ফজলুর রহমান বাবু, বাংলাদেশের অন্যতম সফল এবং দর্শকনন্দিত অভিনেতা। ইতোমধ্যেই তিনি তার অভিনয় দক্ষতা দিয়ে জয় করেছেন কোটি মানুষের হৃদয়। তার অভিনয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, যে চরিত্রে তিনি অভিনয় করেন সেই চরিত্রের মধ্যে নিমিষেই মিশে যেতে পারেন এবং তা ফুটিয়ে তোলেন তার প্রতিটি সংলাপ এবং অভিনয় কলার মাধ্যমে। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে একাধিকবার ভূষিত হয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ছাড়াও আরো অনেক পুরস্কারে। অগণিত দর্শকের ভালোবাসা তো আছেই। এ ছাড়াও তার আরেকটি বিশেষ গুণ হলো তিনি একজন সংগীতশিল্পী, যদিও নিজেকে সেভাবে পরিচিত করেন না তিনি, তবুও মনপুরা ছবিতে গান গেয়ে দর্শকদের মনে সংগীতশিল্পী হিসেবেও একটা জায়গা তৈরি হয়েছে তার। এরপর থেকে হামেশাই গান করেন তিনি। আষাঢ়ের এক বিকেলে রাজধানীর উত্তরায় একটি শুটিং হাউজে নাটকের শুটিং চলছিলো এই গুণী অভিনেতার, সেখানেই হাজির হয়েছিলেন কবি ও সাংবাদিক সুফিয়ান রায়হান। গ্রিনরুমের উজ্জ্বল আলোতে বসে ঝালমুড়ি খেতে খেতে আলাপ হয়েছিলো ফজলুর রহমান বাবুর জীবনের জানা-অজানা নানান বিষয় নিয়ে।

কেমন আছেন?
বেশ ভালো আছি। কাজের মধ্যে আছি, কাজের মধ্যে থাকলে আমি ভালোই থাকি।

অভিনয়টা নেশা আপনার, পরবর্তীতে পেশা হিসেবে এই অভিনয়কে বেছে নেয়ার সুযোগ হয়েছে। কেমন লাগে এই মধুর সমন্বয়ের পর?
যখন শুরু করেছিলাম তখন অভিনয়টা ছিলো নেশা, পরবর্তীতে যখন সিদ্ধান্ত নিলাম এটিকে পেশা হিসেবে নিবো, তখন এটি হয়ে গেলো সাধনা। এই সৃজনশীল কাজটিকে সাধনার মতো করে ভাবতে এবং করতে শুরু করলাম সেই থেকে এই অবধি। চমৎকার লাগে আসলে।

ছোটবেলা কোথায় কেটেছে?
বাবার চাকরির বদলির সুবাদে বিভিন্ন জেলায় কেটেছে, খুব ছোট আমি যখন। গ্রামের সবুজ পাতা আমায় টানতো, পাখির ডাকে অনাবিল সুখ খুঁজে পেতাম, সে সময়। শৈশবে কোনো নিয়মের বেড়াজাল ছিলো না। মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়তাম, এই জন্যই হয়তো এটিকে সোনালি শৈশব বলা হয়। খুলনা যশোর এসব জায়গায় ছোটবেলায় অনেকটা সময় কাটিয়েছি, তবে পরবর্তী সময়ে অনেকটা সময় ফরিদপুরেও কেটেছে।

অভিনয় শুরুর গল্পটা শুনতে চাই।
অভিনয় শুরু করেছিলাম আমি যখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র তখন। ফরিদপুর টাউন থিয়েটারে অভিনয় করতাম; ফরিদপুর টাউন থিয়েটারের নাটক দিয়েই আসলে আমার নাট্যচর্চা শুরু। তারপর বৈশাখী নাট্যগোষ্ঠীতে অভিনয় করেছি।

প্রথম মঞ্চে অভিনয় করতে যেদিন উঠলেন সেদিনটা কেমন ছিলো?
সেদিনটা ছিলো আমার জন্য উত্তেজনায় ভরপুর, প্রথম নাটকের শো-টা করেছিলাম বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে। জাতীয় নাট্যোৎসব হয়েছিল, সেই উৎসবে প্রথম শো ছিলো আমার। আমার মনে আছে, আমি ভয় পাইনি। আমি আসলে বিস্ময়ের সাথে সবটা দেখেছি। বয়সটা আমার ছিলো তখন বিস্ময়ের। পুরোটা সময় একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম আমি।

একটা সময় ব্যাংকে যোগ দিয়েছিলেন, তারপর পুরোপুরি অভিনয়ে সময় দেয়া। এই গল্পটি শুনতে চাই।
আমরা যখন থিয়েটার করতাম তখন এই থিয়েটারকে বা অভিনয়কে পেশা হিসেবে নেয়ার কোনো সুযোগ সেখানে ছিলো না। চলচ্চিত্র ছাড়া অভিনয়ের আর কোনো মাধ্যমই ছিলো না যাকে পেশা হিসেবে নেয়া যায়। সেই জায়গাটি থেকে আমাদের মধ্যে কেউ ব্যাংকে, কেউ শিক্ষকতা বা একেকজন একেক পেশায় গিয়েছে, সেটা নিতান্তই জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে। তারপর অভিনয়কে যখন পেশা হিসেবে নেয়ার সুযোগ হলো তখন থেকে নিয়মিত অভিনয়ই করছি।

একটা নিশ্চিত চাকরি ছেড়ে একটা অনিশ্চিত জীবনের দিকে আপনি যাচ্ছেন, কতটা কঠিন ছিলো সেই সময়টা আপনার জন্য?
অভিনয়টাকে ভালোবাসি, ভালোবেসে সব ছেড়েছি। তবে এটাতো একটা ঝুঁকিই বটে! একটা কথা আছে, ‘বাঙালির চাকরি না থাকিলে থাকিলো কী?’ সেই জায়গাটি থেকে আমি ঝুঁকিই নিয়েছি। কেউ না কেউ তো ঝুঁকি নিতেই হবে, আমি তাদের মধ্যে একজন। তবে সবাই যে সফল হবে তেমন কিন্তু না, আমার মনে হয় আমি সফল হয়েছি, সবার ভালোবাসা পেয়েছি।

টেলিভিশনে কাজ কখন থেকে শুরু করলেন?
ঢাকায় এসে যখন আরণ্যক নাট্যদলের সাথে কাজ করি তখন টেলিভিশনে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করি, তখন একটা নিয়ম ছিলো, কেউ টেলিভিশনে কাজ করতে চাইলে সে যে নাট্যগোষ্ঠীর সাথে কাজ করতো তার অনুমতি নিতে হতো। আমিও আরণ্যক নাট্যগোষ্ঠীর অনুমতি নিয়েই টেলিভিশনে অডিশন দিই, পাস করি এবং তারপর থেকেই কাজ করা শুরু করি।

টিভি নাটকের প্রথম কাজের কথা কি মনে পড়ে?
হ্যাঁ, সে কথা অবশ্যই মনে পড়ে, অনুভূতিটাই চমৎকার। কাজী নজরুল ইসলামের ‘মৃত্যুক্ষুধা’ অবলম্বনে একটা নাটকে প্রথম কাজ করি। খুব ছোট একটা চরিত্র বলা যায়, টিভির পর্দায় শুধু উপস্থিতি আর কিছু নয়। তবুও সেই কাজটিই আমাকে প্রাণিত করে, আজও মনে পড়ে। প্রথম বারের অনুভূতি অসাধারণ হবে এটাই স্বাভাবিক।

বলছিলেন ‘মৃত্যুক্ষুধা’র মাধ্যমে আপনার উপস্থিতি হয়েছে টিভির পর্দায়। পরবর্তীতে নিজেকে পুরোটা মেলে ধরার বা আপনার অভিনয়ের মুন্সিয়ানা দেখানোর সুযোগ পেলেন কোন কাজের মাধ্যমে?
তারপর আমার মনে আছে মামুনুর রশীদের একটা নাটক ছিলো, একক নাটক, সাপ্তাহিক; নাম ছিলো ‘আদিম’। সেখানে আমার অভিনয়ের সুযোগ ছিলো। এবং একটি ধারাবাহিক নাটক ছিলো, ‘ইতিকথা’ প্রথম এই দুটোতেই অভিনয়টা দেখানোর সুযোগ হয়েছিলো। নিজেকে মেলে ধরার একটা প্রয়াস পেয়েছিলাম।

‘আদিম’ নাটকটিতে আপনার সহশিল্পী কারা ছিলেন? তাদের কথা মনে পড়ে?
সেই সময়ে খুব শক্তিমান অভিনেতা অভিনেত্রী বলতে আমরা যাদেরকে বুঝতাম তারা ছিলেন নাটকটিতে। মামুনুর রশীদ, আজিজুল হাকীম, শমী কায়সার, তৌকির আহমেদ এবং আমি। আমরা পাঁচজন ছিলাম। ঐ নাটকটিতে এই পাঁচটি চরিত্রই খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিলো।

এবার বলুন কাদের অভিনয় আপনাকে মুগ্ধ করে?
পৃথিবীটা তো এখন অনেক ছোট হয়ে গেছে, পৃথিবীর অনেক জায়গার কাজ দেখি, অভিনয় দেখি। আমার দেশের শিল্পীদের অভিনয়ও দেখি তারা সবাই আমাকে মুগ্ধ করে। একেক নাটকে একেক সিনেমায় একেক জনের কাজ ভালো লেগে যায়।

নিয়মিত গান করছেন। আপনি তো শখের নায়ক না, তাহলে কী শখের গায়ক?
হা হা হা। আসলে কোনোটাই শখের না, আমি যা করি দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে করি। তবে আমি নিজেকে গায়ক মনে করি না। কারণ গায়ক হতে গেলে যে ধরনের শিক্ষা বা অনুশীলনের মধ্য দিয়ে যেতে হয় সে ধরনের অনুশীলনের মধ্য দিয়ে আমি যাইনি বা যাওয়ার সুযোগও হয়নি।

‘মনপুরা’ সিনেমায় গান করে তো গানের আকাশে রাতারাতি তারকা বনে গিয়েছিলেন। কেমন অনুভূতি ছিলো তখন?
মনপুরা সিনেমায় গান গাওয়ার পর দর্শক-শ্রোতাদের ব্যাপক একটি চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে আমার গানের জন্য, তারা আমার গান শুনতে চায় সেই কারণেই গানটা করা। সেই অনুভূতি অবশ্যই দারুণ, আমিতো গায়ক হতে চাইনি। শ্রোতারা আমাকে গায়ক বানিয়েছে। তবে গানটাকে আমি একদম অবহেলা করছি তেমন না আবার খুব সিরিয়াসলিও নিচ্ছি না। এখন কোনো কোম্পানি বা কোনো সিনেমায় যদি আমাকে দিয়ে গান গাওয়ানোর পরিকল্পনা করে আমি গাইবো, কিন্তু এটা নিয়ে আমার কোনো পরিকল্পনা বা উচ্চাশা নেই।

মনপুরা সিনেমার পর আর কী কী সিনেমায় গান করেছিলেন?
হুমায়ূন আহমেদের ছবিতে গান করেছি, ‘মেয়েটি এখন কোথায় যাবে’ নাদের চৌধুরীর ছবিতে গান করেছি, প্লে-ব্যাক করেছি, অ্যালবামও আছে আমার; তবে নিজেকে আমি কখনো সংগীতশিল্পী পরিচয়ে পরিচিত করতে চাই না।

নতুনরা যারা কাজ করছে তাদের অভিনয়ের বিষয়ে কী বলবেন?
তরুণদের মধ্যে অনেকে বেশ সম্ভাবনাময়। তবে একটা কথা বলা যেতে পারে এটা তো একটা শিল্প। এটি সাধনার বিষয়। তাই প্রকৃত শিক্ষা-দীক্ষা এবং অনুশীলনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। খ্যাতির ভারে নুয়ে না পড়ে মাথা ঠাণ্ডা রেখে এগিয়ে যেতে হবে।

অভিনয়ের জন্য থিয়েটার করে আসাটা কতটা জরুরি মনে করেন?
আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে থিয়েটারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, তবে সবক্ষেত্রেই যে থিয়েটার দরকার এটা আমি মনে করি না। কিন্তু শিক্ষাটা প্রয়োজন। আমাদের দেশে থিয়েটার দরকার কেন বললাম, কারণ আমাদের শিক্ষাটা থিয়েটার থেকেই হয়ে থাকে।

আপনার অভিনয়ের চার দশক পেরিয়ে গেছে, এই লম্বা সময়ে আমাদের নাটকের বা সিনেমার কেমন পরিবর্তন দেখছেন?
দর্শকরাও দেখেছেন, আমরাও দেখছি; অনেক উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে সময়টা পেরিয়েছে। একসময় নাটক দেখার জন্য আমরা বসে থাকতাম। এখন মানুষ নাটকই দেখে না। শত শত হাজার হাজার নাটক সিনেমা হচ্ছে দর্শকরা বেছে বেছে দেখছেন এখন। ভালো নাটক তো হচ্ছেই, তবে খারাপ নাটকের সংখ্যাই বেশি। যেগুলো দেখে দর্শকরা হয়তো মন্তব্য করছেন, আমাদের নাটকের মান তো এটা না।

শিল্পের জন্য যে সাধনা, এই দীর্ঘ সাধনা মানুষকে পরিণতিতে কী দেয়?
মানুষের মতো মানুষ হওয়ার উপায় বলে দেয়। এই একনিষ্ঠ সাধনা একজন মানুষকে মানসিকভাবে দৃঢ় করে তোলে। সৃজনশীল এই সাধনা মানুষকে সুন্দরের পথে এগোনোর প্রেরণা দেয়। তাই একজন শিল্পী হয়ে ওঠেন ফুলের মতো।

আমাদের কিশোর পাঠকরা যারা অভিনেতা হতে চায় তাদের উদ্দেশ্যে কী বলবেন?
কিশোররা তো অনেক দুরন্ত। তাদেরকে বলবো, অভিনয়টা না শিখে করা যাবে না। একটা প্রকৃত শিক্ষা এবং অনুশীলনের মধ্য দিয়ে তোমাদেরকে যেতে হবে। আর অবশ্যই সৎ হতে হবে। সফল শিল্পী হওয়ার প্রধানতম শর্ত তাকে হতে হবে সৎ। আর একটা কথা বলবো তোমরা হও আগামীর, তোমরা হও বাংলাদেশের, তোমরা হও সুন্দরের বাহক, উন্নত সংস্কৃতির সাধক।

Share.

মন্তব্য করুন