সকাল থেকেই মুশলধারে বৃষ্টি। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে নেহা। তার বয়স আট বছর। দু’বছর বয়সে সে বাবা মায়ের সাথে আমেরিকা চলে এসছে। কয়েক দিন পরেই দেশে ফিরবে বাবা মা এবং চাচ্চুর সাথে। তাও আবার দু’মাসের ছুটি। এই দু’মাসের মধ্যেই সকল আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়াতে যেতে হবে। বাবা মা তাকে এমন আরও অনেক গল্প বলেছেন।
নেহার মন খুব খারাপ। এতো দিন সে কিভাবে থাকবে বাংলাদেশে! ছোট চাচ্চুর উপর বেশি মেজাজ খারাপ। সে বেড়াতে না এলে এবার ছুটিতে তারা কানাডা যেতে পারত! ইন্টারনেটে দেখেও রেখেছে কানাডার সুন্দর সুন্দর জায়গা।
হঠাৎ ছোট চাচ্চু পিছন থেকে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘কী রে মা, সকাল সকাল এমন চুপ করে বাইরে তাকিয়ে আছিস কেন! তোর কি মন খারাপ?’
‘না চাচ্চু বৃষ্টি দেখছি।’
‘এখানে বৃষ্টি দেখে তুই বৃষ্টির মজা বুঝবি না মা।
বৃষ্টির আনন্দ উপভোগ করতে হলে তোকে বাংলাদেশে যেতে হবে। টিনের চালের ওপর যখন রিমঝিম বৃষ্টি পড়বে তখন মনে হবে প্রকৃতি নিজেই বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে।’
নেহা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ‘চাচ্চু একটা কথা বলব!’
‘অবশ্যই বলবি মা। একটা না হাজারটা বল।’
‘তোমাদের দেশে আমার যেতে ইচ্ছে করছে না।’
চাচ্চু মন খারাপ করার বদলে তার মাথায় হাত বুলিয়ে গুনগুন করে গাইতে থাকে-
‘‘ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা
ও সে স্বপড়ব দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
ও সে সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি
সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি।”
অতঃপর বলেন, ‘পাগলী মেয়ে ওটা তোরও জন্মভূমি। বাংলার অপরূপ সৌন্দর্যের কারণেই বাংলাদেশকে রূপসী বাংলা বলা হয়।’
‘শুধু ধান আর ফুল ফলের জন্যই একটি দেশকে রূপসী বাংলা কেন বলা হয় চাচ্চু!’
‘শুধু ধান আর ফুল ফলের জন্য হবে কেন বোকা মেয়ে। বাংলাদেশে রয়েছে অসংখ্য নদী-নালা, খাল-বিল, পাহাড়, সমুদ্র। পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বহমান অসাধারণ লেক, রয়েছে সুউচ্চ পাহাড়ের সাথেই নৈসর্গিক ঝর্ণা। যার একটিও কৃত্রিম নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সি-বিচ আমাদের কক্সবাজারে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন আমাদের সুন্দরবন যা বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি। বঙ্গোপসাগর উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত এই সুন্দরবন। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের যা আনুমানিক ১০,০০০ বর্গ কিলোমিটার। যার বৃহৎ অংশ অর্থাৎ ৬,০১৭ বর্গ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশে আর বাকি অংশ রয়েছে ভারতে। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই অপরূপ বনভূমি বাংলাদেশের খুলনা সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুই জেলা উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জুড়ে বিস্তৃত।
নেহার স্বদেশ ভ্রমণ । আরমানউজ্জামানআবার সিলেটের কথা যদি বলি সেখানেও দেখে শেষ করতে পারবি না এমন সব নৈসর্গিক সৌন্দর্য রয়েছে বিছানাকান্দি, মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত, জাফলং, তামাবিল, জৈন্তাপুর, লালাখাল, শ্রীমঙ্গল লাউয়াছড়া রেইন ফরেস্ট, মাধবপুর লেক। আর কতো কী! একটা থেকে একটা সুন্দর। দু’ মাস কেন তুই তো ছয় মাসেও শেষ করতে পারবি না মা।’
নেহা বিস্ময় নিয়ে তার চাচ্চুর দিকে তাকিয়ে আছে!
চাচ্চু বললেন, ‘কী ভাবছিস মা!’
‘এতো সুন্দর আমাদের দেশ চাচ্চু! দেখার মতো এতো কিছু আছে!’
চাচ্চু চোখ মুছতে মুছতে বলে. ‘হ্যাঁ মা। আমাদের দেশ ভীষণ সুন্দর। দেখার মতো অনেক কিছু আছে।’
নেহা বলল, ‘তুমি কাঁদছ কেন চাচ্চু!’
‘সে তুই বুঝবি না মা। আচ্ছা তুই কি কখনো গ্রামে গিয়েছিস? মনে পড়ে গ্রামের কথা!’
নেহা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, ‘হ্যাঁ, চট্টগ্রামে গিয়েছি।
তবে ভালো করে কিছুই মনে নেই।’
চাচ্চু হেসে বললেন, ‘ওটা গ্রাম না মা। কয়েক দিন পড়েই আমরা দেশে ফিরে গ্রামের বাড়িতে যাবো। দেখবি গ্রামও ভীষণ ভালো লাগবে তোর।’
‘শুধু গ্রাম দেখালে হবে না। তুমি যেসব জায়গার নাম বলেছো সব জায়গা দেখাতে হবে।’
অতঃপর নেহা সুন্দর একটি নোটবুক বের করল।
চাচ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি লিখে রাখছি তুমি বলো।’
চাচ্চু বলল, ‘আমরা নিশ্চয়ই সব জায়গাতে যাবো মা। অনেক দিন ফ্যামিলি ট্যুর হয় না। সবাই এক সাথে বেড়াতে যাবার মজাই আলাদা। তোদের জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।’
নেহা নোটবুকে টুকে নেয় আরো নতুন কিছু জায়গার নাম। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি বান্দরবনসহ আরোও কিছু চমৎকার জায়গার নাম। যেখানে একবার গেলে আর ফিরে আসতে মন চায় না। যেমন- সাজেক ভ্যালি, কাপ্তাই লেক, শুকনাছড়া ঝর্ণা, রাইখং লেক, পকুয়ারপাড়া, বান্দরবনের নীলগিরি, নীলাচল, সাঙ্গু নদী, কেওক্রাডং, বগা লেক, থানছি, চিম্বুক পাহাড়, জাদিপাই পাহাড়ের ঝর্ণা ছাড়াও লিখে রাখে মিরসরাইয়ে অবস্থিত খৈয়াছড়া ঝর্ণার কথা।
নেহা চোখ বন্ধ করে কল্পনায় স্বপ্নের জগতে ভাসতে থাকে। ভাবতে পারে না তার জন্মভূমি এতো সুন্দর! চাচ্চুর কাছ থেকে স্বপ্নের মতো গল্প শুনতে থাকে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের কথা। আরো একটি দ্বীপের কথা শুনে চমকে ওঠে নেহা কারণ সেখানে রয়েছে অসংখ্য চিত্রা হরিণের অবাধ বিচরণ। সেই দ্বীপটি হলো নোয়াখালীর হাতিয়াতে অবস্থিত নিঝুম দ্বীপ।
এক অদ্ভুত স্বপ্নের মধ্যে দু’টো দিন কেটে যায় তার।
সে চাচ্চুর দেয়া তথ্য অনুযায়ী ইন্টারনেটে দেখতে থাকে একটি রূপসী বাংলাদেশ। দেখে চাচ্চু বলেনি এমন আরও অনেক সুন্দর সব জায়গা রয়েছে।
যেগুলো সে টুকে নিয়েছে নোটবুকে। দু’দিন আগেও যে ভাবছিল বাবা-মা আর চাচ্চুদের দেশ বাংলাদেশ। আজ সে নিজের পোশাক গোছাতে গোছাতে গুনগুন করছে-
“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
ও সে সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি,
সে যে আমার জন্মভূমি, সে যে আমার জন্মভূমি।”
মেয়ের মুখে এই গান শুনে আকস্মিক নেহার বাবা-মায়ের চোখেও জল এসে গেলো।

Share.

মন্তব্য করুন