলি করলো তারা কই? নিজেকে নিজেই জিজ্ঞেস করে সম্রাট। ওকে বেঁধে রেখে গেলো যারা খবর নেই তাদেরও। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলো ও। চাঁদের আলোয় কারো ছায়া দেখা যায় কি না দেখা যাক। না কাউকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। খুব সাবধানে পা রাখলো গুহার দিকে। এক পা দু’ পা করে এগুচ্ছে ও। চারদিকে চোখ কান খাড়া। কখন বিপদ এসে পড়ে জানে না কেউ। আর যদি ছুটে আসে কোনো বুলেট তবে তো মুহূর্তেই সব শেষ।
বিড়ালের মতো নিঃশব্দে পা বাড়াচ্ছে ও। পৌঁছে গেলো গুহার কাছে। একটু আগে হয়ে যাওয়া গোলাগুলির জায়গাটি দেখলো। দেখে চোখ ছানাবড়া ওর। এখানে ওখানে এলোপাতাড়ি পড়ে আছে বেশ কয়েকটি লাশ।রক্তে ভেসে আছে চারপাশ। লাশের শরীর থেকে রক্ত ঝরছিলো তখনো। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো সম্রাটের। ভাবে আহারে মানুষ। স্বার্থের লোভে অন্যকে মারে। নিজেও হয় খুন। খুন হয়ে এভাবে পড়ে থাকে কুকুর বেড়ালের মতো। প্রায় সাত আটটি লাশ পড়লো ওর চোখে। কে কার পক্ষে মারা গেলো? কেনো মারা গেলো? এই নিঝুম রাত্রিতে কেনোই বা এমন যুদ্ধ হলো এর কিছুই জানে না সম্রাট। শুধু জানে কোনো না কোনো স্বার্থ রয়েছে এর পেছনে। একটি স্বার্থকে জড়িয়ে কেউ পক্ষ কেউ বিপক্ষ। সেই স্বার্থেই বলি এই তরতাজা লোকগুলো।
গুহার অন্ধকার ভয়াবহ। এত অন্ধকার ভয়ে কাঁপন ধরিয়ে দেয় মনে! সম্রাট দেখলো ওর ব্যাগটি পিঠেই বাঁধা আছে। এতক্ষণ খেয়ালই করেনি। বেঁধে ছেদে যা-ই করেছে ওর ব্যাগটির ওপর হাত দেয়নি ওরা। প্রতিপক্ষের আশংকায় কাতর ছিলো বোধ হয়। সম্রাটকে ভেবেছে আকস্মিক এসে পড়া কেউ। পিঠ থেকে ব্যাগটি নামিয়ে নিলো। দেখলো। না সবই ঠিকঠাক। কিছুই খোয়া যায়নি ব্যাগ থেকে। অবশ্য তেমন কিছু ছিলোও না ব্যাগে। একটি লাইটার, একটি নাইফ, একটি পানির পট আর কিছু শুকনো খাবার। লাইটারটি হাতে নিলো সম্রাট। ব্যাগটি আগের মতো বেঁধে নিলো পিঠে। দাঁড়ালো গুহার মুখে। গুহাটি যেনো অন্ধকারের যম। লাইটার জ্বালালো সম্রাট। ডিজিটাল লাইটারটি আকারে বেশ ছোট। কিন্তু তার মুখ থেকে ভেসে আসা আলোর উচ্ছ্বাস বেশ বড়। লাইটারের আলোই আলোকিত হয়ে উঠলো গুহার মুখ। দেখেই বুঝলো সম্রাট এ গুহায় নিত্য যাওয়া আসা আছে কারো। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। গুহাটি ঢালু হয়ে চলে গেছে গভীরে। যে দিকে পাহাড় ক্রমাগত উঁচু হয়ে উঠেছে।
গুহায় প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নিলো সম্রাট। দেখতে হবে গুহার অভ্যন্তর। ওমর জামিলকে নিশ্চয় এখানেই জিম্মি রেখেছে ওরা। বিসমিল্লাহ বলে পা রাখলো গুহার ভেতর। ভেতরটা দেখে নিতে আবারো জ্বালালো লাইটার। মাথা ঝুঁকিয়ে দেখছে গভীরে। ঠিক তখনি মাথার পিছনে ঠাস পড়লো একটি পিস্তলের বাড়ি। মাথায় বাড়ি খেয়েই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার মতো উল্টিয়ে পড়লো সম্রাট। কোনো ভাবেই টাল সামলাতে পারলো না ও। উপর থেকেই ছুঁড়ে দেয়া পাথরের মতো গড়িয়ে পড়ছে গুহার গভীরে। এক সময় সেন্স হারালো। পৃথিবীর কোনো কিছুর অনুভূতি নেই তার। গুহার ভয়াল অন্ধকারের বুকে পড়ে থাকলো ওর নিথর দেহ।

গুহার সাম্রাজ্য । জাকির আবু জাফরচার.
যখন সেন্স ফিরে পেলো নিজেকে জমাট অন্ধকারের ভেতর আবিষ্কার করলো সম্রাট। ভাবতে চেষ্টা করলো কোথায় ও। মাথার পেছনে অনুভূত হচ্ছে তীব্র যন্ত্রণা। সারা গায়ে ব্যথা চিনচিন করছে। কি হলো? কোথায় এলো? নিজেকে নিজেই জিজ্ঞেস করে। হ্যাঁ মনে পড়ছে ধীরে ধীরে। হাত পা বাঁধা ছিলো। একটি লোক পাহারা দিচ্ছিলো। ওহ ঝিমঝিম করছে মাথায়। ভাবতে গেলে যন্ত্রণা বেড়ে যায়। হ্যাঁ- তাইতো লোকটাকেই তো বেঁধে ফেললো ও। তারপর? তারপর গুহার ওপাশে ছড়ানো ছিটানো এলোপাতাড়ি লাশ। তারপর গুহার মুখে। ইস গুহার মুখেইতো সবে নামতে নিয়েছিল ও। তারপরই মাথার পিছনে প্রচণ্ড আঘাত। তারপর মনে নেই আর কিছু। তবে কি গুহার গহীনে এখন। এই ভয়াল অন্ধকারের ডেরায়! হাতিয়ে দেখলো ব্যাগটি পিঠে নেই। খুব ক্ষিদে পেয়েছে। ব্যাগের শুকনো খাবারগুলো কাজে লাগতো বেশ। ডানে বাঁয়ে হাত বাড়িয়ে দেখলো। না কিছুই হাতে বাধে না। তাহলে কিছুক্ষণ দেখি।
হয়তো অন্ধকারে সয়ে যাবে চোখ। কিন্তু না। এ এমন অন্ধকারে কিছুতেই চোখ সোয়া হচ্ছে না। অন্ধকারে দেখা অভ্যস্ত দুটি চোখ আজ কিছুতেই ঠাহর করতে পারছে না। হাত খুলে দেখলো। নাহ হাতে সামান্য চিহ্নও দেখা যাচ্ছে না। গুটগুটে অন্ধকার। কেয়ামতের অন্ধকার বোধহয় এমনি হবে। শোয়া থেকে উঠে বসার চেষ্টা করলো ও। আহা সারা শরীর ব্যথায় টনটন করে উঠলো। শরীরে কেউ কি আঘাত করলো ওকে! মনে তো পড়ছে না। গুহার মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ার দৃশ্যটি ভেসে উঠলো মনে। গুহার গায়ে হয়তো পাথর সাঁটা। সেই পাথরে গড়িয়ে পড়ার ভয়াবহতা শরীরে বিঁধে আছে হয়তো। দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো এবার। কিছু একটা ভেবেই বসে পড়লো।
ভাবলো- দাঁড়াতে গিয়ে যদি মাথায় কিছু ঠেকে। আবার মাথায় আঘাত পেলে হজম করা মুশকিল হবে। বসেই যা করার করতে হবে। আগে ভাবা যাক কি করার আছে ওর। এ অন্ধকূপ থেকে আদৌ বের হতে পারবে ও। নাকি এখানেই নিভে যাবে ওর জীবন প্রদীপ।
বসে বসে এক দিকে যাবার চেষ্টা করলো ও। কোনো ভাবে কোনো আলোর রেখা পায় কি না খুঁজছে খুব। হঠাৎ মনে হলো মেঝেটা বেশ মসৃণ। ভাবলো- গুহার তলদেশে মেঝে এতোটা মসৃণ হবে কেনো? হাত চালিয়ে দেখলো। হ্যাঁ আশ্চর্য রকম মসৃণ। তবে কি ওরা সাজিয়ে নিয়েছে গুহার তলা। বিস্ময জাগে সম্রাটের। মসৃণ মেঝের পিঠে হাত রেখে পরখ করে একদিকে এগিয়ে যাচ্ছে ও। যেতে যেতে একসময় হাত ঠেকলো দেয়ালের মতো কিছুর সাথে। ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলো। হ্যাঁ দেয়ালই তো। হয়তো গুহার তলদেশের একপ্রান্তে এসে গেছে ও। দেয়ালে হেলান দিয়ে পা দুটি মেলে দিলো সামনে। বেশ খানিকটা ভালো লাগছে এখন। দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসাতে শরীর খানিকটা রিলাক্স ফিল করছে। মাথাটা দেয়ালের সাথে ঠেস দিতে গিয়ে কঁকিয়ে উঠলো ব্যথায়। পিস্তলের বাড়িটা জঘন্যভাবে লেগেছে মাথায়। সামান্যতেই ঝিমঝিম করে উঠলো মাথা। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে রইলো ও। বসে বসে ভাবছে ভয়ংকর গুহা থেকে বের হবার পথ। মনে পড়লো ওমর জামিলের কচি মুখটি। আহা কোথায় কিভাবে রেখেছে এই ক্ষুদে বিজ্ঞানীকে।
ভাবতে ভাবতে দু’চোখে ঘুম নেমে এলো। দেয়ালে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে গেলো ও। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে বুঝতে পারে না ও। যখন ঘুম ভাঙলো চোখ খুলে দেখে বেশ আলো ঝলমল একটি কক্ষ। কক্ষটির আয়তন খুব বেশি নয়। ছাদটিও খুব নিচু। মনে হচ্ছে দাঁড়ালে ঘাড় পর্যন্ত হবে। কক্ষটির মেঝ থেকে চার দেয়াল ছাদ সবই শূন্য। কোথাও কিছু নেই। দরজা কোন দিকে দেখার চেষ্টা করে ও। না দরজার কোনো চিহ্ন কোনো দেয়ালে নেই। ভাবে ও ঢুকলো কিভাবে এখানে। আপনা থেকে এখানে আসেনি এটাতো পরিষ্কার। নিশ্চয় ঢুকিয়েছে কেউ। কিন্তু কোন পথে! আধুনিক কোনো ডিজিটাল পদ্ধতি হবে হয়তো। যে পদ্ধতি প্রকাশ্যে দেখাবে না দরজার কিছু। খুব খেয়াল করে প্রতিটি দেয়ালের শরীর খুঁজছে ও। না কোনো দেয়ালেই নেই দরজার মতো কোনো পথ।
হঠাৎ চোখে পড়লো একটি ছায়ার ছাপ। তার উল্টো দিকের দেয়ালে আবছা দেখা যাচ্ছে ছায়ার চিহ্ন। গভীরভাবে দেখলো ও কি এখানে। দরজার কোনো নিশান নয়তো! উঠে এলো সম্রাট। ছায়ার সামনে দাঁড়িয়ে দেখলো। হাত বুলালো। না এ তেমন কিছু নয়। বেশ হতাশ লাগছে ওর। এমন বন্ধিত্ব কখনো বরণ করেনি ও। কিন্তু হতাশহলে বলবে না- নিজেকে বোঝায় সে। যত বিপদ আসুক যেমনি আসুক দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। মৃত্যু জীবনে একবারই আসে। সুতরাং ভয় করে কি লাভ। ক্ষুধা আবারো চোঁ চোঁ করে উঠলো পেটের ভেতর। কিছু না খেলে চলবে না মনে হয়। চার দেয়াল ঘুরে আবার আগের জায়গায় ফিরে এলো। দাঁড়িয়ে থাকতে অসুবিধা বেশ। একে নিচু ছাদ। তার ওপর মাথায় যন্ত্রণা। তার ওপর ক্ষুধার ক্লান্তি! বসে পড়লো ও। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আগের মতোই ছড়িয়ে দিলো পা।
ঠিক এসময় ঝা করে সরে গেলো মাথার ওপরের ছাদটি। যে দেয়ালে ছায়া চিহ্ন সেখানে নেমে এলো একটি মই। মই বেয়ে নেমে এলো পরপর তিনজন মুখোশধারী লোক। একটু পর নামলো আরেকজন। হাতে কিছু খাবার। মুখোশ পরা সেও। প্রথম তিনজনের একজন সম্ভবত এদের লিডার ইশারা দিলে খাবারটি রাখা হলো সম্রাটের সামনে। আরেকটি ইশারায় চলে গেলো লোকটি। ইশারাদাতা লোকটি সম্রাটকে বললোত- খেয়ে নাও বাচাধন। আমাদের খুব প্রয়োজন তোমাকে। তোমার মতো সাহসী মুখ খুঁজছি আমি। আমাদের মিশনে যদি তুমি যোগ হও এ হবে বিরাট ঘটনা। সম্রাট মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো- কোনো কথার জবাব এখন দেবে না ও। আগে খেয়ে নিতে হবে। ওদের মনোপূত জবাব না হলে খাবার কেড়ে নিতে পারে। সুতরাং চুপ করে নিচের দিকে চোখ রেখে দম নিচ্ছে ও। কোনো জবাব না পেয়ে লোকটি কথা বাড়ালো না। আগের মতোই বললো- খেয়ে নাও। তারপর কথা হবে।
সঙ্গের দু’জনকে থাকার নির্দেশ দিয়ে মই বেয়ে উঠে গেলো লোকটি। খাবারের প্লেটটি টেনে নিয়ে খেতে শুরু করলো সম্রাট।

(চলবে)

Share.

মন্তব্য করুন