(গত সংখ্যার পর)

– তো, কী জন্য ঢুকতে চাইছে তারা?
– তারা কী জন্য ঢুকতে চাইছে সেটাই মূলকথা। আমাদের বাড়ি থেকে একটা জিনিস হাতিয়ে নেবার জন্য তারা চেষ্টা করতেছে।
– স্বর্ণ-টর্ণ জাতীয় কিছু নাকি? আকুভাই বলল।
– না, একটা পাথর, নীলপাথর।
– নীলপাথর? আংটির পাথর নাকি? মানে রতড়বপাথর যেগুলোকে বলে আরকি?
– না, আসলে এই পাথরটা আমি খুঁজে পেয়েছি। বান্দরবানের থানচি উপজেলার রেমাক্রি জলপ্রপাত আছে না? সেখানে যাওয়ার পথে রাজাপাথর নামে একটা জায়গা আছে। জায়গাটায় একটা বিরাট পাথর আছে। বর্ষাকালে সব পাথর ডুবে গেলেও এই পাথর ডোবে না। এটাকে স্থানীয়রা দেবতা পূজাজ্ঞান করে, সম্মান করে। তারই পাশে এটা পাহাড়ের দেয়ালে খুঁজে পেয়েছি।
– কখন খুঁজে পেলেন? আপনার সাথে আর কে কে ছিল?
– গত সপ্তাহে আমরা রেমাক্রি থেকে ঘুরে এসেছি। দেখার মতো একটা জায়গা। বাংলাদেশ যে কত সুন্দর হতে পারে সেটা তিন্দু-বড়পাথর-রাজাপাথর-রেমাক্রি ফলস ঘুরে না-এলে বলে বোঝানো যাবে না। এ যেন আল্লাহ স্বয়ং নিজ হাতে সৃষ্টি করেছেন!
– এভাবে বলবেন না, আপনার বর্ণনা শুনে তো ইচ্ছে করছে এখনই ছুটে যাই, যদিও বহুদিনের ইচ্ছে একবার রেমাক্রি ফলস দেখে আসব। কিন্তু যাওয়ার সুযোগটা এখনো পর্যন্ত এলো না। কিছুটা হতাশ ভঙ্গিতে বলল আকুভাই।
সবুজ চুপ মেরে শুনে যাচ্ছে। রেমাক্রি দূরে থাক, নীলপাথর রহস্যের উন্মোচনে সে থাকতে পারবে কি না সেই দ্বিধায় আছে সে।
হাবিব বলল, তো, আমরা রেমাক্রি গিয়েছিলাম মোট চারজন। ছোট একটা নৌ-দুর্ঘটনার কারণে রেমাক্রির পথে রাজাপাথর নামক জায়গায় আমাদের রাত কাটাতে হয়। সেখানেই পাই এই নীলপাথর!
– কিভাবে পেয়েছেন একটু বিস্তারিত বলেন।
– সন্ধ্যার আগেই এই এলাকাটা অন্ধকারে ঢেকে গিয়েছিল, পাহাড়ি এলাকায় সচরাচর যেটা হয় আরকি! এই পাথুরে পাহাড়ি এলাকায় রাতটা কিভাবে কাটাবো সেই ভয়ে আতঙ্কিত ছিলাম সবাই। নৌকার মাঝি ছিল এক উপজাতি তরুণ, নাম রাজিব। সে বলছিল, আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, রাতটা কেমন করে যেন চলে যাবে, দেইখেন। সে বলেছিল ঠিক, বাস্তবে রাত ফুরাচ্ছিল না। রাত বাড়তেই বিভিন্ন অজ্ঞাত পাখির অচেনা ডাক, বিভিন্ন প্রাণীর বেসুরো ডাক আমাদের কাছে আর্তনাদের মতো ঠেকছিল। কেউ কাউকে কিছুই বলতে পারছিলাম না, কারণ এসব নিয়ে আলোচনা করলে সবার মনে ভয়টা আরো চেপে বসবে।
– তারপর? সবুজ বলল।
– তারপর আমরা আমাদের নিজেদের তোয়ালে-গামছা বিছিয়ে পাহাড়ের পাশে একটা সমতলে শুয়ে পড়ি। কখন ঘুম এসেছে বুঝতে পারিনি। মধ্যরাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে যায়। দেখি, একটা নীল আলো আসছে পাহাড়ের ওদিক থেকে। সেই আলোটা ধীরে-ধীরে বাড়ছে, এমনকি সেই আলোতে আশপাশ পুরো আলোকিত হয়ে উঠছে! দেখেত প্রথমে ভয় পেয়ে গেছি আমি! আমার ফ্রেন্ডদের দিকে তাকালাম, তারা তখন বেঘোর ঘুমে, একজন তো নাকও ডাকছে! সাহস করে একটু সামনে গেলাম। তখনো নীল আলোয় নীলচে হয়ে আছে পাহাড়ের দেয়াল! কাছে গিয়ে বুঝলাম দেয়ালের সাথে লেগে থাকা একটা পাথর থেকে এই আলো বের হচ্ছে। বিভিন্ন দামি পাথর নিয়ে প্রচুর পড়েছি বিধায় হঠাৎ লোভ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল! হাত বাড়ালাম পাথরটার দিকে! সঙ্গে-সঙ্গে দেখি আলো কমতে শুরু করল। আলো কমার আগেই পাহাড়ের দেয়াল থেকে সেটা আমি উঠিয়ে নিয়ে চলে আসি অন্যদের পাশে। সে রাতে আর ঘুম হয়নি। রাতভর পাহাড়ের ভেতর থেকে আসা যে শব্দগুলো শুনেছি, মনে করলে এখনো শিউরে উঠি।
– নীলপাথরটা কোথায় এখন?
– আমাদের বাড়িতেই আছে। আমার মনে হচ্ছে, এই ঘটনাটা আমার সাথে থাকা বন্ধুদের কেউ হয়তো দেখে ফেলেছে। তাই নীলপাথরটি হাত করার জন্য আমাদের বাড়িতে প্রতিরাতে হানা দিচ্ছে!
– আপনার বন্ধুদের তো আপনিই চিনবেন, এখানে আমরা কী করতে পারি?
– হ্যাঁ, তোমরাই করতে পারবে। আমি আমার বন্ধুদের নাম-ঠিকানা-ছবি সব দেবো তোমাদের। তোমরা এর পেছনে কে আছে সেটা বের করে দাও! আর একজন আমার বন্ধু ছিল না, বন্ধুর বন্ধু ছিল!
– চিন্তার বিষয়! তবে আমার মনে হচ্ছে, নীলপাথর নিয়ে অনেক কথা আপনি আমাদের বলেননি, গোপন রেখেছেন!
– হ্যাঁ, কিছু বিষয় গোপন রেখেছি!
– কিন্তু ডাক্তারের কাছে রোগের কথা গোপন রাখলে কিভাবে সমাধান দেবে সেই ডাক্তার? আকুভাই বলল।
– আগে রোগনির্ণয় তো শুরু হোক, তারপরে না-হয় সব বলব!
– আচ্ছা, ঠিক আছে। সবুজ থাকতে পারছে কি না আগে দেখি। কাল সকালে আপনাকে জানাবো। কাজটা করতে পারলেও জানাবো, না-পারলেও জানাবো। তবে কাজটা করতে আমার আগ্রহ জন্মেছে, নীলপাথর বলে কথা, তা-ও আবার আলো ছড়ায়!
সবুজ জানে যে, বাড়িতে কল দিয়ে জানালেও তাকে ফিরে যেতে বলবে। তাই আকুভাইকে সে বলল, ভাই, আপনি কল দিয়ে রিকোয়েস্ট করুন আমার আম্মাকে, আপনার কথা রাখবে, না করতে পারবে না!
– হ্যাঁ, তা-ই করতে হবে দেখছি!
– আমারও খুব ইচ্ছে করছে নীলপাথর রহস্যের ঘ্রাণ নিতে! হুম, ফোন দিয়ে দেখি বলে আকুভাই কল দিলো সবুজের আম্মাকে। কল রিসিভ করে তিনি প্রথমে কুশল জিজ্ঞেস করে সবুজ কেমন আছে জানতে চাইল। তারপরে আকুভাইকে কোনো কথা বলতে না-দিয়ে তিনি নিজেই বললেন, তোমরা আরো ক’দিন ওদিকে থাকো। এখানে গত কয়েক রাত ধরে পুলিশ এসে নিরপরাধ লোকজনকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে তোমাদের মতো তরুণদের!
আকুভাই বলল, কেন? ধরে নিয়ে যাচ্ছে কেন?
– শুনলাম, সামনে উপজেলা নির্বাচন, তাই ভয়-ভীতি দেখাতে লোকজনকে চাপে রাখার জন্য নাকি গ্রেফতার করছে!
– আচ্ছা আন্টি, বলে ভালো করেছেন। আমরা আরো ক’টা দিন পরে আসব।
তারপরে সালাম দিয়ে ফোন রেখে দিলো। সবুজ পাশে ছিল বিধায় সব শুনেছে সে। তার খুশি তখন কে দেখে! খুশিতে সে বলে উঠল, রাখে আল্লাহ, তাড়ায় কে!
কথা শেষ করে আকুভাই আর দেরি করেনি। হাবিবকে ফোন করে জানিয়ে দিলো তারা দু’জনেই থাকছে। কাজটা করবে।
শুনে হাবিবও খুব খুশি হলো। সে বলল, তোমরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কি আসতে পারবে?
– পারব, তেমন কোনো কাজ নেই এখন।
হাবিব তাদের বাড়ির ঠিকানাটা দিয়ে দিলো আকুভাইকে। সাড়ে দশটার দিকে হাবিবদের বাড়িতে পৌঁছল আকুভাই ও সবুজ। এলাকাটা শহুরে ছোঁয়া পেয়েছে খুব বেশিদিন হচ্ছে না, বড়জোর দশ বছর। দশ বছরে আমূল পরিবর্তন হয়েছে মূল শহরের বাইরে থাকা এরকম বহু এলাকার। এটা চারদিকে প্রাচীরঘেরা একটা বাড়ি। হাবিব যেমনটা বলেছিল ঠিক তেমনটাই। তবে হাবিবদের বাড়ির দুইপাশে রয়েছে গাড়ি চলাচলের রাস্তা। রাস্তার ওপারে কয়েকটা বড় বিল্ডিং। বাড়িটা বাহির থেকে দেখতে খুব সুন্দর, দেখতে অনেকটা সরকারি বাংলোর মতোন।
হাবিব তাদেরকে ভেতরে নিয়ে বসালো। বাহিরের মতো ভেতরটাও খুব সুন্দর। আলাদা আলাদা রুম, প্রত্যেক রুমে পেইন্টের কারুকাজ, দেখে বোঝাই যাচ্ছে না যে এটা টাইলস নাকি পেইন্ট!
আকুভাইদের একটা রুমে নিয়ে বসালো। রুমে একটা চেয়ার, একটা প্লাস্টিকের মোড়া, একটা টেবিল, টেবিলে ছোট্ট চার্জেবল ল্যাম্প, একটা বড় খাট বিছানো এবং এটাচড্ বাথরুম। রুম থেকে এয়ার ফ্রেশনারের সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। সব মিলিয়ে একটা অভিজাত ঘ্রাণ বেরুচ্ছে।
তাদেরকে বসিয়ে হাবিব ভেতর থেকে নাস্তা নিয়ে এলো।
আকুভাই বলল, আপনার বাবা আছেন?
– না, তিনি দশটার দিকে অফিসে চলে গেছেন।
– ভালোই হলো!
– কেন?
– ওনার সামনে পড়তেই তো লজ্জা করছে! কী বিচ্ছিরি কা-টাই না করে ফেলেছিলাম!
– তাতে তো তোমাদের দোষ নেই, লজ্জার কী আছে!
– তবুও!
যাক, যা হওয়ার হয়ে গেছে, ওসব গত হয়ে গেছে। আমরা এখন বর্তমানকে ধরে ভবিষ্যতের দিকে যাব!
হ্যাঁ, ভবিষ্যতের দিকে যাবার জন্যই তো সবুজের ছুটি বাড়িয়ে নিলাম- বলে আকুভাই নিজেই হেসে দিলেন, তাতে সঙ্গী হলো হাবিব ও সবুজ।
নাস্তা শেষ করে হাবিব রুমের দরজাটা বন্ধ করে খাটে বসল। আকুভাই ও সবুজের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, এখন কিভাবে কী করবে? কোনো প্ল্যান করেছো?
– আপনি কি আপনার ফ্রেন্ডদের ছবি সংগ্রহ করেছেন?
‘হ্যাঁ’ বলে হাবিব মোবাইলের গ্যালারি থেকে একে একে প্রত্যকের ছবি দেখিয়ে তাদের নামগুলো বলতে লাগল। কে কী করে? কার পারিবারিক অবস্থা কেমন সব বলতে লাগল।
ছবিগুলো বান্দরবান ভ্রমণের। একেকজন একেকরকম ভঙ্গিতে ছবিগুলো তুলেছে। আকুভাই ও সবুজ ছবিগুলোর কার চেহারা কেমন তা পরখ করে দেখতে লাগল। এদের মধ্যে যে হাবিবের বন্ধুর বন্ধু তার একটা ছবি খুব করে দেখতে লাগল আকুভাই, যেন চেহারা পড়ার চেষ্টা করছে!
হাবিব বলল, গত রাতেও আমাদের বাসায় ঢোকার চেষ্টা করেছে!
– কিভাবে বুঝলেন!
– আমি জানতাম না, মা বলেছেন। রাত দুইটা-সোয়া দুইটার দিকে নাকি বাড়ির ছাদে কেউ লাফিয়ে পড়ার শব্দ শুনেছেন তিনি। দুইটা লাফের কথা বললেন। মায়ের রুমটার পাশেই একটা কাঁঠাল গাছ। কাঁঠাল গাছ বেয়ে ছাদে আসা খুবই সহজ। তারা বাড়িতে ঢোকার জন্য সেই পথটাই বেছে নিয়েছে।
– তো, আপনার কাকে সন্দেহ হয়?
– আমার বন্ধু শরিফের বন্ধুটাকেই আমার একটু সন্দেহ হচ্ছে! ওর নাম সাজিদ।
– তাকে কেন সন্দেহ করছেন?
– বান্দরবান যাওয়ার সময় একটা তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে তার সাথে আমার হালকা কথা কাটাকাটি হয়েছে, তাই!
– কথা কাটাকাটির পর কি সে আপনার সাথে কথা বলেছে? মানে তার আচরণ কেমন ছিল?
– ওই অর্থে খারাপ ছিল না, স্বাভাবিকই ছিল।
– তাহলে?
– সেদিন রাতে নীলপাথরটা নিয়ে যখন আমি আমার বিছানায় আসি তখন তাকে একটু নড়তে দেখেছিলাম। বাকিরা অবশ্য বেঘোর ঘুমে ছিল!
– ঘুমের মধ্যে নড়াচড়া করা মানেই কি নীলপাথর নিতে আপনাকে দেখে ফেলা?
– ঠিক তা নয়, আমার সন্দেহের কথা বললাম
তোমাকে।
– নীলপাথরের ব্যাপারটি কে কে জানে?
– তেমন কেউ না, আমি আর আমার মা জানে।
– আর কেউ জানে না? মনে করে দেখেন তো!
– মনে পড়ছে না!
– আপনার বন্ধুদের কেউও কি জানে না?
– না, তাদেরকে বিষয়টি মোটেও শেয়ার করিনি আমি।
– আপনার ঘরের মধ্যে কেউ- যেমন, ভাগ্নে-ভাগ্নি বা কাজের লোক!
– না, ভাগ্নে-ভাগ্নিরা কেউ জানে না। তারা এই ক’দিনে আমাদের বাড়িতে আসেনি! তবে কাজের মহিলা আছে একটা, সে শুনে থাকলে বলতে পারব না!
– সে কি আপনাদের ঘরেই থাকে নাকি এসে কাজ করে চলে যায়?
– না, ঘরেই থাকে বহু বছর ধরে। আমাদের ফ্যামিলি মেম্বারের মতো হয়ে গেছে সে!
– আচ্ছা, আপনার বন্ধুরা কি বান্দরবান থেকে ফেরার পর একবারও এসেছিল আপনাদের বাড়িতে?
– একজন এসেছিল, বাকিরা কেউ আসেনি।
– সেই একজনটা কে?
– মাহমুদ। মাথায় গামছা বাঁধা যে ছেলেটাকে দেখেছো সে।
আকুভাইয়ের জানতে চাওয়ার ধরনটা নিজের ব্রেইনে সেট নিচ্ছে সবুজ। সে এক মনে শুনে যাচ্ছে সব কথা।
আকুভাই বলল, আপাতত এটুকুই, বাকি কিছু জানার থাকলে তখন বলব। আর একটা কথা, আমাদেরকে তো রাতে এখানে থাকতে হবে, কোনো সমস্যা হবে?
– আরে না, এই রুমগুলো খালি পড়ে থাকে। কোনো সমস্যা হবে না, যতদিন লাগে থাকবে। আমার দেখতে হবে এরা কারা?
– ঠিক আছে। তবে আমরা বিকালে এলেও চলত। বিকাল পর্যন্ত তেমন কাজ নেই!
– ঘুরে-ফিরে বাড়ির চারপাশ দেখো, কাঁঠাল গাছ, সুপারি গাছ সব দেখো। আরো কী কী দেখা লাগে সব পরখ করে দেখো।
– আচ্ছা।
দুপুরে খেয়েদেয়ে একটা ঘুম দিলো আকুভাই ও সবুজ। ঘুম থেকে যখন উঠল তখন চারটা বিশ বাজে। দ্রুত উঠে সবুজকে নিয়ে বাড়ির বাইরে এসে চারপাশটা দেখতে লাগল। সবুজও কোনো ক্লু পায় কি না খুঁজতে লাগল। সবদিক দেখার পর আকুভাই হাবিবকে ডেকে পাঠালে সে এসে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার? কোনো দরকার?
হ্যাঁ। আচ্ছা, ঐ বিল্ডিংটা কাদের? রাস্তার বিপরীতে থাকা একটা বিল্ডিং দেখিয়ে বলল আকুভাই।
– ওটা এখাকার এক স্থানীয়ের বাসা। কেন বলো তো!
– আজ রাতে ঐ বিল্ডিংয়ের এই পাশের কোনো একটা বাসায় বা ছাদে থাকতে হবে। ওখানে পরিচিত কেউ আছে আপনার?
– এমনিতে তো সবাই পরিচিত, কিন্তু রাতে থাকা… একটু থতমতো খেয়ে বলল হাবিব।
– না, মানে থাকতে পারলে ভালো হতো আরকি!
– ছাদের চিলেকোঠায় একটা ছেলে ব্যাচেলর থাকে। সে আমার পরিচিত, তাকে বলে দেখতে পারি!
– তাকে বলবেন ঠিক আছে, কিন্তু সে যদি জিজ্ঞেস করে কেন ওর ওখানে থাকছি? তখন!
– ওহ, তা-ও তো একটা কথা!
– হ্যাঁ, উত্তর রেডি করে যেতে হবে।
– হ্যাঁ, বলতে হবে, আমাদের বাড়িতে প্রতিদিন চোর ঢোকার চেষ্টা করতেছে, তাই এখান থেকে বিষয়টা দেখার জন্য থাকতে হচ্ছে। কথা তো মিথ্যে না।
– ঠিক আছে, এটাই বলেন।
সন্ধ্যার আগে-আগে থাকার অনুমতি নিয়ে এলো হাবিব। অনুমতি পেয়ে তার নিজেরও ভালো লাগছে। সন্ধ্যার পরপরই তার উৎসাহ-উদ্দীপনা বেড়ে গেল। সে আকুভাই ও সবুজকে ডেকে নিয়ে রুমটা বন্ধ করে লাইট নিভিয়ে দিলো। সবুজ বলল, লাইট নেভালেন কেন?
– ওয়েট। দেখো কী হয়?
একটু পরে একটা কৌটা থেকে বের করে আনল একটা পাথর। হাতের মধ্যে দেখা যাচ্ছে সেটা জ্বলছে, নীলচে আকার ধারণ করেছে পাথরের চারপাশ। একটা কাচের ওপর সেটা রাখল হাবিব। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো অন্ধকার রুম নীলচে আলোয় এমনভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠল যে, তাতে তাদের পরস্পরের চেহারা দেখা যাচ্ছিল! আকুভাই ও সবুজ হতবাক হয়ে গেল নীলপাথরের এমন কারিশমা দেখে! এমন বহু পাথরের কথা ইতঃপূর্বে শুনে থাকলেও আজ প্রম দেখল স্বচক্ষে। একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি কাজ করছে। হঠাৎ সবুজের মনে হলো একটা জোরসে বেগে বাতাস বইছে, কানে এমনটাই বাজছে! সে আকুভাইকে বলতে যাবে এমন সময় আকুভাই বলল, ভূমিকম্প হচ্ছে নাকি? মাথা ঘোরাচ্ছে মনে হলো যে!
– হ্যাঁ, আমারও হালকা মাথা ঘুরাচ্ছে!
হাবিব চুপ মেরে আছে। একটু পরেই পাথরটা একটা কৌটায় ভরে রাখল সে।
লাইট জ্বালানোর পর হাবিব বলল, কী বুঝলে?
– আপনি তো অনেক কিছু জানার পরও আমাদের জানাননি?
– কী জানাইনি?
– এই পাথরটা দেখার পরে মাথা ঘুরানোর ব্যাপারটা!
– শুধু কি মাথা ঘোরানো? একটা বাতাসের আওয়াজ শুনতে পাননি? সবুজ বলল।
– তুমিও পেয়েছো? আমি তো শুধু আমার মনে হয়েছে বলে কিছু বলছি না!
– এরকম আমারও লেগেছিল প্রম কয়েকদিন, এখন আর লাগে না। এমন হওয়ার কারণ কী জানো? হাবিব বলল।
– কী?
– কারণ আমাদের চিন্তা ও কল্পনার একটা সীমাবদ্ধতা আছে, সেটা যখন অতিক্রম করে তখন আমাদের মাথা ঘোরে, অস্থির লাগে, এমনকি কেউ কেউ বেহুঁশও হয়ে যায়!
– কিন্তু এটা আমার কাছে সেরকম কিছু বলে মনে হচ্ছে না!
– তাহলে কী মনে হচ্ছে?
– সেটা রাতশেষে বলতে পারব, আসল ব্যাপার কী! যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে আরকি! তবে আপনার আরো কিছু বিষয় খোলাসা করা দরকার আমাদের!
– কী বিষয়ে?
– কোনো চোরকে কি আপনারা ছাদে উঠতে দেখেছেন? বা প্রাচীর টপকাতে?
– না, দেখিনি।
– তাহলে? তাহলে এরকম আন্দাজের উপরে বলছেন যে চোর ঢুকতে চেষ্টা করছে!
– আমার মনে হচ্ছে কেউ আমার পেছনে লোক লাগিয়েছে। সব সময় মনে হয় কেউ একজন আমার পেছনে আছে, আমাকে ফলো করছে!
– কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এটা ভিন্ন একটা বিষয়!
– কেমন ভিন্ন বিষয়?
– সেটা কাল জানাবো। আর আপনাদের কাজের মহিলাটাকে একটু ডাকুন তো, তার সাথে কথা বলা দরকার।
হাবিব তাদের কাজের মহিলা চেমনারাকে ডেকে নিয়ে রুমে আনলে আকুভাই কোনো ভূমিকা না টেনে বলল, গত কয়েকদিন ধরে লুকিয়ে লুকিয়ে কী দেখছিলেন?
আকুভাইয়ের কথায় চেমনারা যেন আকাশ থেকে পড়ল! সে হতবাক হয়ে বলল, লুকিয়ে লুকিয়ে কী দেখছি মানে? কী বলেন কিছুই তো বুঝি না!
– এখন তো বুঝবেন না, যখন পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দেবো তখন ঠিকই স্বীকার যাবেন!
– সত্যি বলছি, আমি লুকিয়ে কিছুই দেখিনি!
– তাহলে কিভাবে দেখেছেন?
– আমি তো কিছুই দেখিনি! লুকিয়েও দেখিনি, সরাসরিও দেখিনি! আপনি কিসের কথা বলছেন সেটা তো আগে বলবেন!
– বললে তো এখন কেঁদেকেটে একাকার করে দেবেন!
আকুভাই হঠাৎ এসব কী বলছে হাবিব নিজেও বুঝতে পারছে না, সবুজ কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে।
চেমনারা বলল, কী দেখছি সেটা বলেন!
– কেন? হাবিব ভাইয়ের রুমে দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেননি?
– ওটা তো খালাম্মা জিজ্ঞেস করছিল হাবিব ভাই আছে কিনা দেখার জন্য, তাই উঁকি দিয়ে দেখছি!
– এটা ছাড়াও আরো কয়েকবার উঁকি দিয়েছেন! এরকম আরেকজনের রুমে কেন উঁকি দেন?
– আসতাগফিরুল্লাহ! এসব কী বলছেন আপনি!
– এত অভিনয় করবেন না, ভবিষ্যতে এরকম আর কারো রুমে গোপনে উঁকি দেবেন না, যান।
চেমনারা বিরস মুখে চলে গেলে হাবিব বলল, এটা কী হলো?
আকুভাই বলার আগে সবুজ বলে উঠল, নীলপাথরের ব্যাপারে চেমনারা কিছু জানে কিনা যাচাই করে নিলেন!
– হ্যাঁ, ঠিক তা-ই। চেমনারার কথা ও চেহারার ভাবভঙ্গিতে বুঝলাম সে নীলপাথরের ব্যাপারে কিছুই জানে না।

বইচোরের সন্ধানে । আরকানুল ইসলাম

৭.
রাতে খেয়ে-দেয়ে প্রস্তুত আকুভাই, সবুজ ও হাবিব। তবে একটা সিদ্ধান্ত চেঞ্জ হয়েছে। সবুজ রাত জেগে পাশের বিল্ডিংয়ের চিলেকোঠা থেকে হাবিবদের ছাদের দিকে নজর রাখবে। আকুভাই থাকবে হাবিবদের ছাদের ছোট্ট টিনঘেরা রুমে।
হাবিব তার নিজের রুমে থাকবে।
আকুভাই সবুজকে বলল, তোমার কোনো সমস্যা হবে না তো?
– না। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল সবুজ।
– ঠিক আছে, ভালো করে নজর রাখবে। শুধু ছাদে নয়, বাইরেও। কাঁঠাল ও সুপারি গাছ বেয়ে কেউ ছাদে যাচ্ছে কিনা তা-ও দেখবে। হাবিব বলল, আমার কোনো কাজ নেই?
– না, আপনি দেখতে থাকবেন যে গত কয়েকদিনের মতো ছাদে আজও লাফিয়ে পড়ার শব্দ পাচ্ছেন কিনা! পেলে আমাকে একটা টেক্সট দেবেন মোবাইলে। পাশাপাশি সবুজও সন্দেহজনক কিছু দেখলে আমাকে টেক্সট করবে।
– আমার তো মোবাইল নেই!
– তা তো জানি। তুমি হাবিব ভাইয়ের ছোট্ট মোবাইলটা আজ রাতের জন্য সাথে রাখবে। হাবিব সাথে-সাথে তার ছোট্ট মোবাইলটা সবুজকে দিয়ে দিলো।
হাবিব ও আকুভাইসহ গিয়ে সবুজকে পাশের বিল্ডিংয়ের বন্ধুর চিলেকোঠায় দিয়ে এলো। হাবিব তার বন্ধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে এলো। আকুভাই চলে গেল হাবিবদের ছাদের টিনঘেরা রুমে। হাবিব তার রুমে চলে গেল। কারো জন্য অপেক্ষা করাটা খুব কঠিন একটা কাজ। আর অপেক্ষা করা ব্যক্তিটা যদি অজ্ঞাত হয় তাহলে আর কথাই নেই। সেই অপেক্ষাটা তখন যাতনা হয়ে ওঠে। তবে অপেক্ষাটাকে অ্যাডভেঞ্চার হিসেবে নেওয়া হয় তখন ভিন্নকথা! এখন আকুভাই, সবুজ ও হাবিব তিনজনই তিন জায়গায় তিন রকম অ্যাডভেঞ্চার মোডে আছে। নাইট অ্যাডভেঞ্চার!
পাশের বিল্ডিয়ের চিলেকোঠায় সবুজের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়ল। রুমে ছেলেটার নাক ডাকার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। বাহির থেকে কিছুক্ষণ পরপর গাড়ি চলাচলের শব্দ আসছে। সবুজ জেগে আছে। পাহারা দিচ্ছে কড়া নজরদারির মাধ্যমে। তার দৃষ্টি হাবিবদের বাড়ি ঘিরে। রাত বারোটার পর এক ঘণ্টা যায়, দুই ঘণ্টা যায়- কারো আসার নাম নেই! দেখতে দেখতে সবুজের চোখ নেমে আসতে লাগল। ঘুম তাড়ানোর জন্য সে এবার বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। ঘুম এলে সব শেষ হয়ে যাবে, কোনোভাবেই ঘুমানো চলবে না।
এদিকে আকুভাইয়েরও একই অবস্থা। সবুজের রুমটা তা-ও গোছানো, আকুভাইয়েরটা টিন দিয়ে ঘেরা। তবে শীত এখনো একেবারেই যায়নি বলে গরমটা অনুভব হচ্ছে না। গরমকাল হলে তো এমন টিনের রুমে এক মিনিট থাকাও দুষ্কর হয়ে পড়ত। আকুভাইও আগন্তুকের জন্য অপেক্ষা করতে-করতে ক্লান্ত হয়ে উঠল। ওদিকে হাবিব নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে! বিছানায় শুইতেই ঘুমিয়ে পড়ল সে। তার যেন তেমন একটা গরজ নেই, আকুভাই ও সবুজই তো সব করে দেবে! সে ভাবছিল- চোর বা কেউ এলে তো ছাদে লাফিয়ে পড়ার শব্দ শোনা যাবে আর তার মা এসে জানিয়ে দেবে যে, এখনো কেউ একজন লাফিয়ে পড়ার শব্দ শুনলাম, দেখতো! সবুজ একটা টেক্সট দিলো আকুভাইকে। ‘ভাই, কী করেন?’
– ‘বসে আছি, কিছু দেখলে জানিও’ আকুভাই রিপ্লাই দিলো।
ঠিক তার কিছুক্ষণ পর একটা বিকট শব্দ হলো। কেউ যেন লাফিয়ে পড়ল ছাদে! আকুভাই রুম থেকে টিনের ফাঁক দিয়ে দেখতে লাগল। দুটো অবয়ব। দুটোই যেন ঠেলাঠেলি করে এগিয়ে আসছে! কিন্তু তাদের চেহারা দেখা যাচ্ছে না, হাত-পা কিছুই দেখা যাচ্ছে না। একটা অবয়ব দেখা যাচ্ছে। আকুভাই একটু ভয় পেলেন বটে তবুও চোখ সরালেন না। কাছে আসতেই মনে হলো এরা যমজ, আগের মতো ঠেলাঠেলি করছে! দুটোই ছাদে এসে প্রথমে এদিক-ওদিক তাকালো। পরস্পরে কী যেন বলল, তারপরে সিঁড়ির দিকে নামতে লাগল। সিঁড়িতে লাইট জ্বালানো ছিল। তারা সিঁড়ির দিকে গেলে আকুভাই রুম থেকে বের হয়ে তাদের পিছু পিছু যেতে লাগল।
ওদিকে সবুজ তো হতবাক! সে দেখল হাবিবদের পুরো ছাদ নীলচে রঙ ধারণ করে আছে। দুটো ছায়া দেখল বটে, কিন্তু সেগুলোকে মানুষ বলে মনে হলো না! সে আকুভাইকে একটা টেক্সট করল- ‘দুটো ছায়া দেখতে পাচ্ছি ছাদে, আপনি কাছ থেকে তাদের চেহারা দেখতে পাবেন।’ সবুজের টেক্সট পেয়ে ‘দেখছি’ বলে একটা টেক্সট রিপ্লাই করে ওদের কা- দেখতে লাগল।
এতক্ষণেও তাদের চেহারা দেখা গেল না, অথচ তারা মুখ ঢাকেনি! আকুভাইয়ের কেমন যেন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, মানুষ না হলে এরা তবে কী?
বাসার নিচ থেকে দরজা ধাক্কানোর একটা শব্দ আসতে লাগল। একটু পরেই কথা শোনা গেল। একটা মহিলা ও একটা পুরুষের। পুরুষের কণ্ঠটা হাবিবের। হাবিব রুম থেকে বের হয়ে এলে ওর মা বলল, কী হলো দেখতো, ছাদে এত লাফালাফি করছে কে?
হাবিব ছাদের যাওয়ার মুখেই দেখল আকুভাই দাঁড়িয়ে আছে! আকুভাই বলল, নিচে কী হলো?
– কিছুই না। মা বলল, ছাদে লাফালাফির শব্দ শুনতে পেয়েছে, তাই দেখতে এলাম। তোমার কী অবস্থা?
আকুভাই যা যা দেখতে পেল সবকিছু খুলে বলল।
সব শুনে হাবিব বলল, তাহলে এরা কারা? কই গেল তারা?
– সেটাই তো কথা!
আকুভাইসহ নিচে চলে এলো হাবিব। তার মাকে বলল, ছাদে তো কাউকে দেখতে পাইনি। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।
– এরকম শব্দ হলে কি ঘুম আসে?
– তাহলে কী করবে? জেগে থাকবে?
হাবিবের মা কথার জবাব না-দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।
আকুভাই সবুজকে ঘুমিয়ে পড়ার জন্য একটা টেক্সট দিয়ে হাবিবের রুমে চলে গেল। রুমে ঢুকে দু’জনেই হতবাক!
রুমের সবকিছু ছড়ানো-ছিটানো, যেন কেউ কোনো কিছু খুঁজে গেছে! হাবিব তাড়াতাড়ি তার ব্যাগটার দিকে গেল, যেখানে রাখা ছিল সেই নীলপাথর! ব্যাগের ভেতরে রাখা প্যাকেট খুলে দেখে যথাস্থানেই আছে সেটি। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল সে। ছড়িয়ে থাকা রুমের কাপড়-চোপড়, বই-খাতাসহ দ্রুত গুছিয়ে রাখল, তাতে হাত বাড়াল আকুভাই। সে বলল, রুমের এই অবস্থা কেন? কে করেছে?
– সেটাই তো বুঝতে পারছি না। রুম থেকে যখন বের হচ্ছি তখনো সব গোছানো ছিল!
– এরকম আগে কোনো সময় হয়েছে?
– না। তবে একটা-দুইটা জিনিস এদিক-ওদিক হয়েছিল। তখন সেটাকে নিজের ভুল মনে করেছিলাম, কিন্তু এখন…
– এখন কী?
– এখন তো সন্দেহ হচ্ছে!
– কাকে?
– কাউকে না। নির্দিষ্ট কেউ না। এখন মনে হচ্ছে এখানে ভিন্ন কোনো ব্যাপার আছে! তোমার কী মনে হয়?
– ছাদে যা দেখেছি এবং রুমে এসে যে অবস্থা দেখলাম তাতে তো আমার অন্যরকম একটা সন্দেহ হচ্ছে।
– কী রকম? হাবিব বলল।
– আপনার কেমন মনে হচ্ছে সেটা আগে বলেন! আকুভাই বলল।
– এখানে দৈব কোনো ব্যাপার আছে!
– তার মানে পাথর দেখার সময় যে আমার ও সবুজের মাথা ঘুরিয়েছে তা সাধারণ কোনো ঘটনা নয়!
– হ্যাঁ, সেরকমই তো মনে হচ্ছে! আরো একটা ঘটনা আছে! হাবিব বলল।
– কী? জানতে চেয়ে বলল আকুভাই।
– একটা স্বপ্ন দেখেছি। ঠিক স্বপ্ন নয়, দুঃস্বপ্ন!
– কী রকম?
– দেখলাম, দুটো ছায়ার মতো আকৃতি এসে আমার মাথার পাশে বসে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। বলছে, আমাদের দেবতাকে ফিরিয়ে দিয়ে আয়। একে রেখে তুই ভালো থাকতে পারবি না? তোকে শেষ করে ফেলব। হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠল চারপাশ। আগুনের রঙও ছিল নীলচে! দেখে আমি খুব ভয় পেয়ে গেছি! এরই মধ্যে আম্মার ডাক শুনে ঘুম ভাঙে আমার!
– দেবতা মানে কী বুঝাচ্ছে তারা?
– মনে হয় নীলপাথরটাই!
– তো কী করবেন এখন?
– রাজাপাথরকে ওদিকের সবাই দেবতা পূজাজ্ঞান করে। ঐ পাথরটার পাশে কেউ ছবি তোলে না, ওটার পাশে গিয়ে হৈ-হুল্লুড় বা খারাপ কোনো কাজ করে না, যথাযথ সম্মান দেখিয়ে চলে।
– তো, এরা কারা?
– বোধহয় নীলপাথরকে এরাও দেবতা মানে! এরা নীলপাথর বা রাজাপাথরের পূজারি হতে পারে!
– তাহলে নীলপাথর ও রাজাপাথর কী আলাদা কিছু?
– সেটাই বা বলি কিভাবে? এখন তো মনে হচ্ছে রাজাপাথরের প্রাণই হচ্ছে এই নীলপাথর!
– আমারও তা-ই ধারণা! সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে এর পেছনে দৈব কোনো ব্যাপার আছে!
রাত অনেক হওয়াতে কথা আর বাড়ায়নি তারা, ঘুমিয়ে পড়েছে।
পরদিন সকালে সবুজসহ এলে তারা তিনজন আবার বসল।
আকুভাই কী একটা কথা শুরু করতে চাইলে সবুজ বলল, আগে আমাকে বলতে দিন। কাল রাতে যখন ঘুমানোর জন্য আমাকে টেক্সট করেছেন তখন আপনি কোথায় ছিলেন?
– এই রুমে। ছাদ থেকে নেমে গেছি তখন।
– তাহলে তো ঠিকই আছে!
– কী ঠিক আছে? অবাক হয়ে জানতে চাইল আকুভাই।
– যখন আমাকে টেক্সট করেছেন তখনো আমি চিলেকোঠার জানালার পাশে বসা ছিলাম, আপনাদের ছাদ থেকে একবারের জন্য চোখ সরাইনি! ছাদে তখন দুটো নীলচে আকৃতির লোক খুব নাচতেছিল, কিন্তু তাদের চেহারা বুঝা যাচ্ছিল না। আমি ভাবছি, আকুভাইও নিশ্চয় ওদের এসব কাণ্ড দেখছে!
– বলো কী? আমরা তো তখন নিচে ছিলাম!
– কিছুক্ষণ নাচানাচি করে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও ওদের আর দেখিনি। কিন্তু ওদেরকে আমার একবারের জন্যও মানুষ বলে মনে হয়নি।
আকুভাই তখন রাতে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা সবুজকেও জানাল।
সবুজ বলল, হাবিব ভাই, এই যে নীলপাথর, এটা চুরির জন্য আপনার কোনো বন্ধু বা কাছের কেউ আপনার পিছু নেয়নি। পিছু নিয়ে এরাই, যাদের গত রাতে আমি ও আকুভাই দেখেছি, যারা আপনার বেডরুম তছনছ করে কিছু একটা জিনিস খুঁজে গেছে!
– একদম যথার্থ বলেছো সবুজ। সবুজ যেটা বলছে সেটাও আমার কথা।
হাবিবের চেহারায় ঔজ্জ্বল্য চলে গেছে। সে হঠাৎ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। মনমরা হয়ে সে বলল, এখন তাহলে কী করতে পারি? এরা যদি পিছু না ছাড়ে!
– পিছু ছাড়বে বলে তো মনে হচ্ছে না। সবচেয়ে বেটার হয়, আপনি নীলপাথর যেখানে পেয়েছেন সেখানে রেখে আসেন, যাদের জিনিস তাদের কাছেই থাক। ওটাই ঐ পাথরের জন্য নিরাপদ জায়গা।
– তাহলে কি দিয়ে আসতে বলছো?
– হ্যাঁ, দিয়ে আসেন।
– আমার তো ভয় হচ্ছে এখন! যদি কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলে তারা! আর সেটা রেখে আসবই বা কেমন করে?
– কেন? যেমন করে এনেছিলেন ঠিক তেমন করে!
– আমার তো ঐ পথে যেতেই এখন ভয়ে কাহিল হবার জোগাড়! একা কিভাবে যাবো?
– আগেরবার যাদের নিয়েছেন তাদের সাথে যান!
– ওদের সাথে যাওয়া টোটালই পসিবল নয়। কারণ, আবার যদি রেমাক্রি যাই তো তারা সন্দেহ করবেই করবে! এত অল্প সময়ে কেন আবার সেখানে যাচ্ছি তারা সেটাই জিজ্ঞেস করবেই!
– তাহলে কী করবেন?
– সেটাই তো মাথায় আসছে না!
কিছুক্ষণ ভেবে হাবিব বলল, বন্ধুদের বলা যাবে না এসব কথা। কিন্তু আমি একটা প্রস্তাব দিতে চাচ্ছি।
সবুজ বলল, কী প্রস্তাব?
– ভাবছি, তোমরাসহ চলো না বান্দরবানের রেমাক্রি! বেড়ানো বেড়ানো হয়ে গেল, রেমাক্রি ফলসও দেখা হয়ে গেল। তাছাড়া, তোমরা তো রেমাক্রি যাওনি কোনো সময়? এবার চলো। তোমাদের যাওয়া-আসার সব খরচ আমি দেবো! আকুভাই ও সবুজকে পরস্পরের দিকে তাকাতে দেখে হাবিব বলল, পরস্পরের দিকে তাকিয়ে কী হবে? তোমাদের বাড়ি থেকেও তো বলেছে, আপাতত বাড়ি না যেতে, তো সমস্যাটা কোথায়?
– সমস্যার কথা ভাবছি না! ভাবছি, কী কাজে এসে কী সবে যে জড়িয়ে যাচ্ছি!
– এটাই তো গোয়েন্দাদের জীবন! প্যাঁচে ঢুকে গিয়ে আবার প্যাঁচ খুলে বেরিয়ে পড়া! এটাই তো অ্যাডভেঞ্চার!
– এখন সিদ্ধান্ত দিতে পারছি না। আমাকে একটু সময় দিন।
– একটু না, আজ রাত দশটা পর্যন্ত সময় নাও,
রাতে জানাও। তবে সেটা যেন অবশ্যই পজেটিভলি হয়।
আকুভাই ও সবুজ ভাবতে লাগল কী করা যায়!

(সমাপ্ত)

Share.

মন্তব্য করুন