রুদ্র চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভাবলো। ভাবার সময় মানুষের চোখ কি পিটপিট করে? রুদ্রর চোখ অমন করছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রুবিক্স কিউবটা বারবার অন্যমনস্কভাবে ঘোরাচ্ছে সে। মাঝে মাঝে রুদ্র সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। এখন যেমন ভুগছে। তার কাছে দুটো অপশন আছে। দেবে- নাকি দেবে না। প্রচণ্ড শীত পড়ছে। শীতের প্রকোপে থরথর করে কাঁপছে মানুষ। এদিক সেদিক ফায়ার প্লেস দেখা যাচ্ছে। ৩০০৩ সালের বাংলাদেশ। এখানে দেশের সবখানে সমানে বরফ পড়ছে। বিশাল বিশাল উড়াল সড়কগুলো বরফে চাপা পড়ে থমকে আছে। বরফের চাঁই ভেঙে ভেঙে পড়ছে। একটি ছেলের চিৎকার শোনা গেল। রুদ্র জানালা দিয়ে তাকালো। বরফ বরফ খেলছে ছেলেগুলো। একজনের দিকে আরেকজন বরফ ছুঁড়ে মারছে। রুদ্র হাসলো। ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল। নিজের ছেলেবেলার কথা। রুদ্রের মস্তিষ্কে দু’টি মানুষের স্মৃতি রাখা আছে। নিজের দাদার আর একজন এভারেস্টজয়ীর। মাঝে মাঝে দাদার মস্তিষ্কে ঢুঁ মেরে আসে সে। দাদা ঠিক এ বয়সে কী করছেন তা দেখে সে দারুণ মজা পায়।
দাদার ঠিক এ বয়সটিতে দাদা কানামাছি নামের এক অদ্ভুত খেলা খেলছেন। রুদ্র হাসলো। নিজের ছেলেবেলায় কী করছিল একটু দেখতে চাইলো। যে ছেলে বরফ খেলছে তার মস্তিষ্ক স্ক্যান করতে হবে। এটা খুব সোজা। ছেলেটার একটি ছবি নিলো। মস্তিষ্ক স্ক্যান যন্ত্রে ছবিটা পাঠালো। বেরিয়ে এলো ছেলেটার বয়স ২ বছর ৩ মাস ২৬ দিন। রুদ্রর নিজের বয়সটা ঐদিনে ২০৯৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি হয়। রুদ্র নিজের বয়সটা ইনপুট করে ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো। ফলাফল নানা রকম ভাবে দেখা যায়। নিজের মস্তিষ্কে ঐ সময়ের পুরো দিনের দৃশ্য নেওয়া যায়। মানে মস্তিষ্ককে ঠিক ঐ বয়সে নিয়ে যাওয়া যায়। অথবা ভূ-উপগ্রহ থেকে তোলা স্যাটেলাইট বহুমাত্রিক ভিডিওতে দেখা যায় নিজের ঐদিনের কর্মকা-। রুদ্র নিজের মস্তিষ্কে ফিল নিতে চাইলো। আউটপুট বাটনে প্রেস করার আগেই হঠাৎ করে টেলিফোন বেজে উঠলো। সে কত আগের এই জিনিসটা পৃথিবী থেকে উঠে যায়নি কেন তা ভাবতেই অবাক হয় রুদ্র।
কি বিটক্যালে সাউন্ড। সরকারি কাজকর্মে টেলিফোন জিনিসটা না হলে যেন চলেই না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা ধরলো। ওপাশ থেকে ঝিঁ-ঝিঁক ঝিঁ-ঝিঁক একটা আওয়াজ শোনা গেল। গমগমে একটা কণ্ঠস্বর বলে উঠলো- কী সিদ্ধান্ত নিলে?
রুদ্রর মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে গেল। তার ইচ্ছে হলো চিৎকার করে গালি দিতে। একটানে ফোনের তার ছিঁড়ে ফেললো। ফোনটাকে থেঁতলে দিলো চেয়ার দিয়ে। ফোনের উপরে উঠে বার কয়েক লাফ দিলো। পকেট থেকে ছোট একটি চিপ বের করলো। মেমোরি চিপ। মেমোরি চিপটা অনেকক্ষণ ধরে রাখলো চোখের সামনে। দু’চোখ তীক্ষ্ণ করে তাকালে সব কিছু ঝাপসা হয়ে যায়।
ডিএসএলআরের মতো। অনেকক্ষণ এভাবে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করলে চোখ দিয়ে জল পড়ে। রুদ্রের চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল পড়ল। পড়ল মানে কপোলে এসে থেমে গেল। সে এই জলবিন্দু হাতে নিলো। হাতে নেয়ার সাথে সাথে মস্তিষ্ক এ নিয়ে ব্রিফ করা শুরু করলো। চোখের জল কোন গ্লান্ড থেকে আসে, কোথায় তৈরি হয়। শুনতে ভালো লাগছে না রুদ্রর। এখন যদি একটা চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলে তাহলে চুলের বর্ণনা শুরু করবে। রুদ্রর মনে হলো কিছু একটা করা উচিত। এই কিছু একটা কী? তাকে যারা অনুসরণ করছে তাদের বিভ্রান্ত করা। তার মাথায় হাজারো বিশ্লেষণ জমা হয়ে গেছে। কোথায় গেলে সবচেয়ে নিরাপদ, কোথায় গেলে কী হবে। একের পর এক মস্তিষ্কে প্রস্তাবনা আসতে থাকলো। মনের ভেতর কে যেন চিৎকার দিয়ে সুনীল গাঙ্গুলীর একটি কবিতা আবৃত্তি করে চললো, ‘ইচ্ছে করে লণ্ডভণ্ড করি এবার পৃথিবীটাকে। মনুমেন্টের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে বলি আমার কিছু ভাল্লাগে না।’ জানালার শার্সিতে বরফের পুরো আস্তরণ জমে গেছে। একপাশে নিজের নাম লিখলো রুদ্র। নামটা আবার দমকা তুষারে মুছে যাচ্ছে। আবার লিখলো আবার মুছলো।
বাইরে তাকিয়ে দেখলো ছেলেরা নেই। নিশ্চয়ই মা হন্যে হয়ে ঝেঁটিয়ে বাড়ি নিয়ে গেছে। রুদ্রর মন হাহাকার করে উঠলো। মায়ের অভাবে যেন বুকের ভেতরটা কেঁদে উঠলো। মায়ের একটি ছবি টাঙানো আছে সামনে। ছবিটা ক্লিক করলেই মা কথা বলবে। মা কথা বলবে মানে মৃত্যুর আগের রেকর্ডের কথা। ‘খাইছিস, ঘুমা, সকাল সকাল উঠছিস কেন?’ সন্ধ্যায় ভিডিও চালু করলে বলবে, ‘অ্যাই, নো ল্যাপটপ। পড়তে বস।’ এসব একঘেয়ে শুনতে শুনতে আর ভালো লাগে না। রুদ্রের মায়েরা মরে যায় ক্যান! কালো কাচে ঢাকা একটা গাড়ি স্লো মোশনে এসে থামলো রুদ্রের গবেষণাগারের সামনে। ভেতর থেকে নামলো চৌকস এক ব্যাটালিয়ন পুলিশ। অফিসের চারপাশে তারা অনেকটা জালের মতো ঘিরে রাখলো। অফিসের ভেতর ঢুকে এদিক-সেদিক তল্লাশি করে রুদ্রকে কোথাও পাওয়া গেল না। রুদ্রের খোঁজে পুরো গবেষণাগার চেক করা হচ্ছে। রুদ্র হারিয়ে গেছে। রুদ্রের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে তোলপাড় শুরু হলো। জাতীয় নিউজ এজেন্সিগুলো তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকলো রুদ্রর খবর। রুদ্র এমন এক জিনিস আবিষ্কার করেছে যা কল্পনাও করতে পারবে না মানুষ। অদৃশ্য হয়ে যাওয়া নিয়ে অনেক বিজ্ঞানীই কাজ করেছেন। ধারণা করা হচ্ছে একমাত্র সফল ব্যক্তি রুদ্র।
তাই রুদ্রকে সরকার চায়। অন্য দিকে রুদ্র চায় না সরকারের হাতে এ জিনিস যাক। কারণ সরকার এমন কিছু করছে যা দেশের মানুষ জানছে না। ভূ-অভ্যন্তরে খনিজ পদার্থ তোলার নামে বিশাল এলাকা দখল করে কি যেন একটা করছে সরকার। দেশের মানুষকে মিথ্যা বলে দমিয়ে রাখা হচ্ছে। এমনকি এই প্রকল্প নিয়ে কেউ কিছু বললে তাকে গুম করে ফেলা হচ্ছে। এ অবস্থায় রুদ্র এই জিনিস তাদের হাতে তুলে দিলে ঘটনা আরো ভয়াবহ হতে পারে। দেখা যাবে বহু মানুষের মাঝ থেকে একটা ছেলে নাই হয়ে গেছে। অন্যদিকে একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন রুদ্রের কাছে বারবার এ জিনিস চাচ্ছে। তাদের ধারণা রুদ্র এ জিনিস দিয়ে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনটির ওপর ছড়ি ঘোরাবে। তাদের ধারণা একদম বিফলও নয়। সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ‘জেনেরিয়া’ একটি বোমা বিস্ফোরণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল ঢাকায়। এ সময় রুদ্রের একটা মেইল পেল তারা বোমা হামলা হলে সংগঠনের প্রধানকে তাৎক্ষণিক হত্যা করা হবে। ভয়ে তারা পিছু হটে। পিছু হটলেও তারা আসলে নিশ্চিত নয় রুদ্রের অদৃশ্য হওয়ার শক্তির ব্যাপারে। তবু সাবধানের মার নেই। বোমা হামলা চালায়নি। আর না চালানোর কারণেই প্রাণে বেঁচে গেছেন দেশের সেনা কর্মকর্তারা। ঐদিন একটি সেনা কনভয় এদিকে যাওয়ার কথা ছিল। রুদ্রের এই গোপন কর্মকাণ্ডে চৌকস সেনা কমান্ডোরা বেঁচে গেলেন। সেই থেকে জেনেরিয়ার নজর রুদ্রের ওপর, কিন্তু যখন দেখলো খোদ সরকারই রুদ্রের বিরুদ্ধে, তখন তারা রুদ্রের উপর থেকে নজর সরিয়ে নিলো।
একটা লেজ উঁচু পাখির পিছু ছুটতে ছুটতে নিনিত খেয়াল করলো পাখিটি হাওয়া হয়ে গেছে। আরে একটা পাখি হাওয়া হয়ে যায় কেমন করে? নিনিত খুব অবাক হলো। তুষার আবৃত দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু বহু আগে যে পাখিগুলোর আবাসস্থল ছিল সে পাখিগুলো আবার ফিরতে শুরু করেছে। এই পাখিদের একটা লেজউঁচা হাঁড়িচাচা পাখি। নিনিত সবসময় পাখি ধরে বেড়ায়। এটা তার একটি হবি। তার ঘর একটা ছোটখাটো পাখিশালায় রূপ নিয়েছে। এদিকে ফিঙে তো ওদিকে বাদুড়। পাখিগুলো তুষারপাত শুরু হওয়ার ফলে আর বাংলাদেশ অঞ্চলে থাকছে না। তাই একটি বাদুড় দেখার জন্যও নিনিতের বাড়িতে আসছে মানুষ। অবশ্য পাখি পোষায় নিনিতের মেলা টাকা খরচ। খরচ উঠে আসে টিকিটে। কেউ তার পাখিশালায় ঢুকতে চাইলেই মোবাইলে ব্যালান্স থেকে টাকা কেটে নিয়ে ঢোকার অনুমতি দেয়। মোবাইল কোম্পানিগুলোর সাথে নিনিতের একটা চুক্তি আছে। এমন চুক্তি লেখকদেরও থাকে। দামি লেখকদের প্রতিটি লেখার মূল্য অনেক। তারা প্রতিদিন পঞ্চাশ শব্দ লেখেন, তাদের মোবাইলে একটা নির্দিষ্ট টাকা চলে আসে। নিনিত মাঝে মাঝে পাখিদের নিয়ে ফিচার লেখে। পাখি হারিয়ে যাচ্ছে। বন হারিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারটা নিনিতকে পীড়া দেয়। মাঝে মাঝে নিনিত ভাবে তার খাঁচার সব পাখি ছেড়ে দিবে। পাখিদের এভাবে রাখতেও তার কষ্ট লাগে। ধীরে ধীরে খাঁচাটাকে বনে রূপান্তরিত করার একটা চেষ্টা চালাচ্ছে নিনিত। নিনিতের চোখে বিশাল স্বপ্ন। একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বন বানাবে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত না ঠিক। একদম বন্য পরিবেশ বানাবে। সেই আদিম বন্য পরিবেশ। যেখানে তুষারপাত হবে না। একটা বুনো ঘ্রাণ থাকবে। অবশ্য সে ভালো করেই জানে তার ভাবনা কতোটা অবাস্তব। কারণ তার এত বিশাল আলাদা কোনো জায়গা নাই যেখানে বন বানাতে পারবে, অন্যদিকে তার কাছে এমন কোনো প্রযুক্তিও নাই যে বুনো পরিবেশ সৃষ্টি করবে। তবে সে একজন বিজ্ঞানীকে চেনে। রুদ্র নামের এ বিজ্ঞানীর নানান খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। অনলাইনে আজই রুদ্রের ঠিকানা জানার জন্য সার্চ দিবে ভাবলো। পাখির খোঁজ করতে করতে ভাবছিলো নিনিত। এতো বড় বিজ্ঞানী কি তার সাথে কাজ করবে? ভীষণ মন খারাপ করা বিউগলের এক বিষন্ন সুর বাজছে। কারো মৃত্যু হলে সরকারি শ্রদ্ধা জানানোর সিস্টেম এটা।
পৃথিবীর জনসংখ্যা কমতে কমতে তলানিতে পৌঁছে গেছে। আগে সরকারি কোনো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ মারা গেলে বিউগল বাজানো হতো। এখন সরকারের কাছে সবাই গুরুত্বপূর্ণ। ছোট একটা বাচ্চার মৃত্যু মানেও শোকের ব্যাপার। ২০৯৩ সালের দিকে হঠাৎ করে ড্রাইড মহামারীতে আক্রান্ত হলো পৃথিবীবাসী। তখন জনসংখ্যা ঊর্ধ্বমুখী। আগের মহামারীগুলোতে ধনীরা কম মরতো। গরিবরা অধিক হারে মরতো কারণ চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা ছিল না কিন্তু এবার ঘটল অন্যরকম ঘটনা। ড্রাইড মহামারীর কোনো ঔষধ কেউ তৈরি করতে না পারায় লাখে লাখে মানুষ মরতে থাকে। বলা হয় বায়ু দূষণের কারণেই এই মহামারী। চীনের রাজধানী বেইজিংয়েই মারা যায় প্রায় ৩ কোটি লোক। এমনকি রাষ্ট্রপ্রধানরাও মরতে থাকে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে। এক ধাক্কায় পৃথিবীর জনসংখ্যা যখন ৯০ লাখে পৌঁছালো তখন শোনা গেল রুদ্র নামের এক বিজ্ঞানীর কথা। নীরবে তিনি নাকি গবেষণা করে চলছেন ড্রাইড মহামারী নিয়ে। একদিন শহরবাসী দেখেন আকাশ থেকে বিশেষ বিমান বায়ুমণ্ডলে এক ধরনের গ্যাস ছুঁড়ে মারছে। ২০৯৪ সালের ১৭ জুলাই সর্বশেষ ধাক্কা খেলো পৃথিবী। এদিন মৃত্যুবরণ করে ৩ লাখ মানুষ। ১৮ জুলাই তা ২০ হাজারে নেমে আসে। দিকে দিকে বিজ্ঞানী রুদ্রের নাম ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু রুদ্র নামের এ বিজ্ঞানী নাকি লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকতে চান। নোবেলের চেয়েও বড় পুরস্কার তিয়ানসাকা পুরস্কার। চীনের হাতে বিশ্বের কর্তৃত্ব গেলে নোবেল মূল্যহীন হয়ে পড়ে। তিয়ানসাকা পুরস্কারের অর্থমূল্য ১০০ নোবেলের সমপরিমাণ করে দিলো চীন। কে নোবেল নিতে চাইবে? রুদ্রকে দেওয়া হলো তিন শাখায় তিয়ানসাকা পুরস্কার। শান্তিতে, রসায়নে ও চিকিৎসা বিজ্ঞানে। অবাক করা ব্যাপার হলো রুদ্র এই পুরস্কার নিতে আসেনি। এতে চীন সরকার ক্ষেপে গেল। তারই ফলশ্রুতিতে একের পর হামলা হতে থাকলো বিজ্ঞানী রুদ্রের গবেষণাগারে।
জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক । শেরিফ ফারুকীলাল তিনটা ফিতা দেখা যাচ্ছে। মানে এই জায়গাটা সংরক্ষিত। উপরে লেখা আছে- বিজ্ঞানী রুদ্রের গবেষণাগার। সাংবাদিকরা ভেতরে ঢুকতে চাইলেই বাধা দিচ্ছে নিরাপত্তারক্ষীরা। টেলিভিশনে বলা হচ্ছে- ‘বিজ্ঞানী রুদ্রের গবেষণাগারে হামলা চালিয়েছিল সন্ত্রাসীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দৃঢ়তার সাথে হামলা ঠেকিয়েছে।’
গণমাধ্যমের মিথ্যে সংবাদ ফাঁস হয়ে গেলো রুদ্রের একটি ভিডিও বার্তায়। ভিডিও বার্তায় দেশবাসীকে রুদ্র জানিয়ে দিলো সে সরকারের রোষানলের শিকার। ভিডিও বার্তার শুরুতে তাকে সমুদ্রের তলদেশে দেখা যায়। সমুদ্রের তলদেশে দেখার সঙ্গে সঙ্গে নৌবাহিনীর সাবমেরিনগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। সমুদ্রের সম্ভাব্য এলাকায় তছনছ করে খুঁজতে শুরু করে রুদ্রকে। রাস্তায় রাস্তায় রুদ্রের জন্য মিছিল বের হলো। সরকারবিরোধী বিক্ষোভ মিছিলে রূপ নিলো রুদ্রকে বাঁচানোর মিছিল। বিপাকে পড়ে সরকার তার বিরুদ্ধে খোঁজ চালানো বন্ধ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলো। কিন্তু ততক্ষণে ধরা পড়ে গেছে রুদ্র। নিনিত অনলাইন সার্চ দিয়ে দেখলো রুদ্রর বিরুদ্ধে অভিযান হচ্ছে। সে লোকজনকে জড়ো করল। ১০ হাজার লোকের বিশাল এক মিছিল নিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানের বাড়ির দিকে এগোতে থাকলো নিনিত। খবর পাওয়া গেল সরকার সব দাবি মেনে নিয়েছে। সরকারি বাহিনীগুলো পিছু হটেছে। নিনিতদের মিছিল থেমে গেল। কিন্তু নিনিত ঘোষণা করলো যেহেতু আমরা বিজ্ঞানী রুদ্রর ভিডিওবার্তা পেয়ে মিছিলে নেমেছি। সুতরাং তিনি যে এখন বিপদমুক্ত তা না জেনে আমরা ফিরব না।
বলা চলে সরকার মহাবিপদে পড়ে গেল। কারণ রুদ্রকে গ্রেফতারের খবর দিয়েছে সাবমেরিনের কমান্ডোরা। গ্রেফতার অবস্থায় রুদ্র কখনোই স্বীকার করবে না সে মুক্ত আছে। সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বৈঠক বসলো। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো বিজ্ঞানী রুদ্র সরকারের জন্য বিপজ্জনক। সুতরাং তাকে হত্যা করতে হবে। প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবের বিরোধিতা করলো না একজন বাদে আর কেউ। ঐ একজনের পরিবারকে পরেরদিন বিউগলের সুর শুনতে হলো।
বিজ্ঞানী রুদ্রকে খোলা একটা মাঠে দাঁড় করানো হলো। চারপাশে বিশ জন দুর্ধর্ষ সড়বাইপার যাদের হাতের ভেলকিতে খতম হয়ে গেছে সরকারবিরোধী অনেক মানুষ। এবার এই বিজ্ঞানীর পালা। রুদ্রর হাতে একটি পবিত্র গ্রন্থ তুলে দিয়ে বলা হলো, ‘আপনাকে দেশের সাথে বেইমানির জন্য খুন করা হচ্ছে। আপনার শেষ ইচ্ছা কী?’
রুদ্র বললো, ‘আমার শেষ ইচ্ছা হচ্ছে মানুষের মতো মৃত্যুবরণ করা। দেশের প্রতি বেইমানি করেছি এই অপবাদ নিয়ে মৃত্যুবরণ না করা।’ সড়বাইপারদের একজন নাকি সুরে তার কথা পুনরোক্তি করে ভেঙচি কাটলো।
তারপর বললো, ‘চোখ বন্ধ কর বেইমান।’ চোখ বন্ধ করলো রুদ্র। রুদ্রর এখন ইচ্ছা করছে তার দাদা এ মুহূর্তে কী করছিলেন তা দেখতে। রুদ্র নিজের মস্তিষ্ক দাদার মস্তিষ্কে প্রতিস্থাপন করলো। দেখলো ঠিক এই মুহূর্তে দাদারও চোখ বাঁধা ছিল। ব্যাপার কী? দাদার চোখ বাঁধা কেন? রুদ্র দেখলো দাদার চারপাশে সেনা পোশাকের ১২ জন লোক দাঁড়িয়ে আছে। অচেনা এক ভাষায় মারাত্মক গালাগাল করছে তারা। অবাক করা ব্যাপার তো! দাদাকে কেন হত্যার আয়োজন। আজ কি ১৪ ডিসেম্বর? চারপাশ থেকে অস্ত্র তুললো সৈনিকেরা। ঝাঁকে ঝাঁকে অস্ত্র বুক পেট ছেদ করে ঢুকে যেতে থাকলো। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলো রুদ্র। রুদ্রকেও সড়বাইপাররা একই সময় গুলি করেছে।
একটা কাচঘেরা হাসপাতালের কেবিনে রুদ্র জেগে উঠলো। চোখ মেলে খেয়াল করলো সব কিছু অচেনা লাগছে। রুদ্র মনে মনে আওড়ালো। ‘আমি কি মরে গেছি? আমি এখানে কেন?’ রুদ্রকে একটা যন্ত্রের দিকে ঠেলে দেওয়া হলো। ঠেলে দেওয়া হলো মানে যে বিছানায় রুদ্র শুয়েছিল সে বিছানা সমেত খাটটাই ঢুকে পড়লো মেশিনে। এমন আজব কাণ্ড তো আর দেখেনি রুদ্র। নানা রকম বাতি জ্বলছে আর নিভছে। একটা স্ক্রিনে তার সারা শরীর স্ক্যান হতে দেখলো। একটা জায়গায় এসে লাল একটা বাতি জ্বলে উঠলো। যন্ত্র থেকে স্বয়ংক্রিয় একটা চিমটার মতো কিছু সরাসরি পেটে ঢুকে গেলো। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো রুদ্র। ভেতর থেকে একটানে একটা লোহা বের করে আনলো যন্ত্রটা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে রুদ্রর শরীর। একটা স্বয়ংক্রিয় সুঁই এসে রুদ্রর হাতে গেঁথে গেল, শরীরে রক্ত প্রবেশ করতে থাকলো। পেটের কাটা অংশে একটা যন্ত্র এসে সেলাই করতে থাকলো। এক অদ্ভুত ব্যাপার। মানুষবিহীন সবকিছু? নাকি এখানে মানুষই নাই। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ রক্ত দেওয়ার পর থেমে গেলো রক্ত দেওয়া। শরীরের ক্ষতস্থানে এক ধরনের লিকুইড এসে ধুইয়ে দিয়ে গেল। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লো রুদ্র। রুদ্রের যখন ঘুম ভাঙলো, খেয়াল করলো মস্তিষ্কে কিছু একটা হচ্ছে। তীব্র ব্যথা অনুভব করছে রুদ্র। একসময় ব্যথাটা কমে এলো। ব্যথা কমে গেলে কেউ একজন বলে উঠলো, ‘দাদাজান!’
দাদাজান? রুদ্র অবাক হলো। বিয়েই করেনি রুদ্র আর সেখানে কে যেন দাদাজন বলে উঠছে। রুদ্র চমকে উঠে বসে পড়লো। হকচকিত হয়ে এদিক সেদিক তাকালো। কেউই নেই। মানুষ মারাত্মক চাপে থাকলে হ্যালুসিনেশন দেখা দেয়। রুদ্রের মনে হলো এটি অবশ্যই হ্যালুসিনেশন। আবার শুয়ে যাবে এ সময় বলে উঠলো, দাদাজান আমি রুপু। আমার জন্ম ৩০৬০ সালে হবে। রুদ্র প্রাণপণ মনে করতে থাকলো। এটি হ্যালুসিনেশন, অবশ্যই হ্যালুসিনেশন। তখনি মস্তিষ্কের ভেতরে বলে উঠলো, তুমি এভাবে মারা যেতে পারো না দাদাজান, তুমি মারা গেলে একটি বংশধর নষ্ট হয়ে যেত। পৃথিবী আবার পেছনের দিকে চলে যেত। তুমি তোমার অদৃশ্য হওয়ার গবেষণা শেষ না করে মরতে পারো না দাদাজান। আজ যদি অদৃশ্য হতে পারতে, ওদের হাতে গুলি খেতে হতো না। আমি যতক্ষণ তোমার মস্তিষ্কের ভেতর থাকব ততক্ষণ ব্যথা করবে। সুতরাং আমি আর থাকব না। তুমি যেমন তোমার দাদার মস্তিষ্কে ঢুকতে পারো আমিও পারি তোমার মস্তিষ্কে ঢুকতে। ধন্যবাদ দাদা, এই আবিষ্কারটা করে রাখার জন্য। অদৃশ্য হওয়ার আবিষ্কারটাও করে রাখো। তোমার বাম পাশে এক বোতল তরল আছে। অদৃশ্য হওয়ার গবেষণার কাজে লাগতে পারে- বিদায় দাদা। মস্তিষ্কে ভোঁতা এক ধরনের ব্যথা হলো রুদ্রের। তারপর মনে হলো ধুম করে কোথাও পড়ল। পড়তেই চোখ মেলে দেখলো চারপাশে সড়বাইপাররা শুয়ে আছে। মানে খুন হয়ে গেছে ২০টা তাজা সড়বাইপার। কে খুন করেছে? ভবিষ্যতের পৃথিবী থেকে এসে রুপু খুন করেছে?
সরকার প্রেস ব্রিফিংয়ে রুদ্রের মৃত্যুর খবর বলার সাথে সাথেই ক্ষোভে ফেটে পড়লো মানুষ। নিনিতের নেতৃত্বে হাজার বিশেক মানুষ সরকারি বাসভবনের ভেতর ঢুকে পড়লো। বহুদিন মানুষ হত্যা নিষিদ্ধ বলে সরকারি কোনো বাহিনীর হাতের অস্ত্রে বুলেট থাকে না। অস্ত্র কেড়ে নিয়ে লোকজন মুহুর্মুহু আক্রমণ চালালো সরকারি বাহিনীর ওপর। কিন্তু প্রেসিডেন্টের একটা স্পেশাল ফোর্স থাকে। তারা গুলি চালিয়ে চারজনকে খুন করে ফেললো। নিকট অতীত যেখানে একজনকে খুন করারও ইতিহাস নেই, সেখানে চারজন। সুতরাং চারজন মানুষের রক্ত দাবানলের জ্বালানির মতো কাজ করলো। উন্মাদের মতো হয়ে গেল মানুষ। পঞ্চাশ জনের মতো স্পেশাল ফোর্সের লোক নিহত হলো। প্রেসিডেন্টকে গ্রেফতার করলো মানুষ। নিনিত ঘোষণা করলো এ দেশের কোনো প্রেসিডেন্ট থাকবে না। এদেশের প্রত্যেকটা মানুষ আইনের আওতা থেকে মুক্ত। পৃথিবীর ইতিহাসে এক নতুন দেশের যাত্রা শুরু হলো। মুক্তদেশ। যে দেশের কোনো প্রেসিডেন্ট থাকবে না। বিশেষ কোনো আইন থাকবে না। দেশে দেশে এমন দেশব্যবস্থার জন্য আন্দোলন চলতে লাগলো। স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করতে থাকলো মানুষ। বাংলাদেশে কোনো নিয়মই যেহেতু থাকলো না। মাত্র একটি সন্তান জন্মদানের যে নিয়ম তাও উঠে গেল। ৯০ লাখ মানুষ থেকে বাড়তে থাকলো পৃথিবীর জনসংখ্যা। এখন কান পাতলেই শোনা যায় লোকেরা গান করছে, আনন্দ করছে। নানারকম গান শোনা যায়। এই যে এখন শোনা যাচ্ছে, ‘তুমি আসবে বলে হে স্বাধীনতা, শহরের বুকে জলপাই রঙের ট্যাঙ্ক এলো…।’

Share.

মন্তব্য করুন