যদি এমনটা হয় তবে কেমন হবে বলুন তো! আপনার গাড়িটি কোনো স্থানে রেখে দিলেন আর তা নিজে নিজে গড় গড় করে বিনা বাধায় ২০০ গজের মতো উপরে উঠে গেল! কী হতে পারে এটা, জাদু নাকি রহস্য! ঘটনাটি পুরোপুরি সত্য। মনকটন শহরের উত্তরে অবস্থিত চুম্বক পাহাড় বা ম্যাগনেটিক হিল। পাহাড়টি কানাডার নিউ বার্নস উইক প্রদেশে অবস্থিত। এই পাহাড়ের নিচে কোনো গাড়ি রাখলে তা নিজে নিজে উপরে উঠে যায়।
লাদাখের এই পাহাড়কে চুম্বক পাহাড় বলে ডাকা হয়। লাদাখের লেহ অঞ্চল থেকে কারগিলের দিকে ত্রিশ কিলোমিটার দূরত্বেই আছে এই রহস্যময় চুম্বক পাহাড়।
এই পাহাড়ের চূড়ার দিকে যে সড়ক গিয়েছে তা বরাবর গাড়ি চালিয়ে যেতে যেতে যদি কেউ গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দেন এবং গিয়ারকে নিউট্রাল পজিশনে রাখেন, তবে দেখা যাবে সেই গাড়ি খাড়া রাস্তা বেয়ে নিজে নিজেই চলতে শুরু করেছে। এবং তার গতি নেহাত মন্দ নয়। ২০ কিলোমিটার প্রতিঘণ্টা বেগে সেই গাড়ি ওপর দিকে ধাবিত হতে থাকবে।
লাদাখের এই চুম্বক পাহাড় স্থানীয় জনতার বাইরে ভিন্নাঞ্চলের মানুষের কাছে আবিষ্কৃত হয় অনেক পরে। তৎকালীন সময়ে কাশ্মিরের সাধারণ জনগণ ঐ চৌম্বকীয় ক্ষেত্র সম্পর্কে জানতো না। কিন্তু বেশ কিছু মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটনার পর পরিস্থিতি পালটে যায় রাতারাতি। রহস্যের শুরু ১৮৮০ সালে। যখন ছোটখাটো ওয়াগনগুলো এমনি ওপরে উঠে যেত। ১৯৩৩ সালে খবরটি প্রথম ছাপা হল স্থানীয় সিন্ট জন টেলিগ্রাফ জার্নালে। রহস্য উদঘাটনে মাঠে নামলেন বিশেষজ্ঞরা। মনকটন শহরের প্রতিটি পাহাড়ে চলল অনুসন্ধান। পেরিয়ে গেল পাঁচ পাঁচটি ঘণ্টা কিন্তু কোনো ফলাফল নেই। শেষমেশ একেবারে বাড়ি যাওয়ার পথে দেখা গেল বিস্ময়কর কাণ্ড। নির্দিষ্ট একটি জায়গায় তাদের গাড়িটা বিনা বাধায় পাহাড়ের উচ্চভাগের দিকে উঠে গেল। চোখ পড়ল রাস্তার পাশের পানির উৎসটার দিকে। মাধ্যাকর্ষণ নীতি অমান্য করে সেটাও বয়ে চলেছে ওপরের দিকে।
চুম্বক পাহাড় । সাদাফ ইশতিয়াকদ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফেডারেল ও প্রাদেশিক সরকার চুম্বক পাহাড়কে একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে রূপান্তরিত করলেন।
আজকাল অবশ্য এর আশপাশে গলফ কোর্স, চিড়িয়াখানা, রেলওয়েসহ অনেকই কিছুই গড়ে উঠেছে। ২০০২ সালে ম্যাগনেটিক হিল পার্ক জিতে নেয় কানাডার সেরা আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থানের পুরস্কার। শুধু গাড়িই নয়, লাদাখের এই অঞ্চলের ওপর দিয়ে কোনো বিমান যাওয়ার সময় খুব সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। বিমানের গতিপথ যাতে পাল্টে না যায় সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হয় পাইলটকে। এই চুম্বক পাহাড় নিয়ে স্থানীয়দের ভেতর নানান গল্প চালু আছে। তবে সবগুলো গল্পই সেই অতিপ্রাকৃত শক্তির বর্ণনায় শেষ হয়। অবশ্য, পৃথিবীতে যতগুলো এরকম স্থান আছে তার সবগুলোর স্থানীয় জনতার বিশ্বাসও মূলত ওই অতিপ্রাকৃত শক্তিকেন্দ্রিক।
বর্তমানে লাদাখ কর্তৃপক্ষ ওই সড়কটির দুই প্রান্তেই সাইনবোর্ড বসিয়ে দিয়েছে, যাতে কেউ দুর্ঘটনায় পতিত না হয়। তবে চুম্বক পাহাড়ের ওই অঞ্চলের চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের কার্যকারণ যে শুধুমাত্র লোহার বস্তু কেন্দ্রিকই দৃশ্যমান, তা নয়। রাস্তার ধারে বা কিছুটা উঁচু স্থানে দাঁড়ালে তীক্ষ্ণ এক শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। দীর্ঘদিন এই শব্দকে ঐশ্বরিক বলে ধারণা করা হলেও, পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে পৃথিবীর যেসব অঞ্চলে এ ধরনের গ্রাভিটিহিল রয়েছে সেখানে চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের তরঙ্গে ঘর্ষণের ফলে ওই শব্দ উৎপাদিত হয়।
কিন্তু বলা হয়ে থাকে সেখানে আদৌ কোনও চুম্বক পাহাড়ের অস্তিত্ব নেই। ওই এলাকায় যা ঘটে, তা একেবারেই দৃষ্টিভ্রম। ওই স্থানটিতে পাহাড়, রাস্তা ইত্যাদি এমনভাবে অবস্থিত যে, এলাকাটিকে খাড়াই বলে মনে হয়। রাস্তাটি সামান্য উতরাই-যুক্ত। সেই ঢালু পথ বেয়েই নিউট্রাল গিয়ারে থাকা গাড়িটি গড়াতে থাকে। দৃষ্টিবিভ্রমে মনে হয়, তা খাড়াই বেয়ে উপরে উঠছে। তবে কারণ যাই হোক এখানে অনেক পর্যটক আসেন নিজ চোখে জায়গাটি দেখার জন্য। লাদাখের সৌন্দর্য সবাইকে যেমন মুগ্ধ করেছে তেমনি এই পাহাড়টি করেছে আকর্ষণীয়।

Share.

মন্তব্য করুন