স্কুলে যাওয়ার পথে দৃশ্যটা চোখে পড়লো শানের। মুহূর্তেই চোখ ভিজে উঠলো। ব্যাকভিউ মিররে শানকে দেখে চমকে উঠলেন ড্রাইভার চাচা। তিনি গাড়িটা রাস্তার সাইডে পার্ক করে পিছন ফিরে শানের কাছে জানতে চাইলেন কী হয়েছে বাবা? তুমি কাঁদছো কেন? ছোট্ট শান চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো, আমি কাঁদছি না তো চাচা। ড্রাইভার চাচা বললেন, কাদছো না তাহলে চোখে পানি কেন? চোখে কিছু পড়েছে? জানালা তো বন্ধ ছিলো, এসি চলছিল। ততোক্ষণে শান চোখের পানি মুছে ফেলেছে। সে জানালো, তার চোখে পানি এসেছে আনন্দে। ড্রাইভার চাচা বিষয়টা ধরতে পারলেন না। শান বললো, চাচা গাড়িটা একশো মিটার পিছনে নিয়ে যেতে পারবেন। কথা মত ড্রাইভার চাচা শানের গাড়িটাকে একশো মিটার পিছনে নিয়ে গেলেন। শান গাড়ি থেকে নেমে গেলে ড্রাইভার চাচাও নামলেন। এবার তিনিও অবাক হলেন। ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। কোন ছেলেটা? সেটা আর ড্রাইভার চাচাকে বলতে হলো না। তিনিও ভীষণ চমকে গেছেন। ছেলেটার জীর্ণ পোষাকের আড়ালেও দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছে। হাতে ধরে রেখেছে একটা প্ল্যাকার্ড সেটাতে গোটাগোটা অক্ষরে লেখা, ‘থ্যাংক ইউ’!
শানের গাড়িটা যখন ব্যাক করে ছেলেটার পাশে এসে দাঁড়ালো তখন ছেলেটা একটু সরে গেলো। পরে শান যখন গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলো তখন তার মুখে সেকি তুমুল আনন্দের হাসি। জানতে চাইলো, এই তিনদিন তুমি কেন আসোনি এই পথ দিয়ে? ওর কথা শুনে শান আরো অবাক হলো। জানতে চাইলো, তুমি কি তাহলে এই তিনদিনই থ্যাংক ইউ লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে এখানে দাঁড়িয়ে ছিলে? ছেলেটা মাথা নেড়ে সায় দিলো। শানের বয়সী এই ছেলেটির নাম ফিরোজ। মাত্র এক মুহূর্তের পরিচয়ে ছেলেটার সাথে শানের বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। যে সে বন্ধুত্ব নয় বরং এমন বন্ধু যার অপেক্ষায় দিনের পর দিন ফিরোজ নামের ছোট্ট ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে শুধুমাত্র ধন্যবাদ দিবে বলে। এই পথ দিয়ে কত গাড়ি যাওয়া আসা করে। কত মানুষ গাড়ির জানালার ভেতর দিয়ে দেখেছে একটা ছোট্ট ছেলে ‘থ্যাংক ইউ’ লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তারা কেউ জানতেও চায়নি কেন দাঁড়িয়ে আছে, কাকে থ্যাংক ইউ জানাতে চায় সে? কেন জানাতে চায় সে?
স্কুল শুরু হতে এখনো বেশ সময় আছে। শান ফিরোজকে গাড়িতে তুলে নিলো। ড্রাইভার চাচাকে বললো, চাচা আমরা ক্যাপ্টেইন্স ওয়ার্ল্ডে যাবো আইসক্রিম খেতে। ড্রাইভার চাচা গাড়ি চালানো শুরু করলেন। তার মনে একরাশ মুগ্ধতা। ঠিক তিনদিন আগে বনানীর জ্যামে গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিলো। শান তখন আপন মনে গেমস খেলছিলো। স্কুলে যাওয়া আসার পথে ও গেমস খেলতে পছন্দ করে। জ্যামটা বেশ অনেক্ষণ ছিলো। এমন সময় একটা ছোট্ট ছেলে হাতে এক টুকরো কাপড় নিয়ে গাড়ির গ্লাসের পাশে এসে মিনতি করে বললো গাড়িটা মুছে দেই? ড্রাইভার চাচা বললেন, না দিতে হবে না। তখন ছেলেটা আরো মিনতি করে বললো, প্লিজ দেই? বিনিময়ে আমাকে দশটা টাকা দিয়েন! একথা শুনে ড্রাইভার চাচা ধমকে উঠলেন। তার ধমকে শানের সম্বিত ফিরে এলো। গেমস খেলা রেখে সে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো, তার বয়সী একটা ছেলেকে ড্রাইভার চাচা বকছে। শান জানতে চাইলো, চাচা ওকে বকছো কেন? কী করেছে ও? ড্রাইভার চাচা তখন বললেন, ছেলেটা গাড়ির কাচ মুছে দিতে চায় এবং বিনিময়ে দশটা টাকা দাবী করে। বিষয়টা শানের মনে আঁচড় কাটলো। ভিক্ষা না চেয়ে গাড়ির গ্লাস মুছে দিয়ে টাকা চাইছে কেন ছেলেটি? সে ছেলেটিকে কাছে ডাকলো। জানতে চাইলো বিষয়টা। তখনই জানতে পারলো ছেলেটির নাম ফিরোজ। সে বনানীর এক কলোনীর স্কুলে ক্লাস থ্রিতে পড়ে। বাবা নেই, মা অন্যের বাসায় কাজ করে। পরীক্ষার সময় চলে আসছে কিন্তু ফি দিতে পারেনি। তাই এভাবে যদি পরীক্ষার ফি জোগাড় করা যায়!
ফিরোজের কথা শুনে শানের চোখে পানি চলে আসলো। সে ব্যাগ থেকে পাঁচশো টাকার একটা নোট বের করে ছেলেটির হাতে ধরিয়ে দিলো। ফিরোজ নামের ছেলেটির চোখে রাজ্যের অবিশ্বাস! সে বললো, আমার কাছে ভাংতি নেই! শান জানতে চাইলো, ভাংতি লাগবে কেন? ফিরোজ জানালো, ‘আমার পরীক্ষার ফি তো মাত্র দেড়শো টাকা। আমি এতো টাকা নিয়ে কি করবো!’
ওর কথা শুনে শান আরো আশ্চর্য হলো। বললো, রেখে দাও। এবার ছেলেটা বললো, কিন্তু তুমি আমাকে এতোগুলো টাকা দিলে তোমার মা রাগ করবে না? এটা কি তোমার টিফিনের টাকা? শান বললো, না এটা আমার টিফিনের টাকা না। আমারও পরীক্ষার নোটিশ দিয়েছে। আম্মু বিজি তাই আমার কাছেই টাকা দিয়েছে জমা দিতে। ফিরোজ টাকাটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো তোমার পরীক্ষার ফি না দিলে আম্মু বকবে। আমাকে দিতে হবে না রাখো টাকা। তাছাড়া আমাকে দিলে তুমি আম্মুকে কী বলবে?
কিছুটা ভেবে শান বললো, আম্মুকে বলবো টাকাটা হারিয়ে গেছে। ফিরোজ নামের ছেলেটি বললো, না না সেটা বলা যাবে না। তুমি জানো না মিথ্যা বলা মহাপাপ! শান আর কিছু বলতে পারলো না। ট্রাফিক ছেড়ে দেওয়ায় ড্রাইভার চাচাকে গাড়ি ছেড়ে দিতে হলো। ফিরোজ নামের ছেলেটি চোখের পলকে পিছনে পড়ে থাকলো। তার চোখেমুখে রাজ্যের বিস্ময়। গাড়িতে যেতে যেতে ড্রাইভার চাচা বললো বাবা শান এটা তুমি কি করলে?
এখন চারদিকে কত মিথ্যুক মানুষ আছে জানো? সব অভিনয়। অভিনয় করে টাকা হাতিয়ে নেয়। এই ছেলেটিও সেরকম। ড্রাইভার চাচার কথায় সে একমত নয়। ছোট্ট শান বললো, চাচা সবাই এক না। ছেলেটি কীরকম সৎ দেখেছেন? সে নিজে বলেছে মিথ্যা বলা মহাপাপ! তাছাড়া ওর দরকার মাত্র দেড়শো টাকা তাই সে পাঁচশো টাকা নিতে রাজি ছিলো না। শানের কথায় যুক্তি আছে। ড্রাইভার চাচা আর কোন কথা বাড়ালেন না। ওকে স্কুলে পৌঁছে দিলেন। সেদিন বাসায় ফিরে শান আম্মুকে টাকাটার ব্যাপারে যখন বলতে গেলো তখন ভেবেছিল যে, সে বলবে- অনভিতাদের সাথে আইসক্রিম খেয়ে টাকা শেষ করে ফেলেছি। তখনই ফিরোজের কথা মনে পড়লো। মিথ্যা বলা মহাপাপ। সে তখন আম্মুকে সত্যি ঘটনাটা বললো। আম্মু শানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন ঠিক করেছে আমার রাজপুত্রটা। আমি কিচ্ছু মনে করিনি। আম্মুর কথায় শান খুব খুশি হয়েছে। তারপর আম্মু বাবা আর শান মিলে তিনদিনের ছুটিতে বেড়াতে গিয়েছিল। যদিও শানের স্কুল ছিলো কিন্তু ওই তিনদিন সে স্কুলে যেতে পারেনি বাবা মায়ের সাথে বেড়াতে যাওয়ার কারণে। আর কী আশ্চর্য এই তিনদিনই ফিরোজ নামের ছেলেটি ওকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য বনানীর এই যায়গাটিতে প্ল্যাকার্ড হাতে দাড়িয়ে ছিলো!
শানের নতুন বন্ধু । জাজাফীগাড়িতে যেতে যেতে ফিরোজ ওর জামার পকেট থেকে ৩৫০ টাকা বের করে শানের দিকে বাড়িয়ে ধরলো। বললো আমি স্কুলের ফি জমা দিয়েছি। পকেট থেকে সে তার পরীক্ষার প্রবেশপত্রও বের করে দেখালো। ছোট্ট শান ফিরোজকে জড়িয়ে ধরলো। বললো তুমি আমার বন্ধু হবে? সত্যিকারের বন্ধু? তোমার মত বন্ধু আমার চাই। ফিরোজ বললো বন্ধু হবো কেন? বন্ধুতো আমরা সেদিনই হয়ে গেছি যেদিন তোমার সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। গাড়ি থেকে নেমে ফিরোজ আর শানকে ক্যাপটেইন্স ওয়ার্ল্ডে নিয়ে গেলেন ড্রাইভার চাচা। তিনি বললেন শান আজকে তোমাদেরকে আমি নিজে আইসক্রিম খাওয়াবো। ওরা দু’জনই একসাথে থ্যাংক ইউ ড্রাইভার চাচা বলে উল্লাস প্রকাশ করলো। বিকেলে স্কুল থেকে বাসায় ফিরে আম্মুকে শান সব ঘটনা খুলে বললো। আম্মুর চোখেও পানি চলে আসলো। তার ছেলেটা যে একজন সত্যিকারের বন্ধু খুঁজে পেয়েছে সেটা ভেবে তার আনন্দ হচ্ছে। তিনি ভাবলেন ড্রাইভারকে ধন্যবাদ দিবে শানকে দেখে রাখার জন্য। ড্রাইভারকে আর ডাকতে হলো না তিনি নিজেই দরজার কাছে এসে বললেন ম্যাডাম ভিতরে আসবো? জরুরী কথা বলতে চাই। শানের আম্মু বললেন ঠিক আছে আসুন। ড্রাইভার ভিতরে এসে খানিকটা মুখ কাচুমাচু করে একটা খাম এগিয়ে দিলেন শানের আম্মুর দিকে। শানের আম্মু জানতে চাইলেন কী আছে ভিতরে? ড্রাইভার কিছু বলছে না দেখে তিনি খাম খুললেন। ভিতরে বেশ কিছু টাকা! শানের আম্মু জানতে চাইলেন কিসের টাকা? ড্রাইভার বললেন গাড়ি রিপেয়ারিং এ যে টাকা দিয়েছিলেন সেখান থেকে এটা বেচে গিয়েছিল কিন্তু দেওয়া হয়নি! এটুকু বলে সে বেরিয়ে গেলো। শানের আম্মু বুঝলেন কেন এটা ঘটলো। শানের বন্ধুর সততা ড্রাইভারকে প্রভাবিত করেছে। তা না হলে এই টাকাগুলো সে ফেরৎ দিতো না। পরের মাস থেকে গাড়ি বাবদ খরচ আগের তুলনায় দেড় হাজার টাকা কম হতে থাকলো। আম্মু শানকে বললো, একদিন আবার যখন ফিরোজের সাথে দেখা হবে ওকে সাথে করে বাসায় নিয়ে আসবে। শান সেই দিনের অপেক্ষায় আছে।

Share.

মন্তব্য করুন