খায়রুল সাহেব সিএনজি চালকের দিকে তাকিয়ে প্রথমে কিছুটা ভড়কে গেলেন। এমন চুল-ভ্রূ-পশমহীন মানুষত তিনি জীবনেও দেখেননি। তবে ভড়কানোটা তার মধ্যে বেশিক্ষণ ভর করতে পারল না। কারণ, বিচিত্র এই দুনিয়ায় এমন অভূতপূর্ব চিত্র দেখা যেতেই পারে। ‘যা মন চায়, দিয়েন’- সিএনজিওয়ালার এই বাক্যে খায়রুল সাহেবের মন আবেগে আপ্লুত হয়ে গেল। এত ভালো মানুষ এখনো আছেন! সিএনজিচালকেরা সাধারণত মিটারে যেতে চায় না; মুখে একটা ভাড়া বলে দেয়- যাত্রী গেলে যাবে; না গেলে নাই। এই হলো তাদের সেবার নমুনা। এর চেয়েও মারাত্মক, প্রয়োজনের সময় তারা অনেকে যেতেই চায় না।
আজকে খায়রুল সাহেবের ভাগ্য ভালো। পকেটে বেশি টাকা নেই। ড্রাইভার ইচ্ছা অনুযায়ী দিতে বলায় তিনি আর দেরি না করে সিএনজিচালিত অটোরিক্সাটিতে উঠে পড়লেন। যেতে হবে বহুদূর- আগারগাঁও থেকে উত্তরা। সরকারি চাকরি করেন খায়রুল সাহেব। আগারগাঁওয়ে অফিস। বাসা উত্তরার রাজলক্ষ্মীতে। অফিসের সামনে থেকেই পাবলিক বাস পাওয়া যায়। কিন্তু পল্লবী, কালসী, মাটিকাটা ইত্যাদি এলাকা হয়ে দীর্ঘ পথ ঘুরে বাস যায় বলে বাসায় যেতে তার আড়াই ঘণ্টার মতো সময় লেগে যায়। আজ এত দেরি করা যাবে না বলেই এই সিএনজিভ্রমণ।
একমাত্র মেয়ে মীম-এর জন্মদিন। মেয়েকে ভীষণ ভালোবাসেন খায়রুল সাহেব। একটি অনলাইন গিফট শপ-এ অর্ডার দিয়ে অফিসের ঠিকানাতেই মেয়ের জন্য সুন্দর গিফট আনিয়েছেন- বারবি পুতুল, পাঁচ রঙের তাজা পাঁচটি গোলাপ, সুদৃশ্য কাচের ফুলদানি, চকোলেট, ‘হ্যাপি বার্থডে’ লেখা বেলুন এবং সুন্দর উইশ লেখা কার্ড। অনলাইন গিফট শপের সার্ভিসে তিনি সন্তুষ্ট। অফিসের ঠিকানায় নির্ধারিত সময়ের আগেই উপহারসামগ্রী পৌঁছে গেছে।
সিএনজিওয়ালা ছুটছে একটু বেশিই জোরে। এই মুহূর্তে খায়রুল সাহেবের কিছুটা ভয়ও লাগছে। মহাখালী ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছে রানওয়েতে প্লেন-এর মতো ছুটে চলেছে! বলা যেতে পারে, অটোরিক্সাটি চাকার ওপর ভর করে না; বরং বাতাসে ভর করে ছুটছে। খায়রুল সাহেব চালককে আস্তে চালানোর কথা বলতে গিয়ে খেয়াল করলেন, তার কণ্ঠ দিয়ে শব্দ বেরোচ্ছে না! তিনি কথা বলছেন ঠিকই, কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে একদমই শোনা যাচ্ছে না তার কথা!
সিএনজির গতি আরও বেড়ে গেল। লোহার খাঁচায় বন্দী খায়রুল সাহেব দু’পাশে তাকিয়ে হতবাক হচ্ছেন। এত দ্রুত সিএনজি চলছে যে তার মাথার মধ্যে রীতিমতো এলোমেলো লাগছে। মুহূর্তেই তারা বিশ্বরোডের কাছাকাছি চলে এসেছেন। হঠাৎ অটোরিক্সার গতি মারাত্মকভাবে বেড়ে গেল! খায়রুল সাহেব হড়হড় করে বমি করে দিলেন। অসুস্থ লাগছে তার। বাইরে তাকিয়ে দেখলেন, ভয়ঙ্কর গতিতে ছুটছে সিএনজি! তিনি চিৎকার করা শুরু করলেন। কিন্তু লাভ নেই। কোনো শব্দই শোনা যাচ্ছে না! তার মনে হচ্ছে, তিনি জ্ঞান হারাচ্ছেন। খানিক বাদেই ভয়ঙ্কর ঝাঁকি খেয়ে সিএনজির গতি কল্পনাতীতভাবে বেড়ে গেল।
খায়রুল সাহেব চোখে অন্ধকার দেখছেন। চারদিকে নিকষ আঁধার। মাঝে মাঝে লাল-হলুদ-কমলা-নীল নানা রঙের প্যাটার্ন। জ্ঞান হারিয়েছেন কিনা বোঝার জন্য তিনি নিজের হাতে চিমটি কাটলেন। ব্যথা পেয়ে কঁকিয়ে উঠলেন কিন্তু কঁকিয়ে ওঠার শব্দ শোনা গেল না।

স্পেস স্পেসিমেন । আসিফ মেহ্দী

দুই.
কয়েক মিনিটের মধ্যে আবার এক ভয়ঙ্কর ঝাঁকি খেয়ে সিএনজির গতি কমে এল। মুহূর্ত পরেই একদম থেমে গেল। একটি হলরুমের মধ্যে এসে থেমেছে তারা! বিধ্বস্ত অবস্থায় খায়রুল সাহেব সিএনজির ভেতর থেকে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন, সিএনজিচালকের মতো বিশ-পঁচিশজন চুল-ভ্রূ পশমহীন মানুষ সেখানে। প্রত্যেকের গলায় ডাক্তারদের স্টেথোস্কোপ-এর মতো কোনো একটা যন্ত্র ঝোলানো। সবার গায়েই অ্যাপ্রন। অটোরিক্সাটি থেকে চালক নেমে গেল।
শান্তশিষ্ট চেহারার বয়স্ক একজন এগিয়ে এসে অটোরিক্সার কাছে দাঁড়াল। তারপর উপস্থিত অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘প্রিয় ছাত্রছাত্রীগণ, এখানে আছে পৃথিবীর বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ, যার মহাজাগতিক বৈজ্ঞানিক নাম মিল্কিওয়ে আর্থো হোমোস্যাপিয়েনস।
সাড়ে সাত শ কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্রহ পৃথিবী থেকে আমাদের ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট মানুষপ্রজাতির একটি স্পেসিমেন সংগ্রহ করে এনেছেন এই ‘স্পেস ট্র্যাভেল মেশিন’-এ। তাহলে আসুন, আমরা মানুষটিকে ব্যবচ্ছেদ করে আজকের ক্লাস শুরু করি।’ এই কথা শুনে খায়রুল সাহেব আতঙ্কে শিউরে উঠলেন। চোখের সামনে তার পাঁচ বছরের মেয়ে মীম-এর মুখচ্ছবি ভেসে উঠল; প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখ ভেসে উঠল। তিনি সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠলেন। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুত কারণে তার চিৎকারের শব্দ শোনা গেল না।

Share.

মন্তব্য করুন