• [বিশ্ববিখ্যাত রুশ সাহিত্যিক লেভ টলস্টয় (জ. ৯ সেপ্টেম্বর, ১৮২৮ – মৃ. ২০ নভেম্বর, ১৯১০) ছিলেন লেখকদের লেখক। তাঁর সাহিত্য প্রতিভা ও অবিস্মরণীয় অবদানের সূর্যালোকে বিশ্ব সাহিত্য আলোকিত হয়ে আছে। তিনি ছিলেন মানবতাবাদী লেখক। তাঁর প্রধান পরিচয় তিনি ঔপন্যাসিক। ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ ও ‘ আনা কারেনিনা’ উপন্যাস দু’টি টলস্টয়ের অনন্য সাহিত্য প্রতিভার পরিচয় বহন করছে। এ দু’টি উপন্যাসই বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম সেরা সৃষ্টি হিসেবে স্বীকৃত। তিনি ছিলেন উনিশ শতকের রাশিয়ার অভিজাত সমাজের সদস্য তথা উঁচুতলার মানুষ। কিন্তু তাঁর সাহিত্য সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। বলা হয়ে থাকে যে তাঁর সাহিত্যে অবাস্তব বলে কিছু  নেই। যা দেখেছেন, জেনেছেন তাই সাহিত্যে এনেছেন, অভিজ্ঞতার বাইরে কোনো কিছুকে তিনি সাহিত্যে আনেননি। আমৃত্যু তিনি সৃষ্টি করেছেন বিপুল বিচিত্র সাহিত্য সম্ভার। তাঁর সাহিত্য রচনার উদ্দেশ্য ছিল মানব কল্যাণ ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ সাধন। উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি বেশ কিছু ছোটগল্পও লিখেছেন। এ সব গল্প সাহিত্য স্রষ্টা টলস্টয়কে বিপুল সম্মান ও মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। রাশিয়া ও রাশিয়ার বাইরের জনজীবনের ছবি অতুলনীয় নৈপুণ্য ও দক্ষতার সাথে আঁকা হয়েছে গল্পগুলোতে । তিনি ছোটদের জন্যও গল্প লিখেছেন যাতে তুলে ধরা হয়েছে নীতি ও সত্যের জয়। শিশুদের ভবিষ্যত জীবন গঠন ও তাদের অনুপ্রেরণা দানে এ গল্পগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর বিখ্যাত গল্পগুলোর মধ্যে ‘ককেশাসের বন্দী’ অন্যতম। এটিকে ছোট উপন্যাসও বলা হয়ে থাকে। এতে একজন বন্দীর মুক্তির অদম্য পিপাসা চিত্রিত হয়েছে।]

(গত সংখ্যার পর)

মনিবও পাল্টা হাসি দেয়। দোভাষী তাকে ঝিলিনের কথা অনুবাদ করে শোনালে সে বলে-
: আমি তাদের ভালো কাপড়-চোপর দেব। পায়ের মাপ মত বুট দেব। তাদের রাজপুত্রের মত ভালো খাবার দেব। চাইলে তারা এক সাথেই গোলাঘরে থাকতে পারে। কিন্তু আমি দিনের বেলা তাদের পায়ের শিকল খুলে দেব না, কারণ তারা পালিয়ে যেতে পারে। তবে রাতের বেলা শিকল খুলে নেয়া হবে। তারপর সে ঝিলিনের কাঁধে চাপড় মেরে বলে-তুমি ভালো, আমিও ভালো।
ঝিলিন টাকা চেয়ে চিঠি লিখল ঠিকই, কিন্তু ঠিকানা দিল ভুল যাতে কোনোদিনই সেটা ঠিক জায়গায় না পৌঁছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে- পালাবে।
দু’জনকে গোলাঘরে ফিরিয়ে নেয়া হয়। মেঝেতে বিছানোর জন্য তাদের ভুট্টার কিছু খড়, একটি পানি ভরা জগ, কিছু রুটি, দু’টি পুরনো কম্বল ও কয়েক জোড়া পুরনো সামরিক বুট দেয়া হয়। বোঝা যায়, বুটগুলো মৃত রুশ সৈনিকদের পা থেকে খুলে নেয়া হয়েছে। রাতের বেলা সত্যিই তাদের পা থেকে শিকল খুলে নিল মনিব। তবে গোলাঘরে তালা লাগিয়ে দিতে ভোলে না।

তিন
দু’জনের বন্দী জীবনের একমাস পেরিয়ে গেছে। মনিব তাদের দেখলেই সব সময় হাসে আর বলে- তোমরা ভালো, আমি ভালো। কিন্তু সে তাদের ভালো কিছু খেতে দেয় না। খামির ছাড়া ভুট্টার রুটি- আটার তৈরি চ্যাপ্টা কেক, কোনো কোনো সময় না সেঁকা ময়দার কাঁচা ডেলা দেয় খাবার হিসেবে।
মুক্তিপণের টাকা চেয়ে কস্তিলিন দ্বিতীয়বার চিঠি লিখেছে বাড়িতে। সারাদিন তার কাটে মনমরা হয়ে আর টাকা পৌঁছনোর আশা করে। কখনো সে ঘুমিয়েই দিন ও রাত কাবার করে দেয়, কখনো বসে চিঠি আসার অপেক্ষা করে। ঝিলিন জানে তার চিঠি কোনোদিনই কোনো ঠিকানায় পৌঁছবে না। তাই সে দ্বিতীয় চিঠি লেখেনি। তার মা টাকা কোথায় পাবে? সে যে টাকা পাঠাত তাই দিয়েই মূলত তার মায়ের দিন চলত। এখন তাও বন্ধ। পাঁচশ’ রুবল যোগাড় করতে হলে বেচারী মারা যাবে। ঝিলিন ভাবে, স্রষ্টা সাহায্য করলে সে পালাতে পারবে। তাই সে চারদিকে নজর রাখার পাশাপাশি কিভাবে পালানো যায় তার পরিকল্পনা করতে থাকে। আউলের (তাতারদের গ্রাম) চারদিকে শিস দিতে দিতে হেঁটে বেড়ায় ঝিলিন। কখনো বসে কাজ করে। মাটি দিয়ে পুতুল বানায় কিংবা ডালপালা দিয়ে তৈরি করে ঝুড়ি। তার হাতের কাজ ছিল ভালো।
একদিন সে নাক, হাত ও পা সহ একটি মাটির পুতুল তৈরি করে। তারপর একটি গাউন পরিয়ে সেটা রেখে দেয় গোলা ঘরের ছাদের উপর।
প্রতিদিনের মত সেদিনও তাতার মেয়েরা পানি আনার জন্য তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। সবার আগে মনিবের মেয়ে দীনার চোখে পড়ে পুতুলটি। অন্য মেয়েদের ডেকে সেটা দেখায়। সবাই তাদের জগ নামিয়ে রেখে পুতুলটি দেখে হাসতে থাকে। ঝিলিন তখন পুতুলটি নামিয়ে এনে তাদের কাছে রাখে। কি ঘটে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে সে।
দীনা দৌড়ে এসে পুতুলটি হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। তারপর সেটা হাতে করে ছুটে পালিয়ে যায়। পরদিন সকালে বাইরে এসে ঝিলিন দেখে দীনা পুতুলটি নিয়ে তাদের বাড়ির আঙ্গিনায় খেলা করছে। লাল কাপড় পরিয়েছে। পুতুলটিকে কোলে নিয়ে দোল দিতে দিতে তাতারদের একটি ঘুমপাড়ানি গান গাইতে থাকে দীনা। এ সময় এক বৃদ্ধা মহিলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। পুতুল নিয়ে খেলতে দেখে তাকে ধমক দেয় সে। তারপর পুতুলটি কেড়ে নিয়ে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেলে। দীনাকে পাঠিয়ে দেয় তার নিজের কাজে।
ঝিলিন আগেরটির চেয়ে আরো সুন্দর করে একটি পুতুল বানিয়ে দেয় তাকে।
একদিন দীনা একটি ছোট জগ হাতে করে তার কাছে আসে। জগটি মাটিতে রেখে নিজেও মেঝেতে বসে পড়ে। আঙ্গুল দিয়ে জগটি দেখিয়ে ঝিলিনের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে সে। ঝিলিন অবাক হয়। মেয়েটি হাসছে কেন তা সে বুঝতে পারে না। পানি আছে মনে করে জগটি হাতে নিয়ে দেখে তার ভেতরে দুধ ভরা। প্রায় এক চুমুকে দুধটকু নি:শেষ করে সে। তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে-চমৎকার!
দীনা খুব খুশি হয়। বলে- ভালো ইভান, ভালো। উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দেয় সে। তারপর জগ তুলে নিয়ে এক দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। এরপর থেকে প্রতিদিনই সে ঝিলিনের জন্য গোপনে খানিকটা করে দুধ এনে দেয়।
তাতাররা ছাগলের দুধ থেকে এক ধরনের পনির তৈরি করে। ছাদে শুকায় তারা এটা। দীনা কখনো কখনো তার জন্য এক টুকরো পনির চুরি করে আনে। একদিন তাদের বাড়িতে একটা ভেড়া জবাই করা হয়। দীনা জামার হাতার ভিতরে ঝিলিনের জন্য রান্না করা একটুকরো মাংস নিয়ে আসে। ঝিলিনের সামনে সেটা ছুঁড়ে দিয়েই দৌড়ে পালায় সে।
প্রচন্ড ঝড় বয়ে গেল একদিন। তারপর প্রায় এক ঘন্টা ধরে বৃষ্টি হল মুষলধারে। ঝর্ণাগুলোতে ঘোলা পানির জোরালো স্রোত বইতে থাকল। হাঁটু সমান পানির উচ্চতা দাঁড়াল প্রায় সাত ফুট। স্রোতের বেগ এত প্রবল হল যে পাথরও গড়িয়ে নিয়ে চলল। নানা স্থানে সৃষ্টি হল পানির নালা। ঝড়ের গর্জন প্রতিধ্বনিত হতে লাগল পাহাড়ে। ঝড় থেমে যাওয়ার পর ঝিলিন তার মনিবের কাছ থেকে একটি ছুরি চেয়ে নেয়। তার সাহায্যে ছোট একটি সিলিন্ডার তৈরি করে সে। একটি বোর্ড কেটে ছোট ছোট টুকরো করে একটি চাকা বানায়। তার দু’প্রান্তে জুড়ে দেয় দু’টি পুতুল। দীনা তাকে কাপড়ের ছোট ছোট কিছু টুকরো দিয়েছিল। সে কাপড় দিয়ে পুতুল দু’টির একটিকে চাষী অন্যটিকে চাষী বউ হিসেবে সাজায়। চাকাটি সে এমনভাবে স্থাপন করে যাতে স্রোতে তা সহজেই ঘুরতে পারে। চাকাটি ঘুরতে থাকে আর সে সাথে নেচে চলে ঝিলিনের বানানো চাষী ও চাষী বউ।
এ মজার দৃশ্য দেখার জন্য পুরো আউলের লোকই জড়ো হয় সেখানে। ছোট বালক-বালিকা, তাতার নারী-পুরুষ কেউ বাদ যায় না।
: বাহ্ রুশ! বাহ্ ইভান! তাদের মুখ থেকে প্রশংসা বেরিয়ে আসে।
দীনার বাবার কাছে একটি ভাঙ্গা রুশ ঘড়ি ছিল। একদিন ঝিলিনকে সে দেখায় তা। ঝিলিন তাকে বলে-
: ওটা আমাকে দাও, আমি ঠিক করে দিচ্ছি। সে ছুরি দিয়ে ঘড়িটির সব অংশ খুলে ফেলে খুব যত্ন করে আবার লাগায়। ঠিকমত চলতে শুরু করে সেটা। ঝিলিনের এ কাজে খুব খুশি হয় তার মনিব। এত খুশি যে নিজের বহু ছিদ্রযুক্ত পুরনো একটি টিউনিক সে তাকে উপহার দেয়। ঝিলিন নেয় সেটা। কারণ, রাতে এটাক বিছানার চাদর হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
এ ঘটনার পর চারদিকে ঝিলিনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে তাতাররা নষ্ট বা খারাপ বন্দুক, পিস্তল বা ঘড়ি মেরামতের জন্য তার কাছে আসতে শুরু করে। ব্যাপার দেখে তার মনিব খুব খুশি। তাকে সাঁড়াশি, তুরপুন, ফাইল সহ কিছু জরুরি সরঞ্জাম এনে দেয় সে।
একদিন এক তাতার অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার আত্মীয় এসে ধরে ঝিলিনকে-
: চল, তাকে দেখবে। চিকিৎসা করবে। ঝিলিনের চিকিৎসার ব্যাপারে কোনো জ্ঞান ছিল না। তারপরও সে তাদের সাথে অসুস্থ লোকটিকে দেখতে গেল। ভাবল, কোনো ভাবে হয়ত লোকটি সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।
গোলাঘরে ফিরে আসে সে। গ্লাসে পানি নিয়ে তার সাথে কিছুটা বালি মেশায়। তারপর তাতারদের সামনে মন্ত্র পড়ার মত বিড়বিড় করে কিছু পড়ে। সেই পানি খেতে দেয় অসুস্থ লোকটিকে। যে কোনো কারণেই হোক, লোকটি ভালো হয়ে যায়।
ঝিলিন তাতারদের ভাষা কিছুটা শেখার চেষ্টা করে। কয়েকজনের সাথে তার বেশ খাতির হয়ে যায়। তারা যখন তার কাছে আসে তখন ইভান! ইভান ! বলে ডাক দেয়। অন্যরা তার দিকে বাঁকা চোখে তাকায়। যেন জঙ্গলের কোনো জানোয়ারকে দেখছে।
লাল দাড়ি তাতার ঝিলিনকে দেখতে পারে না। তাকে দেখলেই সে বেজার হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেয় কিংবা অভিশাপ দেয়। এক বুড়োকে রোজই দেখতে পায় ঝিলিন। আউলের বাইরে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে আসে লোকটি। মসজিদে যাওয়ার সময় ঝিলিনের সাথে তার দেখা হয়। ছোটখাটো দেহের লোকটার মাথার টুপির ওপর সাদা কাপড়ের পাগড়ি। তার গোঁফ ও দাড়ি বরফের মত সাদা , মুখের পাটল রঙের চামড়া কুঁঁচকে গেছে। ঈগলের মত বাঁকা তার নাক, ধূসর চোখ দুটোর কারণে চেহারা নিষ্ঠুর দেখায়। সামনের দাঁত দু’টি ছাড়া মুখে আর কোনো দাঁত নেই। লাঠি হাতে নেকড়ের মত চারপাশে তাকিয়ে সে পথ হাঁটে। ঝিলিনকে দেখলেই দাঁত-মুখ খিঁচে অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ায়।
বুড়ো লোকটি কোথায় থাকে তা দেখতে একদিন পাহাড়ে যায় ঝিলিন। পথের একপাশে পাথরের দেয়াল ঘেরা একটি বাগান দেখতে পায় সে। বাগানে চেরি ও অ্যাপ্রিকট গাছের সারি। তার পিছনে সমতল ছাদের একটি কুটির। আরেকটু এগোতে খড় দিয়ে তৈরি কিছু মৌমাছি পালনের বাসা চোখে পড়ে। সেগুলোকে কেন্দ্র করে মৌমাছির দল উড়তে থাকায় গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল।
হাঁটু গেড়ে বসে মৌমাছির একটি বাসা ঠিক করছিল বুড়ো লোকটি। সে কি করছে তা দেখার জন্য ঝিলিন পা বাড়াতেই তার শিকলে শব্দ হয়। বুড়ো লোকটি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখে চেঁচিয়ে ওঠে। মুহূর্তের মধ্যে কোমরের বেল্ট থেকে পিস্তল বের করে ঝিলিনকে গুলি করে সে। তবে চোখের পলকে দেয়ালের ওপাশে ঝাঁপিয়ে পড়ে বেঁচে যায় ঝিলিন।
বুড়ো লোকটি ঝিলিনের মনিবের কাছে গিয়ে তার বিরুদ্ধে নালিশ জানায়। মনিব ডেকে পাঠায় ঝিলিনকে। হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে –
: তুমি বুড়ো লোকটির বাড়ি গিয়েছিলে কেন?
ঝিলিন বলে-
: তার কোনো ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে নয়, সে কিভাবে থাকে তাই দেখতে গিয়েছিলাম।
মনিব বুড়োকে তার কথা ভাষান্তর করে শোনায়। কিন্তু তাতে তার রাগ কমে না। তর্জন-গর্জন করে, দু’টি দাঁতের সম্বল বের করে, হাতের ঘুঁষি বাগিয়ে ঝিলিনকে ভয় দেখিয়ে চলে যায়। যাবার আগে তার মনিবকে কিছু সময় ধরে কি যেন বলে সে। তার সব কথা না বুঝলেও সে এটুকু বুঝতে পারে যে একজন ঘৃণ্য রুশকে আউলে না রেখে মেরে ফেলা উচিত – মনিবকে এ কথাই বলে গেল বুড়ো লোকটা।
মনিব বলে-
: তিনি একজন বিরাট মানুষ। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী যোদ্ধা ছিলেন তিনি। এক সময় খুব ধনী ছিলেন। তাঁর ছিল তিন স্ত্রী ও আটটি ছেলে। একটি গ্রামে বাস করতেন তারা। একদিন শয়তান রুশরা আসে। সাত ছেলেকে হত্যা করে তারা। বাকি ছেলেটি রুশদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। তখন তিনি নিজেও গিয়ে তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। রুশদের সাথে তিনমাস বাস করেন তিনি। যেদিন ছেলেকে প্রথম দেখতে পেলেন সেদিনই তাকে নিজের হাতে হত্যা করে পালিয়ে আসেন। তারপর থেকে লড়াই করা ছেড়ে দেন তিনি। পরে মক্কায় গিয়ে হজ করেন। সে জন্যই পাগড়ি পরেন মাথায়। সব হাজিই মাথায় পাগড়ি পরে। তিনি রুশত সৈন্যদের দেখতে পারেন না। তোমাকে হত্যা করার জন্য আমাকে বলেছেন তিনি। কিন্তু আমি তা করব না। কারণ, তোমার জন্য আমার অনেক খরচ হয়ে গেছে। তাছাড়া তোমার গুণের ভক্ত হয়ে গেছি আমি, ইভান। হত্যা তো দূরের কথা, মুক্তিপণ পেলে ছেড়ে দেব বলে ওয়াদা না করলে তোমাকে আমি যেতেই দিতাম না। তারপর হেসে বলে সে- তুমি ইভান ভালো, আমি আবদুল ভালো।

আধুনিক পক্ষিরাজ ঘোড়ার গল্প । আশরাফ পিন্টুচার.
এর পর আরো এক মাস পেরিয়ে যায়। দিনের বেলা ঝিলিন আউলের এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায় কিংবা বসে বসে এটা ওটা দিয়ে নানা রকমের জিনিসপত্র তৈরি করে। রতের বেলা আউলের সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন ছুরি দিয়ে মেঝে খুঁড়তে শুরু করে সে। পাথরের কারণে কাজটা খুবই কঠিন,তাই ছুরির সাথে ফাইলও ব্যবহার করে। অবশেষে দেয়ালের নিচ দিয়ে একটি মানুষের আসা-যাওয়ার মত একটি গর্ত তৈরি হয়। ঝিলিন ভাবে-এলাকা আমার অচেনা, পথও চিনি না। তাতারদের কেউই আমাকে কিছু জানাবে না। তাহলে পালাব কিভাবে!
সে এমন একটি দিন বেছে নিল যেদিন তার মনিব বাড়ি থাকবে না। দুপুরের খাবারের পর সে বাড়ির পিছনে পাহাড়ের দিকে রওনা হয়। উদ্দেশ্য, পাহাড়ের উপর উঠে আউলটি ভালো করে তাকিয়ে দেখা। এদিকে তার মনিব বাড়ি থেকে যাওয়ার আগে তার বালক ছেলেকে নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিল যে সে যেন ঝিলিনের উপর চোখ রাখে এবং কোনো সময় তাকে চোখের আড়াল না করে। তাই ঝিলিন বাড়ি থেকে বের হতেই সে তার পিছু নেয়। চিৎকার করে বলেঃ যেও না, যেও না। বাবা রাগ করবে। থাম।
ঝিলিন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। বলে-
: ভয় নেই, বেশি দূরে যাব না। শুধু ঐ পাহাড়াটায় উঠব। আমি অসুস্থ লোকদের চিকিৎসার জন্য একটি ভেষজ গাছ খুঁজতে যাচ্ছি। ইচ্ছে হলে তুমিও আমার সাথে আসতে পার। আমার পায়ে শিকল। এটা নিয়ে কিভাবে পালাব, বল? শোন, কাল তোমাকে আমি তীর-ধনুক বানিয়ে দেব।
বালকটি তার কথা বিশ্বাস করে ফিরে যায়। পাহাড়ের দিকে তাকায় ঝিলিন-পাহাড়ের চূড়া খুব দূরে বলে মনে হয় না। পায়ে শিকল নিয়ে পাহাড়ে ওঠা কঠিন। তবু সে উপরে উঠতে থাকে এবং এক সময় চূড়ায় পৌঁছে। সেখানে বসে চারপাশ চেয়ে দেখে। দক্ষিণে গোলাঘরের পিছনে একটি উপত্যকা। সেখানে ঘোড়ার পাল ঘাস খাচ্ছিল। উপত্যকার তলায় দেখা যাচ্ছিল আরেকটি আউল। তারপর একটি খাড়া পাহাড়, তার পিছনে আরেকটি।

(চলবে)

Share.

মন্তব্য করুন