এক ম্যাচে শ্রীলঙ্কার হয়ে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ২ রান করেই আউট হয়ে গেলেন উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান সনথ জয়সুরিয়া। টিভি ধারাভাষ্যকার রাসেল অরনল্ড বলে উঠলেন, ‘মিস্টার এমপি গন ফর অনলি টু রানস’। যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘এমপি সাহেব মাত্র ২ রান করে আউট’! ক্রিকেট ইতিহাসে এমন ঘটনা ওই প্রথম। খেলোয়াড়দের রাজনীতিতে নামার ঘটনা নতুন নয়। তবেত সেটা সাধারণত হয়ে থাকে খেলা থেকে অবসরের পর; কিন্তু জয়সুরিয়া তার ক্যারিয়ারের ইতি টানার আগেই নাম লেখান রাজনীতিতে। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি এমপি হয়ে জাতীয় দলের পক্ষে ম্যাচ খেলতে নেমেছেন।
শ্রীলঙ্কার ১৯৯৬ বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য ও পরবর্তীতে অধিনায়ক তিনি। ঝড়ো ব্যাটিংয়ের কারণে তাকে বলা হতো ‘মাতারা হারিকেন’। সেই জন্মভূমি মাতারা থেকেই ২০১০ সালে তিনি নির্বাচন করেন সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ রাজাপাক্ষের দল থেকে। এমপি হওয়ার পরও ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত খেলেছেন জাতীয় দলের হয়ে। এক মেয়াদে মন্ত্রিসভায় উপমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন সনথ।
জয়সুরিয়ার মতো আমাদের মাশরাফি বিন মুর্তজাও জাতীয় দলে থাকতেই রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন। হয়েছেন এমপি। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই। তবে আমরা তাতে যোগ না দিয়ে আজ আলোচনা করবো এমন কয়েকজন খেলোয়াড়ের কথা যারা এক সময় খেলার মাঠ দাবড়ে বেড়িয়ে এখন রাজনীতির মাঠে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। চলো বন্ধুরা জেনে নেই তাদের কয়েকজনের সম্পর্কে।
খেলার মাঠ থেকে রাজনীতিতে । আহমেদ ইবনে হাবিবএই আলোচনায় শুরুতে যে নামটি আসবে সেটি ইমরান খানের। পাকিস্তানের বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক ইমরান এখন দেশটির প্রধানমন্ত্রী। বিশ্ব ক্রিকেটের এক সময়ের সবচেয়ে উজ্জল নক্ষত্র ইমরান খান রাজনীতির মাঠেও অদম্য। ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা অলরাউন্ডারদের নাম নিতে গেলে ইমরান খানের নাম সেখানে থাকবে উপরের দিকে। ব্যাটিং-বোলিং দুই ভূমিকাতেই দলকে অনেক ম্যাচ জিতিয়েছেন। ১৯৭১ সালে টেস্ট অভিষেক হওয়া ইমরান পাকিস্তানের জার্সিতে খেলেছেন ১৯৯২ সাল পর্যন্ত। সে বছর বিশ্বকাপ ক্রিকেটে শিরোপা জিতে জাতীয় দলকে বিদায় বলেছেন। এরপর ১৯৯৬ সালে রাজনীতিতে নামেন ইমরান। প্রচলিত কোন দলে যোগ না দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন নতুন দল পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফ। ধীরে ধীরে দলটিকে পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসেন। দীর্ঘ ২২ বছর সংগ্রামের পর আসে চূড়ান্ত সফলতা। ২০১৮ সালের পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে দলটি। ইমরান খান শপথ নেন পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। এর আগে অবশ্য বেশ কয়েকবার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। তার দল একটি প্রদেশে সরকার গঠনও করেছে। খেলার মাঠে বিশ্বজয় করা মানুষটি রাজনীতির মাঠেও হলেন সফল নেতা।
ইমরান খানের মতো বিশ্বজয় না করতে পারলেও আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে নিজ সময়ে ভালোই দাপট ছিলো লাইবেরিয়ার জর্জ উইয়াহ’র। চেলসি, ম্যানচেস্টার সিটির মতো ক্লাবের সাবেক এই তারকা স্ট্রাইকারই এখন পশ্চিম আফ্রিকার দেশ লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট।
আফ্রিকায় ভালো খেলার সুবাদে সুযোগ আসে ফ্রান্সের ক্লাব মোনাকোতে খেলার। সেটি ১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে। চার মৌসুম সেখানে কাটিয়ে যোগ দেন প্যারিস সেন্ট জার্মেইতে। যে ক্লাবটিতে এখন খেলছেন ব্রাজিলের নেইমার, ফ্রান্সের কিলিয়ান এমবাপ্পে। এখানে কয়েক মৌসুম কাটানোর পর তাকে কিনে নেয় ইতালির সেরা ক্লাব এসি মিলান। এরপর ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব চেলসি ও ম্যানচেস্টার সিটিতেও খেলেছেন দুটি মৌসুম। লাইবেরিয়া জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন দীর্ঘদিন। ১৯৮৭ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ৬০ ম্যাচে করেছেন ২২ গোল। ক্লাব ফুটবলে এসি মিলানের হয়ে করেছেন ৪৬ গোল। ফুটবল বিশ্বে লাইবেরিয়া ছোট দল হিসেবেই পরিচিত। কখনো বিশ্বকাপে খেলা হয়নি। তবে এই দলটি যেটুকু সাফল্য পেয়েছে উইয়াহ’র হাত ধরেই। তিন বার আফ্রিকা মহাদেশের সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হয়েছেন উইয়াহ। আফ্রিকার গত শতাব্দীর সেরা খেলোয়াড়ের মুকুটও উঠেছে তার মাথায়।
খেলা থেকে অবসরের পর রাজনীতিতে যোগ দেন উইয়াহ। ২০০৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হলেও হেরে যান। তবে খেলার মাঠের মতো রাজনীতির মাঠেও ছিলেন লড়াকু। ফলস্বরূপ একযুগ পর ২০১৭ সালের নির্বাচনে জিতে দেশটির ২৫তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন।
খেলার মাঠ থেকে রাজনীতিতে । আহমেদ ইবনে হাবিবইমরান খানের মতো বিশ্বকাপ জয়ী ক্রিকেট অধিনায়কদের মধ্যে আরো একজন রাজনীতিতে নেমেছেন। তিনি অর্জুনা রানাতুঙ্গা। ১৯৯৬ সালে শ্রীলঙ্কার বিশ্বকাপ জয়ী দলের অধিনায়ক। দ্বীপদেশটির হয়ে খেলেছেন ৯৩টি টেস্ট ও ২৬৯ ওয়ানডে ম্যাচ। ইমরানের হাত ধরে পাকিস্তানের ক্রিকেট যেমন বিশ্বের শক্তিধর দলে পরিণত হয়েছে। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটকেও সেই পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন রানাতুঙ্গা। ১৯৮২-১৯৯৯ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা রানাতুঙ্গা ২০০১ সালে নাম লেখান রাজনীতিতে।
ইমরানের মতো অতটা না হলেও রানাতুঙ্গাও রাজনীতির ইনিংসে বেশ দক্ষতার সাথেই ব্যাট করছেন। শ্রীলঙ্কান ফ্রিডম পার্টিতে যোগ দিয়ে তার রাজনীতির শুরু। সে বছর কলম্বো থেকে সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে এমপি হন। ২০০৪ সালে শিল্প, পর্যটন ও বিনিয়োগ মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। কয়েক দফা দল পরিবর্তন করা রানাত্ঙ্গুা বর্তমানে প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনার দল থেকে তার সরকারের বন্দর ব্যবস্থাপনা বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। জীবনের বাকিটা সময় হয়তো রাজনীতির মাঠেই দেখা যাবে তাকে।
ক্রীড়াঙ্গন থেকে রাজনীতিতে যোগ দেয়ার তালিকায় ভারতীয় ক্রিকেটারদের সংখ্যাই বেশি। সাবেক ব্যাটসম্যান নভোজোত সিং সিধু বর্তমানে ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের মন্ত্রী। ৫১ টেস্ট ও ১৩৬ ওয়ানডে খেলা সিধু বিজেপির টিকেটে ২০০৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে (লোকসভা) অংশ নিয়ে এমপি নির্বাচিত হন। পরে অবশ্য তিনি বিজেপি ত্যাগ করে কংগ্রেসে যোগ দেন।
খেলার মাঠ থেকে রাজনীতিতে । আহমেদ ইবনে হাবিবভারতের সাবেক অধিনায়ক আজহার উদ্দিন ২০০৯ সালে কংগ্রেস থেকে ভোটে দাঁড়িয়ে এমপি নির্বাচিত হন। ভারতকে ৪৭ টেস্টে নেতৃত্ব দিয়েছেন আজহার। ভারতের এবারের নির্বাচনে বিজেপির হয়ে দিল্লি থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন ২০১১ বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য গৌতম গম্ভীর। ভোটের কয়েকদিন আগে গম্ভীর আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে যোগ দেন।
তবে পলিটিক্সের প্রতিকূল কন্ডিশন আর বাউন্সার সামলে সবাই অবশ্য সেট হতে পারেন না ক্রিজে। অনেক সফল তারকা খেলোয়াড়ও তাই এখানে এসে হয়েছেন ব্যর্থ। ভারতের হয়ে দুটি বিশ্বকাপ খেলা মিডল অর্ডার বাটসমান ও তুখোড় ফিল্ডার মোহাম্মাদ কাইফ ২০১৪ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন। তবে তিনি জিততে পারেননি। দুইবার ভোটে দাঁড়িয়ে জিততে পারেননি ভারতের কিংবদন্তি অধিনায়ক মুনসুর আলী খান পাতৌদি। এরপর রাজনীতির মাঠ ছেড়েই চলে গেছেন পাতৌদির নবাব।
বাংলাদেশী ক্রীড়াবিদদের মধ্যে প্রথম টেস্ট অধিনায়ক নাইমুর রহমান দুর্জয় ২০১৪ সালের নির্বাচনে এমপি হন। জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আরিফ খান জয় এমপি ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতীয় ফুটবল দলের আরেক সাবেক অধিনায়ক গোলরক্ষক আমিনুল হক বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত আছেন। তবে তিনি এখনো পর্যন্ত নির্বাচনে প্রার্থী হননি।
এদের মধ্যে একটি জায়গার সবার চেয়ে ব্যাতিক্রম ইমরান খান। সবাই কোন না কোন রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়েছেন; কিন্তু ইমরান নিজেই একটি দল প্রতিষ্ঠা করে সেই দলটিকে নিয়ে গেছেন রাষ্ট্র ক্ষমতার মসনদে। ক্রিকেট মাঠের মতোই এখানেও তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছেন অসাধারণ হিসেবে।

Share.

মন্তব্য করুন