সন্ধ্যাবেলা চুপি চুপি কুয়োপাড়ে এলো পানু। চটিজোড়া আগেই এনে রেখেছিলো সেখানে। পানির শব্দটা যাতে না হয় সেজন্য খুব সাবধানে হাত-পা ধু’লো পানু। তারপর পেছনের দরজা দিয়ে নিঃশব্দে পড়ার ঘরে এসে ঢুকলো। ওকে দেখে হৈ চৈ করে উঠলো বাবলু আর মিলি। বলল, ‘আজো দেরি করে এসেছিস?’
‘ছিঃ ছিঃ এত মার খাস, তবুও লজ্জা করে না?’
‘ভয় করে না তোর?’
ওদের কথার কোন উত্তর দেয় না পানু। জ্ঞাতিশত্রু এই ভাই-বোন তিনটের তেতো কথা হজম করে, নিজের বইপত্র নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় বসলো শুধু। ভেতরের দরজার ঝুলন্ত পর্দার দিকে তাকালো পানু। উঃ কি ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে। পানি…পানি…। কিন্তু পানি পাবার উপায় নেই। পানির জন্যে ভেতরে গেলেই মার খেতে হবে। পানুর দৈনন্দিন জীবনের রুটিন বাঁধা কাজের মধ্যে এটাও অন্তর্ভূক্ত। রোজ সন্ধ্যাবেলা একবার করে মার খাওয়া।

সংসারের কোন কাজেই পানুর সাহায্য পাওয়া ভার। সকালে চারটে খেয়ে স্কুলে যাওয়া। আর সেখান থেকে ফিরে এসে আর চারটে নাকে মুখে পুরে, আবার খেলার মাঠে ছোটা। এইতো পানুর জীবন। আর এটাই ওর সবচে’ বড় অপরাধ। কোনো বাধা-বিপত্তিই একদিনের জন্যেও ওর এই বিকেলের নেশাকে রোধ করতে পারে না। পরিবারের কেউ- এমনকি মাও আটকাতে পারেন না ওকে। পৃথিবীর কোন আকর্ষণই যেন ওর কাছে বড় নয়। একমাত্র খেলাটাই ওর জীবনের সব।
কতদিন মানা করেছেন মা। বলেছেন, ‘রোগা শরীরে এত পরিশ্রম সইবে না। অসুখে পড়বি যে!’
মায়ের কথাটা কানে গেলেও-এর কোন মূল্য আছে বলে মনে করে না পানু। ভাবে- এমন কথা বলবেনই। ওটা মায়ের অভ্যাস।
‘পানু ভাই-মা আপনাকে ডাকছেন। চাকর ছোঁড়াটার ডাকে অবাক না হলেও ব্যথা পায় পানু। এ ডাকের অর্থ সে জানে। আর জানে বলেই তো ভেতরে আসতেই মা তাঁর বলিষ্ঠ হাত দিয়ে পানুর সরু কালো হাতটা চেপে ধরলেন। লিক্ লিক্ করে উঠলো তাঁর হাতের বেতটা। বললেন- ‘আজ আবার সন্ধ্যা পার করে ফিরেছিস? তোকে না মানা করেছি রোগা শরীর নিয়ে রোজ খেলতে যাবিনে। কথা কানে যায় না?’
সপাং করে লিকলিকে বেতটা এসে পড়লো পানুর পিঠের ওপরে।
‘মা-মাগো!’ ডুকরে কেঁদে উঠলো পানু।
‘আর অবাধ্য হবি? যাবি রোজ রোজ?’
‘না-না-না-। কোন দিন না-।’
কিন্তু পরদিন আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
এমনকি প্রতিদিনই হয়। কষ্ট হলেও এর জন্যে প্রস্তুত থাকে পানু। পানু জানে শুধুমাত্র এজন্যেই এত বড় পরিবারের কেউ তাকে দেখতে পারে না। পছন্দ করে না ছোট ভাই-বোনগুলোও। ওদের সামনে রোজ মার খাওয়া…কি যে লজ্জার…কিন্তু উপায় নেই। এর বেশী ভাবতে পারে না পানু। একেক সময় অবাক হয়ে ভাবে সে, কেন ওরা বোঝে না, কি আনন্দ এই খেলাতে…। কেন ওরা ভাবতে পারে না যে, মায়ের কোল ঘেঁষে রাজপুত্তুরের অভিযানের গল্প শোনার চাইতে ঢের বেশী আনন্দ আছে এই খেলার মাঠে। আছে বীরত্ব।
পড়ার টেবিলে ভাইবোনদের সাথে কোনদিনও খেলার
মাঠের গল্প করে না পানু। কোনদিনও জানায়নি স্কুলে
ঐ কালোপনা রোগা ছেলেটার কত মূল্য…!
কি হবে বলে? কই, কেউ কোনদিনও জানতে চায়নি ওকে? ভুলেও তো কেউ জিজ্ঞাসা করেনি যে কত বড় মাঠে পানু খেলতে যায়?
মিলিটা না হয় ছেলে মানুষ। কিন্তু বাবলু আর শীনু?
ওরা কি কোনদিন কল্পনা করতে পারবে, কেন পানুকে দলে নেবার জন্যে ছেলেদের মধ্যে এত ঝগড়া হয়?
ওরা কি জানে যে এমন ভারী হকিস্টিক আর ক্রিকেট ব্যাটটা পানুর হাতের পুতুল? কি করে ভাবতে পারবে ওরা? চাতালে বসে ক্যারাম আর লুডু খেলার মাথা নিয়ে কি অতো বড় বড় চিন্তা করা যায়? কিন্তু সব ছেলেইতো খেলা শেষে সন্ধ্যা করে বাড়ী ফেরে। তাই বলে ওরা কি রোজ মার খায়? পানুর কোন দামইতো নেই বাড়িতে। পরিবারের কারো সেড়বহ-ভালোবাসা পায় না সে। এ-জন্যে দুঃখ করে না পানু। সে জানে বাড়ির কেউ তাকে ভালোবাসে না। মেজো কাকু, ছোটমামা, দাদু, বাবা-মা কেউ না, কেউ না…। সব বোঝে সে। সব জানে, আর জানে বলেইতো সংসারের বন্ধন ওকে ধরে রাখতে পারে না।
কিন্তু মন কি চায় না?
একটু আদুরে ধমক, একটু স্নেহস্পর্শ, রাগ করলে কাছে টেনে নেয়া…চোখ মুছিয়ে দেয়া…। বুক ঠেলে একটা অব্যক্ত ব্যথার ঢেউ উঠতে চায়। সামলে নেয় পানু। বাড়িতে কবে প্রাণ খুলে হেসেছে সে…? কবে জোরে দু’টো কথা বলে দাবি আদায় করেছে…? মনে পড়ে না ওর।

পরদিন বিকেলে স্কুলের মাঠে গেল পানু। চারদিকে ব্যস্তভাবে তাকালো। কিন্তু বিশেষ কাউকেই চোখে পড়লো না ওর। হেডস্যার কাছে এসে পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘বাহ্! এবারকার ফার্স্ট প্রাইজগুলোও তাহলে তুমি পাচ্ছো!’
সলাজ হেসে পানু বললো, ‘আজ কি খেলা হবে না, স্যার! মিঠুরা আসেনি আজ?’
‘এসেছে। সবাই ফাংশনের আয়োজনে ব্যস্ত। আর মাত্র ক’টা দিন আছে হাতে। তুমি হলে যাও। ওখানে সবাইকে পাবে।’ বললেন হেডস্যার।
খুশি হ’ল পানু। আসছে রোববার স্কুলের পুরস্কার বিতরণী উৎসব। জুনিয়র গ্রুপের সবগুলো ফার্স্ট প্রাইজ পাবে পানু। তাছাড়া সবার ওপর রয়েছে চ্যাম্পিয়ানশীপ। উঃ! ভাবতে ভীষণ ভাল লাগছে পানুর। কী যে আনন্দ…! সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলো পানু। বৃষ্টিতে ভিজে। শার্ট-প্যান্টে কাদা লাগিয়ে। বাড়ির কাউকেই এই আসনড়ব সুখবরটা জানাল না সে। ভাবলো- ঐ দিনই হঠাৎ প্রাইজগুলো এনে বাড়ির সবাইকে একেবারে চমকে দেবে। তখন ওরা বুঝবে পানুর মূল্য…।
ভেজা কাপড় ছাড়ার বিপদ অনেক। তাই ওগুলো না ছেড়েই অনিচ্ছা সত্ত্বেও পড়ার টেবিলে বসলো পানু। শরীর বড্ড ক্লান্ত শীত শীত করতে লাগল। গায়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেছে সজারুর কাঁটার মত। কে জানে, বৃষ্টিতে ভেজার জন্যই হয়ত এমন শরীর খারাপ লাগছে। চোখ দু’টো বুজে আসতে চাইছে বারবার।
একটু ঘুমুতে পারলে যেন বেশ হ’ত। উঃ! ভয়ানক ঘুম পাচ্ছে।
হেডস্যার সব ছেলেদেরকে বলেছেন, বাড়ি গিয়ে গরম দুধ খেয়ে লেপমুড়ি দিয়ে…।
আর সব ছেলেমেয়েরা হয়ত তাই-ই করছে। কিন্তু পানুর সাহস হ’ল না গরম দুধ আর লেপের কথা ভাবতে। টেবিলে মাথা রেখে, চোখ বুজলো পানু। স্বপ্ন দেখলো…। …অনেকগুলো প্রাইজ ওর হাতে। যমদূত প্রায় একটা লোক জোর করে প্রাইজগুলো নিয়ে যেতে চাচ্ছে। না-না-না…। কিছুতেই দেবে না পানু। সেই লোকটা মারছে ওকে বেদম জোরে। উঃ! মা-মাগো…। ঘুমের মধ্যে কঁকিয়ে উঠলো পানু। সপাং করে মায়ের হাতের বেতটা এসে পড়ল পানুর পিঠের ওপর।
‘পড়ার টেবিলে ঘুমান? সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজে, বাঁদরামো ক’রে, সন্ধ্যাবেলা পড়ার টেবিলে ঘুমানোর মজা বের করছি দাঁড়া। মুখপোড়া ছেলে…এই বাদলাতে কি তোর না গেলেই নয়?
‘মা!’
মায়ের ক্ষিপ্ত গর্জনের মাঝে তলিয়ে গেল পানুর ক্ষীণ আর্তনাদ। এতদিন এরচেয়ে বেশী মার খেয়েও কোনদিন এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেনি পানু। কিন্তু আজ সামান্য আঘাতেই ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললো। সে রাতে জ্বর এলো পানুর। ঘণ্টায় ঘণ্টায় জ্বরের মাত্রা বাড়তেই লাগলো। গোঙাতে লাগলো বিছানায় পড়ে। মা গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠলেন।
প্রলাপ বকতে শুরু করল পানু।
অবস্থা খারাপের দিকেই এগুতে লাগলো। ডাক্তারের পরামর্শে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হ’ল পানুকে। মা কেঁদে ফেললেন, ‘রক্ষা করো-খোদা…।’
পুরো দেড়দিন পর জ্ঞান ফিরলো পানুর। ক্লান্ত চোখ দু’টো মেলে চারদিকে চেয়ে কাকে যেন খুঁজলো। তারপর বলল, ‘আমি স্কুলে যাবো। তোমরা আমায় স্কুলে দিয়ে এসো। এখানে থাকলে আমি মরে যাবো।’
মা কেঁদে ফেললেন। ‘হ্যাঁরে…একবারও তো মা বলে ডাকিসনি? স্কুলটাই তোর আপন হ’ল? আমি তোর কেউ নই?’
মায়ের মুখের দিকে চেয়ে রইল। মা কাঁদছে। কাঁদছে তারই জন্যে…। চোখ সরাল পানু। দৃষ্টি মেলে দিল দূরে অনেক দূরে…। পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘে আকাশটা হারিয়ে গেছে। কত কথা মনে পড়ে পানুর। ঐ স্তুপীকৃত মেঘের আড়ালে যেন কত স্মৃতি লুকিয়ে আছে। কত ঘটনা। আজ এই মুহূর্তে ঐ মেঘের বুকে আকাশের জানালায় চোখ পেতে অনেক কিছু ভাবতে ইচ্ছা করে পানুর।
স্কুলে খবর দেয়া হ’ল। পুরস্কার বিতরণী উৎসবে যোগ দিতে পারলো না পানু। অনুষ্ঠানের ঘোষণা করা হ’ল- ‘জুনিয়র গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন পানু অসুস্থ। পানুর প্রাইজগুলো নিয়ে হাসপাতালে এলেন হেডস্যার। এলেন আরো অনেক ছাত্র শিক্ষক। হেডস্যার বললেন, ‘পানু আমাদের স্কুলের গৌরব। এমন ছেলে আর হয় না।’
পানু আবার জ্ঞান হারাল। জ্বর ক্রমশ বেড়েই চললো। ডাক্তার জানালেন- টাইফয়েড। বাবা-মা আরো ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। অনেকগুলো অব্যক্ত প্রহর কাটলো। অতন্দ্র প্রহরীর মত জেগে ছিলেন সবাই। শেষ পর্যন্ত ডাক্তারের ব্যস্ততা কমল। পানু সেরে উঠলো। কিন্তু অবশ হয়ে গেল ওর ডান পা’টা।
নতুন করে আঘাত পেল সবাই। মাকে সান্তনা দিতে গিয়ে অনেকদিন আগের ভুলে যাওয়া হাসি হাসলো পানু।
‘ভালই হ’ল মা। এখন থেকে তোমার ছেলে আর খেলতে যাবে না।’
ওকে বুকে চেপে হুহু করে কেঁদে ফেললেন মা।
মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে চোখের জল চাপতে পারল না পানু। ওর মনে হ’ল…পা হারিয়ে এই প্রথম সেত মায়ের বুকে আশ্রয় পেল।
ক্রিকেট, ব্যাট, হকিস্টিক আর ফুটবলটা ছেলেদের দিয়ে দিল পানু। কি হবে আর ওগুলো রেখে? অথচ কত ভালোবাসে সে জিনিসগুলোকে… আর সে জন্যেই হয়ত…। বিছানার ধারে খোলা জানালা।
ওপাশে করমচা গাছে ফুল ফুটেছে অসংখ্য। জানালা গলিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি মেলে দেয় পানু। অনেক অনেক মেঘ ভেসে চলেছে আকাশে…। হালকা সাদা নরম তুলোর মত সব মেঘ। চিলগুলো অত উপরে উঠতে পারে? কই আগেতো কখনো চোখে পড়েনি পানুর? আর পড়বেই বা কেমন করে? আগেতো কখনো বিছানায় অলসভাবে শুয়ে আকাশ পানে দৃষ্টি মেলে দেবার অবকাশ পায়নি পানু।
ক’টা বাজে এখন? চারটে? নিশ্চয়ই খেলার মাঠে ভিড় জমে গেছে এতক্ষণে…? সব যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে পানু। শুনতে পাচ্ছে ছেলেদের উচ্ছ্বল হাসি। ওদের পায়ে পায়ে ছুটছে পানুর দেয়া বলটা। ক্রিকেট ব্যাটের ঠক্ঠক্ শব্দ…। উহঃ! কত পরিচিত…।
‘আউট… আউট’ করে চেচাঁচ্ছে ওরা।
খেলাটা কিছুতেই জমছে না।
কেন এমন হচ্ছে? ভাবছে এ পক্ষের ছেলেরা।
দুয়ো দুয়ো হেরে গেছে!
হল্লা করছে ওপক্ষের ছেলেরা। এরা ভাবছে, তাইতো?
আমাদের পানু আসেনি আজ!
ও না এলে কি খেলা জমে?
টপটপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো পানুর রোগা গাল বেয়ে।

Share.

মন্তব্য করুন